গভীর অবিশ্বাস বাসা বেধেছে

একটা জাতীয় বিপর্যয়ের পড়ে যখন, থোক থোক রক্তের মধ্যে পড়ে থাকা একটা ফুলের গল্পকে, শুধু মানবিকতা নয় এমনকি পলায়নপরতার জায়গা থেকেও মানুষ বিশ্বাস করতে দ্বিধাবোধ করে তখন বুঝে নিতে হবে , সেই সমাজে এবং রাষ্ট্র গভীর অবিশ্বাস বাসা বেধেছে- এবং- সেই অবিশ্বাসের চাষ এক দিনে হয় নাই।
বাংলাদেশের সেকুলার মিডিয়াকে এখন কেউ বিশ্বাস করে না- অন্তত- রাজনীতির প্রশ্নে না। এবং সেই তথ্য যখন বাংলাদেশের, টিপিকাল- ইসলাম-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গি প্রশ্নে হয় -তখন আরো না।
কারণ, এই প্রশ্ন গুলোতে ক্ষমতাসীন সেকুলার এস্টাব্লিশ্মেন্ট বিগত কয়েক বছরে এতো বেশী মিথ্যার চর্চা করেছে যে, তাকে বিশ্বাসের কোন সুযোগ নাই।
মাত্র গতকালকেও আমার এক বন্ধু তার বন্ধুর রেফারেন্সে বললো, ফজরের নামাজ পড়তে যেতে পারি না। দাড়ি দেখে রাস্তায় পুলিশ জিজ্ঞেস করে, কই যান, কেন যান।
এবং শুধু মাত্র, দাড়ি, টুপি থাকার জন্যে মৌলবাদী রাজাকার গালি খাওয়া, বা সেকুলার নেরেটিভের বাহিরে অবস্থান নিলে ছাগু বা ছুপা ছাগু গালি খাওয়া, অথবা, ইসলামিক বই সহ ধরে, জ্বিহাদী বই সহ ধরা পড়েছে বলে বয়ান, রাসুলের অবমাননার প্রতিবাদ করতে হেফাজতের মিছিলে চপ্পল পড়ে আসা ছেলেদের জীবনের চেয়ে গাছের প্রতি দরদ, তাদেরকে কান ধরে উঠানো বসানো, শিবির নামে গুলি করে ফেলার পরে সেকুলার মিডিয়ার নীরব উল্লাস এবং চরমপন্থী গ্রুপের সরব উল্লাস, নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জঙ্গি নাম দিয়ে মানুষ হত্যা, পিতামাতাকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা, তাদের রিপ্রেজেন্টিভ মিডিয়াকে বন্ধ করে দেয়াতে মতামত প্রকাশ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে দেখতে না পারা- এখন মানুষের মনস্তত্ত্বের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে।

একটা জিনিষ খেয়াল করতে হবে, মিডিয়া শুধু গল্প বলেই না। গল্প শোনেও । ইস্লামিস্টদের অধিকাংশ গ্রাম গঞ্জে মফস্বলে শহরে ক্ষমতাহীন হত দরিদ্র মানুষ। মসজিদের একজন ইমামের ক্ষমতা ছাত্র লীগের একটা নিচু সারির পাণ্ডা বা বিএনপির একজন মধ্য পর্যায়ের নেতা বা একজন প্রিমিও হাঁকানো বুর্জোয়ার থেকে অনেক অনেক নীচে। এদের তেমন কোন চাওয়া ছিলনা। এরা শুধু এম্পাথি চেয়েছিল। চেয়েছিল তাদের গল্প সেকুলাররা শুনুক।
মানুষ মানুষকে বেশী কিছু দিতে পারেনা। কিন্তু, এম্পাথি দিতে পারে। মানুষ তার গল্প বলে কারণ, সে মনের ভেতরে এম্পাথি চায়।
কিন্তু, তাদের মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, হেফাজতের মিছিলের দিন ১০ লক্ষ মানুষের ভারে ঢাকার রাস্তা কাঁপছে, আর সেকুলার মিডিয়া সেইদিন সাকিব খানের সিনেমা আর গানের অনুষ্ঠান দেখিয়েছে, যেন কিছুই হচ্ছেনা। তার গল্পও বলতে দেয়া হয়নি, শোনাও হয়নি।
কিন্তু, এই সব ক্ষমতাহীনকে ক্ষমতাসীন দেখিয়ে, তাদের হাতে বাংলাদেশের নির্যাতন দেখানোর যে বয়ান সেকুলার এস্টাব্লিশ্মেন্ট তৈরি করেছে, তার লেয়ারে লেয়ারে এতো পরিমাণ মিথ্যা সেইটা ইতোমধ্যেই বর্জিত হয়েছে এবং বাংলাদেশের বড় একটা জনগোষ্ঠীর কাছে সেকুলার এস্টাব্লিশ্মেন্টের সামান্য গ্রহণযোগ্যতা নাই।
অনেক অনেক ঘটনা যেইটা সাধারণ মুসলমান এবং ইস্লামিস্টদের নার্ভে আঘাত করেছে, সেকুলার মিডিয়া চেপে গ্যাছে,, কারণ, সেইটা ক্ষমতাসীনদের নেরেটিভের সাথে যায় না।
ক্ষমতার রাজনীতির জন্যে, আজকে আমরা গভীর আস‌ ভারসাস্ দেম (Us Vs Them) তৈরি করছি।
তাই কোন আস কোন দেমের মানবিকতার গল্প শুনতে রাজি নয়।
এই মানুষ কত পারসেন্ট মানুষ আমি জানিনা। কিন্তু, বাংলাদেশের ৪০% আওয়ামী লীগ, ৪০% বিএনপি আর ২০* ইন্ডিপেন্ডেন্ট এই গল্প আমি বিশ্বাস করিনা। আমি আমার চারে পাশে যাদেরকে দেখি, সেই স্যাম্পল অনুসারে দেখি, বাংলাদেশে ১০% আওয়ামী লীগ, ১০% বিএনপি, ১০% ইস্লামিস্ট এবং বাকি সবাই ইন্ডিপেন্ডেন্ট যে তার নিজের বিশ্বাস অনুসারে যে সত্য কথা বলছে, তার স্বার্থের কথা বলছে- তার অনুসারী হয়।
আমার ধারনা, এই ৭০% মানুষ এখন কাউকে বিশ্বাস করেনা।

তাই আজকে সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ তরুণ ফারাজের অসাধারণ সেক্রিফাইসের গল্প শুনতেও ওরা রাজি নয়। সন্ত্রাসীদের বন্দুক হাতে কালো ব্যাকড্রপের সামনে যে ছবি আইএস করে , ‘আকাশ, বিকাশ,ডন, বাধন ও রিপন” তত্ত্ব নাকচ করেছে সেই লিস্টে ফারাজের নাম না থাকাই যে স্মোকিং গান প্রুফ সেই ধোয়া দেখেও তাদের ধোঁয়াশা কাটেনা।
কারণ, এখন সত্য খুব রিলেটিভ হয়ে গ্যাছে।
কারণ, মিডিয়া যখন মিথ্যা বলতে বলতে বলতে বাতিল হয়ে গ্যাছে , তখন মানুষ তার নিজের বায়াসটাকেই বিশ্বাস করে। এর বাহিরে কোন সত্য তার কাছে সত্য থাকেনা। এইটাই বায়াসড মিডিয়ার বিপদ।
তাই ট্রান্সকম গ্রুপের মালিকের নাতির কোন মানবিক গল্প সে বিশ্বাস করবেনা। তার কাছে, ক্ষমতা দখলে জন্যে, শিবির বা জঙ্গি নাম দিয়ে ইস্লামিস্টদেরকে খুন করার উল্লাসের ন্যাচারাল জাস্টিস- “জঙ্গি” ফারাজের মৃত্যু। আল্লার বিচার।
প্রথম আলো আমি নিয়মিত ফলো করি। প্রথম আলোকে আমি রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, পুরো সেকুলার এস্টাব্লিশ্মেন্ট এবং মধ্যবিত্ত সমাজের চিন্তার কাঠামো প্রথম আলো তৈরি করে। প্রথম আলো অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে, অনেক ক্ষেত্রে অব্জেক্টিভ থাকার চেষ্টা করে ,কিংবা সেকুলার এস্টাব্লিশ্মেন্টের জন্যে সেন্সিটিভ জিনিষ গুলো এড়িয়ে যায়, অথবা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেনা। ইসলাম-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গি প্রশ্নেও প্রথম আলো সতর্ক ভাবে কলম পরিচালনা করে। তারা কাউকে চেতাতে চায় না কারণ তাকে তার নিজের এবং তার সহযোগীদের বিশাল বিজনেস এম্পায়ারের দায়িত্ব নিতে হয়। ।
তাই, তাদের ভূমিকা এখন অনেক নতজানু। একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিডিয়া যখন কর্পোরেট হাউজ হয়ে যায় তখন কর্পোরেটদের ইন্টারেস্ট রক্ষাই তার সংবাদ দর্শনে পরিণত হয়। এইটা তার ন্যাচারাল বিবর্তন।
কিন্তু সময়টাতে এখন বিভাজন মাত্র তিন বছরে এতো গভীরে গ্যাছে, আস ভারসাস দেমের খেলায় অনেকের কাছেই, জঙ্গিবাদি ৭১ টিভি এবং ধরি মাছ না ছুঁই পানি প্রথম আলোর দূরত্ব মাত্র আধ ইঞ্চি। কারণ দূরত্ব যাত বাড়ে, তখন, রিলেটিভ দূরত্বের পারসেপ্সান আরো কমে আসে।
তাই এই আস ভারসাস দেম নেরেটিভে, লতিফুল হক সাহেবের নাতি হওয়ার দায় নিতে হচ্ছে ফারাজের।
এইটা ফারাজের প্রতি বড় অমানবিকতা।
কারণ, আমি ফারাজের গল্পে বিশ্বাস করি । আমি বিশ্বাস করি, একজন সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ তরুণের পক্ষে, তার বন্ধুদের মৃত্যুর মুখে ছেড়ে না এসে নিজের প্রাণ বিসর্জন সম্ভব। এইটা লতিফুল হকের নাতি কিনা সেইটা ইম্ম্যাটেরিয়াল। এই বয়সে মানুষেরা বন্ধুদের জন্যে জীবন দিতে পারে। ফারাজ দিয়েছে।
কিন্তু, একই সাথে, আমার চরম প্রতিক্রিয়াশীল বন্ধুদের সাথে একমত,
আনিসুল হক যখন লেখেন,
“পৃথিবী জেনে রাখো, ফারাজই বাংলাদেশ”
সেই খানে একটা সুশীল প্রতারণা আছে,
ব্যক্তিগত ভাবে, এই প্রতারণাতেই আমার প্রথম আলোকে নিয়ে প্রধান আপত্তি।
প্রকৃত বাংলাদেশ হচ্ছে, সিকিউরিটি গার্ড আব্দুস সাত্তারের ছেলে, দেড় বছর ধরে, হলি বেকারিতে কিচেন এসিস্টেন্টের কাজ করা জাকির হোসেন শাওন,যে রক্তাক্ত অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে, পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে, প্রচণ্ড মার খেয়ে, এখন ঢাকা মেডিকেলে হাত কড়া অবস্থায় আটক।
শাওনের মা রাত আট টায় কথা বলেছিল ছেলের সাথে। ছেলে জানিয়েছিল যে কাল বোনাসের টাকা পেয়ে, ঈদের বাজার করে বাসায় আসবে। কিন্তু নয়টার পর থেকে তার নাম্বার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে পড়ে, হলি বেকারিতে সন্ত্রাসী আক্রমণের খবর শুনে ঢাকায় ছুটে এসে দরোজায় দরোজায় ঘুরছেন তিনি এবং তার পিতা মেঘনা ঘাটের সিকিউরিটি গার্ড আব্দুস সাত্তার।
সাংবাদিকদের ছবি দেখে চিনতে পেরেছেন, ছেলে সন্ত্রাসী হিসেবে আটক।
ফারাজের ছবি আইএসের লিস্টে নাই দেখিয়ে, আমরা যদি প্রমাণ করতে পারি, সে আইএস ছিল না। তখন, আইএসের লিস্টে না থাকা “ফইন্নির পুত” শাওনের ছবি
দিয়েও প্রুফ হয় সে সন্ত্রাসী ছিল না।
কিন্তু, সেই গল্পে প্রথম আলো পুলিশের ভার্সন লেখে, “পুলিশের কাছে সন্দেহভাজন দুই জঙ্গি চিকিৎসাধীন”- তথ্য দেয় সত্য উদ্ঘাটন করে না।
এই সত্য উন্মোচন না হলে,
এখন আকাশ, বিকাশ,ডন, বাধন ও রিপনের সাথে শাওনের নাম যোগ করে,
জঙ্গি পরিচয়ে তাকে ক্রস ফায়ার করলেও অবাক হবো না। তার জন্যে, কেউ লিখবেনা, শাওনই বাংলাদেশ। সে সুশীল মিডিয়ার কলাম স্পেস পাবেনা। ক্রসফায়ার হয়ে বা গ্রেপ্তার হয়ে সে জাস্ট একটা সংখ্যা হয়ে হারিয়ে যাবে। ।
তার দরিদ্র পিতা-মাতা বাবা আব্দুস সাত্তার ও মা মাসুদা বেগম পুলিশের কাছে, আদালতে ঘুরতে থাকবে। হাউ মাউ করে কাঁদবে, তার শরীরে তীব্র নির্যাতন দেখে। কেঁদে লাভ নাই, আরো করা হবে। বেতন বোনাসের রাগের রাতের ঘটনায়, তার পরিবারের ঈদতো দূরের কথা ছেলেকে উদ্ধার করতে ঘুষের টাকা দিতে এবং মামলা চালানোর খরচে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে যাবেন। সারা জীবন কাঁদবেন।
কিন্তু, কেউ তাকে নিয়ে লিখবেনা, শাওনই বাংলাদেশে।
এ এক সাধারণ গল্প যা প্রতিদিন ঘটে।
যেই দিন,আনিসুল হকেরা লিখতে পারবে, শাওনই প্রকৃত বাংলাদেশ, ফারাজ প্রকৃত বাংলাদেশ নয়- ফারাজ এক্সেপশান, শাওন নিত্যতা- সেইদিন তাদের বাকি কথাও মানুষ বিশ্বাস করবে।

****************

মন্তব্য ফেবুতে করেন।

Loading

জিয়া হাসান

About জিয়া হাসান

লেখক: প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : শাহবাগ থেকে হেফাজত: রাজসাক্ষীর জবানবন্দি -

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *