ক্ষমতার শেষ শেকড়টিও কেটে গেছে উপজেলা নির্বাচনে

শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বে সব বিরোধী দল অংশ নিতে রাজি হয়নি যেসব আশঙ্কায় তার সবই বাস্তবে দেখা গেছে প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচনে। ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট, প্রতিদ্বন্দ্বীদের এজেন্টদের বিতাড়ন, অস্ত্রবাজি এবং সাধারণভাবেই সরকারি তাণ্ডব ছিল বুধবারের (১৯ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচনের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দিক। দেশবাসীর আরও প্রত্যয় ঘটল যে অসাধু উপায়ে নির্বাচনে জয় আওয়ামী লীগের সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের ভারত-মার্কিন মাস্টার প্ল্যানের নির্বাচনেও এসব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ বুঝেই নিয়েছে, তাদের স্বৈরতন্ত্রী এবং সন্ত্রাসী রাজনীতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে পরাজয় নিশ্চিত জেনেই তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে সাজানো নির্বাচন করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। গত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনও তারা করেছে একই কারণে। অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তারা আদৌ কোনো আসন পেত কিনা সন্দেহ আছে।

মোট ৪৬০টিরও বেশি উপজেলার নির্বাচন হচ্ছে পাঁচ দফায়। স্থানীয় নির্বাচনগুলো হওয়ার কথা অরাজনৈতিক ও নির্দলীয়ভাবে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন আর কোনো কিছুই অরাজনৈতিক কিংবা নির্দলীয়ভাবে করা সম্ভব নয়। মেরূকরণ এমনই চরমে পৌঁছেছে। বিদেশিরা হয়তো এসব নির্বাচন থেকে জাতীয় রাজনীতির প্রবণতার পরিমাপ করতে চাইবে না। সেটা অনেকটা হবে ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখার কিংবা অ্যাডমিরাল নেলসনের অন্ধ চোখে দুরবিন ধরে শত্রু বহরের মূল্যায়ন করার শামিল। ভোট ও ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনকে এই বিদেশিরা বিশ্বাসযোগ্য কিংবা গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করেনি। তা সত্ত্বেও মূলত ভারতের চাপে কোনো কোনো দেশ ক্রমেই শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে লেনদেন করতে রাজি হচ্ছে। তাদের দিক থেকে স্থিতিশীলতার দোহাই দেয়ার চেষ্টা লক্ষণীয়।

তারা সম্ভবত ভুলে যাচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্ভবত দীর্ঘতম স্থায়ী শাসক ছিলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের জোসেফ স্ট্যালিন। তার ৩১ বছরের শাসনের অধিকাংশ সময় গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে মস্কোর ভয়ানক এক স্নায়ুযুদ্ধ চলেছে। সোভিয়েট ইউনিয়নেই কত লাখ মানুষ যে এ সময়ে মারা গেছে, তার হিসেব করাও সম্ভব নয়। পাকিস্তানে বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান স্থিতিশীলতার দোহাই দিয়েই গদি আঁকড়ে থাকতে চেয়েছেন। আরো আধুনিক কালে রবার্ট মুগাবে গত ৩৭ বছর ধরে জিম্বাবুয়ের রাষ্ট্রপতির গদি দখল করে আছেন। এ সময়ে জিম্বাবুয়েতে যেসব অমানুষিক অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে তার কিছু কিছু ছবি টেলিভিশনে দেখেছি, বিবিসি থেকে প্রচারও করেছি সে সংক্রান্ত খবর। পশ্চিমা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই তিনি অগ্রহণযোগ্য। স্থিতিশীলতার দোহাই দিয়ে যারা শেখ হাসিনার গণবিরোধী সরকারের সঙ্গে লেনদেন করতে রাজি হবে, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই দ্বিমুখী নীতি এবং কাটা জিহ্বা দিয়ে কথা বলার অভিযোগ উঠবে।

জানুয়ারির সে নির্বাচনে দেশের মোট দুই শতাংশ ভোটারও ভোট দেননি। ১৫৩ নির্বাচনী এলাকার চার কোটি ৯০ লাখ মানুষকে আদৌ ভোটদানের সুযোগ দেয়া হয়নি। অন্য ১৪৭ এলাকায় বহু কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। সরকার বিদেশিদের ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করছে এই বলে যে, বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জন এবং বাধাদান না ঘটলে তারা বিশ্বাসযোগ্য সংখ্যক ভোট পেত। ঠিক সে কারণেই উপজেলা নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিবেচনা করা সবারই কর্তব্য হবে। প্রথম দফায় ৯৭টি উপজেলায় নির্বাচনে প্রধান বিরোধী বিএনপি দল ৪৪টিতে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৩৪টিতে জয়লাভ করেছে।

জামায়াতের এত সাফল্য যে কারণে

বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ হচ্ছে ১৩টি উপজেলায় জামায়াতের এবং মাত্র একটি উপজেলায় বর্তমান সংসদের গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির জয়লাভ। সব মিডিয়া এবং পর্যবেক্ষক একমত যে, সরকারের দিক থেকে তাণ্ডবগুলো না ঘটলে বিএনপির জয় আরও চাঞ্চল্যকর হতো। এমনকি নির্বাচন কমিশন থেকেও স্বীকার করা হয়েছে যে ভোট জোচ্চুরি ও অন্যান্য অনিয়মের বহু অভিযোগ তাদের কাছে এসেছে। এসব সরকারি তাণ্ডব না হলে আওয়ামী লীগ আদৌ কোনো উপজেলায় জয়ী হতো কিনা সন্দেহ। উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত বছর সিটি করপোরেশনগুলোর নির্বাচনেও শাসকদল আওয়ামী লীগ তাদের সব ‘তাণ্ডব’ দেখিয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি করপোরেশনেই মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী।

মাত্র একটি উপজেলায় সরকারি প্রভাবের জোরে জাতীয় পার্টির জয় আবারও প্রমাণ করে যে এই সুযোগসন্ধানী দলটি গত মাসের সংসদ নির্বাচন নিয়ে যেসব কেলেঙ্কারি করেছে তাতে তাদের সীমিত সমর্থকরাও ঘৃণায় নাক সিঁটকে নিয়েছে। এমনকি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান লেজে হুমু এরশাদ নিজেই বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টির ভবিষ্যত্ এখন অন্ধকার।’ অবশ্যি এরশাদ প্রায়ই আমাকে ব্রিটিশ আবহাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেন। শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত, শরত্—চারটি ঋতুই একদিনে দেখা সম্ভব ব্রিটেনে। এরশাদের মুখে সকাল, দুপুর, বিকাল আর সন্ধ্যায় পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা প্রায়ই শোনা যায়। দল হিসেবে জাপার অস্তিত্ব এখন সত্যি সত্যি বিপন্ন মনে করতেই হবে। আর জামায়াত যে ১৩টি উপজেলায় জয়ী হয়েছে, তার থেকে ধরে নিতেই হবে যে দেশের মানুষ সরকারের মিথ্যার মুখোশ খুলে ফেলতে এখন বদ্ধপরিকর।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০১১ সালের আগস্ট মাসে বলেছিলেন, জামায়াত বাংলাদেশের মানুষকে ভারতের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন করে তুলছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (নাইন-ইলেভেন) নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে আল কায়দার সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে আমেরিকার সাধারণ মানুষ ইসলামী সন্ত্রাস সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে গদিলাভের সময় থেকেই মার্কিন জনমতের এই প্রবণতার অপসুযোগ নেয়ার লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন বাস্তব-অবাস্তব সংস্থার নাম দেখিয়ে টুপি-দাড়িধারী মানুষকে গ্রেফতার এবং নির্যাতন করে সরকার মার্কিনিদের মন পাওয়ার চেষ্টা শুরু করে। মনমোহন সিংয়ের উক্তিটির পর ভারতকে খুশি করার মতলবে জামায়াতের বিরুদ্ধে যেন সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। টুপি-দাড়ি পরিধান এবং মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া যেন মঙ্গলগ্রহ কিংবা অন্য কোনো তারকালোক থেকে হঠাত্ করে বাংলাদেশে এসে পড়েছে। সরকারের ভাবখানা সে রকম। সনাতনী কাল থেকেই এ দেশের মানুষ যে ধর্মপ্রাণ, বর্তমান শাসকরা যেন ইতিহাস বইতেও সেসব কথা পড়েননি।

দেশবাসীর সহানুভূতি যাবে নির্যাতিতের দিকে

সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। ভারতের দালাল এবং ইসলামবিরোধী চক্রের দাবিতে সন্ত্রাসী দল অপবাদ দিয়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা কষছে সরকার। তাদের উসকানি দিচ্ছে শাহবাগ কুখ্যাত ধর্মদ্রোহী ভারতের দালাল কতিপয় জীব। টুপি-দাড়ি পরিহিতদের লাশ এখন প্রায়ই এখানে-সেখানে পড়ে পাওয়া যায়। সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী ত্রাস এখন মমজিদেও ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের স্বীকৃতি অনুসারেও ‘ইসলামী সন্ত্রাসী’ খুঁজে বের করার জন্য আওয়ামী লীগের ফেউ পাঠানো হচ্ছে মসজিদে। অনেক মুসলমান এখন নামাজ আদায় করতে মসজিদে যেতে ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতকে ব্যাপক সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যেন শেখ হাসিনার সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখালো। প্রমাণ হয়ে গেল অন্যায়ভাবে এ সরকার যাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাবে জনসাধারণের সহানুভূতি ঘুরে যাবে তাদের দিকে।

সরকারের মন্ত্রীদের, বিশেষ করে মন্ত্রিসভার প্রধানের মুখে খিস্তি-খেউড় যে আবার শালীনতার সব মাপকাঠির বাইরে চলে যাচ্ছে, তাতে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে। তাদের পায়ের তলার মাটি সরে গেছে, ক্ষমতার শেষ শেকড়টিও ছিন্ন হয়ে গেছে মাত্র ৯৭টি উপজেলার নির্বাচনী ফলাফলে। দেশি-বিদেশি সবাই এখন বুঝে গেছে, সর্ববিধ সরকারি তাণ্ডব এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ব্যবহার করেও তারা গণতন্ত্রকামীদের দমিয়ে রাখতে পারছে না। যে স্থিতিশীলতার দাবি তারা করছে, সেটা কত ভঙ্গুর প্রমাণ হয়ে গেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে বাকি চার দফার উপজেলা নির্বাচনে তারা আরও মরিয়া হয়ে উঠবে। কিছু লক্ষণ এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর ১৯ দলের জোটের নেতাকর্মীদের হত্যা বেড়ে গিয়েছিল। প্রথম দফার উপজেলা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর সরকার ও শাসকদলের হিংস্রতা আরও বেড়ে গেছে মনে হয়। কিন্তু তাতে করে আরও সুস্পষ্ট প্রমাণ হয়ে যাবে, বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ের ওপর চেপে বসে থাকার কোনো অধিকার এই সরকার আর এই দলের অবশিষ্ট রইল না।

কী শিক্ষা নেবে ১৯ দলের জোট

কী করবে এখন ১৯ দলের জোট এবং সে জোটের প্রধান শরিক বিএনপি? এতদিন আন্দোলন করেও একটা অমোঘ সত্য তারা উপলব্ধি করতে পারেনি। বিদেশিরা, বিশেষ করে বিদেশি কূটনীতিকরা যখন তাদের সমালোচনা করে এবং যখন তাদের সমর্থন করে, সেটা কখনোই নিছক ন্যায়ান্যায় এবং নিয়ম-নীতির কারণে নয়। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার পত্রিকা এবং সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের সমর্থন সংগ্রহ করে ভারতের হাইকমিশনার বীণা সিক্রির সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টম্যাস আওয়ামী লীগকে গদিতে বসানোর জন্য যখন বহু ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন, তখন তার সঙ্গে ন্যায়নীতির কিংবা গণতান্ত্রিক আদর্শের কোনো সম্পর্ক ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতা বলে দাবি করে এবং সাধারণত গণতন্ত্রের পক্ষে থাকতে চায়। সে কথা মেনে নিতেই হবে। কিন্তু তার বিশ্বস্বার্থ সময় সময় গণতন্ত্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হয়ে দেখা দেয়।

একবিংশ শতকের প্রথম দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন স্বার্থ ছিল উদীয়মান পরাশক্তি চীনের প্রভাব সীমিত রাখার লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলা, যে ভারত সআয়ু যুদ্ধের সূচনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু সোভিয়েট ইউনিয়নের মিত্র ছিল। ভারত বরাবরের মতো বাংলাদেশে এমন একটা সরকার চেয়েছিল যে সরকার তার সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু নতুন শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে মার্কিন স্বার্থের কিঞ্চিত্ পরিবর্তন ঘটেছে। ওয়াশিংটন বঙ্গোপসাগরে তার নৌশক্তি বাড়াতে চায়। সে লক্ষ্য ভারতের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সুতরাং ওয়াশিংটন গণতন্ত্রের বিবেচনাকে তুলে ধরে বিএনপি ও বিরোধী জোটের প্রতি আনুকূল্য দেখিয়ে এসেছে।

কিন্তু বিরোধী জোটের সঙ্গে এত বেশি ঘনিষ্ঠ হতে সে চায়নি যাতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ভারত বিশাল দেশ। তার সমরাস্ত্রের বাজার বিশাল। বর্ধিষ্ণু মধ্যবিত্ত ও ভোক্তা শ্রেণীর চাহিদা অপূরণীয় বলে ভুল হতে পারে। অন্যান্য বহু দেশের মতো আমেরিকার ব্যবসায়ীদের প্রলুব্ধ দৃষ্টি ভারতের দিকে নিবদ্ধ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাপারে এশিয়ার দ্বিতীয় পরাশক্তি ভারতের সমর্থন ওয়াশিংটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্যই বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন নীতি ও মনোভাবে কিছু আপাতঃবিরোধিতা লক্ষ করা যায়। রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা যখন গণতন্ত্রের প্রতি প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ঘৃণা এবং বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন লক্ষ করেন, তখন সেটাকে আন্তরিক বলতেই হবে। কিন্তু তিনি যখন সহিংসতার সমালোচনা করে বিরোধীদের আন্দোলন সংযত করার পরামর্শ দেন, তখন কূটনীতিক হিসেবে নিজ দেশের স্বার্থের প্রতি তার মনোযোগ প্রধান হয়ে ওঠে।

ইউক্রেনের বিপ্লবের সাফল্য যে কারণে

ইউক্রেনে বিগত তিন মাসে যে অগ্নিস্রাবী এবং রক্তঝরা বিপ্লব ঘটেছে তাতেও বিদেশি কূটনীতির এই উভয় সঙ্কট পরিষ্কার হয়ে যায়। ইউক্রেন সোভিয়েট ইউনিয়নের একটি অঙ্গরাজ্য ছিল। সোভিয়েটের পতনের পর ১৯৯১ সালে সে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন হয়ে যায়। কিন্তু রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন যত বেশি সম্ভব সাবেক অঙ্গরাজ্যকে আবার রাশিয়ার প্রভাবাধীনে আনতে চান। মুসলিমপ্রধান চেচনিয়া ও দাগেস্তানকে তিনি অস্ত্রবলে দখল করে রেখেছেন। সাবেক অঙ্গরাজ্য জার্জিয়াকে আরো কুক্ষিগত করার জন্য ২০০৮ সালে পুতিন সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। সে যুদ্ধ দক্ষিণ ওসেটিয়া যুদ্ধ নামে খ্যাত। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের লঘিষ্ঠ মানুষ রুশ ভাষাভাষী। প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইউনোকোভিচ এবং তার সরকারের সদস্যরা রুশ প্রভাবিত ছিলেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন সে সুযোগ নিয়ে ইউক্রেনকে আবার রাশিয়ার আধিপত্য বলয়ে ফিরিয়ে আনতে চান।

সম্প্রতিকালে ইউক্রেনের অধিবাসীরা তাদের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ইওরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইউনোকোভিচ সংশ্লিষ্ট চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। বিপ্লবের সূচনা সেখান থেকে। ইওরোপীয় ইউনিয়নের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও জনসাধারণকে সমর্থন দেয়, কিন্তু বাংলাদেশের মতো সেখানেও ওয়াশিংটন আন্দোলনকারীদের সংযুক্ত থাকতে পরামর্শ দেয়। বৃহত্ শক্তির রাজনীতি এখানেও সঞ্চালক শক্তি ছিল। সিরিয়ার জটিল গৃহযুদ্ধের অবসান এবং ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরি থেকে নিবৃত্ত রাখা মধ্য প্রাচ্যের যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বড়ো সমস্যা। সিরিয়া ও ইরানের ওপর রাশিয়ার প্রভাবই সর্বাধিক। সে কারণে ওয়াশিংটন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে চটাতে চায়নি। আন্দোলনকারীদের সেজন্যেই সংযমের পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন মার্কিন নেতারা।

জনতা পিছল পথে যায়নি
কিন্তু কিয়েভের ইন্ডিপেনডেন্ট স্কোয়ারের (ওরা বলে ময়দান) জনতা বৃহত্ শক্তির খেলায় মারপ্যাঁচে ভরসা করতে পারেনি। তারা অবিরাম এবং আপসবিহীন আন্দোলন চালিয়ে গেছে। প্রচুর রক্তও তারা দিয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সরকারের দাঙ্গা পুলিশ এবং সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে ৮৮ ইউক্রেনীয় প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে তারা বিজয় অর্জন করেছে। প্রথমে প্রেসিডেন্ট ইউনোকোভিচের সমর্থক ১৫ পার্লামেন্ট সদস্য পদত্যাগ করেন। জনতা অনেকগুলো সরকারি ভবন দখল করে নেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য জার্মানি, ফ্রান্স আর পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যস্থতায় এবং রাশিয়ার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আন্দোলনের কয়েকজন নেতা প্রেসিডেন্ট ইউনোকোভিচের সঙ্গে চুক্তি করেন যে একটা সর্বদলীয় সরকার গঠন এবং চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হবে।

ইউক্রেনের জনতা সে সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি হয়নি। তারা নিশ্চয়ই ভয় করছিল যে ইউনোকোভিচকে অমন দীর্ঘ সময় দেওয়া হলে কি ষড়যন্ত্র করে তিনি পরিস্থিতির মোড় কোন দিকে ঘুরিয়ে নেবেন কে জানে? আন্দোলনের তীব্রতার মুখে হঠাত্ করে কিয়েভের রাজপথ থেকে পুলিশ ও সৈন্য উধাও হয়ে যায়। পার্লামেন্টের স্পিকার পদত্যাগ করেন। স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা, কয়েকজন মেয়র ও গভর্নর পালিয়ে রামিয়ায় চলে যান। প্রেসিডেন্ট উউনোকোভিচও রাশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বর্ডার গার্ড বাহিনী তার ব্যক্তিগত জেট বিমানকে উড়তে দেয়নি। তিনি এখন পলাতক আছেন। পাইকারি হত্যার দায়ে বিচারের জন্য তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে এবং নতুন অস্থায়ী সরকার দেশব্যাপী তার খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে। কিন্তু জনতা ময়দান ছেড়ে যেতে রাজি হচ্ছে না। বন্দি মুক্তি, হত্যাযজ্ঞের বিচার এবং সম্ভবত মে মাসে নির্বাচনসহ দাবিগুলো পূরণ হওয়া পর্যন্ত তারা প্রতিবাদ বিক্ষোভ চালিয়ে যেতেই চায়।

এদিকে দেশটির অবস্থা এখন গভীর উদ্বেগের বিষয়। প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। রাশিয়া ঋণদানের প্রস্তাব প্রত্যাহার করেছে। ইউক্রেন দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। তিন মাসের আন্দোলনে কয়েকশ’ মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। এসবের জন্যে দায়ী বৃহত্ শক্তিগুলোর ইতস্তত ভাব, আপাতবিরোধী নীতি এবং তাদের বিশ্বস্বার্থের সংঘাত।

ইউক্রেন বনাম বাংলাদেশ
বাংলাদেশে বিগত পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক বিরোধিতাকে পঙ্গু করে দেয়ার আশায় শত শত নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। খুনের আসামিকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য কারাগারে স্থান করেছে সরকার। তা সত্ত্বেও জেলখানাগুলো এখন টইটম্বুর, তিল ধারণের স্থান নেই সেখানে। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও বিচারবহির্ভূত হত্যা চরমে উঠেছে। ইউক্রেন থেকে বহুগুণ বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান গণতন্ত্রের আন্দোলনে। বিশ্বস্বার্থের বিবেচনায় বিদেশিরা গড়িমসি করেছে, গণতন্ত্রের পরিবর্তে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তিকে তোষণ করেছে।
তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচনের দ্বারা গণতন্ত্র সংহত করার আন্দোলন খালেদা জিয়া যখন শুরু করেন বাংলাদেশের মানুষ তাতে নজিরবিহীন সাড়া দিয়েছে। আন্দোলনের সে বেগ অব্যাহত থাকলে স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি অনেক আগেই পরাভূত হতো। হয়নি অনেকগুলো কারণে। কূটনীতিকরা সংযম আচরণ আর ধীরে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। বিএনপিতে কোনো কোনো মহল সত্যি সত্যি আশা করেছিলেন যে শেখ হাসিনার সরকার বিদেশি পরামর্শের কাছে নতি স্বীকার করবেন। অন্যেরা সে যুক্তিতে ধুয়া ধরেছেন শুধুই আন্দোলনকে সাবোটাজ করার উদ্দেশ্যে। সংযম আচরণ আর ধীরে চলার পরামর্শের পেছনেও বহুমুখী স্বার্থ কাজ করেছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই বিরোধী আন্দোলনে, বিশেষ করে বিএনপির ভেতরেও শত্রুপক্ষের বর্ণচোরা এজেন্টরা সক্রিয় ছিল। তাছাড়া বিএনপির নেতৃত্বে এমন সব মহল আছে, যারা শুধু পদ ও গদির লোভেই রাজনীতি করেছেন, বিনিময়ে ত্যাগ স্বীকারের কথা যারা ভাবতে পারেন না।

রয়ে-সয়ে জিরিয়ে জিরিয়ে আন্দোলনে বাংলাদেশের মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র তারা অবশ্যই চায়। তারা সংগ্রাম করতে রাজি আছে, কিন্তু সে সংগ্রামে তারা নেতাদেরও দেখতে চায়। আন্দোলন-বিপ্লব কীভাবে করতে হয়, দেখিয়ে দিয়েছে ইউক্রেনের জনতা। যুদ্ধের ময়দানে নেমে তারা বিরতি দেয়নি, লক্ষ্য অর্জিত হওয়া পর্যন্ত তারা রণাঙ্গনে অবস্থান নিয়েছে। আধিপত্যবদী রুশ দালালরা এখন গদি হারিয়েছেন, প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু সংগ্রামী জনতা এখনো কিয়েভের ইন্ডিপেনডেন্ট স্কোয়ার ছাড়তে রাজি নয়। নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং অন্যান্য লক্ষ্য অর্জিত হওয়া পর্যন্ত সেখানেই তারা থাকবে। বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন করছেন ইউক্রেনের মানুষের কাছ থেকে তাদের অনেক শিক্ষা নেয়ার আছে। সৌভাগ্যবশত খালেদা জিয়া দলীয় সংগঠন চাঙ্গা করার দিকে জরুরি মনোযোগ দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। তাকেও মনে রাখতে হবে, লক্ষ্য অর্জিত হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন এতটুকু শিথিল হতে দিলে তার পরিণতি মারাত্মক হয়। বাংলাদেশে যে ইউক্রেনের চেয়ে বহুগুণ বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছে, কিন্তু তাতেও সাফল্য আসেনি, এই হচ্ছে তার কারণ।

(পূর্ব প্রকাশিত আমার দেশ, ২৮/০২/২০১৪)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *