এবারের বিজয় দিবস ঘুমিয়ে কাটাব ভাবছি

ইংরেজি বছরটার শেষ মাস এখন। একটি বছর যেতে বসলে মনটা সবারই আনচান করে। গোটা বিদায়ী বছরের স্মৃতিরা স্রোতের মতো ভেসে আসে আর চলে যায়। ২০১৪ সালের বিশেষ তাৎপর্য ব্রিটেনের মানুষের জন্য। এক শ’ বছর আগে এ দেশ তাদের অস্তিত্ব এবং মানবজাতির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য গোটা ইউরোপ রণক্ষেত্রে গিয়েছিল। চার বছর ধরে চলে প্রথম মহাযুদ্ধ। ব্রিটেন ও তৎকালীন কমনওয়েলথের (কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড) প্রায় ৯ লাখ লোক সে যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিল। সে কালের ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর আরো লাখ লাখ লোক মারা গেছে। এদের সঠিক সংখ্যা সংগ্রহ করা সময় ও কষ্টসাধ্য হবে। তবে এটুকু উল্লেখ করা যেতে পারে, ব্রিটিশের ভারত সাম্রাজ্য থেকে ১০ লাখ সৈন্য এসেছিল ইউরোপীয়দের এই যুদ্ধে। আফ্রিকা মহাদেশ এবং ক্যারিবিয়ানের উপনিবেশগুলো থেকেও এসেছিল বহু লাখ সৈনিক। তাদের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যা প্রাণ দিয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলোরও বহু লাখ মানুষ মারা গেছে উভয় পক্ষে। একমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই (১৯৩৯-১৯৪৫) এর চেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে এ যাবৎ।
আমি ব্রিটেনে থাকি। বছরটার শুরু থেকে আজ অবধি রেডিও এবং টেলিভিশনে বহু প্রামাণ্য অনুষ্ঠান শুনেছি এবং দেখেছি প্রথম মহাযুদ্ধ সম্বন্ধে। পত্রপত্রিকায় পড়েছি অজ¯্র প্রবন্ধ। সব বয়সী বহু লোক প্রামাণ্য অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিয়েছেন। সে যুদ্ধে তাদের পিতামহ ও প্রপিতামহরা কোথায় কোথায় যুদ্ধে গেছেন, কোথায় তারা প্রাণ দিয়েছেন, সেসব কাহিনী তারা সবিস্তারে বলেছেন। অনেকে সে বীর পূর্বপুরুষদের ফ্যাকাসে হয়ে আসা আলোকচিত্র কিংবা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে লেখা তাদের চিঠি নিয়ে এসেছেন সাথে; জীবিত কিংবা মরণোত্তর তারা যেসব মেডেল পেয়েছিলেন সগৌরবে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে দেখিয়েছেন। 
 ভিডিও তখনো আবিষ্কার হয়নি, কিন্তু খুব উঁচু মানের না হলেও চলচ্চিত্র ছিল। ছিল নিশ্চল আলোকচিত্র এবং যুদ্ধ-শিল্পীদের আঁকা ছবি। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তৈরি সিনেমা ফুটেজ ইত্যাদি মিলিয়ে বহু প্রামাণ্য ছবি তারা তৈরি করেছেন। তখনকার যুদ্ধ জর্জরিত ব্রিটিশ সমাজের অবস্থা, যুদ্ধকালে ব্রিটিশ নারী কী করে চাষবাস করে জাতির জন্য খাদ্য ফলিয়েছে, কিভাবে তারা কলকারখানায় বন্দুক-কামান ও গোলাবারুদ তৈরি করেছে, সেসব নিয়েও অনেক অনুষ্ঠান তৈরি হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেসব ছবি ব্রিটিশ জাতি দেখেছে, দেখে পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় তাদের হৃদয় আপ্লুত হয়েছে।
লন্ডনে টেমস নদীর দক্ষিণ দিকে ইম্পিরিয়াল ওয়ার মিউজিয়ামে প্রথম মহাযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র ও সমরোপকরণ তো বটেই, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পাঠানো সৈনিকদের চিঠি, আলোকচিত্র এবং রণাঙ্গনে পড়ে পাওয়া মৃত সৈনিকদের হেলমেট, বুট, ইউনিফর্ম ইত্যাদি সযতেœ সংরক্ষিত আছে। এক শ’ বছর পরও অজস্র মানুষ এই জাদুঘরে যান, সে যুদ্ধ সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করেন। এই শতবর্ষ পরে এখনো যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত সৈনিকদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, কঙ্কাল ও টুকরো টুকরো হাড় ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। ওয়ার মিউজিয়ামে রাখা তাদের স্মৃতিচিহ্নের সাথে মিলিয়ে এবং ডিএনএ পরীক্ষা করে এতকাল পরও বহু মৃত সৈনিককে শনাক্ত করা হচ্ছে। 
 
এক শ’ বছর পরও পরিচয় শনাক্ত হচ্ছে
 প্রথম মহাযুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধগুলো হয়েছে বেলজিয়ামের ফ্যান্ডার্স এবং পূর্ব ফ্রান্সের সম এলাকায়। যুদ্ধের সময় রক্তরাঙ্গা পপি ফুল আর হতাহত সৈনিকদের রক্ত মিশে একাকার হয়ে গেছে। সমে এবং ফ্যান্ডার্সে কয়েক ডজন সমাধি ক্ষেত্রে হাজার হাজার সৈনিককে সমাহিত করা হয়েছে। প্রত্যেক সমাধিতে তাদের নাম ও সামরিক পরিচয় খোদিত স্মৃতি প্রস্তর। যাদের সঠিক পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি তাদের জন্যও আছে সমাধি, তবে নামের বদলে স্মৃতি প্রস্তরে খোদাই করা আছে ‘নোন টু গড’, বিধাতার কাছে পরিচয় আছে। গাছ, ফুল আর সযতেœ রক্ষিত ঘাসের লনে ভারি সুন্দর দেখায় গোরস্থানগুলোকে। মৃত সৈনিকদের বংশধরেরা প্রায়ই দেখতে আসেন। পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন। শতবার্ষিকী উপলক্ষে এবার এসেছেন বহু গুণে বেশি। রাজা-রাজড়া আর সরকারপ্রধানও এসেছেন অনেক। সমের একটা সমাধি ক্ষেত্রে যুদ্ধ সমাপ্তির পর থেকে আজ অবধি প্রতি সন্ধ্যায় বিউগলে লাস্টপোস্ট (ব্যারাকে সৈনিকদের ঘুমাতে যাওয়ার সঙ্কেত সঙ্গীত) বাজানো হয়ে এসেছে।
 প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর বেলা ১১টায় (বছরের একাদশ মাসের ১১ তারিখ সকাল ১১টায়) শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে। প্রতি বছর এ উপলক্ষে লন্ডনের হোয়াইট হলের সেনেটাফে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে বর্তমান ও সাবেক সৈনিকেরা কুচকাওয়াজ করেন, রানী, রাজপরিবার ও রাজনৈতিক নেতারা নিহত সৈনিকদের স্মৃতিতে পুষ্পমাল্য নিবেদন করেন। নভেম্বরের গোড়া থেকে প্রায় সবাই কাগজের তৈরি পপি ফুল পরে পোশাকের ওপর। সাবেক সৈনিকদের বিভিন্ন সংগঠন সারা বছর ধরে এসব পপি তৈরি করে, স্বেচ্ছাসেবীরা নভেম্বরের গোড়া থেকে সেসব ফুল বিক্রি করেন এবং বিক্রিলব্ধ অর্থ সাবেক সৈনিকদের কল্যাণে ব্যয়িত হয়। শতবার্ষিকী উপলক্ষে অভিনব আয়োজন করেছিল টাওয়ার অব লন্ডন। নিহত প্রত্যেক ব্রিটিশ ও কমনওয়েলথ সৈনিকের স্মৃতিতে একটি করে প্রায় নয় লাখ সিরামিকের তৈরি পপি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছিল টাওয়ারের চার ধারের সবুজ লন। প্রায় পঞ্চাশ লাখ দর্শক টিকিট কিনে দেখতে এসেছিলেন। ‘আর্মিস্টিস ডে’র (১১ নভেম্বর) পরে সিরামিকের ফুলগুলো তুলে বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতাদের চাহিদা বিরাট বলে জানা গেছে। এসব সিরামিকের ফুল দিয়ে কয়েকটি জাদুঘরে অভিনব শিল্পকর্ম সাজানো হয়েছে। সেগুলোও দেখতে আসছে বহু লোক।
 
ইতিহাস আর ইতরামি যেখানে সমার্থক
আমরাও একটা মরণপণ যুদ্ধ করেছিলাম আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের জন্য। মাত্র ৪৩ বছর হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের। সে যুদ্ধ যারা করেছেন এবং যারা সে যুদ্ধ দেখেছেন তাদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন সৌভাগ্যবশত। কিন্তু সে যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বলতে পারবেন কেউ? কয়টা প্রামাণ্য চিত্র তৈরি হয়েছে, কয়টা পাঠযোগ্য নাটক কিংবা উপন্যাস লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে? এক বছর ধরে অনেক টেলিভিশন চ্যানেলে, অনেক রেডিও স্টেশনে প্রথম মহাযুদ্ধের শতবার্ষিকী উপলক্ষে আকর্ষণীয় এবং তথ্যবহুল বহু অনুষ্ঠান দেখেছি আর শুনেছি। বাংলাদেশে বিজয়ের এক দিনে দেখানোর মতো যথেষ্ট প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়েছে? কয়টা প্রামাণ্য ফিচার ফিল্ম তৈরি হয়েছে? কয়জন মুক্তিযোদ্ধার আত্মীয় ও বংশধর জানেন এই যোদ্ধাটি দেশের সঠিক কোথায় শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন? অথচ সাধ্যি না থাকলেও সাধ আকাশচুম্বী। একটি বিশেষ দিনে যথেষ্ট তথ্য দেয়ার সঙ্গতি যেখানে নেই, সেখানে একটি দিন নয়, গোটা মাস ধরে বেতারে আর টেলিভিশনে সাংস্কৃতিক ‘তাণ্ডব‘ চলে। মানুষের আবেগ আর অনুভূতি নিয়ে অযথা ফানুস ওড়ানো হয়। 
অন্য দিকে, মুক্তিযুদ্ধের নামে বিশেষ করে  ছয় বছর ধরে যেসব কাণ্ডকারখানা ঘটেছে সেটাকে নোংরামি আর ইতরামি না বলে উপায় আছে? সবচেয়ে মারাত্মক নোংরামি হয়েছে এবং হচ্ছে মুুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে। উদোরপিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। যুদ্ধ করেছে রহিমরা, আর কৃতিত্ব দেয়া হচ্ছে রামদের। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, দেশটাকে পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত করাই ইতিহাস বিকৃতির উদ্দেশ্য। এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল লাখখানেক মানুষ। অথচ এই সরকারের আমলেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেয়া হয়েছে তিন লাখের বেশি। এই সনদের জোরে তারা সরকারের দলীয়কৃত পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগে চাকরি পায়, শাসক দলের সন্ত্রাসী ক্যাডারে লাভজনক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ-ও এখন প্রমাণিত সত্য যে, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় সচিবরা পর্যন্ত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে লাভবান হয়েছেন। এসবই সরকারি যোগসাজশে হচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে। কেননা দোষী প্রমাণিত হলেও কাউকে শাস্তি পেতে দেখিনি। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় ১৯৭১ সালে এই তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাদের কারো কারো জন্মই হয়নি, অন্যরা তখন মায়ের কোলে ছিল। সরকারের ডাকসাঁইটে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের পুরো নেতৃত্ব তখন ছিল ভারতে। কিন্তু স্বাধীনতার সব কিছু সুযোগ-সুবিধা তাদেরই প্রাপ্য বলে দাবি করা হচ্ছে।
 
শহীদদের নামের তালিকা কেউ করেনি
 ইচ্ছে করলে মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের একটি তালিকা তৈরি সম্ভব ছিল। সে তালিকা কোনো প্রস্তর-দেয়ালে খোদাই করে রাখা যেতÑ কেন্দ্রীয় কিংবা আঞ্চলিকভাবে। বাংলাদেশে গ্রামের সংখ্যা ৮৬ হাজার। কর্মীরা সেসব গ্রামে গিয়ে ভোটার তালিকা ও পরিচয়পত্র তৈরি করেন, হালনাগাদ করেন। শহীদদের পবিত্র নামের তালিকা তৈরি কেন সম্ভব ছিল না? এবং এখনো সম্ভব। সরকার দাবি করছে ত্রিশ লাখ লোক মারা গেছে সে যুদ্ধে। সে দাবি সত্যি হলে গ্রামপিছু গড়পড়তা ৩৫ জন করে মানুষ মারা যাওয়ার কথা। বাংলাদেশের গ্রামে এখনো এমন বহু লোক আছেন গ্রামের শহীদদের নাম যারা সমাদরে মনে করে রেখেছেন। এই সরকারের কিছু বিশেষত্ব আছে। গঠনমূলক কোনো কিছু তারা করে না। তারা লুটপাট দাঙ্গাবাজি আর গুম-খুন করে গদি দখলে রাখতে চায়। আর ত্রিশ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন স্বীকার না করলে লোকের মাথা ফাটায়, নতজানু আদালতে মানহানির মামলা করে। আমার তখন জানতে ইচ্ছা করে সত্যিকারের মানটা কার? স্বাধীনতার শহীদদের? না ক্ষমতা লোপাটকারীদের? আর হ্যাঁ, তিন মিলিয়ন মারা গেছে বলে অবাস্তব দাবি করে বিশ্বের মানুষকে হাসায় তারা। 
প্রথম মহাযুদ্ধের পরে হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সে যুদ্ধ চলেছে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অনেক বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছে। উইনস্টন চার্চিল কিংবা জেনারেল আইজেনহাওয়ার অথবা ব্রিটেন কিংবা আমেরিকার কোনো রাজনৈতিক দল সে যুদ্ধে বিজয়ের মালিকানা দাবি করেননি। চার্চিল-আইজেনহাওয়ারের কোনো বংশধর তাদের দেশের সম্রাট কিংবা সম্রাজ্ঞী হতে চাননি। সারা বিশ্বের মানুষ আজো সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করে যে তারা যুদ্ধ করেছিল ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে। এবং শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে তারা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাকেই সমুন্নত করেছে। আগেই বলেছি, একাত্তরে আওয়ামী লীগ ছিল ভারতে। এ দলের নেতা ছিলেন পাকিস্তানে। দেশের মানুষের সাথে কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তাদের ছিল না। কোনো প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব কিংবা নির্দেশও তারা দেননিÑ এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো জেলখানা থেকে চিরকুট পাঠিয়েও না।
মানুষ যুদ্ধ করেছে বলতে গেলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কে কার দলে বিশ্বাস করে সে প্রশ্ন কখনো ওঠেনি। কিন্তু বিজয়ের আলামত টের পেয়েই আওয়ামী লীগ নেতারা ছুটে এসেছেন সে বিজয়ের মালিকানা দাবি করতে, স্বাধীনতার ফলগুলো ভোগ করতে। সে অধিকার এখন আওয়ামী লীগ চিরস্থায়ীভাবে দাবি করছে। দেশের মানুষ একাত্তরে যুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখন গণতন্ত্রকে হত্যা করে চিরস্থায়ী স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে লক্ষ্যে প্রয়োজনবোধে তারা স্বাধীনতাকেও পরের হাতে তুলে দিতে উদ্যত হয়েছে। সেটাই নাকি একাত্তরের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ব্রিটেনের, ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ দু-দু’টি মহাযুদ্ধ করেছে, বহু কোটি মানুষ এই দু’টি যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। আমি ৫৪ বছর ধরে ইউরোপের যুক্তরাজ্যে আছি। আমেরিকাতেও গেছি একাধিকবার। কিন্তু মহাযুদ্ধের চেতনার কথা কারো মুখে শুনিনি কখনো। 
 
দেখিয়ে দিক স্বাধীনতা কোথায় 
তবু বিজয় দিবস নিয়ে মাতামাতি করছি আমরা। এখন আবার বিজয় দিবস বিজয়ের মাসে সম্প্রসারিত হয়েছে। বায়াত্তরের শুরুতে ইউফোরিয়া দিয়ে তারা মানুষকে নিজেদের সমস্যা-সঙ্কট ও অভাববোধ ভুলিয়ে রেখেছিল। এখন সে ব্যাপারটাই হচ্ছে আরো বড় আকারে। গণতন্ত্রের আর স্বাধীনতার দাবি থেকে বেঁচে থাকার নিত্যকারের সমস্যা-সঙ্কট থেকে মানুষের দৃষ্টি ভিন্নমুখী করতে হবে। হয়তো শিগগিরই বছরজুড়েই বিজয়ের উৎসব পালিত হবে। যেসব রাজনীতিক উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন, রাষ্ট্রক্ষমতা জবর-দখল করে নিয়েছেন, যেসব ক্যাডার ও পেশিশক্তি বিজয়ের নামে পরের সম্পদ অপহরণ করছেন, তাদের দম্ভ ও লাফালাফির অবধি নেই।
শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবীরা ১৯৭২ সালের গোড়ার ক’টি দিনের মতো ইউফোরিয়া (অবাস্তব উল্লাসের আতিশয্য) ছড়াচ্ছেন। বিজয়ের পর প্রয়োজন ছিল বিধ্বস্ত দেশটাকে পুনর্নির্মাণের। তার বদলে স্তবস্তূতি আর ফাঁকা উল্লাসে দেশের মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্নমুখী করে রেখে দেশের যা কিছু সম্পদ ছিল লুটপাট করা হয়েছে। স্বাধীনতা লোপাটকারীদের কৃপায় যারা বেশি পুরস্কৃত হয়েছেন, তাদের লাফালাফি অবশ্যই বেশি। বায়াত্তরের ইউফোরিয়া আর স্তবস্তূতি কিভাবে অর্থনীতির সর্বনাশ করেছে, দেশের সর্বনাশ করেছে আর দুর্ভিক্ষ ডেকে এনে ৪০ হাজার মানুষ হত্যা করেছে, সবই আমি দেখেছি। অন্যরাও দেখেছেন। তার পরেও কী করে ইউফোরিয়ার উল্লম্ফন হজম করতে পারব বুঝে উঠতে পারছি না। তার চেয়ে ১৬ ডিসেম্বর দিন রাতজুড়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাব ভাবছি। স্বাধীনতাটা কোথায় আগে কেউ দেখিয়ে দিক। বিজয় দিবস পালনের কথা ভাবব তার পরে।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *