জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লিখা – ’বিলাতে ব্রিটিশ বাংলাদেশী কম্যুনিটির অভ্যুদয়’

হঠাৎ করে নজরে এলো জনাব আব্দুল গফফার চৌধুরী সাহেবের লিখা ’বিলাতে ব্রিটিশ বাংলাদেশী কম্যুনিটির অভ্যুদয়’ শিরো নামে একটি প্রবন্ধ । জনাব আব্দুল গফফার চৌধুরী আমার একজন প্রিয় লিখক । শিরোনামটি দেখেই আমার প্রবন্ধটি পড়ার বারতি আগ্রহ জন্ম নিল। প্রথম কারণ অতি সমপ্রতি আমি ক্যানাডা থেকে বিলাতে গিয়ে লণ্ডন শহর সহ বেশ কটি শহর ঘুরে এসেছি এবং দ্বিতীয় কারণ আব্দুল গফফার চৌধুরীর প্রবন্ধের শিরোনামে ’বাংলাদেশী কম্যুনিটি’ শব্দের ব্যবহার আমার চিন্তার বাহিরে। তিনি কখনও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন বলে আমার জানা নেই; বরং তিনি বঙ্গালী জাতিয়তাবাদে চিরন্তন বিশ্বাসী বলেই আমার বদ্ধমূল ধারণা। প্রবন্ধটি মনোযোগ দিয়েই পড়লাম।  প্রবন্ধের ভিতরে তিনি বাংলাদেশী এবং বাঙ্গালি দুটি শব্দই বহুবার ব্যবহার করেছেন; মনে হয় তিনি তার পূর্বের’ অবস্থান থেকে সরে- এসে উভয় কূলে পা রাখতে চাচ্ছেন। জীবনের শেষ প্রান্থে এসে এভাবে অনেকেই তাদের’ পূর্ব অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। আমার প্রার্থনা- তিনি যেন আরও দীর্ঘজীবি হন এবং তার জীবনের শেষে পরিবর্তন করার সময় পান। জনাব গাফফার চৌধূরী তার প্রবন্ধে বিলাতে বাংলাদেশী বর্তমান প্রজন্মের, অবস্থান মোটামোটি সুন্দর’ ভাবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই প্রবদ্ধেও- তার সভাব-সুলভ ভাবেই ইসলাম প্রসঙ্গ আসলেই বিরূপ এবং বিকৃত করে লেথা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পারেনি। বিলাতে বাংলাদেশী মুসলিম তরুণ-তরুণীদের ইসলামী আদর্শে জীভন-যাপন করার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,   ”নব্বই দশকের কিছু আগে থেকে বাংলাদেশী তরুণদেও এক উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে দেখা দেয় প্রশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি বিমূখতা এবং ইসলামী সংস্কুতির নামে মধ্যপ্রচ্যের সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য।…….এটা সউদি আরব থেকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে পশ্চিমাদেশ গুলোতে মুসলমান তরুণ-তরুণীদের- খৃষ্টান ও পশ্চিমা কালচারের প্রভাব খেকে মুক্ত করার যে গোপন ও প্রকাশ্য অভিযান শুরু করা হয় এটা তার ফল।” জনাব গফফার চৌধুরীর এ বর্ণনা শুধু বিরূপ এবং বিকৃত নয়, বরং সত্যকে গোপন করার অপচেষ্টা মাত্র।  জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরী বাংলাদেশ স্বধীন হওয়া পরে সম্ভবতঃ ১৯৭৪ এর দিকে বিলাতে আগমন করেন। তখন থেকেই বিলাতে বাংলাদেশী সমাজের সর্বজন নন্দিত নেতা হিসাবে তিনি সকলের কাছে খুবই সমাদৃত ও পরিচিত। ১৯৭৮ আমি এক জন ব্যবসায়ী হিসেবে বিলাতে গিয়ে প্রায় ১০ বছর অবস্থান করে- স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য ক্যানাডার টরন্টো শহরে চলে আসি। কেন বিলাত ছেড়ে ক্যানাডায় চলে আসি তা বলব একটু পরে।  ১৯৮০ সালে পূর্বে বিলাতে বাংলাদেশীদের মধ্যে আওয়ামিলীগ ছাড়া আর কোন দল বা দলের তেমন কোন সমর্থক ছিল না। বরং তখন বিলাতি বাংলাদেশীরা আওয়ামিলীগ এর সমর্থনে ছিল প্রায় পাগল। নয় মাসের স্বাধিনতা যুদ্ধের সময় বিলাতে বাঙ্গালিদের, বিশেষ করে- লণ্ডনী সিলেটিদের অবদানের কথা সবার জানা। বাংলাদেশ স্বাধিন হওয়ার পর- বিলাতে বাংলাদেশী সমাজের নেতা বিলাতের আওয়ামী লীগ নেতারাই ছিলেন। জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরী বিলাতে আগমনের পর সেখানের আওয়ামী লীগ ও সামাজিক নেতাদের নেতা হিসাবে পরিগণিত হলেন। একটি ঘটণা উল্লেখ করি; আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম আমার এক বন্ধুর যিনি আওয়ামী লীগ নেতা সাথে প্রয়োজনীয় কাজ ছিল তাই। সম্ভবতঃ ১৯৮২/৮৩ সালে রমজান মাসে লণ্ডন আওয়ামী লীগ একটি ইফতার পার্টির- আয়োজন করেছে লণ্ডনের বাঙ্গালি পাড়া নামে পরিচিত এর ব্রিকলেন জামে মসজিদে। ইফতার পার্টির- আয়োজন প্রায় শেষ; এর মধ্যে খবর এল জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরী ঐ তারিখে অন্যত্র দাওয়াৎ আগেই গ্রহণ করেছেন তাই তিনি ঐ তারিখে ব্রিকলেন জামে মসজিদে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ইফতার পার্টিতে আসতে পারবেন না। লণ্ডনের সব আওয়ামী লীগ নেতারা বসে যে তারিখে জনাব আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাদের- ইফতার পার্টি ব্রিকলেন জামে মসজিদে আসতে পারবেন সেই তারিখে ইফতার পার্টির- তারিখ পরিবর্তন করতে সিদ্ধান্ত নেন। তখন আমি বুঝলাম তিনি বিলাতে আওয়ামী লীগ নেতাদেরও নেতা।   ১৯৮০ দশকেই পূর্ব-লণ্ডনের টাওয়ার হামলেট এলাকা বাঙ্গালী পাড়া বিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু বিলাতে বাঙ্গালী নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি অনগ্রসরতা, শিক্ষা গ্রহনে অহিনার সাথে ভয়াবহ আকারে মাদকাসক্তি ও অপরাধ প্রবনতা বিস্তার লাভ করে। লণ্ডন বাঙ্গালী পাড়ার তরূণদের মধ্যে মাদক ব্যবসা, মাদকাসক্তি এবং অপরাধ প্রবণতার উর্ধ-গতি ব্রিটিশ সরকারকে খুবই চিন্তিত করে তুলে। তাই বাঙ্গালী তরূণ তরূণীদেরে শিক্ষা গ্রহনের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে, এবং মাদকাসক্তি সহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা কমাতে বিপুল অর্থ ব্যায়ে “ঞযব ইধহমষধফবংযরং ঊফঁপধঃরড়হ ঘববফং রহ ঞড়বিৎ ঐধসষবঃ” নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে। যার প্রধান কার্যালয় ছিল ব্রিকলেন এবং নিউরোডের মধ্যখানে ব্রুিড সেনটার নামে একটি বিশাল দালানে, এবং “The Bangladeshis Education Needs in Tower Hamlet”নামে একটি প্রতিষ্ঠান করে যার প্রধান কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ পান জনাব আব্দুল গফফার চৌধুরী।   ইতি মধ্যে টেমস নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে কত জল এবং তার সাথে ভেসে গেছে বিলাতে বাঙ্গালী মা-বাবাদের- সকল স্বপ্ন। মাত্র কটি বছরে- নব্বই দশকের প্রথমেই গোটা ইউরোপের সব প্রত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রধান খবর  “বিলাতের পুর্ব-লণ্ডনের বাঙ্গালীপাড়া ইউরোপের মাদক রাজ্য” বাঙ্গালী নেতারা এবং নেতার  নেতারা  এসব দেখে হাসলেন না কাঁদলেন তা কিছুই বুঝা গেল না। এসময়ে আমি আমার সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তা করে- কাপুরুষের মত ল্ণ্ডন ছেড়ে ক্যানাডায় চলে এলাম। কিন্তু বিলাতে ব্রিটিশ সরকার এবং বাঙ্গালী ক্যমিনিউটি নেতারা যেখানে ব্যর্থ হলেন সেখান থেকেই বাঙ্গালী মা বাবারা  কাজ শুরু করলেন। বিলাতের বাঙ্গালী তরূণ-তরুণীদের পিতা-মাতারা তাদের দায়িত্ববোধ এর চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মাঠে নেমে গেলেন এবং ব্যাক্তিগত এবং সমষ্টিগত ভাবে তাদের সন্তানদের ভবিষত জীবন মাদকাসক্তি মূক্ত এবং শিক্ষার আলোকে আলোকিত করে- গড়ে তুলার নীরব আন্দোলন শুরূ করে দিলেন। বাঙ্গালী ভাষা এবং সংষ্কৃতি চর্চার ও আধুনিক শিক্ষার সাথে সাথে জীবনে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং ইলামী জীবন-যাপনে সন্তানদের উৎসাহিত, উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রানিত করতে পদক্ষেপ নেন। আর তাদের প্রচেষ্টায় বাঙ্গালী তরুণ-তরুণীরাও আত্মিক প্রশান্তি, আত্বমর্যাদা, আত্মপ্রতিষ্ঠা এবং সামাজিকভাবে উন্নত ভাবমূর্তির- প্রতিক হিসাবে বিলাতের বহু জাতিক সমাজে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে সফলকাম হতে লাগল। বর্তমান বিলাতের বাঙ্গালী তরুণ-তরুণীগণ ইসলামী মূল্যবোধে জীবন যাপনের পাশাপাশি উচ্চতর আধুনিক শিক্ষা গ্রহণে অনেক এগিয়ে গেছে যা আজ আমাদের জন্য অহংকারের বিষয়। ৭ ফেব্রুয়ারী থেকে ২২ ফেব্র“য়ারী এই দু-সহপ্তা বিলাতে আমার অবস্থান কালে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের সৌভাগ্য হয়েছিল। বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল দুপুরে। জহরের নামাজ আদায় করতে হল বিয়ের অনুষ্ঠানের বিরাট হল রোমের এক পাশে। প্রায় এক হাজার মেহমানের মধ্যে প্রায় ৮০ পার্সেন্ট তরুণ-তরুণী এবং প্রায় সবাই বিলাতে জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ নাগরিক। স্বতঃস্ফ’র্ত হয়ে তাদের- নামাজ আদায় করতে দেখে, তাদের পরিমার্জিত খুবই উন্নত মানের পোষাক এবং ব্যবহার দেখে মনে হল ওরাই ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক। অনেক আত্মীয় এবং বন্ধু বান্ধবের বাসায় গিয়ে প্রথম যে বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তাহল গৃহের দেয়ালে টাঙ্গানো ছেলে মেয়েদের- গ্রাজোয়েশন অনুষ্ঠানের তুলা ছবি। দ্বিতীয় আকর্ষণ হচ্ছে তাদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে তাদের- পঠ্য-পুস্তকের সাথে বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদদের বই। যে সব চিন্তাবিদদের- সাথে আমরা বয়স্ক বাংলাদেশীরা মোটেই পরিচিত নই এবং আমার মনে হল বাংলাদেশের মুল্লা-মৌলভীরাও হয়তো এসব ইসলামী চিন্তাবিদদের জ্ঞান থেকে বহু দূরে। বিলাত থেকে বিদায়ের আগের দিন গিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর বাসায়। আমার বন্ধুর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে; সবাইকেই বিলাতে উচ্চ শিক্ষিত করার গৌরব অর্জন করেছেন। তাঁর ছোট মেয়ের নাম তাজকিয়া দিবা, সেও সম্প্রতি আইন বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রী নিয়েছে। ওর সাথে কথা বলে মনে হল আমরা বাংলাদেশীদের নিরাশ হওয়ার কারণ নেই। আমরা, আমাদের- নেতারা এবং নেতার নেতারা যেখানে ব্যর্থ সেই ব্যর্থতার গ্লানি মূছে দিয়ে আশার আলো জ্বালাবে যারা তারা প্রস্তুত হচ্ছে, সজ্জিত হচ্ছে উচ্চতর শিক্ষায়, উন্নত চরিত্রে, এবং নৈতিক মূল্যবোধে।

সুতরাং বিলাতে বাংলাদেশী নতুন প্রজন্মের- এই উত্তরণ মধ্যপ্রাচ্চের ধর্ম প্রচারে- সাউদী বাদশার ও ইরানের অর্থায়নে নয়। বরং বাংলাদেশী মুসলমানরা যে মুল্লা-মৌওলভীর মত ধর্মান্ধ নয় এবং নৈতিকতা বিবর্জিত অতি জাতীয়তাবাদ অন্ধও নয়, বিলাতের বাংলাদেশী নতুন প্রজন্ম তারই প্রমাণ। নব্বই এর দশকে মাদকাশক্তির করুণ পরিণতি দেখে- ভূল থেকে শিক্ষা নেয়ার নীতি- এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের জন্মগত চিরন্তন কৌতুহল, সত্যকে জানার এবং সত্যপথে চলার নৈতিক প্রেরণাই বিলাতের বাংলাদেশী নতুন প্রজন্মকে শিক্ষার পথে, নৈতিকতার পথে, সম্মানজনক আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে নিয়ে এসেছে। তাদের প্রতি রইল আমার প্রাণঢালা শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *