জিরো পয়েন্ট ফিল্ড ও আল্লাহতে বিশ্বাস

ভূমিকা

গত বৎসর এক ভাই “সুবহানাল্লাহ অর্থাৎ শূন্যই আল্লাহ”, এই মর্মের একটি লেখা পড়তে অনুরোধ করেন। লেখাটির লিঙ্ক এখানে । ওখানে বলা হয়েছে, “সুবহুন মানি শূন্য (void) এবং সুবহান আল্লাহ মানে শূন্যই আল্লাহ”। মাআযাল্লাহ!

এই ধারণাটি ভুল এবং একটু দীর্ঘ বিশ্লেষণে গেলে এমন বিষয়কে পৌত্তলিকতায়ও দেখা যেতে পারে। লেখাটির বিভিন্ন পর্যায়ে স্ববিরোধীতা রয়েছে। শব্দ ও বাক্যের ব্যবহারের দিকে তাকালে তা লক্ষ্য করা যাবে। এই প্রেক্ষিতে আমি একটি লেখা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু অপরিপূর্ণ অবস্থায় রেখে অন্য বিষয়ে ব্যস্ত হয় যাই। ইদানীং, সেই লেখাটির কথা মনে হল। তাই এর প্রধান অংশের সাথে আরও কিছু সংযুক্ত করে তা পরিপূর্ণ করেছি।

শুরুতে আমি সেই লেখা থেকে একটি উদ্ধৃতি নিচ্ছি। তবে স্কয়ার বন্ধনীতে ‘[]’ আমার কথা সংযোজন করেছি এবং ইটালিক এর ব্যবহারও আমার।

কুয়ান্টাম ফিজিক্সের কোয়ান্টাম যেমন শূন্য নয় … এই শূন্যের ভিতরে শক্তি আছে … তেমনি আল্লাহও শূন্য নন, [?] কারণ আল্লাহ কোন তথ্য নন। Non information … [বাক্য গঠনের দিক দিয়ে এখানে যুক্তির ছেদ পড়েছে, আল্লাহ কোন তথ্য নন –এই অংশে।] আল্লাহর প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না [না জেনে কীভাবে উপরের ধারণায় যাওয়া হয়? তিনি information অথবা non-information, এটা কোন ধরণের information এর সংজ্ঞায় ব্যক্ত হয় এবং এটা কোন ধারণায় ‘অর্থ’ প্রকাশ করে এবং কোন উৎসে স্থাপিত?]। এ কারণেই শূন্য [তাহলে তিনি শূন্য? আগে কী বলা হল?]। ওয়ালাম ইয়াকুন লাহু কুফুয়ান আহাদ। তিনি কারোর মতোই নন [প্রথমের যেমনতেমনের তুলনার দিকে লক্ষ্য করুন]। … তিনিই আলফা তিনিই ওমেগা, তিনি গুপ্ত গোপনীয় অপ্রকাশিত মিশরীয় গড আমুন, তিনি সর্বশক্তিমান কাহ্হার গ্রীক এপোলো, তিনিই ধ্বংসকারী শিব, তিনিই তাও …[তাহলে তিনি এগুলোও?]।

উপরের কথাগুলো এলোপাথাড়ি, তা দেখলেই বুঝা যায়। তাছাড়া অপর ধর্মের পৌত্তলিক নিক্তিতে ধারিত দেবনামগুলো অনেকটা একাকার অর্থে উল্লেখিত। তবে সর্বতোভাবে লেখাটিতে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জিরো পয়েন্ট এনার্জির ধারণায়, তুলনায় এবং উপমায়ই সুবহানাল্লাহকে “শূন্যই আল্লাহ” বলা হয়েছে। আমরা কেবল এই শেষের কথাটি নিয়েই আলোচনা করব কেননা সবকিছুর আলোচনা সম্ভব নয়।

আমি এখানে সর্বাত্মক চেষ্টা করব যাতে লেখককে এক পাশে রেখে, বস্তুনিষ্টভাবে, কেবল তার লেখাকেই আলোচনা করা যায়। এখানে বিতর্কের কোন মনোভাব নেই। আক্রমণের কোন মনোভাব নেই। তাওহীদের ব্যাপারে কোন ধারণা যদি কোথাও অস্পষ্ট থাকে, তবে তা স্পষ্ট করে দেখাতে পারলে সকল তাওহীদবাদী পক্ষের জন্যই উত্তম হয়। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যাতে আমার কথাগুলো সঠিক হয়।

প্রথমত, ‘সুবহানাল্লাহ’এর অর্থ কখনই ‘শূন্যই আল্লাহ’ নয়। আল্লাহ কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক জিরো পয়েন্ট ফিল্ডের সাথে “তুলনীয়” কোন সত্তা নন। এই ফিল্ডটি সৃষ্ট। আর আল্লাহ বস্তুর কোন স্তরে, কোন পর্যায়ে, কোন রূপে, কোন গুণে সত্তাগতভাবে সম্পর্কিত নন। তিনি আমাদের এই বস্তু জগতের স্রষ্টা এবং তার আরও অনেক সৃষ্টি রয়েছে যা আমরা দেখি না এবং সেসবের মর্মও ভেদ করতে পারি না। সর্বোপরি তিনি বস্তুর ঊর্ধ্বে, (transcendental), সৃষ্টিলোকের ঊর্ধ্বে কিন্তু এই ‘ঊর্ধ্ব’ শব্দটি ‘উপর’ অর্থে নয় যা নিচের প্রতিকূলে।

আমরা যদি লেখকের ‘সুবহ’কে শূন্য বলে ধরেই নেই, তবুও তা ‘শূন্যই আল্লাহ’ হয় না। যদিও বাংলায় ‘সুবহানাল্লাহ’ একই শব্দে লেখা হয় কিন্তু আরবিতে ওখানে দুটি শব্দ রয়েছে –সুবহানা আল্লাহ। ব্যাকরণের দিক থেকে ’সুবহান’ এবং ‘আল্লাহ’ -এই শব্দদ্বয় অধিকারের বা কর্তৃত্বের সম্বন্ধবাচক অর্থে গঠিত হয়েছে যাকে আমরা ইংরেজিতে possessive case এবং আরবিতে ইদাফাহ (الإضافة) বলি। যেমন ধরুন, যায়েদের কলম, আরবিতে ‘কালামু যাইদ’(قلم زيد), ইংরেজিতে Zaid’s pen হয়। কিন্তু এর অর্থ কখনো ‘কলমই যায়েদ’ হয় না। ঠিক সেভাবে ‘সুবহানাল্লাহ’এর অর্থ কখনো ‘শূন্যই আল্লাহ’ হয় না। মাআযাল্লাহ!

এই লেখাটির পরে আমি আরেকটি প্রবন্ধ রচনা করব যেখানে সুবহান শব্দটির ধাতু, ক্রিয়ারূপ, এবং ‘সুবহানাল্লাহ’ এর বৈয়াকরণিক রূপ উল্লেখ করে এর সঠিকই অর্থ উপস্থাপন করতে চেষ্টা করব। তবে যেহেতু কোয়ান্টাম ফিজিক্সের জিরো পয়েন্ট ফিল্ডকে আল্লাহর সাথে তুলনা করা হয়েছে তাই প্রথমে এই বিষয়টি দেখা দরকার। আমি পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র নই তবুও এ বিষয়ে যতটুকু বুঝি সেই বিনম্র (humble) ধারণার আলোকে তা দেখব।

জিরো পয়েন্ট ফিল্ড

বারনার্ড হেইশ (Bernard Haisch) তার ‘দ্যা গড থিওরি –ইউনিভার্স, জিরো পয়েন্ট ফিল্ডস, এণ্ড হোয়াট বিহাইন্ড ইট অল’ (THE GOD THEORY –Universes, Zero-Point Fields, And What’ Behind It All. San Francisco: Weiser Books, 2009:69-77) পুস্তকে এ বিষয়টিকে সহজভাবে বুঝাতে দেয়াল ঘড়ির দোলকের সাথে কোয়ান্টাম বস্তুর (quantum object) তুলনা দেন। ঘড়িতে চাবি দিতে ভুলে গেলে এক সময় উদঘর্ষণ বা ফ্রিকশন (friction) তার দোলককে স্থির করে দেবে। কিন্তু ক্ষুদ্র জগতের সেই কোয়ান্টাম বস্তুটি কখনো সেভাবে সম্পূর্ণ স্থির হয়ে যায় না। হেইশ বলেন যে হাইজেনবার্গ-অনিশ্চিত-তত্ত্ব (Heisenberg Uncertainty Principle) এই মর্মে ধারণা দেয় যে কোন কোয়ান্টাম বস্তু কখনো ‘সম্পূর্ণভাবে’ স্থির হতে পারে না। এতে সর্বদাই কিছু এলোপাথাড়ি মৃদু ঝাঁকি (বা residual random jiggle) অবশিষ্ট থাকে -এটা কোয়ান্টাম ফ্লাকচ্যুয়েশন (quantum fluctuations) বা অস্থিতির কারণেই হয়। এটা এক সাধারণ নিয়ম যে কোয়ান্টাম থিওরিতে হাইজেনবার্গ-অনিশ্চিত-তত্ত্ব ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গে (in electromagnetic wave) প্রয়োগ হয়, কেননা ইলেকট্রিক ও ম্যাগনেটিক ফিল্ড শূন্যতা (space) ভেদ করে অসিলিয়েট (oscillate) বা আন্দোলিত হয় –দুলে, যেমন দোলক আন্দোলিত হয়। এই নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক সম্ভাব্য ফ্রিকোয়েন্সিতে একটু ক্ষীণ পরিমাণ ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ঝাঁকি (বা jiggle) সব সময়ই চলতে থাকে। এই বিরামহীন ঝাঁকি বা অস্থিরতার (ceaseless fluctuations) সমষ্টি একত্রিত করলে এক সাগর পরিমাণ আলোর পটভূমি পাওয়া যাবে যার শক্তি (energy) হবে বিরাট। এটি হচ্ছে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক জিরো পয়েন্ট ফিল্ড। এই ফিল্ডটি হচ্ছে শক্তির সর্বনিম্ন অবস্থা (the lowest possible energy state)। অপরাপর শক্তি এই জিরো পয়েন্ট শক্তির ঊর্ধ্ব থেকে কার্যকরী হয়। হেইশ বলেন:

Take any volume of space and take away everything else –in other words, create a vacuum –and what you are left with is the zero point field. … The vacuum as condition of complete emptiness, as an absolute void, does not exist. Rather the laws of quantum mechanics posit the seat of zero point filed as state both paradox and possibility –a seething sea of particle pairs, energy fluctuation and force perturbations popping in and out of existence. … The quantum vacuum is, therefore, in reality a plenum, but in keeping with tradition I will continue to use the term quantum vacuum (Haisch, 2009:70).

যেকোনো আয়তনের স্থানকে ধারণ করে তার মধ্য থেকে সকল কিছু বের করে নিয়ে আসেন, অর্থাৎ তাতে শূন্যতা সৃষ্টি করেন –অতঃপর এটাই হবে জিরো পয়েন্ট ফিল্ড। (তবে) … শূন্যতা (vacuum) একদম পরিপূর্ণ শূন্যতার শর্ত হিসেবে বা পরম-শূন্যতার (absolute void) শর্ত হিসেবে অস্তিত্বশীল নয়। বরং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কার্যকরী নিয়ম জিরো পয়েন্ট ফিল্ডের স্থানকে এমন এক অবস্থা হিসেবে স্থাপন করে যা একদিকে আপাতবৈপরিত্যতার (paradox) এবং অন্য দিকে সম্ভাব্যতার (possibility) অবস্থান হয় –এতে থাকে জোড়া পার্টিকলের (of particle pairs) উলট-পালটের সাগর, শক্তির উঠা-নামা (energy fluctuation) ও শক্তির অস্থিরতার আসা-যাওয়া (অস্তিত্বে আসা ও বিলীন হওয়া)। … সন্দেহ নেই যে হাইজেনবার্গ-প্রিন্সিপল এই অনুজ্ঞা অর্পণ করে যে সকল শূন্যতাই (all of space) জিরো পয়েন্ট এনার্জি দ্বারা পরিপূর্ণ হতে হবে, তবে আমি প্রথাগতভাবে ‘কোয়ান্টাম শূন্যতা’ পরিভাষা ব্যবহার করব।

এখানে আমরা যা পাচ্ছি তা হল কোয়ান্টাম জাগতিক পদার্থেরই ব্যাখ্যা –পদার্থের সর্বনিম্ন শক্তির এক অবস্থান। হেইশের দোলকের উপমা আমার মনে হয় খুব একটা যথার্থ হয় নি তবে আমরা ব্যাপারটি বুঝতে পারছি, তিনি নিছক ‘দোলনের’ ব্যাপারটি বুঝাতে উপমা ব্যবহার করেছেন। অতঃপর, যদিও তাতে শূন্যতার পরিভাষা আরোপ করা হয়েছে তথাপি তাতে এক প্রকার শক্তিও অবশিষ্ট রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে –নাই নয়। হাইজেনবার্গ-প্রিন্সিপল অনুযায়ী জিরো পয়েন্ট এনার্জি দ্বারা তা ‘পরিপূর্ণ’।

এখানে পদার্থের যে ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে এর প্রেক্ষিতে ‘এটাই আল্লাহ’ (নায়ূজুবিল্লাহ) বা অনুরূপ কিছু বলার অবকাশ নেই। এই জগতে মানুষ অনেক চৌকশ বস্তু দেখেছে, তারপর পূজাও দিয়েছে। আবার চৌকশ কিছু পেলে তাতে দৈবিক কিছু আবিষ্কার করতেও চেয়েছে। এটাই ছিল পৌত্তলিকতা। কেউ গাছ-পালা বের করে পূজা দিয়েছে আর কেউ নিজ হস্তে মূর্তি তৈরি করে মন্ত্রপাঠ করত: তাতে (তাদের বিশ্বাসে) দেবপ্রাণ এনে, সেটাকে ‘প্রতিমা’ আখ্যায়িত করে, তাদের বিশ্বাসের সার্থকতা ঘটিয়েছে। খোদাকে স্থান-কালে নির্দিষ্ট করতে পারলেই পৌত্তলিকতার দুয়ার খুলে। আমাদের বিশ্বাস কখনো বস্তুকেন্দ্রিক নয়, হোক তা বস্তুর অতি মৌলিক অবস্থা, তার প্রকৃতি বা রূপ। আমরা কেবল বস্তুর স্রষ্টাতেই বিশ্বাসী।

অন্যদিকে, এই জগত শূন্যতা থেকে অমনি অমনি বেরিয়ে এসেছে বলে যে থিওরি বিরাজ করছে তাতেও অনেকের দ্বিমত রয়েছে। ইউরোপিয়ান অনেক নাস্তিকও আছেন যারা এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। তাদের মতে এই ধারণাটি হচ্ছে বিব্লিক্যাল ধারণার নিছক প্রতিস্থাপন: বাইবেলে ছিল খোদা বিশ্ব জগতকে শূন্যতা থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, এখন তা হয়ে পড়েছে শূন্যতাই বিশ্ব জগতকে অস্তিত্বে এনেছে। আগে ছিল খোদার অলৌকিকতা, এখন তা শূন্যতার অলৌকিকতা! খোদার অলৌকিকতাকে শূন্যতায় প্রতিস্থাপন করাতেই বিষয়টি বিজ্ঞান হয়ে গিয়েছে! (নিচের বাক্যের পরে একটি ভিডিও লিঙ্ক দিচ্ছি যেখানে জিম হল্ট (Jim Holts) এর ভাষায় উল্লেখিত ধারণা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ভিডিওতে অংশগ্রহণকারী প্যানেলিস্টরা নাস্তিক, তবে লরেন্স ক্রাউসকে মিলিট্যান্ট নাস্তিক হিসেবেও অনেকে পরিচয় করেন। ভিডিও লিঙ্ক।)। জিম হল্টস ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ (natural laws) সম্বলিত ব্যাখ্যারও সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে নিউটোনিয়ান পদার্থ বিদ্যা নিয়মানুবর্তিতার এক সারসংক্ষেপ (a summary of regularity) দেয় যেমন গ্রহাদি সূর্যকে আবর্তন করে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এই নিয়ম তাদের উপর কোন শক্তি প্রয়োগ করে। এদিক থেকে বিশ্ব জগতের অস্তিত্ব এই প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়ে একান্ত ব্যাখ্যা করা যায় না, কেননা এই নিয়ম অস্তিত্বে-আসা বস্তুর অন্তর্নিহিত (inherent)। এই নিয়মটি ‘কেন’ (why) প্রশ্নের উত্তর দেয় না। থিওরি কেন্দ্রিক ‘স্বয়ংক্রিয়বাদে’ (নিজে নিজে সৃষ্টি হয়ে যাওয়া বা অমনি অমনি সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার) যে ধারণা রয়েছে তাতে বস্তুজগত কীভাবে (how) আছে -এই প্রশ্ন জরুরি হয়, প্রথম প্রশ্নটি নয়।

তবে শূন্যতা থেকে মহাবিশ্বের থিওরিতে ‘চক্রাকার বিশ্বতত্ত্ব’ (cyclical cosmology) দ্বিমত পোষণ করে। এই থিওরির বক্তব্য হচ্ছে জগত এক সময় লয়প্রাপ্ত হয়, তারপর সেখান থেকে আবার শুরু হয়। কথাটা এভাবে যে এই জগত ধীরে ধীরে সংকোচিত বা ক্ষুদ্রতর হয়ে আসতে থাকে। তারপর অতিকায় এই ক্ষুদ্র বস্তু থেকে বিগ-ব্যাং হয় –এই অবস্থানেরই প্রতিক্রিয়া স্বরূপ। সুতরাং এদিক থেকে পরম শূন্যতা কখনোই থাকতে পারে না, সর্বদাই কিছু না কিছু থাকে।

এই বিশ্বের অস্তিত্ব নিয়ে বিজ্ঞানে, দর্শনে ও ধর্মে অনেক মত রয়েছে। এমন আলোচনার জের অতি পুরাতন। ‘এই জগত চিরন্তন’: এটা আগেও ছিল, এখনো আছে এবং আগামীতেও থাকবে, এমন চিন্তা মানুষ আগেও করেছে। আবার এই জগত ও জগতের মালিক ওতপ্রোতভাবে জড়িত (pantheism) -এমন ধারণাও অতীতের। এই জগত আর জগতের মালিক উভয়ই আলাদা আলাদা বিষয় (transcendental belief) এমনটাও আগে ছিল –এখনো আছে।

এই অস্তিত্ব জগত সম্পর্কিত যত ব্যাখ্যা এবং এর চেইন অব কজেশনকে (chain of causation) যতভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন সেই ব্যাখ্যার স্থান থেকে আল্লাহর ধারণা সরিয়ে দেয়া চিরন্তনভাবে (infinitely) অসম্ভব। পূর্বকালে অতি প্রাথমিক কোজেল (causal/ কারণিক) ব্যাখ্যায় স্রষ্টাকে যেভাবে দেখা হত, অতি কমপ্লেক্স ব্যাখ্যা ও থিয়োরিতেও সেই ধারণা সেইভাবেই থেকে থাকে –ব্যাখ্যার মাত্রাগত রূপ ভিন্ন হয় মাত্র। সব সময় মনে রাখতে হবে যে বস্তুকে কেন্দ্র করে যে ব্যাখ্যা সৃষ্টি হয়, তাতে মানুষের বস্তুভিত্তিক মস্তিষ্ক কাজ করে -অর্থাৎ প্রকারান্তরে বস্তুই বস্তুর ব্যাখ্যা দিয়ে যায়। এক্ষেত্রে আমাদের ধর্মীয় ‘বিশ্বাস’ ভিন্ন। আমাদের বিশ্বাস আমরা ওহীর মাধ্যমে পেয়েছি: সম্মানিত রাসুলদের মাধ্যমে পেয়েছি, জিব্রাঈলের (আ) মাধ্যমে পেয়েছি। এই স্থান থেকে চোখ সরালেই অবিশ্বাস এসে চিন্তার দিগন্ত আচ্ছন্ন করবে।

মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞানের অঙ্গনে নতুন কিছু দেখলেই দ্রুত ধর্ম প্রমাণের প্রয়োজন নেই। প্রথমে দেখতে হবে জিনিসটি কী, কারা কী বলছে। এক শ্রেণীর নাস্তিক, ধর্মীয় এবং নানান সামাজিক কাল্টের মত, নিজেদের শ্রেণীতে ‘কেরামতি’ বই বিক্রি করেন। চৌকশ কথার মাধ্যমে বই বিক্রির বিজ্ঞাপনী কায়দা অবলম্বন করেন এবং তাদের সমর্থক মিডিয়া-বাহিনী তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেখা যাবে, বই বের হবার আগে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বলা হচ্ছে, ‘খোদা এই বিশ্ব জগতের স্রষ্টা নন’। অথবা কেউ প্রচার করছে, ‘ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রাণের সঞ্চার করা হয়েছে’। কিন্তু শেষে দেখা যাবে, ঢোল-পিটানো স্থানটির পরিধিকে খড়কুটা দিয়ে প্রশস্ত করা হয়েছে। এই যে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব –এটাতেও অনেক ফাও কাজ করছে। এই শূন্যতার বিষয় নিয়ে এখনো অনেক কিছু জানার বাকি রয়েছে। এই স্থানটি অবলোকনের (observation এর) আওতাভুক্ত নয় (হেইশ, ২০০৯:৭১)। বিষয়টির কিছু জটিলতা বুঝতে এই এই ভিডিও দেখুন।

সারাংশ

আমাদের কথার শুরু ও শেষ এটাই যে আল্লাহ কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ‘জ্ঞাত’ শূন্যতা নন। তিনি এভাবে ‘জ্ঞাত’ হবার মত কোন সত্তা নন। তিনি বস্তুর অংশ নন, বস্তুতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রাথমিক অবস্থাও নন। তিনি এমন ধারণায় সংশ্লিষ্ট হওয়া থেকে পবিত্র এবং এভাবে ধারিত চিন্তা থেকে দূরত্বে।

সুবহানাল্লাহ হচ্ছে মহিমান্বিত (sublime, তানজিহী, تنزيهي) ও প্রশংসাসূচক ধারণা প্রকাশের এক অভিব্যক্তি (expression)। বস্তু জগত থেকে স্রষ্টাকে ঊর্ধ্বে দেখাতে এবং সৃষ্ট বস্তুর সীমাবদ্ধতা ও সংশ্লিষ্টতা থেকে তার পবিত্রতা কীর্তন করতে এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়। আল্লাহ যাবতীয় তুলনার ঊর্ধ্বে। এটা এই অর্থেও যে আমরা তাকে যেভাবে ভেবে থাকতে পারি তিনি অবিকলভাবে (exactly) আমাদের অর্থ জগতের তেমন কেহ নন, তিনি মহিমান্বিত, ঊর্ধ্বে। আমাদের জ্ঞানের সীমা বস্তু জগত থেকে অর্জিত -আর তিনি ‘অতুলনীয়’, অসাদৃশ্য। কথাটি আবার বলা হোক: তিনি বস্তুতে নেই (বস্তুত নির্মিত দেবদেবীসহ যাবতীয় বস্তু) এবং বস্তুর সম্পর্কেও নেই (তিনি কারও পিতামাতা নন, তার কোনো সন্তান নেই ইত্যাদিসহ) এবং সৃষ্ট কোন ফিল্ডেও নন। তাকে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক জিরো পয়েন্ট এনার্জি ফিল্ড বলা, তুলনা করা, এই নিক্তিতে দেখা -সবই ভুল ধারণা, পৌত্তলিকতার সমার্থক। সুতরাং কেউ যদি ‘শূন্যই আল্লাহ’ ‘শূন্যতাই আল্লাহ’ (নায়ূযুবিল্লাহ) এমন কিছু বলে থাকেন, তবে তা সম্পূর্ণ ভুল হবে। এমন ধারণা থেকে বেঁচে থাকা তাওহীদবাদীদের জন্য প্রয়োজন। এমনটি শুনলে আল্লাহর আশ্রয় চাইতে হবে, বলতে হবে ‘সুবহানাল্লাহ’, মাআযাল্লাহ।

আমার পরবর্তী লেখায় সুবহানাল্লাহ –এর শাব্দিক ও বৈয়াকরণীক ব্যাখ্যা এবং এই উক্তির তাৎপর্য নিয়ে কোরানি আয়াত ও হাদিসসহ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব –ইনশাল্লাহ।

-প্রথম পর্ব সমাপ্ত-

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *