গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র সংষ্কার বনাম ফ্যসিষ্ট শাসন

বাংলাদেশের বর্তমান কর্তৃত্ববাদী, স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার অবসান এবং ভবিষ্যতে এধরণের অবস্থার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা চিরতরে দূর করতে হলে বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন অপরিহার্য।

এটা ঠিক যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের এই অপরিহার্য এবিষয়টি কখনোই বাস্তবায়িত হবে না যতদিন শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী সমর্থকেরা ক্ষমতাসীন থাকবে। তবে গত ১০ই ডিসেম্বর শনিবার ঢাকার গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির বিভাগীয় গণ সমাবেশে হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবিসহ ১০ দফা দাবি আদায়ের নতুন আন্দোলন অনেকের মনে আশার সঞ্চার করলেও বর্তমান শাসন-তান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে সত্যিকার অর্থে ভবিষ্যতে দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক সুশাসন নিশ্চিত হবে তা বলা যাবে না।

অতএব, সত্যিকার দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো এবিষয়টি বুঝতে সক্ষম হয় নাই বলেই রাষ্ট্র সংস্কারের কাঙ্ক্ষিত গণ-বিপ্লব সম্ভব হচ্ছে না। বিএনপি যদিও জাতীয় সরকারের কথা বলছে কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমে যে সংস্কার দরকার সে বিষয়ে সুস্পষ্ট রূপরেখা দেবার প্রয়োজন মনে করছে না।

এখানে হয়তোবা অনেকে বলতে পারেন যে আগে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের ফ্যসিষ্ট শাসনের পতন হউক তার আগে এখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে Putting the cart before the horse মানে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ানো। তবে বর্তমান এক দলীয় দখলদার সরকার হঠানোর আন্দোলনের একই সাথে বিগত ৫০ বছর থেকে চলে আসা রাজনীতির প্রকৃত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথে বাস্তবমুখী কর্মপদ্ধতির রূপরেখা দেখাতে পারলে সেটি গণআন্দোলনের পথে বাধা হবে না বরং জনগণের আস্থা ও ভালবাসা অর্জন করে বর্তমান স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলন আরও বেগবান হবে।
গত চৌদ্দ বছরের একদলীয় শাসনে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা খুবই দুর্বল হয়ে উঠেছে। ফলে শাসক দলের কোন অন্যায় অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা বলার শক্তি ও সাহস চলে গিয়েছে।

আমরা জানি যে , সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত একটি সংস্কার মূলক ব্যবস্থা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন কিন্তু সংবিধানের ভুলের কারণে গণভোট ছাড়াও দলীয় স্বার্থে সেটি বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়েছে।

তবে বাংলাদেশে একটি দুর্নীতি মুক্ত ও জবাবদিহিতার শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় কি করা হবে সে পরিকল্পনার রূপরেখা সামনে আসতে হবে। মানুষকে স্বপ্ন দেখার সুযোগ দিতে হবে। শুধু মাত্র শেখ হাসিনা হঠাও বলে গণআন্দোলন হবে না। বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে জনসমাগম দেখে খুব বেশী খুশী হওয়া সঠিক হবেনা। কারণ বিএনপির জনসভায় যে বিরাট সংখ্যক মানুষ আসছেন এরা আগে থেকে এমনিতেই আওয়ামী বিরোধী মহলের লোক যার সাথে কিছু সাধারণ মানুষও আছে। কিন্তু একটি গণ আন্দোলনের জন্য দেশের আপামর জনসাধারণের মাঝে যে সাড়া জাগানোর দরকার সেটি করতে বিএনপি এখনও সফল হয়নি বলা যায়।

আওয়ামী লীগ তাদের দলে শুরু থেকেই অনেক গুণ্ডাপাণ্ডা লালন করার ইতিহাস আছে। তাছাড়া বিগত ১৪ বছর ক্ষমতায় থেকে তাদের কুশাসনে সে পেশী শক্তি অনেক বৃদ্ধি করেছে। সেই সাথে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সর্বস্তরে তাদের দলীয় লোকদের দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে এবং অবাধ দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়ে তাদের সেই অংশীদারিত্ব ও সহযোগীতা অনেক বেশী মজবুত করতে সক্ষম হয়েছে।

১৮ কুটি মানুষের দেশে এমন অনেক লোক যেমন হাসিনাকে সহ্য করতে পারছেন না আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনের কারণে তেমনি অনেক লোক আছেন যাদের চোখে হাসিনার কোন অপরাধ কিংবা অব্যবস্থাপনা ধরা পড়ে না সেই সাথে বিএনপিকে অপছন্দ করার লোকেরও অভাব নাই।

মনে রাখতে হবে অতীতের স্বৈরাচারী শাসকদের সাথে ২০২২ সালের শেষ প্রান্তে এসে শেখ হাসিনার শাসন ক্ষমতার তুলনা করা যাবে না। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে এসে একজন স্বৈরশাসক ও তাদের মাফিয়া গুষ্টি যেমন শক্তিশালী হতে পারে তেমনি তার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন জাগানোও খুব সহজ হতে পারে যদি সে আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি ও উদ্দেশ্য গণমুখী হয় যেখানে মানুষ একটি সুন্দর ভবিষ্যতের বাস্তব স্বপ্ন দেখার মত সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি দেখতে পায়। তবে এটাও ঠিক যে আমাদের মত ৩য় বিশ্বের দেশে বিশ্ব মোড়লদের স্বার্থ রিজিম চেইন্জে বিরাট ভূমিকা রাখে কিন্তু সে পরিবর্তন সব সময় যে দেশের আপামর জনসাধারণের কোন কল্যাণ বয়ে আনবে সে আশা করা যায় না।

বলা হয় বাঙালি জাতির দূরদৃষ্টির খুবই অভাব এবং দেওয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত নড়তে চায়না। পায়ের তলে উত্তাপ লাগলে ঝাঁপ দিতে পারে কিন্তু কোথায় পড়ছে সে খেয়াল নাই! তাই দেখা যায় উত্তপ্ত কড়াই থেকে এক লাফে পড়ে যায় জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *