কোরানের আলোকে ইসলামের ইতিহাস (৪)

চলুন তাহলে ছোট বেলা থেকে ধর্মীয় কিচ্ছা কাহিনী যা আমরা সাধারন জ্ঞান হিসাবে জেনেছি , সেগুলো ভুলে গিয়ে কোরানের আয়াত এবং আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের আলোকে আমাদের অনুসন্ধান শুরু করি।

কোরানের মিছ্‌র ( م ص ر) এবং প্রাচীন মিশর কি সমার্থক?

কোরানে ৫ বার মিছ্‌র ( م ص ر) শব্দটির উল্লেখ আছে। প্রায় সকল মুসলমান বিশ্বাস করে যে মিছ্‌র ( م ص ر) দিয়ে নীল নদের দেশ প্রাচীন মিশরকেই বোঝানো হয়েছে। ফলে তাদের বদ্ধমূল ধারনা হয়েছে মূসা ও তার অনুসারী ইস্রাইলিরা প্রাচীন মিশরে তাদের শাসনকর্তা ফেরাউনের দ্বারা নিগৃহিত ও বিতাড়িত হয়েছে। এই সাধারন জ্ঞান কি প্রশ্নাতীত সকল বিতর্কের উর্ধে?

কোরানে সত্যি সত্যিই এক ফেরাউনের কথা বলা হয়েছে যে কিনা মিছ্‌র নামে এক জায়গার শাসনকর্তা ছিল। আমরা এটা অস্বীকার করছিনা।ফেরাউন নিজেই তার প্রজাদের কাছে ঘোষনা করছে-
{ফেরাউন তার সম্প্রদায়কে ডেকে বলল, হে আমার কওম, আমি কি মিসরের অধিপতি নই? এই নদী গুলো আমার নিম্নদেশে প্রবাহিত হয়, তোমরা কি দেখ না? ৪৩:৫১}

কোরানের এই মিছ্‌র কি আসলেই প্রাচীন মিশরকে বোঝাচ্ছে? এটাই আমাদের প্রশ্ন।

শুরু করা যাক মুহাম্মদের সময়ে কোরান যখন নাযিল হচ্ছিল , সে সময়ের ৬ষ্ঠ শতাব্দির আরবরা প্রাচীন মিশরকে কি নামে জানত সেটার উত্তর খোঁজার মাধ্যমে। দেখা যাক সেই সময়ের কোন ডকুমেন্ট পাওয়া যায় কিনা , যাতে আরবিতে প্রাচীন মিশরের নাম লেখা আছে।

ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী মুহাম্মদ প্রতিবেশি দেশগুলোর রাজা বা শাসনকর্তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন। এমনই একটি চিঠি , যার ফটো কপি নিচে দেয়া হলো , তিনি তৎকালীন রোমান অধীনস্ত নীল নদের দেশ মিশরের শাসককে লিখেছিলেন। এই শাসকের টাইটেল – আল-মুকাওওয়াস।

ঐ চিঠির বঙ্গানুবাদ- ” রহমানুর রহিম আল্লাহর নামে। আব্দুল্লাহ পুত্র মুহাম্মদ হইতে কিব্‌তের সর্বোচ্চ আল-মুকাওওয়াসের প্রতি। যারা নির্দেশনা অনুসরন করে তাদের উপরে শান্তি। আমি এতদ্বারা আপনাকে ইসলাম গ্রহনের আমনত্রন জানাচ্ছি , যাতে আপনি মুক্তি পেতে পারেন এবং আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুন পুরষ্কার দেবেন। যদি আপনি অস্বীকার করেন , কিব্‌তের সকল পাপের দায়িত্ব আপনাকে বহন করতে হবে…. “

এই চিঠিটি মুহাম্মদের নিজের হাতে লেখা বলে দাবী করা হয়। চিঠিটিকে প্রমান হিসাবে উপস্থাপন করা নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে , কারন মুহাম্মদ যে সত্যি সত্যিই এই চিঠি তৎকালীন নীল নদের দেশের শাসককে লিখেছিলেন তা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। সমালোচনাকারীদের জন্য আমাদের জবাব হলো তারা এই চিঠিকে প্রমান হিসাবে দেখানোর আসল উদ্দেশ্য বুঝতে ভুল করেছেন। কেন, সেটা বলছি- 

আমরাও একমত যে মুহাম্মদ সম্ভবত এচিঠি নিজে লেখেন নি , এটি একটি জাল চিঠি। সত্যি বলতে আমরা ৯৯% নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি মুহাম্মদ পরবর্তি সাম্রাজ্যবাদী ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফারা সম্রাজ্য দখলের ধর্মীয় আবরন দেয়ার লক্ষ্যে এই জাল চিঠি বানিয়েছিলেন। এখন চিন্তা করুন , আমি যদি মুহাম্মদ পরবর্তি আরবের বাসিন্দা হতাম এবং মুহাম্মদের নামে নীল নদের দেশের শাসনকর্তার কাছে একটি চিঠি লিখতাম , তাহলে সেই সময়ের মানুষ যে নামে এই দেশকে জানত সেই নামই এই চিঠিতে উল্লেখ করতাম। নয় কী? নিশ্চয় এমন কোন নামের উল্লেখ করতাম না , যা তখনকার মানুষ জানত না। চিঠিটির লেখার স্ক্রিপ্টের সাথে সবচেয়ে প্রাচীন কোরানের স্ক্রিপ্টের মিল আছে। অর্থাৎ মোটামুটি বলা যায় মুহাম্মদ পরবর্তি ২০০ বছরের মধ্যেই এই জাল চিঠি বানানো হয়েছে। এত কিছু বলার উদ্দেশ্য এটাই যে মুহাম্মদ পরবর্তি ২০০ বছর পর্যন্ত আরবের লোকেরা নীল নদের দেশকে কীব্‌ত নামেই জানত , মিশর নয়।

এই চিঠি থেকে এটা পরিস্কার যে মুহাম্মদ তৎকালীন নীল নদের দেশের রোমান শাসককে সম্বোধন করেছেন “আজীমুল কিব্‌ত”(কিব্‌তের মহান অধিপতি) নামে। কিব্‌ত নামেই মুহাম্মদের সমসাময়িক আরবের লোকেরা লাল সমুদ্রের (red sea) অপর পারের নীল নদের দেশকে জানত এবং এই দেশের লোকদেরকে বলত “আকবাত”। চিঠির কোথাও কি “মিস্‌র/মিশর” বা “মিসরিউন” (মিশরের অধিবাসী) লেখা আছে? না , নেই।

সত্য হলো মুহাম্মদের নামে অন্যান্য রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে লেখা আরো যে সব জাল চিঠি বানানো হয়েছে , সেগুলোতেও একি ডিপ্লোম্যটিক রীতি মানা হয়েছে। যেমন- রোমের বাইজ্যন্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসকে সম্বোধন করা হয়েছে ” হিরাক্‌ল , আজীমুল রুম”। পার্সিয়ান রাজা খসরুকে ” কিসরা , মালিকুল ফার্স” , ইথিওপিয়ার শাসনকর্তা নেগাসকে ” আল-নাজাসি , আজীমুল হাবাসা”। এর থেকে বোঝা যায় তখনকার আরবরা যেমন রুম নামে ইটালিকে , ফার্স নামে ইরানকে , হাবাসা নামে ইথিওপিয়াকে জানত , তেমনই কিব্‌ত নামে বর্তমানের মিশরকে জানত এবং একই যুক্তিতে কিব্‌তের মানুষকে আকবাত বলত এটা বলাই যায়।

মুহাম্মদের সময় আরবের মানুষ নীল নদের দেশকে যে কিব্‌ত নামে জানত , তা আমরা আরো জানতে পারি মারিয়া আল-কিবতিয়া এই নামের মাধ্যমে। ইসলামি গল্প অনুযায়ী মুহাম্মদকে নীল নদের দেশ থেকে মারিয়া নামের একটি দাসী উপঢৌকন হিসাবে পাঠানো হয়েছিল , যাকে পরে মুহাম্মদ বিয়ে করেছিলেন। মারিয়ার দেশের নাম অনুসারে তার টাইটেল বা নামকরন করা হয় আল-কিবতিয়া।

তাহলে কোরানে বর্নীত মিস্‌র/ মিশর দেশ বা জায়গাটি কোথায় এবং এই নামটিই বা কোথা থেকে আসলো ? এর উত্তর খুঁজে বের করা আমাদের প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর একটি।

এখন পর্যন্ত আমরা দেখলাম মুহাম্মদের সময় আরবের লোকেরা নীল নদের দেশকে কিব্‌ত নামে জানত। তাহলে কবে থেকে আরবের লোকেরা এবং সেই সাথে বিশ্বের মুসলমানরা নীল নদের দেশকে কিব্‌তের বদলে মিস্‌র/মিশর নামে মেনে নিল? কোরানে মিস্‌র নামটি এসেছে মুসা ও ফেরাউনের আবাসভূমির নাম হিসাবে। স্বভাবতই মিস্‌র কোথায় , এর জবাব ইহুদিদের কাছ থেকে জানা সম্ভব এবং মুসলমানরা সেই কাজটিই করেছে। ফলস্বরুপ ইহুদিরা খৃঃপূঃ ৩০০ সালে কিব্‌তকে মিশর বলে চালিয়ে দেয়ার জালিয়াতি সফলভাবে মুসলমানদের মন মানসে ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। কোরানের মিস্‌র কোথায় সেটা জানতে হলে আমাদের জানতে হবে আনুমানিক ৩০০০বছর পূর্বে মুসার সময় নীল নদের দেশকে সেদেশের মানুষ কি নামে জানত এবং ঐ সময়ে সেই দেশের শাসকের নাম বা টাইটেল ফেরাউন ছিল কিনা?

( বিঃদ্রঃ- একজন প্রশ্ন করেছেন ফেরাউন বা মিস্‌র কোথায় এটা জেনে লাভ কী? 

এটা জানার মাধ্যমে আমরা জানতে পারব কিভাবে ইসলামের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে , কিভাবে আমরা কোরান থেকে দুরে সরে গিয়েছি। যে জেরুসালেম নিয়ে আমরা আজ জীবণ দিচ্ছি , সেই জেরুসালেমে বা বর্তমানের মিশরে মুসা বা ইব্রাহিম কখনো পদার্পন করেনি। যে মক্কা মুসলমানদের পবিত্র ভূমি , যেখানে মসজিদুল হারাম অবস্থীত , কোরানের আয়াত বিশ্লেষন করলে মনে হয় সেই মক্কায় মুহাম্মদ জন্মানো দুরে থাক কখনো পা ও ফেলেনি। যদিও পরকালে মুক্তির জন্য এগুলো জানা আবশ্যক নয় , তবে নিজের কৌতুহল মেটাতে এবং কোরান যে সত্য সে বিশ্বাস দৃঢ় করতে এই জ্ঞান সাহায্য করবে।)

Comments are closed.