খলিফার অর্থ আসলে কি

খলিফার যে অর্থ বুঝতে দেয়া হয় না সে ব্যাপারে কিছু কথা রাখছি এখানে। তবে তার আগে আরো কিছু বিষয় জানা দরকার।

মোহাম্মদ (স:) সহ কুরআনে যে বিভিন্ন নবীর কথা এসেছে সেখানেও অনেক কিছু শিক্ষণীয় বিষয় আছে যা একজন মুসলিম এড়াতে পারে না।

আদম (আ:) কে যখন তার ভুলের জন্য দুনিয়ায় পাঠানো হয় তখন তাকে বলে হয়েছে দুনিয়ায় তোমার শত্রু হচ্ছে ইবলিশ বা শয়তান। সেখানে মানুষকে তার শত্রু মনে করতে বলা হয় নাই। তাই মানুষকে কেন আমরা শত্রু মনে করব?

আমরা যদি কোরআনে ইউসুফ (আ:)এর কাহিনী দেখি সেখানে দেখা য়ায় ইউসুফ (আ:) মুশরিক বাদশাহর অধীনেই খাদ্য মন্ত্রী হয়ে তার নবুয়্যতী প্রকাশ করেছেন এবং তাকে মিশরের রাজা হয়ে যেতে হবে বলেও আল্লাহর তরফ থেকে কোন হুকুম আসে নাই।
মুসা (আ:) বার্তা শুধু বনি ইসরাইলের জন্য ছিল না ফেরআউন সহ সবাইকে তিনি আহ্বান করেন আল্লাহর পথে আসতে। ঈসা (আ:) ইতিহাসও এ কথা বলে যে তিনি রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থেকেই আল্লাহর বানী প্রচার করেন।

একইভাবে আরেকটি সুন্দর উদাহরণ ইব্রাহীম (আ:) এর সময়ে পৌত্তলিক বাদশাহ নমরুদের সাথের কথোপকথনে আমরা দেখতে পাই। তিনি যখন বলেছিলেন যে আল্লাহই হচ্ছেন জীবন-মৃত্যুর মালিক তার জবাবে নমরুদ বলেছিল যে, সেও মানুষের জীবন মৃত্যু দিতে পারে। ইব্রাহিম (আ:) নমরুদের সে কথাতে তর্ক না উল্টো প্রশ্ন করেছিলেন যে আমার প্রভু সূর্যকে পূর্ব থেকে উদয় করেন তুমি কি তা পশ্চিম দিক থেকে করতে পারবে? সে প্রশ্নে অবিশ্বাসী নমরুদ তখন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল!

আজকের যুগের মুসলিমরা ইসলামের ব্যাপারে দুটি রাস্তার অন্য কিছু ভাবতে চায় না! অর্থাৎ বিজয়ী হব না হয় মরিব এই dichotomyতে ভুগছে!

প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেমে দ্বীন মৌলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান বলেন মুহাম্মদ (স:) কখনও dichotomy বা দুটি অপশন নিয়ে ডুবে থাকেন নাই। তার মিশন সফলকাম করতে তিনি তৃতীয় অপশনও অবলম্বন করেছেন যেমনটি ছিল হিজরতের সিদ্ধান্ত অর্থাৎ নিজের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া। তিনি যেহেতু আল্লাহর নবী তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে মক্কায় থেকেই তো তার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

একি ভাবে হুদাইবিয়ার প্রান্তে এসেও তার কাছে দুটি অপশন ছিল হয় যুদ্ধ করে মক্কায় প্রবেশ না হয় খালি হাতে ফিরে যাওয়ার কিন্তু তিনি সে সময়ে শান্তি চুক্তির তৃতীয় অপশনটি কাজে লাগান।

মরহুম মৌলানা ওয়াহিদুদ্দিনের মতে মুসলমানদের মাঝে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে এক ইন্টেলেকচুয়াল বিভ্রান্তি বিশেষ করে ” আমরা বনাম ওরা” এই মনোবৃত্তিকে আঁকড়ে ধরা। আর এটি যে ভীষণ counter-productive বা নিষ্ফল চিন্তা সে উপলব্ধির প্রচণ্ড অভাব। তিনি বলেন আজকের যুগে মুসলিম অমুসলিম দেশ বলতে কিছু নাই বরং পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও মানুষেরা হতে পারে ইসলামের বানী গ্রহণের পটেনশিয়াল বা সম্ভাব্য উর্বর ভূমি। সেই সম্ভাব্যতা কাজে লাগাতে মানুষকে ভালবেসে মানুষের কল্যাণে কথা বলতে হবে এবং সকল ধর্মের মানুষের সাথে মানবতার সেতু বন্ধন গড়তে হবে।

প্রথম কথা হচ্ছে এ পৃথিবী কখনই সম্পূর্ণ সমস্যা মুক্ত থাকবেনা এবং পৃথিবীকে সে উদ্দেশ্যে সৃষ্টিই করা হয় নাই। ইসলামকে বুঝতে পারলে এ সহজ বিষয়টি বুঝা কঠিন হতে পারে না। আজ কাল মুসলিমদের অত্যাচারিত হওয়ার যে দৃশ্য আমরা দেখছি সেটি ইসলাম ও ইসলাম-হীনতার ধন্ধ কিংবা সভ্যতার সংঘর্ষ নয় এগুলা হচ্ছে স্বার্থের সংঘর্ষ। মৌলানা ওয়াহিদুদ্দিনের খানের মতে Samuel P. Huntington এর লিখিত বইয়ের টাইটেল clash of civilization একটি ভুল টাইটেল এটি হওয়া উচিৎ ছিল Clash of Interest.

আজকাল মুসলিমদের মাঝে অনেকে স্বপ্ন দেখেন ইসলামী সাম্রাজ্য পুন: প্রতিষ্ঠা বা পুনর্জাগরণ তাই প্রয়োজন মুসলিম খিলাফত । আমরা জানি বর্তমানে ৫৭টি মুসলিম দেশ আছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই দেশগুলি এক সাথে মিলে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র করলেই তো একটি মুসলিম সাম্রাজ্য হয়ে যায়! ৫৭টি বাদ দেন ১৭টি মিললেও তো এক বিশাল সাম্রাজ্য হতে পারে। ইসলামের নামে সৃষ্টি হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিও ২৫ বছরের বেশী মুসলিমসংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের সাথে একসাথে থাকতে পারে নাই! আর হুজুররা আছেন খিলাফতের ধান্ধায়!

অবশ্য পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, বিশ্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫০টি দেশ রয়েছে । আরও তথ্য দেখায় যে এই দেশগুলি বিশ্বের জিডিপির প্রায় মাত্র 8% অবদান রাখে। সর্বাধিক মুসলমানের অঞ্চলটি হচ্ছে মধ্য প্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকা অঞ্চল। অন্যান্য বিশাল অঞ্চলগুলির মধ্যে রয়েছে মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, উপ-সাহারা আফ্রিকা এবং এশিয়া-ওশেনিয়া। সামান্য ছোট শতাংশ আমেরিকা এবং ইউরোপে বাস করে অবশ্য ইহুদীদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী।
ইন্দোনেশিয়ায় সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যা ২২৯ মিলিয়ন, পাকিস্তান রয়েছে ২০০ মিলিয়ন এবং ভারত ১৯৫ মিলিয়ন, বাংলাদেশে অমুসলিমদেরকে বাদ দিলে হয়তবা ১৫০ মিলিয়নের কাছাকাছি।

আল্লাহ মুসলমানকে খলিফা হিসাবে পাঠানোর কথা বলেন নাই বরং তিনি মানুষকে খলিফার ক্ষমতা দিয়ে পাঠিয়েছেন বলেছেন। আজ মানুষ material world বা জাগতিক বিশ্বে যে শক্তিমান হয়েছে, যে প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করে যাচ্ছে, বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কার করতে পেরেছে, নিজের ডানা না থাকলেও পাখির মত কষ্ট না করে আরামে শুয়ে আকাশ ভ্রমণ করতে পারছে, চাঁদে পৌছাতে পারছে, মানুষের হার্ট ট্রেন্সপ্ল্যন্ট করতে পারছে ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের প্রচেষ্টা করতে পারছে, বড় বড় মেশিন কলকারখানা, কম্পিউটার ও কৃত্রিম বুদ্ধি নির্ভর যন্ত্রপাতি সহ কত কিছু আবিষ্কার করতে পারছে। যা বিশ্বের অন্য কোন সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয় অর্থাৎ কোন পশু পাখি কিংবা বিরাট জন্তু-জানোয়ারের পক্ষে সম্ভব নয় । তাদের পক্ষে জাগতিক বিশ্বে এভাবে সৃজনশীল সক্ষমতা অর্জন সম্ভব নয়। এটি কেবল মানুষই করতে পারে। এগুলোই হচ্ছে খিলাফতের লক্ষণ।

এগুলোই হচ্ছে খিলাফতের লক্ষণ। আর এই খিলাফতের ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করছেন আমল ও আচরণে কোন মানুষ উত্তম তখন তাকে পরকালের অসীম জীবনে পুরস্কৃত করবেন।

ইন্নি যাইলুন ফিল আর‌দি খলিফা। অর্থ; নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করিব। ~ সুরা বাক্বারাহ আয়াত ৩০। এই খলিফার অর্থ আসলে উপরোল্লেখিত মানুষের ক্ষমতার বহিপ্রকাশ ও ভবিষ্যতে সাম্ভাব্য আরো অনেক সক্ষমতা যে ক্ষমতা পশু পাখি কিংবা বিরাট জন্তু-জানোয়ারের নাই । এটিই হচ্ছে খলিফার বৈশিষ্ট্য।

এখন এই খলিফার মানে পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েমের জন্য ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েম করা? যারা এ অর্থ বুঝে তার মানে কুরআনের “আয়াত আল কুরসিতে” আল্লাহ যে ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন তা যথেষ্ট নয় সেজন্য ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েম করে আমাদেরকে সেটি পরিপূরণ করতে হবে? এসব হচ্ছে ভিত্তিহীন কথা।

ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন পরিবর্তন করা এখানে অবহেলা করলে পরকালে শাস্তি জাহান্নাম এবং বিশেষ ক্ষেত্রে ইহকালেও এ শাস্তি কিছুটা হতে পারে। আসল কথা হচ্ছে জীবন শেষে সবাইকে একাই নিজের কবরে যেতে হবে। সেখানে ব্যক্তির নিজের জীবনে ধর্মের কতটুকু পালন হয়েছে ও অন্য মানুষের সাথে কি ব্যবহার করেছে ইত্যাদি সে প্রশ্নের জবাব নিজেকেই দিতে হবে।

কিন্তু যেহেতু সমাজে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে সেখানে কোন এক গুষ্টির ধর্মের বাধ্যবাধকতা দিয়ে তাড়াহুড়া করে কিংবা জোর করে রাষ্ট্র সামজে সবার জন্য বাস্তবায়িত করা যায় না। সে জন্য মানুষের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ঐক্যমতের প্রয়োজন।

রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন মানব সভ্যতার ইতিহাসের একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেটি মানুষের চিন্তাভাবনার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ধাপে উত্তরণ হয়ে আসছে সেই প্রস্তর যুগ থেকে। যে দেশের মানুষ শিক্ষিত ও সভ্য তারা দ্রুত সফল হচ্ছে এবং আরো উন্নত হবে।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *