উপলব্ধি, বুদ্ধি ও সংবেদনা – ধর্মের পর্যালোচনা ও বাংলাদেশে ইসলাম

আলোচনা করছি ধর্ম আর চিন্তা সম্পর্ক সম্বন্ধে আমাদের একটি নির্বিচার অনুমান নিয়ে। সেটা হোল, ধর্ম ও চিন্তা আলাদা ব্যাপার। এই অনুমান নিয়েই আমরা সাধারণত চলি। এই অনুমানই ধর্ম কিম্বা চিন্তা উভয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চার চরিত্র আগাম নির্ধারণ করে দেয়। দাবি করে, একটি বিশ্বাসের জগৎ আর অপরটি যুক্তিবুদ্ধির; আর, চিন্তার জগৎ একান্তই যুক্তিবুদ্ধির, সেখানে বিশ্বাসের স্থান নাই। বিশ্বাসের জগৎ যুক্তিবুদ্ধি বা চিন্তার ক্ষেত্র থেকে আলাদা। ধর্ম ভাবনার মধ্যে চিন্তা নামক কোন পদার্থ নাই, তাই ধর্ম নিয়ে চিন্তা কিম্বা পর্যালোচনারও কিছু নাই। এই অনুমানটিকেই আমরা শুরুতে নাকচ করছি। কারণ ধর্মের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিভঙ্গির এটা গোড়ার জায়গা। অবিশ্বাসীদের অভিযোগ যে যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারা কোন চিন্তা করে না, তারা যে সত্যের দাবি করে সেটা কোন চিন্তার নির্ণয় নয়, সেটা নিছকই অন্ধ বিশ্বাস। চিন্তার ছিটেফোঁটা থাকলেও তা পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল ও আবেগসর্বস্ব। অতএব ধর্মের সত্যকে সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না, কারণ তার নির্ণয় যুক্তিবুদ্ধির পদ্ধতি ও প্রকরণ মেনে- অর্থাৎ চিন্তার দ্বারা ঘটে না।
বিস্ময়ের হলেও সত্য যে এই অনুমান অবিশ্বাসী, ধর্মবিরোধী বা ধর্মবিদ্বেষীদের মধ্যেই রয়েছে তা নয়, এটা বিশ্বাসীদের মধ্যেও প্রবল। যে কারণে বিশ্বাসীরা প্রায় সব সময়ই ধর্মের পর্যালোচনা এড়িয়ে চলেন। তাঁরাও বিশ্বাস করেন, ধর্ম বিশ্বাস মাত্র, ঈমান-আকিদার ব্যাপার, এর মধ্যে কোন চিন্তা নাই, যা নিয়ে চিন্তা তার নিজের পরিমণ্ডলে ভাবতে ও পর্যালোচনা করতে পারে। তাঁরা ধর্ম নিয়ে তর্কবিতর্ক করেন না তা নয়, তর্কবিতর্কের কারণে বিভিন্ন মজহাব ও ফেরকায় সদাই ভাগও হয়ে যান। সেটা অনেক ক্ষেত্রে খুনোখুনি ও হানাহানি অবধি গড়ায়, কিন্তু সেই সকল ব্যাখ্যা তাঁদের দৃষ্টিতে চিন্তার সমস্যা নয়। সেটা তাঁদের ধর্মগ্রন্থ বা কেতাবের ব্যাখ্যার পার্থক্য কেবল। ধর্মগ্রন্থে বা কেতাবে যে সত্য নাজিল হয়েছে তাঁরা সেই সত্যেরই খবরদারি করছেন মাত্র। ফলে তাঁদের সত্যের দাবি নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ কিম্বা কোরআন-হাদিসের বরাতেই হয়ে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় ঐতিহ্য। বলাবাহুল্য, এর মধ্যেও ব্যতিক্রম আছেন, কিন্তু এটাই প্রধান ধারা।
ধর্মে কোন চিন্তা নাই এই অনুমানের আপদ নতুন কিছু নয়। দর্শনকেও এই অনুমান মোকাবিলা করতে হয়েছে। দর্শন কিভাবে সেই অনুমান মোকাবিলা করেছে এবং এখনও করে সেই দিকেই আমরা এখন মনোযোগ দেব। সে আলোচনা আমরা পাশ্চাত্য দর্শনের অন্দরমহল থেকেই করব। এর কারণ পদ্ধতি হিসাবে আমরা এই লেখায় আপাতত ধরে নিয়েছি যে পাশ্চাত্য দর্শনে ধর্মের পর্যালোচনা কোথায় কিভাবে শেষ হয়েছে তার হদিস নিতে গিয়ে আমরা পাশ্চাত্য দর্শনের সীমাবদ্ধতা শনাক্ত ও পাশ্চাত্য চিন্তাজগতের সামগ্রিক সঙ্কট আন্দাজ করতে পারব। এই কাজটুকু করা গেলে বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তিক দেশগুলোতে ধর্মের পর্যালোচনার ক্ষেত্র ও অভিমুখ কী হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা আরো পরিচ্ছন্ন করা যাবে আশা করি। বাংলাদেশে ধর্ম বিশেষত ইসলাম নিয়ে ভালগার তর্কাতর্কির কারণে পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে ধর্ম পর্যালোচনার বিষয়টির মোকাবিলা কিভাবে হয়েছে সে বিষয়ে কোন ধারণা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি।
বলা যায়, ‘ধর্মে কোন চিন্তা নাই’ অনুমানকে কার্ল মার্কসের গুরু গেঅর্গ ভিলহেল্ম হেগেল (১৭৭০-১৮৩১) প্রশ্ন করেই তাঁর দর্শনের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁকে ইম্মেনুয়েল কান্টের (১৭২৪-১৮০৪) পর্যালোচনা করতে হয়েছে। যে কারণে কান্টের চিন্তা হেগেল কিভাবে মোকাবিলা করেছেন তার প্রতি আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। হেগেল শুধু কান্টকেই মোকাবিলা করেছেন তা নয়, তাঁর আগের ও সমসাময়িক কালের আরো অনেকের চিন্তারই তিনি পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর নিজের দর্শনের স্থাপত্য সেই সকল পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে।
আগেই বলেছি হেগেলের দার্শনিক স্থাপত্যের গোড়ায় রয়েছে এই সিদ্ধান্ত যে ধর্ম আদতে চিন্তারই একটি ধরণ, চিন্তারই ধর্মরূপ মাত্র। ধর্মে সত্য ধরা পড়ে ছবিমূলক ভাবনা বা উপলব্ধির মধ্যে। বাংলাদেশে যাঁরা দর্শন নাড়াচাড়া করেন তাঁরা অনেক সময় ইংরেজি শিক্ষার বদৌলতে একেই ‘ইনটুইশান’ বলে বুঝে থাকেন। বাংলায় একে ‘স্বজ্ঞা’ বলেও মাঝে মধ্যে অনুবাদ করা হয়। পরবর্তীতে আরেক শক্তিশালী দার্শনিক মার্টিন হেইডেগার (১৮৮৯-১৯৭৬) আসার পর ‘ইনটুইশান’ বা ‘স্বজ্ঞা’র বিচার ভিন্নমাত্রা পরিগ্রহণ করে। কান্ট ও হেগেল যেভাবে ইনটুইশান বা স্বজ্ঞা বুঝেছেন ও বিচার করেছেন তা তখন নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে। এতে ‘ধর্ম’ শুকিয়ে যাওয়া দূরের কথা, বরং ধর্মের তাৎপর্য নতুন মাত্রা পায়।
বাংলার ভাবচর্চার দিক থেকে ইনটুইশান বা ‘স্বজ্ঞা’কে আমরা সত্যের স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধি হিসাবে বুঝি। কিন্তু ইংরেজি বা সংস্কৃত দিয়ে এর তাৎপর্য বাংলার ভাব পরিমণ্ডলে ধরা যায় না। বাংলায় আমরা আরো সরলভাবে সত্যের স্বতঃস্ফূর্ত উপলব্ধিকে ‘সহজ’ বলি। অর্থাৎ যে উপলব্ধি, জ্ঞান বা বোঝাবুঝি আমাদের সহজে ঘটে, তাই ‘সহজ’। যা আমাদের সহজাত, যে সত্য সহজে ধরা দেয়, যাকে আমরা সহজে বুঝি ইত্যাদি। এই সহজ বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে বেদ, শাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তি, বুদ্ধি ইত্যাদি প্রকট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সহজ বটে, কিন্তু তা সহজ নয়। কারণ আমাদের সকল ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা কিম্বা সংক্ষেপে আমাদের সমগ্র শরীর, ইন্দ্রিয় ও বৃত্তির জাগরণের মধ্য দিয়ে সেই সত্যের স্বতঃস্ফূর্ত উৎপত্তি ঘটে। বুদ্ধিকে সত্য নির্ণয়ের একমাত্র সর্দার জ্ঞান করলে সেই সত্য ধরা দেয় না। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে ‘সহজ’-এর প্রধান আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘জন্মের সহিত জাত’। অর্থাৎ শরীরের উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই যার উৎপত্তি। বাংলার ভাবচর্চা বা দর্শন যেহেতু চিন্তাকে শরীর থেকে আলাদা কোন বিশেষ গুণ, প্রতিভা বা ঘটনা গণ্য করে না, তাই বাংলার ভাবচর্চার দিক থেকে ধর্মের পর্যালোচনা আমাদের আরেকটি দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। কিন্তু আলোচনার যে প্রাথমিক স্তরে আমরা রয়েছি তাতে সেই আলোচনায় প্রবেশ এখনও বাংলাদেশে দুঃসাধ্য। কিন্তু কথাটা বলে রাখছি, ধর্মের পর্যালোচনা চিন্তার যে ক্ষেত্রগুলো নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে সহায়তা করতে পারে সে সম্পর্কে খানিক ইঙ্গিত দিয়ে রাখার জন্য।
উপলব্ধির সত্য ও বুদ্ধির নির্ণয়ের মধ্যে ফারাক থাকলেও হেগেল দেখান কিভাবে ইন্দ্রিয়োপলব্ধি হোক, কিম্বা হোক বুদ্ধির পরিমণ্ডল সকল ক্ষেত্রেই চিন্তা সজীব ও সক্রিয় থাকে। এখানেই হেগেলের গুরুত্ব। এই কারণে তিনি দাবি করতে পারেন ধর্মের বিষয় আর দর্শনের বিষয় একই। তবে উপলব্ধির স্তরে আমরা একটি বিষয়কে যেভাবে বুঝি আর বুদ্ধির স্তরের সেই একই বিষয়কে বোঝা ও বিশ্লেষণের ধরনে ফারাক আছে। বাংলা ভাষায় দর্শন চর্চার শক্তিশালী ধারার অনুপস্থিতির কারণে উপলব্ধির সত্য ও বুদ্ধির নির্ণয়ের ভেদ কিম্বা অভেদ কোনটিই আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
তবে সাধারণভাবে উপলব্ধির সত্য ও বুদ্ধির নির্ণয়ের মধ্যে ফারাক বুঝতে হলে সাধারণ মানুষের ভাষা অনুসরণ প্রাথমিকভাবে আমাদের অনেক কাজে লাগতে পারে।
মানুষ যখন কোন সত্যের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বলে, তার ‘মন’ বলছে এটা সত্য; তখন বোঝা যায় ‘মন’ কথাটার মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয়োপলব্ধি কিম্বা বা বুদ্ধির বাইরের ‘অতিরিক্ত সংবেদনা’ দিয়ে সত্য নির্ণয়ের দাবি উঠছে। অর্থাৎ এমন এক সত্যের দাবি উঠছে যাকে শুধু বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় সম্ভব নয়, এমনকি ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জ্ঞানও সেই সত্য উপলব্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। এই সংবেদনা ব্যক্তির ব্যক্তিগত উপলব্ধি হবে তারও কোন কথা নাই। সমাজের সামষ্টিক মনও ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ উপলব্ধি কিম্বা বুদ্ধির নির্ণয়ের অতিরিক্ত সত্যের ‘সাক্ষী’ হতে পারে।
যাঁরা ইসলামকে দর্শনের ক্ষেত্র থেকে বিচারে আগ্রহী তাঁরা ‘সাক্ষ্য’ কথাটা আশা করি মনে রাখবেন। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং মুহাম্মদ (সা:) তাঁর রাসূল- এই সত্যের সাক্ষ্য হয়ে থাকা বা সাক্ষী দেওয়ার দার্শনিক তাৎপর্য অনেক গভীর। এ প্রসঙ্গে আমরা পরে আরো বিস্তৃতভাবে ফিরে আসব, কিন্তু এখানে কিছু ধারণা দিয়ে রাখা জরুরি।
ইসলামে সাক্ষ্য দেওয়া বা সাক্ষী হয়ে থাকা আপাতদৃষ্টিতে নিছকই ঈমান-আকিদার বিষয় হলেও দর্শনের দিক থেকে তাৎপর্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, ইসলাম একত্ববাদী ধর্ম। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এটা শুধু ইসলাম বলে তা নয়, ইসলামের আগে ও পরে আসা অনেক ধর্মই সে কথা বলে। কিন্তু আল্লাহর সাক্ষ্য দেওয়া বা সাক্ষী হওয়ার দাবির মধ্য দিয়ে ইসলাম অন্যান্য একত্ববাদী ধর্ম থেকে পৃথক হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত মুহাম্মদ (সা:)কে আল্লার রাসূল বলার মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসের সত্য আবির্ভাবের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তেরও সাক্ষী হওয়া ছাড়া নিজেকে কেউ ‘মুসলমান’ দাবি করতে পারে না।
প্রশ্ন হোল, সাক্ষ্য দেওয়া বা সাক্ষী হওয়া কেন ইসলামে বাধ্যতামূলক হোল? ধর্মের পর্যালোচনা বা বিচার করা গেলেই কেবল ইসলাম দর্শনকে কোথায় এবং কিভাবে নতুন করে গঠন করবার প্রস্তাব করছে তার তাৎপর্য আমরা বুঝতে পারব। নইলে কলমা পড়া একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতির অতিরিক্ত কিছু বোঝাবে না। আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা এতোটুকু বলতে পারি যে ইসলাম চিন্তার নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচন করতে চেয়েছে। এর আভাস আমরা কিভাবে পেতে পারি? এটা অন্তত বোঝা যায় ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ এবং বুদ্ধির অতিরিক্ত সত্য রয়েছে ইসলাম তা মানে। নইলে গায়েবে ঈমান আনবার কথা উঠত না। কিন্তু গায়েবের প্রমাণ কী? যা গায়েব বা নিরন্তর অনুপস্থিত তাকে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ সত্য হিসাবে যেমন জানা সম্ভব নয়, তেমনি বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয়ও অসম্ভব। সেই সত্যের প্রমাণ মোমিনের সাক্ষ্যে। দর্শন প্রশ্ন তুলবে মোমিনের সাক্ষ্য দর্শন মানবে কেন? এর উত্তর হচ্ছে, আল্লাহকে একবার ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ উপলব্ধির সত্য কিম্বা আরেকবার বুদ্ধির নির্ণয় হিসাবে খণ্ড খণ্ড ভাবে বিচার করবার ভুলটা আমরাই করি। ইন্দ্রিয় উপলব্ধি বা বুদ্ধি দুটোই মানুষের দরকার, কিন্তু মানুষ এভাবে খণ্ড খণ্ডভাবে বিরাজ করে না। তা ছাড়া ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধি ছাড়াও মানুষের আরো অনেক বৃত্তি রয়েছে যার মধ্যে কল্পনা, সঙ্কল্প, ইচ্ছা, অভিপ্রায়, অপরের প্রতি সংবেদনা ইত্যাদি অন্যতম। মানুষকে কোন একটি বিশেষ বৃত্তিতে সংক্ষিপ্ত করে ভাবা একান্তই আধুনিক কালের পরিণতি। ইসলাম তা প্রত্যাখ্যান করে। অতএব উপলব্ধি ও বুদ্ধির অতীত কিম্বা বুদ্ধির অতিরিক্ত সত্য নির্ণয়ের ক্ষমতা মানুষের নাই সেটা দর্শন দাবি করতে পারে না। মানুষ এখনও সম্ভাবনা কেবল, তার স্বরূপের কিছুই এখনও পরিপূর্ণ বিকশিত হয়নি। সেই রূপ আমরা এখনও দেখিনি। কিন্তু সম্ভাবনা বলেই উপলব্ধি ও বুদ্ধির অতিরিক্ত সত্যের সাক্ষী মানুষ হতেই পারে।
মানুষ এখনও খণ্ড খণ্ডভাবে হাজারভাবে ভাগ করে বিরাজ করছে। তাই আমরা উপলব্ধির সত্য বা বুদ্ধির নির্ণয়ের ছকবাঁধা জগৎ ভাঙতে পারছি না। যিনি নিরন্তর অনুপস্থিত বা গায়েব তাঁকে একমাত্র সত্য হিসাবে উপলব্ধি সামগ্রিক অখণ্ড মানুষের পক্ষে মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। তার সাক্ষ্য মানুষের পক্ষে দেওয়া খুবই সম্ভব। ইসলামে আরো সম্ভব কারণ মানুষ একই সঙ্গে ইহলোকে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধিও বটে। খলিফা হিসাবে তার কর্তাসত্তার উদ্বোধন মানুষ ঘটাতে পারে। যিনি নিরন্তর গায়েব বা অনুপস্থিত অথচ একমাত্র সত্য তার সাক্ষ্য হবার মধ্য দিয়েই সেই কর্তাসত্তার উদ্বোধন ঘটে। নিজের সকল বৃত্তিকে জাগ্রত করার মধ্য দিয়ে গায়েব বা অনুপস্থিতির সংবেদনা মানুষের মধ্যে তৈরি হতে পারে।
হেগেলের কাছে গায়েব বা অনুপস্থিতির ধারণা ছিল না। দেশকালের অতীত নিরন্তর অনুপস্থিত সত্যের সঙ্গে দেশকালে হাজির সীমিত মানুষের সম্পর্কের বিচারও পাশ্চাত্যে দর্শনের বিষয় হয়ে ওঠেনি। তারপরও ধর্ম যে সত্যের জন্য আকুল দর্শন সেই সত্যকেই তার বিষয় জ্ঞান করে, খ্রিস্টীয় চিন্তা কাঠামোর পরিমণ্ডলে হেগেলের এই দাবি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হেগেলের ভাষায় একমাত্র আল্লাহ, আল্লাহই হচ্ছেন সত্য। ধর্মের যা বিষয়, দর্শনেরও বিষয় তাই। পাশ্চাত্য আল্লাহকে জ্ঞানের বিষয় হিসাবে ভজনা করেছে, কিন্তু আল্লাহকে গায়েব বা নিরন্তর অনুপস্থিতি হিসাবে বিচার করে দেখেনি। পাশ্চাত্য দর্শনের পথ ধরে হলেও ধর্মের পর্যালোচনা সেই সদর রাস্তা আমাদের জন্য খুলে দিতে পারে। যদি সত্য অখণ্ড মানুষের ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বা বুদ্ধির অতিরিক্ত সংবেদনাই হয়ে থাকে, সেই সংবেদনার সত্য জারি হবে কিভাবে? এখানেই সাক্ষ্য দেওয়া বা সাক্ষী হওয়ার গুরুত্ব।
ইসলাম এক ও দ্বিতীয় সত্য হিসাবে আল্লাহকে জানার জন্য মানুষের ঐতিহাসিক অন্বেষণকে সব সময়ই স্বীকার করে। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কিম্বা বুদ্ধি নির্ণয়ের অধীনে এনে সেই জানাকে সিদ্ধজ্ঞান করা কখনই যথেষ্ট মনে করেনি; সেই সত্যের সাক্ষ্য দেওয়া বা সাক্ষী হওয়া সে কারণেই জরুরি। প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লার আবার সাক্ষীর প্রয়োজন হোল কেন? তিনি গায়েব ও অনুপস্থিত রয়েছেন সেভাবেই অন্যান্য একত্ববাদী ধর্মের মতো থেকে যেতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজনটা তাঁর নয়। মানুষের। যিনি আছেন অথচ যিনি নিরন্তর গায়েব বা অনুপস্থিত, তাঁর সাক্ষী হবার মধ্য দিয়ে দেশ-কালে সীমিত মানুষ দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করে যাবার সাধনা করে। ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির যিনি অতিরিক্ত তাঁর সাক্ষ্য দেওয়া ও তাঁর সাক্ষী হওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ সীমাকে সম্প্রসারিত করে, তার নিজের বিকাশ সম্পন্ন করে। এই সাক্ষ্যের মধ্য দিয়েই মানুষ দিব্যতাকে মূর্ত বা ‘বর্তমান’ করে তোলে। যা অদৃশ্য তা মানুষের মধ্য দিয়েই দৃশ্যমান হয়। মানুষই পারে। মানুষের মধ্য দিয়েই জগৎ মূর্ত হয়ে ওঠে, মানুষের মধ্য দিয়েই নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। যা নাই, ইতিহাসে তাকে মূর্ত করে তোলার আকাক্সক্ষা ও তার বাস্তবায়ন মানুষের মধ্য দিয়েই আল্লাহ সম্পন্ন করেন। ইসলামের বৈশিষ্ট্যসূচক দিক এভাবেই দর্শন ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে পারে।

হেগেলের দিক থেকে দর্শনের কাজ হচ্ছে পরম সত্যকে জানা। সেই সত্য কিভাবে বর্তমান হয়েছে এবং এখন বিরাজ করছে তাকে চিন্তা ও ইতিহাস উভয় দিক থেকে জানা। দর্শন প্রসঙ্গে এই সাধারণ সূত্রের সঙ্গে ইসলাম আপত্তি করবে না। কিন্তু ইসলামের দাবি অন্যত্র। দর্শন ইসলামের পরমার্থ নয়, বিচিত্র ও বিভিন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে একই সমাজ গঠনের সাধনা ইসলাম করে। দর্শন নতুন নতুন ফেরকা ও ফেতনা তৈরি করে যে কারণে দর্শনের প্রতি ইসলাম সব সময়ই সন্দিহান। আল্লাহ বা পরম সত্য অন্বেষণ বা সত্যের প্রতি ধাবিত হওয়ার মধ্যে কোন দোষ নাই, সেই সত্যের অন্বেষণ মানবেতিহাসে জ্ঞানের যে বিকাশ ঘটায় বা ঘটাচ্ছে ইসলাম তাকে স্বাগত জানায় ও সাদরে গ্রহণ করে। ঠিক যেমন আখেরি নবীর আবির্ভাবের আগের সকল নবী-রাসূল ও অন্যান্য জনগোষ্ঠির কাছে প্রেরিত পথপ্রদর্শক সকলেই আল্লাহর তরফেই এসেছিলেন ইসলাম তা মানে ও তার ঈমানের অঙ্গ মনে করে। যারা করে না তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।
তবে দর্শনের প্রতি সন্দিহান হবার ইসলামের গুরুতর দার্শনিক কারণ রয়েছে। আল্লাহ বা পরম সত্যকে নিছকই জ্ঞানের বিষয়ে পর্যবসিত করার ঘোর বিরোধী ইসলাম। এটা ইসলামের চোখে শেরেকি। আল্লাহ গায়েব। কেবল ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ জগতে নয়, বুদ্ধির জগতেও তিনি নিরন্তর অনুপস্থিত থাকেন। এই কারণে তিনি শধু ইন্দ্রিয়ের অতীত বা অতিরিক্ত নন, একই সঙ্গে তথাকথিত বুদ্ধিরও অতীত ও অতিরিক্ত। একমাত্র মোমিনই তার সাক্ষী হতে পারে, যিনি রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে আল্লাহপ্রদত্ত সকল বৃত্তি নিয়ে হাজির থেকে অনুপস্থিতির এবাদত করতে সক্ষম। মোমিনের সাক্ষ্যই উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির সম্পর্ক প্রণয়নের মুহূর্ত। মোমিনই সেই মুহূর্ত যার কর্তাসত্তার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে জাহেলি চুরমার হয়ে যায়, নতুন ইতিহাস নির্মাণের সম্ভাবনা তৈরি হয়। মানুষের মধ্যেই সেই সম্ভাবনা রয়েছে। মানুষ আল্লাহর খলিফা, দর্শন এই ধর্মতাত্ত্বিক প্রস্তাবকে এভাবেই ব্যাখ্যা করবে। আল্লাহর অনুপস্থিতিতে তাঁর কর্তব্য সম্পাদন, সৃষ্টির সুরক্ষা ও দায় পালনের শক্তি মানুষের রয়েছে। তাহলে সাক্ষ্য দেওয়া বা সাক্ষী হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ধারণা বটে। পাশ্চাত্য চিন্তার সঙ্গে ইসলাম যেখানে আলাদা হয়ে যায়।
ধর্ম ব্যক্তি-মনের সত্য/মিথ্যা নির্ণয়ের মামলা নয়। হেগেলীয় অর্থে মানুষের ‘মনের ইতিহাস’ (Phenomenology of the Spirit) যখন আমরা বিচার করতে বসি তখন দেখা যায়, ধর্ম সামষ্টিক জনগোষ্ঠির কোন-না-কোন সাক্ষাৎ উপলব্ধির ওপর দাঁড়িয়ে নিজের সত্য জাহির করে, মানুষ আত্মসচেতন না হলে তার মর্ম ধরা পড়ে না। যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা নিজ নিজ সত্যের নিশ্চয়তা প্রত্যক্ষ উপলব্ধির মধ্য দিয়ে পেতেই পারেন। হেগেলের দাবি ছিল শুধু প্রত্যক্ষ উপলব্ধি হিসাবে সত্য জানা ও প্রকাশের ধরণ আত্মসচেতন চিন্তা বা বুদ্ধির কাছে যথেষ্ট নয়। সেই ক্ষেত্রে মানুষ ধর্মের মর্মকে বুদ্ধির সত্য হিসাবে হাজির করবার দায় নেবার অনিবার্য তাগিদ বোধ করে। আর এটাই দর্শনের কাজ। অর্থাৎ ধর্মের মর্ম শুধু বুদ্ধি দিয়ে নয়, আত্মসচেতন চিন্তার আঙ্গিকে হাজির করা। দর্শনের কারবার সেই একই মর্ম নিয়ে, যা ধর্মেরও বিষয়। বুদ্ধির জায়গায় দাঁড়িয়ে ধর্মের পর্যালোচনার অর্থ হচ্ছে ধর্মের মর্মকে বুদ্ধির ভাষায় প্রকাশ, যাতে মানুষ তার আগাম জানা সত্য সম্পর্কে নিজে সচেতন ও সজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে। উপলব্ধি, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাসহ মানুষের সকল বৃত্তির সামগ্রিক বিকাশ নিশ্চিত করবার জন্য চিন্তার এই আত্মসচেতন সক্রিয়তাই দর্শন। একেই আমরা কখনো জ্ঞান কিম্বা আরো সচেতন অর্থে প্রজ্ঞা বলি।
এই দিক থেকে ধর্মের সত্যকে জ্ঞানের বা প্রজ্ঞার সত্য হিসাবে মানা এবং তার পর্যালোচনার ক্ষেত্রে দর্শনের কোন বাধা নাই। অর্থাৎ ধর্মের সঙ্গে চিন্তার যে বিরোধ আমরা অনুমান করি, হেগেল তা নস্যাৎ করে দিয়েছেন। হেগেলের পুরা দার্শনিক কাজটাই হচ্ছে এই অর্থে ধর্মের পর্যালোচনা- খ্রিস্ট ধর্মের সত্যতা প্রমাণ করা। ধর্মের মধ্যে কোন চিন্তা নাই, চিন্তা বা চিন্তার প্রক্রিয়া ধর্মচিন্তা থেকে আলাদা, এই অনুমানকে বাতিল প্রমাণ করা। এতে তিনি দর্শনের জগতে গৌণ হয়ে যাননি। সেই প্রশ্ন কখনই আসেনি। তর্কটা সত্য প্রকাশের ধরন, রূপ বা আঙ্গিক নিয়ে। হেগেল বুদ্ধির নির্ণয় বা দর্শনের সত্যকেও নির্বিচারে সত্য মানেননি, তারও পর্যালোচনা করেছেন। চিন্তা নিজেকেও নিজে পর্যালোচনা করতে সক্ষম। অর্থাৎ চিন্তা শুধু ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা করে তা নয়, বুদ্ধির পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্তকেও পর্যালোচনা করে। এই চর্চার মধ্য দিয়েই বুদ্ধি প্রজ্ঞা হয়ে ওঠে।
হেগেলের ওপর বারবার জোর দিচ্ছি এ কারণে যে মার্কস হেগেলের পর্যালোচনা করেছেন, সেটা আমরা জানি। মার্কস কিভাবে হেগেলকে আত্মস্থ করেছেন সেই প্রসঙ্গে আমরা আসব। বাংলাদেশে যারা ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকেন, তারা এই অবস্থান মার্কসের বরাতে নিয়ে থাকেন। কিন্তু ধর্মের মধ্যে চিন্তা নাই, কিম্বা মুক্তচিন্তার অর্থ ধর্মের সত্যকে অস্বীকার করা, এই বালখিল্য চিন্তা মার্কসে নাই। মার্কস বরং উল্টা বলেছেন, ধর্ম বরং জগৎ সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধির সত্য হাজির করে, ধর্ম হচ্ছে জগতের তত্ত্ব। মার্কস একবারও দাবি করেননি ধর্ম জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোন তত্ত্ব নির্ণয়ে অক্ষম। একবারও ধর্মের জীবন ও জগৎ সম্পর্কে চিন্তা করবার ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা অস্বীকার করেননি। তবে দাবি করেছেন, যেহেতু খোদ জগৎটাই উল্টা, তাই মানুষের উপলব্ধির মধ্যে প্রতিফলিত জগৎটারও মাথা মাটিতে আর পা আকাশে। এর মীমাংসা হচ্ছে খেয়ে না খেয়ে ধর্মের বিরোধিতা নয়, উল্টানো বাস্তব জগৎটাকে বদলানো। উল্টানো জগৎকে সোজা করলে মানুষের উপলব্ধিও বদলাবে। সারা জীবন সেই কাজ কিভাবে সম্পন্ন করা যায় তার পথ দেখিয়ে দেবার জন্য তিনি কাজ করে গিয়েছেন। সেই কারণে দর্শনের ক্ষেত্র থেকে ধর্ম পর্যালোচনার বিশেষ তাগিদ মার্কস বোধ করেননি। বরং মানুষের ইহলৌকিক জগতের আর্থ-সামাজিক ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। পরিণত বয়সের পুরাটাই কাটিয়েছেন পুঁজি ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের ব্যাখ্যায়। তাঁর কাছে ধর্মের জগৎ অতিক্রম করে যাবার সদর রাস্তা ছিল সমাজ ও ইতিহাসের বৈষয়িক ব্যাখ্যা। মার্কস হেগেল ও ফয়েরবাখের বাইরে নতুন করে ধর্ম পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। অর্থশাস্ত্রই তাঁর ধর্ম পর্যালোচনার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। বিদ্যমান বৈষয়িক বাস্তবতা কিভাবে বদলানো সম্ভব তার প্রতিই তাঁর মনোযোগ ও নিষ্ঠা নিবদ্ধ ছিল।
মার্কসের আগে যারা ধর্মের পর্যালোচনা করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ। আরো ছিলেন ডেভিড স্ত্রাউস, ব্রুনো বাউয়ের, মাক্স স্টারনার, আর্নল্ড রুজ প্রমুখ। হেগেল এদের প্রত্যেককেই সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। কিন্তু এরা হেগেলের দর্শনের পর্যালোচনাও করেছেন। অধিকাংশই হেগেলের চিন্তার পরিমণ্ডল অতিক্রম করে যেতে পারেননি, ব্যতিক্রম ফয়েরবাখ। এরা ‘ইয়ং হেগেলিয়ান’ বা ‘লেফট হেগেলিয়ান’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। জর্মন ভাবাদর্শের সেই জমিনে দাঁড়িয়ে মার্কস বলেছিলেন, ‘জার্মানিতে ধর্মের পর্যালোচনা মোটামুটি শেষ হয়েছে, আর সকল পর্যালোচনার আগে ধর্মের পর্যালোচনা সেরে রাখা দরকার।’ এটা জার্মানি সম্পর্কে বলা, প্রাচ্য সম্পর্কে নয়, প্রাচ্য ধর্ম সম্পর্কেও নয়। এমনকি তর্কের খাতিরে বলা যায়, জার্মানির বাইরে বা প্রটেস্টান্ট ধর্মের বাইরে অন্যান্য ধর্মের পর্যালোচনা শেষ হয়েছে সেই দাবিও এটা নয়। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, প্রাচ্যের এই সকল ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের কথা খাটে না।
পরের কিস্তিতে আমরা ফয়েরবাখ সম্পর্কে আলোচনা করব। হেগেল দর্শনকে ধর্মে পরিণত করে ফেলেছেন, নিজের শিক্ষকের বিরুদ্ধে ফয়েরবাখ এই অভিযোগ এনে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এটাই তাঁর প্রধান অভিযোগগুলোর মধ্যে আমাদের আলোচনার জন্য কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। এই অভিযোগ বিচার করে দেখার মধ্য দিয়ে আমরা হেগেলকে যেমন নতুন করে বুঝব, তেমনি মার্কস ফয়েরবাখের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও কিভাবে ফয়েরবাখের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন সেই দিকগুলো নিয়েও আলোচনার চেষ্টা করব। বুঝব ফয়েরবাখের নাস্তিকতা আর মার্কসের ধর্ম পর্যালোচনার ধারণা এক নয়। এতে আমরা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট নামধারী গণবিচ্ছিন্ন ও ধর্মবিদ্বেষীদের উৎপাতের বাইরে মার্কসের চিন্তার সঠিক মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবো। এতে স্পষ্ট হবে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট নাম নিয়ে ধর্মবিদ্বেষীরা মানবেতিহাসের বৈপ্লবিক ধারা থেকে গণমানুষকে কিভাবে ক্রমাগত বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে চলেছে। অপর দিকে কিভাবে মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের হাতিয়ার হয়ে ইসলামপন্থীরা এখনও শেরেকির বিরুদ্ধে লড়াই স্থগিত রেখে নাস্তিকতা ও নাস্তিক কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ঘুরিয়ে চলেছে। আমরা তরুণ কার্ল মার্কসের কথার প্রতিধ্বনি তুলে এটাও বোঝার চেষ্টা করব কেন কমিউনিজম কোন স্থিরনির্দিষ্ট পাথরে লিখিত মতাদর্শ নয়, বরং মানবেতিহাসের সেই অভিমুখ, যা মানুষের স্বরূপ বা স্বভাবের অন্তর্গত। প্রজাতি হিসাবে দুনিয়ার সকল মানুষের সঙ্গে ঐক্যের বন্ধনে মিলিত হবার তাগিদ থেকে মানুষ বারবার নতুন করে সেই অভিমুখ আবিষ্কার করে। সেই গন্তব্যে মানুষ পৌঁছাবেই যেখানে পরিবার, রক্ত, গোষ্ঠি, গোত্র, জাতি, ভূগোল, ভাষা, সংস্কৃতি কিছুই মানুষকে অপর মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাধা হবে না, কারণ এই সব কোন কিছুই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্মাণের, সমাজ গঠনের ভিত্তি নয়, হতে পারে না। হেগেলের প্রতিধ্বনি করে বলা যায়, এটা ঘটবেই কারণ চিন্তা নিজের পরিমণ্ডলেই জানতে পারে, আল্লাহ একমাত্র আল্লাহই সত্য। ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ধর্মের এই সারকথা অনুধাবন আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।

৮ আগস্ট ২০১৫। ২৪ শ্রাবণ ১৪২২। শ্যামলী

পূর্ব প্রকাশিত-  নয়াদিগন্ত 

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *