কোরানের আলোকে ইসলামের ইতিহাস (২)

পবিত্র জালিয়াতি 

“এবং এমন এক সময় আসবে যখন আমাদের ছেলে মেয়েরা (আমেরিকান রেডইন্ডিয়ান) উপলব্ধি করবে যে তারা বনী ইস্রাইলের বংশধর, এবং তারা আল্লাহর সন্তান (children of God); তখন তারা জানবে তাদের পূর্বপুরুষরা তাদের জন্য কি সম্পদ রেখে গেছে , এবং এতে তারা আনন্দিত হবে।”
(The book of Mormon- 14:15)

প্রিয় পাঠক এখন দেখব কিভাবে আল্লাহর নামে বর্তমানেও সক্রিয় ভয়ানক পবিত্র জালিয়াতি (holy fogery) সংঘটিত হয়েছিল এবং হচ্ছে , যাতে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে মুহাম্মদ পরবর্তি মুসলমানদের চেতনায় সফলভাবে বিভিন্ন পবিত্র জালিয়াতি ঢুকানো হয়েছে। যে উদাহরন এখানে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা সম্ভবত একটি জোক বা মিথ্যা কৌতুক হিসাবে শুরু হয়েছিল , কয়েক শতাব্দি ধরে এই মিথ্যা পুনঃ পুনঃ পুনরাবৃত্তির পরে এটি একটি জীবন্ত ধর্মে পরিনত হয়েছে এবং যার ফল আমরা আজ ভোগ করছি।

১৮৩০ সালে জোসেফ স্মিথ নামে এক আমেরিকান একটি “পবিত্র/holy” বই প্রকাশ করে , যার নাম The book of Mormon। তার দাবী মতে খৃষ্ট পূর্ব ৪র্থ শতকের একটি সোনার ট্যবলেটে লেখা প্রাচীন ঐশী লিপির অনুবাদ এই বই। এই ট্যবলেটটি এতকাল নিঊইয়র্ক শহরের উপকন্ঠে তার বাড়ির কাছে মাটির নিচে রক্ষিত ছিল। ১৮২৩ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর ‘মরমন’ নামে এক ফেরেশতা দেখিয়ে না দিলে তার পক্ষে এই ট্যবলেট খুজে পাওয়া সম্ভব হতো না। এই ফেরেশতাই তাকে সাহায্য করেছে প্রাচীন লিপির অর্থোদ্ধারে।

এই বইয়ে লেখা অনেক ঐশী সত্য ঘটনার একটি হলো- খৃষ্ট পূর্ব ৬ষ্ঠ ও ৪র্থ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইহুদীদের দুইটি দল , একটি জেরুসালেম থেকে এবং অন্যটি ব্যাবিলন থেকে মাইগ্রেট করে নুতন পৃথিবীতে এসে বসতি স্থাপন করে। এই নুতন পৃথিবীই হলো আজকের উত্তর আমেরিকা। কালে কালে ব্যবিলনিয় ইহুদীরা হারিয়ে যায় বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় , আর জেরুসালেমের ইহুদীরা বংশবিস্তার করে সমগ্র আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে ,যারা রেড ইন্ডিয়ান নামে পরিচিত। এদের চারনভূমির এক ঐশী নাম ও দেয়া হয়েছে- জীয়নদের ভূমি / The Land of Zion.

মরমন ঐশী গ্রন্থের লেখক জোসেফ স্মিথ।

সোনালি ট্যাবলেটটি কেঊ কখনো দেখেনি , কারন স্মিথের অনুবাদ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নাকি মরমন ফেরেশতা সেটি নিয়ে গেছে। এই বই প্রকাশের পর স্মিথ একটি নুতন চার্চ প্রতিষ্ঠা করে , যার নাম দেয় “The church of Jesus Christ of later day saints”

যদি ভেবে থাকেন এখানেই গল্পের শেষ , তাহলে ভুল ভাবছেন। ১৮৪২ সালে স্মিথ আগেরটার থেকেও অদ্ভুত ‘ইব্রাহিমের বই / The Book Of Abraham’ নামে আরো একটি বই লেখে। স্মিথ দাবী করে যে ওহিওর কার্টল্যন্ডে মিশরীয় মমির প্রদর্শনির সময় একটি কফিনের ভিতরে সে কিছু প্যাপিরাসের পান্ডুলিপি পায় এবং এর গুরুত্ব বুঝতে পেরে সে ওগুলো কিনে নেয়। আবারো সেই মরমন ফেরেশতার সাহায্যে এর পাঠোদ্ধার করে জানতে পারে এগুলো হিয়েরগ্লাফি বর্ণে ইব্রাহিমের নিজের হাতে লেখা পান্ডুলিপি। এ বইতে সে কয়েক্টি হাতে আঁকা ছবি ছাপে , যেগুলো পান্ডুলিপির অরিজিনাল ছবির নকল। এমনি একটি ছবিতে দেখা যায় রাজার সামনে একট পাথরের বেদিতে ইব্রাহিমকে শোয়ানো আছে যেন এখনি প্রাচীন দেবতাদের উদ্দেশ্যে তাকে বলী দেয়া হবে।

বাস্তবতা হলো স্মিথের সাথে তর্ক বিতর্ক করা সম্ভব ছিল না , কারন সেই সময়ে হিয়েরোগ্লাফ জানা লোকের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন থেকে থাকলেও তাদের খুজে বের করে স্মিথের কাছে তর্ক করার জন্য আনা সম্ভব ছিলনা। তখন প্লেনও ছিলনা বা আজকের মতো মিডিয়া ও ছিল না! ফলে স্মিথ মনের মাধুরি মিশিয়ে যা ইচ্ছা তাই লিখেছে এবং তার অনুসারীরা আজকের মুসলমানদের মতোই যুক্তি বুদ্ধিকে হিমঘরে পাঠিয়ে তা নত মস্তকে মেনে নিয়েছে। ইব্রাহিম নবির কথা , প্রকারান্তরে আল্লাহর বাণী বলে কথা! তর্ক করে কে দোযখে যাবে!!

ভাবা গিয়েছিল মূল প্যাপিরাসের পান্ডুলিপি ১৮৭১ সালে বিখ্যাত চিকাগোর আগুনে ভষ্মীভূত হয়েছে , রয়ে গেছে শুধু “The book of Mormon ও The book of Abraham” এর পর যতই দিন যেতে থাকে ততই এই শেষ গ্রন্থদ্বয়ের প্রতি বিশ্বাসী লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং তারা বিশ্বাস করে এগুলো ঐশী গ্রন্থ। পদ্ধতি খুবই সোজা , কোন প্রমানের দরকার নেই। শুধু দাবী কর – রসূল এমনটা বলেছেন , আল্লাহ এমনটা বলেছেন।

এরপরে প্রায় ১০০ বছর বিনা বাধায় এই নুতন চার্চের তত্বাবধানে মরমন ধর্মের প্রচার ও প্রসার চলতে থাকে। ১৯৬৬ সালে চমকানোর মতো দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথম চমকটি হলো- নিউইয়র্ক মেট্রপলিটান আর্ট মিউজিয়মের ভল্টে কাকতালীয়ভাবে প্রাচীন কিছু প্যাপিরাসের পান্ডুলিপি পাওয়া যায় , যাতে স্মিথের ২য় বইয়ে আঁকা মূল ছবিগুলো ছিল । ফলে ধারনা করা হয় এগুলোই সেই পান্ডুলিপি যা অনুবাদ করে স্মিথ তার ২য় বই লিখেছিল। আর দ্বিতীয় চমকটি হলো- এতদিনে প্রত্নতত্ব ও প্রাচীন ভাষা নিয়ে বিজ্ঞান এতটাই উন্নতি করেছে যে প্রায় নিখুঁতভাবে মিশরীয় হিয়েরোগ্লাফির অনুবাদ সম্ভব।

যেমনটি ভাবা গিয়েছিল , এই প্রাচীন পান্ডুলিপি আবিষ্কারের সাথে সাথেই বিজ্ঞানীরা ঝাপিয়ে পড়ল এর পাঠোদ্ধারে। এর পাঠোদ্ধারে পরে সকলের কাছে স্মিথের মিথ্যা , ফাঁকিবাজি ও জালিয়াতি ধরা পড়ে গেল। তাতে কী? স্মিথ তো ইব্রাহিমের বইয়ে নিজের হাতে বানিয়ে লেখাগুলোকে আল্লাহর বাণী বলে প্রচার করেছে। প্রিয় পাঠক এই প্যটার্ন কি পরিচিত মনে হচ্ছে?

মূল পান্ডুলিপিতে প্রাচীন মিশরের মৃতদের সৎকারের নিয়ম ও পদ্ধতি লেখা ছিল এবং তাদের সমাজের কৃষ্টির সাথে জড়িত নামের (হোরাস , সেট , ওসিরিস ইত্যাদি) উল্লেখ ছিল। পক্ষান্তরে স্মিথ তার বই The Book of Abraham য়ে যে নামগুলো উল্লেখ করেছে যেমন ইব্রাহিম , ফেরাউন , ফেরেশতা তার কোন কিছুই মূল পান্ডুলিপিতে খুজে পাওয়া যায় নি। এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পরে কাগজে মিডিয়ায় স্মিথের জালিয়াতি নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত দিয়ে দেখানো হয়েছে রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে প্রাচীন ইস্রাইলিদের কোন যোগসুত্র নেই। কোন লাভ হয়েছে কী? না। আজ পৃথিবীতে মরমনদের সংখ্যা প্রায় ১৩ মিলিয়ন , যার ৪০% এর বাস আমেরিকায়। ২০৮০ সাল নাগাদ এদের সংখ্যা ১০০ মিলিয়নে পৌছাবে বলে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছে।

ভূমিকায় মরমনদের এই গল্প বলার উদ্দেশ্য কী?

এই গল্পের মাধ্যমে আমরা এটাই দেখলাম কত সহজে ধর্মের নামে , আল্লাহ ও রসূলের নামে একটি মিথ্যাকে বাজারজাত করে মানুষের বিশ্বাসের গভিরে প্রবেশ করানো হয়। প্রতিটি মিথ্যার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও থাকে। স্মিথ রেডইন্ডিয়ানদের ভালবাসত বলেই তাদেরকে ইস্রাইলিদের বংশধর ও তাদের বাসভূমিকে জীয়নদের ভূমি বলে প্রচার করেনি , বরং উত্তর আমেরিকার উপরে ইস্রাইলি জায়োনিস্টদের অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল তার উদ্দেশ্য। ইহুদিদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন বলতে পারে তারা অনাদি কাল থেকে আমেরিকার আদিবাসী। আজ আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রন করে কারা? ইহুদিরা।

ঠিক একিভাবে আজ থেকে ২৩০০বছর পূর্বে সম্রাট আলেক্সান্ডারের সময় সেপ্টুজিন প্রিষ্টরা ওল্ড টেস্টামেন্টকে আরামিক থেকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদের সময় ছোট খাট কিছু জালিয়াতির মাধ্যমে আজকের জেরুসালেমের উপরে ইহুদিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এই বলে যে এই প্যলেস্টাইন নাকি তাদের আল্লাহ কর্তৃক প্রতিশ্রুত ভূমি। 

এই মিথ্যা শতাব্দির পর শতাব্দি প্রচার হওয়ার ফলে আজ সকলেই ,এমনকি মুসলমানেরা ও এই মিথ্যাকে সত্য বলে জানে। মুসলমানদের চেতনায় শুধু যে এই মিথ্যা ঢুকেছে তা কিন্তু নয়। বাইবেলের প্রভাবে ইহুদি খৃষ্টান্দের অনেক ধর্মীয় রীতি নীতি শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে বোগাস হাদিসের মাধ্যমে মুসলমানদের রীতি নীতির সাথে মিশে গেছে এবং উত্তরাধিকার সুত্রে আমরা তা পালন করে চলেছি।

এই বইতে কোরান ও বাইবেলের আয়াতের বিশ্লেশন , প্রাচীন আরবের ইতিহাস ও কাব্য গাথা থেকে উদাহরন এবং প্রত্নতাত্বিক গবেষনা ও নিদর্শনের মাধ্যমে ইহুদিদের এই মিথ্যাকে উম্মোচনের চেষ্টা করা হয়েছে।

Comments are closed.