পশ্চিমা মিডিয়ায় গাজাতে ইসরাইলি হামলার ঘটনা কি আসলেই সঠিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে? এই প্রশ্নে অনেকেই দ্বিধাবিভক্ত। ইসরাইলের নারকীয় হামলা এবং ফিলিস্তিনিদের মানবিক বির্পযয়ের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে অনেক স্থানীয় ফিলিস্তিনি সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশ করছেন প্রকৃত অবস্থা। তেমনই একজন ফিলিস্তিন নারী 'রাশা এন আবুশাবান', তিনি ফিলিস্তিনে একটি আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি আর স্থানীয় অদেখা বিষয় নিয়ে তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখে চলেছেন। – |
১০ জুলাই ২০১৪ আজ যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন, আমি বোধহয় আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময় পার করছি। আজ বিকেলে আমার বাড়ির কাছে এক প্রচন্ড শব্দে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। বোমা বিস্ফোরণের ফলে আমার বাড়ি ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে, ঠিক সেই সময় আমার বোনের ফোন পাই। আতঙ্কিত উচ্চারণে এবং ভাঙা ভাঙা শব্দে বোন বললো,' ইসরাইলি বিমান হামলা, আমাদের প্রতিবেশী, আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছি…. সব শেষ।" ফোন কলটি কেটে যায়। আমি এবং আমার পরিবারের সবাই দিশেহারা এবং অসহায়বোধ করি। বারবার বোনকে কল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। আমার বাবা এবং ভাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল বোনের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেওয়ার। তারা দু'জন গাড়ি নিয়ে প্রায় ফাঁকা রাস্তায় বেরিয়ে গেল। তারা বের হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যে আরেকটি বোমা প্রচন্ড শব্দে খুব কাছেই বিস্ফোরিত হলো। খুবই ভয় পেয়ে গেলাম, মনে হচ্ছিল আমার হার্ট-বিট এর দ্রিম-দ্রিম শব্দ সারাবিশ্ব শুনতে পাচ্ছে। বাবা-ভাই এর চিন্তায় আমার মা আহাজারি শুরু করে দিলেন আর আমার মনে হচ্ছিল আমি মারা যাচ্ছি। সেই অবস্থায়ই আমি মা'কে সান্তনা দিতে থাকলাম। সেই সময় আমার মনে হচ্ছিল, যদি আমার কোনো 'সুপার পাওয়ার' থাকতো! তাহলে আমি সেই পাওয়ার ব্যবহার করে ইসরাইলি বাহিনীকে গাজা থেকে বের করে দিতাম, থামিয়ে দিতাম তাদের বোমা-ড্রোনের শিস, যুদ্ধ বিমান এবং ট্যাংক।
বোমা বিস্ফোরণের ফলে আমার বাড়ি ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে
কিছুক্ষণের মধ্যে আমার বোন এবং তার বাচ্চারা আমাদের বাসায় এসে হাজির হলো। বোনের ফোন কল এবং বাসায় এসে পৌছানোর মধ্যে যে ২০ মিনিট সময় অতিবাহিত হয়েছিল, তা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আতঙ্কিত সময়। আমার বোনের বাচ্চারা আমাকে জড়িয়ে ধরলো এবং আমার মনে হচ্ছিল তারা আমার বুকের মধ্যে লুকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু হায়! তারা হয়তো জানতে পারছিল না যে, আমি তাদের মতই শক্তিহীন এবং অসহায়। আমার বোন এবং তার পরিবারের সদস্যরা আমাদের সাথেই থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যতদিন না পরিস্থিতি পরিবর্তন হয় অথবা পরবর্তী কী করতে হবে তা নির্ধারণ না করা পর্যন্ত। সে (বোন) বলতে শুরু করলো কিভাবে তার প্রতিবেশী চিৎকার করে সবাইকে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বলছিল। তার এক প্রতিবেশীর বাড়িতে ইসরাইলি অ্যাপাচে সর্তকবার্তা দিয়েছিল যে কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে এফ-১৬ বিমান হামলা করবে। অনেকসময় লোকজন বাড়ি ছাড়তে যথেষ্ট সময় পেয়ে থাকেন, বেশিভাগ সময়ই পান না। সেক্ষেত্রে আমার বোনের পরিবার ভাগ্যবান বলা যায়। আমার বোনের স্বামী যখন সবাইকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান, ঠিক তার ৬ মিনিট পরেই তাদের বাড়ির ঠিক উল্টোপাশের বাড়িতে মিসাইল আঘাত হানে। চারিদিকে মহিলা-শিশুদের চিৎকার-কান্না। মিসাইলের আঘাতে বাড়িটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে, আর আশেপাশের বাড়িগুলোও মুর্হুতেই বসবাস অযোগ্য হয়ে পরলো।
হাসপাতালে আহত ফিলিস্তিনি শিশু
আমি আর্শ্চয এবং আতঙ্কিত হয়ে আমার ভাইবোনের বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে তাদের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলাম। আরও বোঝার চেষ্টা করছিলাম, যুদ্ধের এই সামগ্রিক নারকীয়তা গাজার নারী-শিশু-জনগনের উপর কি প্রভাব ফেলছে। পেশাগত কারণে আমার অভিজ্ঞতা আছে যুদ্ধের কারণে মানসিক আঘাত-অবসাদগ্রস্থ শিশুদের সাথে কাজ করার। আমি জানি তাদের সাথে কী ব্যবহার এবং কীভাবে কাউন্সিলিং করতে হয়। অস্থির টালমাটাল অবস্থার মধ্যেও আমি কয়েক ঘন্টা ঘুমানোর সময় বের করে নিলাম। ঘুম থেকে উঠেই কম্পিউটারের সামনে সংবাদ দেখতে থাকলাম। অন্যদিকে ইসরাইলি নৌবাহিনী ক্রমাগত গাজার বিভিন্ন স্থান লক্ষ্য করে সেল নিক্ষেপ করেই যাচ্ছে। প্রতি মুর্হুতেই নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। একটি খবর দেখে থমকে গেলাম, ইসরাইলি নৌবাহিনী গাজার বাড়িঘর, মসজিদ, নারী-শিশুদের উপর হামলার সাথে সাথে অ্যাম্বুলেন্স, চিকিৎসাকর্মী এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা শুরু করেছে। এটা কী ধরণের উন্মাদনা? এই যুদ্ধ শুধুই সাধারণ জনগণকে মারার যুদ্ধ। কোথায় মানবাধিকার আইন আর কোথায় আর্ন্তজাতিক আইন? কেন জেনেভা কনভেনশন তৈরি হয়েছিল? না ব্যবহার করার জন্য? জাতিসংঘ নামক প্রতিষ্ঠানটি কেন আছে? নাকি জাতিসংঘ তৈরিই হয়েছে ফিলিস্তিনিদের দূর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য? জাতিসংঘকে কখনই ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা এবং ইসরাইলিদের আগ্রাসন বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেথা যায়নি। লজ্জা হচ্ছে আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিরবতায়, লজ্জা জাতিসংঘের অক্ষমতায়।
ইসরাইলি বোমার আঘাতে ধ্বংসপ্রায় গণমাধ্যমের গাড়ি
গাজার প্রধান হাসপাতাল 'শিফা হাসপাতাল' সর্ম্পকে একটি খবর শুনতে পেলাম। হাসপাতালটি হঠাৎ করেই যেন জনসমুদ্রে পরিনত হয়েছে আহত ফিলস্তিনি এবং তাদের পরিবারের পদভারে। গুরুতর আহতদের সড়িয়ে নিতে মিশরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে 'রাফাহ ক্রসিং' খুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু মিশর সেদিকে কান না দিয়ে এখনও রাফাহ ক্রসিং বন্ধ রেখেছে। আমি শুনতে পেলাম একজন ইসরাইলি সেনাকর্মকর্তা নাকি জানিয়েছে, গাজাতে সাম্প্রতিক অভিযানের সাথে মিশরের আগাম সম্মতি এবং প্রত্যক্ষ সহোযোগিতা আছে। হামাসকে নিয়ন্ত্রণে এটা হয়তো ইসরাইল এবং মিশরের যৌথ পদক্ষেপ। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নিরীহ শিশু-নারীসহ সাধারণ জনগণ হত্যায় সহযোগিতা? কি বিধ্বংসী পরিকল্পনা! আমাদের ইফতারের সময় হয়ে এসেছিল, কিন্তু কোনো বিদ্যুৎ ছিল না। অনেকদিন, অনেকমাস এমনকি অনেক বছর হলো মাত্র ৮ ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকছে। যদিও আমার পরিবারের সৌভাগ্য যে আমাদের ব্যাপআপ ব্যাটারি আছে, তা দিয়ে আমাদের বাড়ির কিছু বাতি এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য ওয়াই-ফাই ডিভাইস চালু করতে পারি। প্রচন্ড গরমের মধ্যে মাঝে মাঝে বৈদ্যুতিক পাখা চালাতে পারি। আমাদের মতো সৌভাগ্যবান খুব কমই আছে গাজাতে, বেশিরভাগ মানুষকেই সন্ধ্যার পরে অন্ধকারে থাকতে হয়। মাগরিবের আজানের একটু আগে আমার বোন তার শ্বশুরবাড়ির আত্নীয়দের ফোন করে তাদের অবস্থা জিঙ্গেস করলো। বোনের শ্বশুরবাড়ির কিছু মানুষ তখনও তাদের ধ্বংস বাড়ির মধ্যেই কোনো রকমে বসবাস করে আসছিল। রমজান উপলক্ষে তাদেরকে তাদের প্রতিবেশী এক খ্রীষ্টান পরিবার খাবার সরবরাহ করেছে ইফতারের জন্য। বোনের চোখ-মুখে কিছুটা প্রশান্তি লক্ষ্য করলাম। আসলে এটাই আমাদের প্রকৃত গাজার ধর্মীয়-সামাজিক সহাবস্থানের উদাহরণ। এভাবেই আমরা একে অপরের সুখে-দুখে শান্তনা এবং সাহস সঞ্চয় করে থাকি।
হাসপাতালটি হঠাৎ করেই যেন জনসমুদ্রে পরিনত হয়েছে আহত ফিলস্তিনি এবং তাদের পরিবারের পদভারে
দিনের বেলায় দু:সংবাদ শুনতে হয়েছে, আমার খুবই ঘনিষ্ট বন্ধুর চাচা এবং চাচাতো ভাই মারা গেছে। তারা সাধারণ মানুষ ছিল, নিরস্ত্র ছিল। তারা তাদের বাড়ি ছেড়ে নিজেদের ফার্ম-হাউসে গিয়েছিল আগুন থেকে গাছগুলোকে রক্ষার জন্য। তাদের ফার্মটি ছিল গাজার মধ্যবর্তী স্থানে। মিসাইল হামলার অ্যালার্ট তাদের কানে যায়নি অথবা পাত্তা দেয়নি। মিসাইল মামলায় নিহত হওয়ার কিছু সময় আগেও তাদের পরিবর ছিল, সন্তান ছিল, ছিল প্রিয়জন। সারাটা দিন আমার হ্নদয়ের মাঝে মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠছিল, আর এভাবেই যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন চলে গেল। ওহ! আসলেই কি যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন চলে গেল? তৃতীয় দিন এসে গেছে? আমি জানি না। আমার সময়জ্ঞান আর অনুভূতি শক্তি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাচ্ছে, অনবরত বোমা হামলা চলছে, ড্রোন শিস দিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা আক্ষরিক অর্থে বেঁচে আছি। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনে প্রায় ৪৫০ ইসরাইলি মিসাইল আছড়ে পরেছে গাজাতে, প্রায় ৫৫ বাড়িঘর-মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫৮ জন এখন পর্যন্ত মারা গেছেন এবং ৪৮৬ জন আহত হয়েছেন, যদিও এই সংখ্যা প্রতি মুর্হুতে বেড়েই চলেছে। এটি কোনো পরিসংখ্যান বা সংখ্যা ভিত্তিক প্রতিযোগিতা নয়। যারা নিহত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই একটি নাম ছিল, সৃষ্টিকর্তার দেওয়া জীবন ছিল। আমি বুঝতে পারি না পৃথিবীর কোন আইনে এধরণের ঘটনা ঘটলো তাদের সাথে? দিনটি অনেক লম্বা মনে হচ্ছে আমার কাছে, ভারাক্রান্ত মন এবং ক্লান্ত শরীর যেনো দাবি করছে লম্বা ঘুমের। যদিও আমি সব সময়ই বাইরে বের হবার কাপড় পরে তৈরি হয়ে আছি, আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র-জিনিস তৈরি আছে, যাতে করে আমি যেকোনো মুর্হুতে স্বল্প সময়ের নোটিশে বের হতে পারি। যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন শেষে এটাই কামনা পরবর্তী দিন শান্তি বয়ে আনবে।
পূর্ব প্রকাশিত: