কোরানের আলোকে ইসলামের ইতিহাস (৩)

বিশ্ব সচেতনতা থেকে লুকিয়ে রাখা সত্যের সন্ধানে

সুদুর অতীতে সংঘটিত যে জালিয়াতির ফলে আজো প্যালেস্টাইনে রক্ত ঝরছে , সেই জালিয়াতির স্বরুপ উদ্ঘাটনের দীর্ঘ যাত্রা শুরু করব ছোট একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মাধ্যমে।

মূসার জীবদ্দশায় ফিরাউন (Pharaoh) কে ছিল?

প্রাচীন ইহুদি প্রিষ্টরা যে সকল ইতিহাস বিকৃতি ইহুদিদের সাথে সাথে মুসলমান সহ সারা বিশ্বের মানুষের চেতনায় সফলভাবে ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে , তার অন্যতম মূসার ফিরাউনের পরিচয় (Identity) পরিবর্তন। কোরানে নির্দিষ্টভাবে নৃশংশ , নিজেকে ইলাহ দাবীদার এই ফিরাউনের বর্ণনা আছে।

ঠিক কিভাবে প্রিষ্টরা আরামিক থেকে গ্রীকে বাইবেলের অনুবাদের সময় নিজের হাতে এই জালিয়াতি করেছিল এবং এই জালিয়াতির মাধ্যমে কিভাবে বর্তমানের প্যলেস্টাইন ও জেরুসালেমের উপরে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল আমরা এখন সেটাই বিশ্লেষন করব। প্রিষ্টরা যে নিজ হাতে আল্লাহর বাণীর পরিবর্তন করে , সে ব্যপারে কোরানেও বলা আছে। {অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে ২: ৭৯}

আমরা শুরু করব ফিরাউনের দুটি ছবি দিয়ে। নিচের ছবি দুটি দেখুন-
আপনার মনের কল্পনায় ফিরাউনের যে ছবি আঁকা আছে ,তার সাথে ৩নং নাকি ৪নং ছবির বেশি মিল খুজে পান?

মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় অধিকাংশ পাঠক ৩নং ছবিটির দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করবে। খুব কম সংখ্যক পাঠক ৪নং ছবিটিকে বিবেচনায় নেবে , কারন এ ছবিটিকে দেখে ফিরাউনের পরিবর্তে আবু সুফিয়ান বা আবু লাহাবের ছবিই তাদের মনে ভেসে উঠবে।

কিন্তু পৃথিবীতে হাতে গোঁনা কিছু ঐতিহাসিক , প্রত্নতাত্বিক , 
ভুগোলবিদ আছেন , যারা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন ৩নং ছবির ফিরাউনের সাথে মুসা বা ইস্রাইলিদের কোন সম্পর্ক নেই। বিশ্ব জনমতের বিরুদ্ধে যেয়ে সত্যকে তুলে ধরা সহজ কাজ নয়। এবং সেটার সাথে যদি ধর্ম জড়িত থাকে তাহলে গ্যলিলিওর মতো কারাবাস ঘটতে পারে বা জীবন ও যেতে পারে। 

এমনি কিছু চিন্তাবিদ গবেষক ও প্রফেসর , যারা সাহস করে ফিরাউনের সত্যিকার পরিচয় তাদের কর্মের মাধ্যমে উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন , তারা হলেন – কামাল সালিবি , আইমান ফদা , আহমদ দাউদ , ইবনে কারনাস , বার্নার্ড লিমান , ফারাজাল্লাহ সালেহ দীব এবং অন্যান্যরা। কিন্তু তাদের কাজ বা লেখা বিশ্ব মিডিয়ায় উপেক্ষিত হওয়ার ফলে কম মানুষের নজরে এসেছে। এর কারন ও অজানা নয়। বিশ্ব মিডিয়া কে নিয়ন্ত্রন করে জানেন নিশ্চয়। ইহুদিরা।

মূসার জীবদ্দশায় ফিরাউন (Pharaoh) কে ছিল?

এখন আপনি ও যদি ৩নং ছবিটিকে বেছে নিয়ে থাকেন ,  তবে আপ্নার কাছে প্রশ্ন : প্রাচীন মিশরের শাসনকর্তাই যে কোরানে বর্ণীত ফিরাউন সেটা কিভাবে নিশ্চিত হলেন? কোন প্রমান আছে? 

এই প্রশ্নটিই একটি আরব দেশের যদৃচ্ছভাবে বাছাই করা ১০০জন মুসলমানকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। ৬০% লোকের জবাব , “এটা তো সাধারন জ্ঞান” বা “বাপ দাদারা এমনটাই বলেছে”। 
২৫% লোক কোরানের বিভিন্ন তাফসীর বই বা ধর্মীয় স্কলারদের কাছ থেকে জেনেছে। বাকি ১৫% ইতিহাসের বই বা মিডিয়া (সিনেমা, ডকুমেন্টারি ইত্যাদি) থেকে জেনেছে।

এখন আমরা সংক্ষেপে জ্ঞানের উৎস নিয়ে আলোচনা করব-

১)সাধারন জ্ঞান

বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠির মাঝে বিদ্যমান এই সাধারন জ্ঞান কি সব সময় সত্যি? যেমন ধরুন প্রাচীন বিশ্বের মানুষ বিশ্বাস করত আমাদের এই পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র এবং এর চারপাশে চাঁদ সূর্য তারা সবকিছু ঘুরছে। এটাই ছিল তখনকার সাধারন জ্ঞান। এমনকি সক্রেটিস এরিস্টোটলের মতো দার্শনিক বিজ্ঞানি ও এমনটাই বিশ্বাস করতেন। আজ আমরা জানি এই সাধারন জ্ঞান ভুল ছিল।

জাতি ধর্ম নির্বিশেষে প্রার্থনা বা উপাসনার সময় মানুষের তৈরি মূর্তি  বা সৌধকে , যেমন বৌদ্ধ মূর্তি ,শীব মূর্তি , পশ্চিম দেয়াল , পীর পয়গম্বরদের মাজার বা কাবাকে কিবলা বানিয়ে থাকে। কারন তাদের সাধারন জ্ঞান বলে , এমনটাই নিয়ম বা এমনটা না করলে প্রার্থনা বা উপাসনা গৃহিত হবে না। এই সাধারন জ্ঞান কি সত্য?

১০০ কোটি ক্যাথোলিক বিশ্বাস করে ২০০০ বছর পূর্বে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল আজকের জেরুসালেমে বা মুসলমানরা বিশ্বাস করে কোরানে বর্ণীত মসজিদুল আকসা এই জেরুসালেমে অবস্থীত । সত্যিই কি তাই , নাকি এটা সকলের বিভ্রম? বা রাজনৈতিক কৌশল!! সমবেত বিভ্রম সম্পর্কে কোরানে সাবধান করা হয়েছে -{বস্তুতঃ তাদের অধিকাংশই শুধু আন্দাজ-অনুমানের উপর চলে, অথচ আন্দাজ-অনুমান সত্যের বেলায় কোন কাজেই আসে না। আল্লাহ ভাল করেই জানেন, তারা যা কিছু করে ১০:৩৬}

বুদ্ধিমান মুসলমানের উচিৎ জ্ঞান বিজ্ঞানের মাধ্যমে যাঁচাই না করে কোন সাধারন জ্ঞানকে , যা তারা বাপ দাদা ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে গত ১৪০০ বছর উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়ে আসছে , তাকে সত্য হিসাবে মেনে নেয়া।

{যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং রসূলের দিকে এস, তখন তারা বলে, আমাদের জন্যে তাই যথেষ্ট, যার উপর আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে পেয়েছি। যদি তাদের বাপ দাদারা কোন জ্ঞান না রাখে এবং হেদায়েত প্রাপ্ত না হয় তবুও কি তারা তাই করবে ৫:১০৪} 

{তারা বললঃ আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে এদের পুজা করতে দেখেছি ২১:৫৩} 

{তারা আরও বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের কথা মেনেছিলাম, অতঃপর তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল ৩৩:৬৭}

এই আয়াত গুলো কি বর্তমানের মুসলিম সমাজের সঠিক প্রতিফলন নয়? ১৪০০ বছর আগেই আমাদের সাবধান করা হয়েছে।

২ )কোরানের তফসির

মুসলমানদের সামগ্রিক জ্ঞানের একটি অন্যতম উৎস হলো বিভিন্ন তফসির গ্রন্থ। মনে রাখতে হবে এই সব গ্রন্থের লেখকগণ(ইবনে কাথির, জালালাইন এবং আরো অনেকে) যত বড় ইমামই হন না কেন , তারা আমাদের মতোই মানুষ ছিলেন এবং তাদের কেউই নবীর সমসাময়িক ছিলেন না বা কোন সাহাবি বা সাহাবিদের শিষ্যদের সাথে ও তাদের সাক্ষাৎ হয়নি বা তাদের কাছে আল্লাহর ওহি ও আসত না। তারা তাদের চিন্তা ভাবনা থেকেই এই সব গ্রন্থ লিখেছেন। সুতরাং এই সকল তাফসির গ্রন্থকে কোরানের সাথে এক কাতারে ফেলা যাবে না। 

কোরান নিয়ে চিন্তা ভাবনা অতীতের ইমামরা করে গেছে বলে আমাদের আর চিন্তা ভাবনা করা লাগবে না তা কিন্তু নয়। আমাদের জেনারেশনকে ও চিন্তা ভাবনা করা লাগবে। এমনটাই কোরানের নির্দেশ। 

{তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ? ৪৭:২৪} 

{অতএব তারা কি এই কালাম সম্পêেক চিন্তা-ভাবনা করে না? না তাদের কাছে এমন কিছু এসেছে, যা তাদের পিতৃপুরুষদের কাছে আসেনি? ২৩:৬৮}

বরঞ্চ এখন যারা কোরান নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে তাদের পক্ষে ইবনে কাথির ও জালালাইনদের থেকে ও সঠিক তাফসির গ্রন্থ লেখা সম্ভব বলে বিশ্বাস করি। কারন তাদের আমলে আমাদের মতো অবাধ তথ্য প্রবাহ ছিল না , ঘরে বসে মাউসের বোতাম টিপেই যে কোন বই পড়ার সুযোগ ছিল না বা অন্যান্যদের সাথে লেখার ত্রুটি নিয়ে পর্যালোচনার (peer review) জন্য মিডিয়া ও ছিল না।

কোরানে বহু আয়াত আছে , যেখানে মুহাম্মদ ও তার অনুসারীদের পৃথিবী ঘুরে অতীতের জাতিদের পরিনতি দেখতে বলা হয়েছে । {তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে। ৩:১৩৭}

অতীতে আজকের মতো এত সহজে ঘোরাঘুরি সম্ভব ছিল না বা প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা ও আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতি আজকের মতো এত উন্নত ছিল না। ফলে আমাদের পূর্বপুরুষরা ইহুদি রাব্বিদের বলা ইতিহাস বিনা তর্কে ও বিচারে মেনে নিয়েছে এবং তা বংশপরম্পরায় আমদের সাধারন জ্ঞানে পরিনত হয়েছে। সময় এসেছে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে আমাদের হুজুররা নবি রসূলদের নিয়ে যে সব কিচ্ছা কাহিনী বলেন তা আধুনিক জ্ঞানের মাধ্যমে যাঁচাই করা।

চলবে••••

Comments are closed.