কমিউনিজম, মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ: একটি মন্তব্য-ব্লগ

-এক-

শিরোনামের শব্দগুলোর সাথে দার্শনিক ঐতিহাসিকতা, বিশেষ করে, দ্বান্দ্বিকবাদের (dialectic) সম্পর্ক রয়েছে।  বিষয়টি এভাবে: ক্লাসিক্যাল দর্শনে আলোচ্য বিষয়ে পাক্ষিক-বিপাক্ষিক দুটি স্থান নির্ণয় করা হত। তারপর বিতর্ক ও আলোচনার পরে উল্লেখিত দুই স্থানের মধ্যবর্তী আরেকটি নতুন স্থান পাওয়া যেত। এই তৃতীয় স্থানটিকে পূর্বের দুই স্থানের synthesis (সম্বাদ) বলা হত। আলোচনার শুরুতে যে উপপাদ্য থাকত, বা যা নিয়ে আলোচনা শুরু হত, সেটিকে বলা হত thesis (‘বাদ’) এর মোকাবেলায় দ্বিতীয় যে স্থানটি আসত সেটিকে বলা হত anti-thesis (প্রতিবাদ)।

কিন্তু এ-ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উপলব্ধি করা হয়। যে স্থানটি মীমাংসিত হয়ে এল, বা যে নতুন ধারণায় (synthesis -এ) এখন উপনীত হওয়া গেল, তাও কিন্তু শেষ কথা হয়ে থাকবে না। আগামীতে এই synthesis এর ভিতরে আরেকটি anti-thesis এর জন্ম হবে, আর এভাবে চিন্তার উৎকর্ষ বা বিকাশ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এই ধরণের ‘চিন্তা-ব্যবস্থা’র নাম হচ্ছে dialectic।

-দুই-

দার্শনিক হেগেল এই চিন্তা-ব্যবস্থাকে (thesis, anti-thesis, synthesis) সামাজিক সংঘর্ষের সাথে প্রথমে প্রয়োগ করেন। তিনি বলেন যে একটি সমাজ ব্যবস্থাও এই dialectic প্রোসেসে তার সামাজিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধ মীমাংসা করে করেই ‘প্রগতির’ পথে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ একটি সমাজের পরের অবস্থান তার পূর্ববর্তি সামাজিক অবস্থান থেকে অধিক উন্নত। এটা আগের তুলনায় নতুন থিসিস।

এই ধারণা কিন্তু হেগেলেরও নয়। আমরা এটি সমাজ বিজ্ঞানের পিতা ইবন খালদুনের মধ্যে পাই। হেগেলের ধারণায় সামাজিক ব্যবস্থার দ্বান্দ্বিকতা ও মীমাংসা চলতে চলতে কোনো এক অনাগত কালে উপনীত হবে যখন সমাজের মধ্যে আর কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না, সবার মধ্যে সমতা আসবে। তার দৃষ্টিতে পরম সত্তা (Absolute Spirit) এই দ্বান্দ্বিকতার ভিতরেই তার উৎকর্ষের কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। এক সময় তিনি সংঘাত নিরসন করে ফেলবেন। হেগেলের ধারণায়ও কমিউনিজম ছিল। তার মতেও এই দ্বন্দ্ববিহীন সমাজ হবে একটি কমিউন (commune) যেখানে স্থাবর অস্থাবর বস্তুর মালিকানা-দ্বন্দ্ব থাকবে না। এই সামাজিক বাস্তবতাই কমিউনিজম।

-তিন-

কার্ল মার্ক্স হেগেলের ধারণাকে অতীন্দ্রিয় বা খোদায়ী সম্পর্ক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে সামাজিক দ্বান্দ্বিকতাকে ‘বস্তু-ভিত্তিক’ দ্বান্দ্বিকতায় ব্যাখ্যা করেন। তার এই ব্যাখ্যাকে dialectic materialism (বস্তুতান্ত্রিক দ্বন্দ্ববাদ) বলা হয়। মার্ক্সের ধারণায় সামাজিক সংঘাত/দ্বন্দ্ব হচ্ছে মূলত শ্রেণী সংঘাত –মালিক ও শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ-সংঘাত। এই দুই পক্ষের মধ্যে সব সময় বিরোধ থাকবে এবং এই সংঘাত আবার প্রকৃতিজাত (natural)। এখানে কোনো ঐশী সত্তার হাত নেই। মানুষ সংঘাতময় প্রগতির মাধ্যমে ঐশীক ধারণার পর্যায় (phases of suparnatural beliefs) অনেক আগে অতিক্রম করে (চিন্তার ‘বিবর্তনের’ ভিত্তিতে) এখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল যুগে পদার্পণ করেছে। এভাবে শ্রেণী-সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজ উন্নত-স্তর থেকে আরও উন্নত-স্তরে পৌঁছে একসময় এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় উপনীত হবে যেখানে ব্যক্তি-মালিকানা থাকবে না। প্রকৃতির উপকরণ (natural resources) সকলের হবে। এই যে ‘কমিউন’, বা সামাজিক ব্যবস্থা আসবে, সেটিই হবে সাম্যের সমাজ, প্রকৃত কমিউন। ল্যাটিন ‘কমিউন’ অর্থ সার্বিক স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত ‘সকলের মিলনে গঠিত একটি দেওয়াল’ আরবিতে যে কথাটি আমরা বুনিয়ান অর্থে বুঝি। মধ্যযুগে বিভিন্ন আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকতে বিভিন্ন শহরে এবং লোকালয়ে এমন কমিউন গঠন করা হত। এই ধারণা ঐতিহাসিকতা বেয়ে এখানে এসেছে।

কমিউনিজম এক বৃহত্তর সামাজিক ধারণা। সমাজতন্ত্র, কখনও একই অর্থে, কিন্তু বেশির ভাগই অর্থনৈতিক ধাঁচ, পলিসি বা ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ হয় যা ধনতন্ত্রের ভিতরে থেকেও প্রতিষ্ঠিত করার ধারণা করা হয়। সমাজতান্ত্রিক দলগুলো তাই বর্তমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না করে ‘অর্থ-ব্যবস্থার’ কিছু পরিবর্তের রূপ দিয়ে সমাজ ব্যবস্থা সাজাতে চান। এই ধারণা নানান মুনির কাছে নানানভাবে হয়ে থাকে। এই পার্থক্য মামুলি অর্থে বললাম।

-চার-

আবার মার্ক্সের ধারণায় ফিরি। মার্ক্সের কমিউনিস্ট ধারণা ছিল নিছক একটি দার্শনিক মতবাদ। এই কমিউনিজমে উপনীত হওয়ার কথা ছিল ঐতিহাসিক ধারায়, (সামাজিক বিবর্তনের মাধ্যমে) অর্থাৎ তা আপনা-আপনি এসে হাজির হবে, কেননা এটা ‘প্রগতির’ ধারাবাহিকতার অংশ (part of the social dialelctic process)।

-পাঁচ-(ক) লেনিন, স্টালিন

মার্ক্সের ধারণা ছিল যে কমিউনিজম জার্মানী, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এমন ধরণের দেশেই হবে কেননা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইভল্যুশন এখানেই হচ্ছিল। সেদিন কমিউনিজম মধ্যযুগে পড়ে থাকা একটি দেশ -রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হবে এমন ধারণা পাগল-কমিউনিস্টদেরও ছিল না। কিন্তু তা “হওয়ানো” হয়েছে। (এটা প্রথম মহাযুদ্ধে রাশিয়াকে কন্ট্রোল করতে জায়োনিষ্টদের পায়তারায় লেনিন ও স্টালিনের আন্দোলনকে সরাসরি সাহায্য দানে করা হয়।) নোয়াম চমস্কির দৃষ্টিতে লেনিনবাদ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে ছিটকে পড়া একটি অংশ। এটা ছিল লক্ষ্য বিচ্যুত, একটি কলঙ্ক-ধারা যার পরিসমাপ্তি দেখতে রাশিয়ার জনগণ প্রায় ৬ দশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তার দৃষ্টিতে লেনিনবাদ একটি সুবিধাবাদী অগ্রণীদল দল (radical group)। এই দল নিজেদের স্বার্থে প্রগতিবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহ ও আন্দোলনসমূহকে ব্যবহার (exploit) করেছিল শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতা করায়ত্ত করতে। তারপর সেই রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করেছিল গণ-সত্তার অবশিষ্ট অংশে চাবুক মারতে। এই অনৈতিক ক্ষমতায়ণ এবং ক্ষমতা আত্তীকরণ ছিল নোয়াম চমস্কি ও আরও বড় বড় থিয়োরিস্টদের মতে মার্ক্সবাদ পরিপন্থী। মূলধারার মার্ক্সবাদী চিন্তাবিদগণ তাই লেনিনবাদকে বিচ্যুতির ধারা হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। এদিক থেকে বলশেভিজম হচ্ছে মার্ক্সবাদ থেকে সরে পড়া একটি বিধ্বংসী আন্দোলন। লেনিন যখন ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন করেন তখন থেকেই এই বিচ্যুতি তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। পূর্ববর্তী বছরগুলোতে তার ধ্যান-ধারণা স্পষ্টভাবে আরও বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এই স্থান থেকে দেখতে গেলে লেনিনবাদ হচ্ছে নৈরাজ্য ও অরাজকতার রাষ্ট্র ও সমাজ-ব্যবস্থা। সমাজতান্ত্রিক মূল চিন্তা ছিল উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ শ্রমিকদের কর্তৃত্বে রাখা (workers’ control over production), কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের পর (চমস্কি এটাকে ‘বিপ্লব’ না বলে ‘কু’-Coup বলেন, এটা এক অবৈধ পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখল বলে তিনি উল্লেখ করেন), তারা প্রথমে ক্ষমতা হাতে নিয়েই ফ্যাক্টরি কাউন্সিলকে ধ্বংস করে দেয়। প্রথম পর্যায়ে ট্রটস্কিও এক সাথে ছিলেন। কিন্তু দ্রুতই লেনিনবাদীদের কর্মকাণ্ড সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ধ্যান-ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ঙ্খলন, বিচ্যুতি হয়ে পড়ে। এটা কেন হল? চমস্কি বলেন, কারণ ‘সুবিধাবাদ’। লেনিনবাদ মূলত সমাজতান্ত্রিক কোন আন্দোলন নয়, কোন চিন্তা চেতনাও নয়, যদিও এটাকে সমাজতন্ত্র বলে সারা বিশ্বে ‘প্রোপাগান্ডা’ করা হয়।

-পাঁচ- (খ) লেনিন, স্টালিন

লেনিন, স্টালিন ও সরেলের দৃষ্টিতে সমাজের পরিবর্তন কখনো ‘সহিংসতা’ ব্যতীত ঘটতে পারে না। তাদের এই নৈতিক দর্শনকে ethics of violence বা সহিংসতাবাদী নৈতিকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই নৈতিকতায় প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে হত্যা, নির্যাতন, গুম, বাড়িঘর পুড়ানো এগুলো সবই ঠিক। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিথ্যাচারও ‘সঠিক’ এবং ‘নৈতিক’। এই বাস্তবতা আপনি রাশিয়ান বিপ্লবে দেখে থাকবেন এবং বাংলাদেশে লেলিনবাদীদের কর্মকাণ্ডেও তা দেখতে পাবেন।

-ছয়-

রৈখিক বা লিনিয়ার প্রগতিবাদ (linear progressivism):

এবারে কমিউনিস্টদের “প্রগতিবাদের” ধারণা নিয়ে আরও দুটি কথা। কমিউস্টরা যে ‘প্রগতিবাদে’ বিশ্বাস করে, প্রগতির এই ঐতিহাসিকতা নীচশা (Nietzsche) সঠিক মনে করেননি। তার ধারণায় হেগেলের থিওরিও ভুল হয়ে পড়ে। তার দৃষ্টিতে মানব সভ্যতা “প্রগতির” মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার কোনো নজির নেই। প্রত্যেক সমাজ তার পূর্ববর্তী সমাজের চেয়ে উত্তম -এমন লিনিয়ার (linear theory) দর্শন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনায় টিকে না। বরং সভ্যতা কোনো স্থানে গড়ে ওঠে কিন্তু তার চেয়ে উত্তম আরেকটি সভ্যতার জন্ম দেবার আগেই তা বিলীন হয়ে যেতে পারে পারে। প্রাচীন সভ্যতা এভাবে গড়ে ওঠেছে এবং বিলীন হয়েছে। প্রগতির চিরন্তনতার ধারণা ইবন খালদুনেও নেই। হরপ্পা, মোহেঞ্জদারো, বেবিলন ইত্যাদি গড়েছে এবং ধ্বংসও হয়েছে। মার্ক্সবাদ নীচশার হাতে দারুণভাবে মার খেয়েছে বলা যায়।  অধিকন্তু প্রগতির সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে অনাগত কোন এক কালে মানুষের সমাজে ‘মান্না-সালওয়ার’ যুগ আসবে  –এমন কোন উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা মানব জীবনকে বা তাদের ইতিহাসকে অর্থবহ করে তুলতে পারে –এমনটি তিনি মনে করতেন না। Empirical facts এই ধারণাকে সমর্থন করেনা। বিশ্ব মানবতার চরম লক্ষ্য কোন এক অনাগত সময়ে (end time) নিপতিত বা স্থাপিত থাকবে, এমন ‘প্রগ্রেসিভ/প্রগতির’ গল্পকে তিনি অগ্রাহ্য করেন। একটি সমাজ বা জাতি আরেকটি সমাজ বা জাতির পরে এসেছে বলেই তা অপেক্ষাকৃত ‘সভ্য’ বা ‘উন্নত’ হয়েই থাকবে -এমন ধারণা অবৈজ্ঞানিক।

নীচশার পরে মার্ক্সবাদী একাডেমিয়ায় ধ্বস নেমে আসে। ফুকোও (Foucault), লিওটার (Lyotard), ডিলুস (Dileuze) এবং আরও অনেক বড় বড় থিয়োরিস্ট (ডেরিডা/Derridaসহ) মার্ক্সবাদের সমালোচক হয়ে ওঠেন। এদের কেউই আস্তিক নন এবং কেউই ‘প্রগতিবাদী’ নন, প্রগতিবাদের ধারণাকেই বরং outdated বলা যেতে পারে। ১৯৮০ দশকে সৌভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ে। প্রগতির ধারা অতিক্রম করে কমিউনিজমে পৌঁছার থিওরির উদাসীনতা স্পষ্ট হয়। ক্রমশ সমাজ কমিউনিজমের দিকে ধাবিত না হয়ে, উল্টো ক্যাপিটালিজমের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অর্থাৎ progress না হয়ে digress হল।

Loading

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *