ইসলাম জিন্দা হয় প্রতিবার, কারবালার পর

মহররম এবং অভিন্ন হিজরি ক্যালেন্ডার
মহররম এসে গেছে। পাঠক এই কলাম পড়ছেন বুধবার ২১ অক্টোবর ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ, ৬ কার্তিক ১৪২২ বাংলা সন, অর্থাৎ বাংলাদেশের হিসাবে ৭ মহররম ১৪৩৭ হিজরি। সৌদি আরবসহ অনেক দেশে, বাংলাদেশের সাথে, হিজরি বা ইসলামি ক্যালেন্ডারে এক-দুই দিনের পার্থক্য আছে। অ্যাসট্রোনমি বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বা নভোমণ্ডলের বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগে, আমাদেরকে এই বিষয়টির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশের অনেক মনীষী প্রস্তাব দিয়েই চলছেন যে, মুসলিম বিশ্বের একই ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা উচিত। আবার কিছু মনীষী এরূপ প্রস্তাবের বিপক্ষে। তাই এই বিষয়ে গবেষণা এবং সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। যা হোক, আমরা মহররম প্রসঙ্গে আসি।
মহররম মাসের ১০ তারিখ দ্বীন ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। মানবাধিকারের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। সত্য ও মিথ্যার সঙ্ঘাতের আঙ্গিকে গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের কল্যাণে আত্মত্যাগের আঙ্গিকে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেকেই এই আঙ্গিকগুলো প্রসঙ্গে সচেতন নই। তাই সংক্ষিপ্তভাবে শুধু একটি আঙ্গিক এখানে উপস্থাপন করছি; যথা- ১০ মহররম কারবালার ময়দানের ঘটনা। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘মহররম’ কবিতাটি পড়ার আহ্বান জানাচ্ছি। স্থানাভাবে এখানে এই কলামে সেই বিখ্যাত মর্মস্পর্শী কবিতাটি উদ্ধৃত করছি না। যেদিন আমার কলাম আপনারা পড়বেন, সেদিন আমার ফেসবুক পেজে এই কবিতাটি উদ্ধৃত করে দেবো। ফেসবুজ পেজের শিরোনাম ‘মেজর জেনারেল-অব: সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক’

ইসলামের যুদ্ধগুলো প্রসঙ্গে রচনা
আট-নয় বছর আগে, ২০০৮ সালের শুরুতে, (বর্তমান সরকার কর্তৃক বন্ধ করে দেয়া) ইসলামিক টিভির তৎকালীন চেয়ারম্যান (মরহুম) অবসরপ্রাপ্ত মেজর সাইদ ইস্কান্দার আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করেছিলেন একটি বিশেষ ইসলামি অনুষ্ঠান তাদের টিভিতে করার জন্য। টিভি চ্যানেলের নাম ছিল ইসলামিক টিভি; প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানটি যথার্থই নামের সাথে ও টিভি চ্যানেলের উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অনুষ্ঠানটি ছিল এইরূপ: ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোকে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করা। তবে উপস্থাপন করতে গিয়ে একইসাথে দু’টি আঙ্গিক খেয়াল রাখতেই হবে। প্রথম আঙ্গিকটি হলো, কয়েকটি যুদ্ধ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে। মহানবী সা:-এর আমলের সবগুলো যুদ্ধ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদিসে উল্লেখ আছে। অতএব, পবিত্র কুরআন ও হাদিসে উল্লিখিত ইশারা বা ব্যাখ্যা খেয়াল রাখতেই হবে। তার সাথে যুক্ত হবে দ্বিতীয় আঙ্গিক তথা সামরিক ব্যাখ্যা বা যুদ্ধবিদ্যার যে বিজ্ঞান, এর ব্যাখ্যা। সাইদ ইস্কান্দারের মতে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যেহেতু একজন গ্রহণযোগ্য সামরিক বিশ্লেষক এবং তিনি কষ্ট করে চেষ্টা করলে ইসলামি আঙ্গিকটি যুক্ত করতে পারবেন, তাই ইবরাহিমকেই অনুরোধ করেছিলেন ওই অনুষ্ঠানমালা করতে। পর পর ১৩ সপ্তাহে, ১৩টি ভিন্ন পর্বে, ইসলামের ১৩টি যুদ্ধের বর্ণনা বাংলাভাষী টেলিভিশন দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করার দুর্লভ সুযোগ আমার হয়েছিল। সময়টা ছিল মার্চ-এপ্রিল ২০০৮। আমি মনে করি, এটি মহান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি বিশেষ দয়া। কারণ, মহানবী সা:-এর আমলের যুদ্ধগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে, আমাকে সবিশেষভাবে জানতে হয়েছে এবং আমার সেই অর্জিত ক্ষুদ্র জ্ঞান দেশবাসীর সাথে শেয়ার করতে পেরেছি। কয়জনের সৌভাগ্য হয় মহানবী সা:-এর যুদ্ধের নেতৃত্বের বিষয় অন্যের সামনে উপস্থাপন করার। তা শতভাগ আদবের সাথে, শতভাগ রাসূলপ্রেমের সাথে নাও হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটিগুলোর জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী; নিশ্চিতভাবেই মহান আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করতে পারেন।

একটি ব্যতিক্রমী বই
টেলিভিশনের সেই ১৩টি মৌখিক উপস্থাপনা, পরবর্তী সময়ে, লিখিতভাবে বইয়ে প্রকাশ করার মতো করে সাজানো হয়েছিল। বিখ্যাত প্রকাশক ‘অনন্যা’ বইটি প্রকাশ করেছিলেন। বইটির নাম ‘দি ব্যাটেলস অব ইসলাম’ (বা ইসলামের যুদ্ধগুলো)। সেই বইয়ের ১২তম অধ্যায় হচ্ছে কারবালা ময়দানের যুদ্ধ। বিশদভাবে প্রেক্ষাপটসহ বইটির পরিচয় দিলাম একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। তা হচ্ছে সম্মানিত পাঠককুল, বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়, ইসলামের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যেন জানতে চেষ্টা করে। যেসব ছাত্রছাত্রী স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ইসলামের ইতিহাস পড়েন, বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের স্টাডিজ পড়েন, বা মাদরাসায় পড়েন, শুধু তারা জানলে হবে না। ইতিহাসের উত্তরাধিকারী আমরা সবাই। বইটি নিশ্চিতভাবেই বাজারে অনেক জায়গায় পাওয়া যাবে, কিন্তু প্রেস ক্লাবের নিচে ‘বাতিঘর’ নামক দোকানে, ঢাকা পুরনো বিমানবন্দরের পাশে বুক ওয়ার্ম নামক দোকানে অথবা নাটক সরণি খ্যাত বেইলি রোডে সাগর পাবলিশার্সে অবশ্যই পাবেন।

হজরত আলী রা: ও হজরত মু’আবিয়া রা:
৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ৮২ বছর বয়সে, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান রা: বিদ্রোহী আততায়ীদের হাতে শহীদ হওয়ার পর হজরত আলী রা: তৎকালীন ইসলামি রাষ্ট্রের খেলাফতের দায়িত্ব নিতে, প্রথমে, বিনীতভাবে অস্বীকার করলেও, কয়েকজন বিশিষ্ট সাহাবির অনুরোধে পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁর এই দায়িত্বগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেননি। এর তিনটি উদাহরণ : মিসরের তৎকালীন শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ বিন সা’দ বিন সবুর, সিরিয়ার তৎকালীন শাসনকর্তা ও বিশিষ্ট সাহাবি হজরত মু’আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান এবং তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান রা:-এর মন্ত্রণা সচিব হজরত মু’আবিয়ার দূরের চাচাতো ভাই মারওয়ান বিন হাকাম।
হজরত আলী রা: ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জুন তথা ৩৫তম হিজরি বছরের জিলহজ মাসের ২৫ তারিখে মদিনার মসজিদে উপস্থিত মুসলমানদের আনুগত্য গ্রহণ করত খলিফার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। দায়িত্ব গ্রহণের কয়েক মাসের মধ্যেই একটি বিদ্রোহ বা যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হয়, ইতিহাসে যাকে বলা হয় ‘উটের যুদ্ধ’। অতঃপর তিনি চেলডিয়া ও মেসোপটেমিয়ায় বিদ্রোহ দমন করেন। এগুলো শেষ হতে না হতেই সিরিয়ার শাসনকর্তা হজরত মু’আবিয়া বিদ্রোহ শুরু করেন। এরূপ প্রেক্ষাপটে তিনি প্রশাসনিক রাজধানী মদিনা থেকে ইরাকের কুফা নামক স্থানে স্থানান্তর করেন। উল্লিখিত যুদ্ধের একপর্যায়ে, একটি সন্ধি হয় মু’আবিয়ার পক্ষের সাথে। ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ তথা ৪০তম হিজরি বছরের ১৭ রমজান তারিখে রাজধানী শহর কুফায় হজরত আলী রা: আততায়ীর আক্রমণে শাহাদতবরণ করেন। কুফা শহরের পাশ দিয়ে ফোরাত নদী বহমান ছিল। ওই নদীর প্লাবন থেকে কুফা শহরকে বাঁচানোর জন্য একটি শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। ওই বাঁধের পাশেই হজরত আলী রা:-কে সমাহিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে, ক্রমান্বয়ে ওই স্থানে ‘নাজাফ’ শহর প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে নাজাফ মুসলিম বিশ্বের একটি বড় অংশের কাছে অতি পবিত্র শহর।

হজরত হাসান রা: ও হুসাইন রা:
কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ১০ মহররম তারিখে। আর তিন দিন পর বাংলাদেশে ১০ মহররম পালিত হবে। পৃথিবীর অন্যত্র দিবসটিকে কিরূপ গুরুত্ব দেয়া হবে কি, হবে না, সে সম্বন্ধে মন্তব্য করছি না। কিন্তু আমি কামনা করি, বাংলাদেশের তরুণেরা যেন কারবালার যুদ্ধকে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করেন। তাৎপর্য অনুধাবন করেন কারবালার যুদ্ধের। ওই যুদ্ধে যিনি নিষ্ঠুর পরিস্থিতির শিকার হয়ে শাহাদতবরণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী, রাহমাতাল্লিল আলামিন হজরত মুহাম্মদ সা:-এর অতি প্রিয় এবং স্নেহের কনিষ্ঠ নাতি হজরত ইমাম হুসাইন বা (বানান ভেদে) হোসেন রা:। তিনি চতুর্থ হিজরির ৫ শাবান মোতাবেক ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রা: এবং মা রাসূল সা:-এর কন্যা হজরত ফাতেমা রা:।
হজরত আলী রা: শাহাদতবরণের পর, তাঁর বড় ছেলে অর্থাৎ হুসাইন রা:-এর বড় ভাই, ৩৬ বছর বয়সে ৪০ হিজরিতে ইরাক প্রদেশে খলিফা নির্বাচিত হন এবং সেখান থেকেই হিজাজ ও খোরাসান প্রদেশও শাসন করতেন। তাঁর শাসনকালের চার মাসের মাথায়, তৎকালীন অপর শাসনকর্তা মু’আবিয়া কর্তৃক পুনরায় যুদ্ধ উসকে দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হলো। সন্ধির অন্যতম শর্ত মোতাবেক, হজরত হাসান রা: মু’আবিয়ার অনুকূলে খেলাফত ত্যাগ করেন। তিনি ক্ষমতা পরিত্যাগ করে মদিনায় চলে যান। সন্ধির অপর শর্ত ছিল, মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর হজরত হাসান রা:-এর ছোট ভাই ইমাম হুসাইন রা: খলিফা নির্বাচিত হবেন।
৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে মু’আবিয়ার মৃত্যু হলে তার পুত্র ইয়াজিদ ক্ষমতা দখল করেন এবং পিতা কর্তৃক সম্পাদিত চুক্তি মান্য করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এর ফলে তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মতে, উম্মাহর ধর্মীয় নেতা ও ইসলামি রাজ্যের শাসনকর্তা তথা খলিফা হওয়ার কোনো প্রকার চারিত্রিক, নৈতিক, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইয়াজিদের মধ্যে ছিল না। এই কারণে, হজরত আলী রা: ও ইমাম হাসান রা:-এর ইরাকি সমর্থকেরা ইয়াজিদ কর্তৃক বেআইনি ও অনিয়মিত বা প্রথাবহির্ভূত পদ্ধতিতে ক্ষমতার আসনে আরোহণ করায় তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।

হুসাইন রা: দায়িত্ব নেয়ার প্রেক্ষাপট
এইরূপ ঘটনাবলির সময় ইমাম হুসাইন রা: অস্থায়ীভাবে পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করছিলেন। সঙ্কটপূর্ণ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে কুফাবাসীদের উপর্যুপরি আমন্ত্রণ ও আনুগত্যের আশ্বাসে ইমাম হুসাইন রা: মুসলমানদের পক্ষে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হন। ওই সময় কোনো কর্মপন্থা সুনিশ্চিতভাবে অবলম্বন করার আগে ইমাম হুসাইন রা: তাঁর একজন জ্ঞাতি ভাইকে (মুসলিম ইবনে আকিল) পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য ইরাকের কুফা নগরীতে প্রেরণ করেন। সেখানে হাজার হাজার মুসলমান, মুসলিম ইবনে আকিলকে সাক্ষী রেখে ইমাম হুসাইন রা:-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। সেই হাজার হাজার মুসলমানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই, মুসলিম ইবনে আকিল ইমাম হুসাইন রা:-কে পত্র লিখেন যে, তিনি যেন মক্কা ত্যাগ করে ইরাক চলে আসেন। ইতোমধ্যে ইয়াজিদের খ্রিষ্টান উপদেষ্টাদের পরামর্শ মোতাবেকÑ ইয়াজিদ ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদকে কুফার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। দায়িত্ব নিয়েই ওবায়দুল্লাহ তাৎক্ষণিকভাবে মুসলিম ইবনে আকিলকে বন্দী ও হত্যা করে। এই বন্দী করা ও হত্যা করার বিষয়টি ইমাম হুসাইন রা: জানতে পারেননি। তিনি খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার লক্ষ্যে, রাজধানী কুফা শহরের উদ্দেশে ৬০ হিজরি সালের জিলহজ মাসের ৩ তারিখে মক্কা ত্যাগ করে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, স্বেচ্ছাচারী শাসনের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য যেসব মুসলমান ইমাম হুসাইন রা:-এর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন তাদের সাহায্য করা তিনি কর্তব্য বলে মনে করলেন। কুফার উদ্দেশে অগ্রসরমান ইমাম হুসাইন রা:-এর দলটি ছিল অতি ক্ষুদ্র, তথা পরিবার-পরিজন ও পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি দল। কোনো অবস্থাতেই, কোনো যুদ্ধের দল বা কন্টিনজেন্ট নয়।

কারবালার প্রান্তরে বাধ্যতামূলক অবস্থান
কুফা আসার পথেই এই দলটি ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদের অশ্বারোহী বাহিনীর নজরদারিতে পড়ে। এই অশ্বারোহী বাহিনী ইমাম হুসাইন রা:-এর দলকে অগ্রযাত্রা বন্ধ করতে আহ্বান জানায় এবং ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করার দাবি জানায়। কিন্তু ইমাম হুসাইন রা: এই দাবি মানতে অস্বীকার করেন। কারণ, এই দাবি মেনে নেয়ার অর্থই ছিল অন্যায় ও অসত্যের সাথে, স্বেচ্ছাচারিতার সাথে আপস করা তথা নতিস্বীকার করা। শেষ পর্যন্ত ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে হুসাইন রা:-এর দল অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ফোরাত নদীর ইংরেজি নাম ইউফ্রেটিস। এই ফোরাত নদীর তীরে তখনকার আমলের কারবালা প্রান্তর ছিল ধু-ধু মরুভূমি। এখানে শত্রুপক্ষ ইমাম হুসাইন রা:-এর দলকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার নিমিত্তে ফোরাত নদীর পানি ব্যবহার করার সব পথ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী কয়েকটি দিন শ্বাসরুদ্ধকর এবং একতরফা শক্তি প্রদর্শনের চূড়ান্ত নমুনা ছিল। অবরুদ্ধ অবস্থায় ইমাম হুসাইন রা:-এর দল কুফা থেকে সাহায্যকারী বা সমমনা দল আশা করেছিলেন। কিন্তু কুফা থেকে অনুগত মুসলমান বাহিনীও বিভিন্ন কারণে তথা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, ইমাম হুসাইন রা:-কে সাহায্য করার জন্য কারবালার উদ্দেশে রওনা হতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতেই, ১০ মহররম ৬১ হিজরি সকালে জনৈক উমার ইবনে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ৪০০০ উমাইয়া সৈন্যের সেনাপতি হিসেবে ইমাম হুসাইন রা:-এর মাত্র ৭০ বা ৭২ সদস্যসংবলিত দলের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দণ্ডায়মান হয়। আত্মসমর্পণে আবারো অস্বীকৃতি জানানোর পর, উমাইয়া বাহিনী ইমাম হুসাইন রা:-এর ক্ষুদ্র দলটিকে আক্রমণ করে। ইমাম হুসাইন রা: বাহিনীর সবাই শাহাদত বরণ করেন।

কারবালার আত্মত্যাগের মূল্যায়ন
বড় ও বিস্তৃত একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে মাত্র তিনটি অনুচ্ছেদে, সারমর্ম করে প্রকাশ করা কঠিন কাজ। অতএব ভুলভ্রান্তি মার্জনীয়। অনুরূপভাবে, মূল্যায়নও বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করতে পারছি না। কারবালার ময়দানে ইমাম হুসাইন রা:-এর শাহাদতের ঘটনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইতিবাচক যে প্রসঙ্গটি সবার আগে বলতে হবে, সেটি হলোÑ বেদনার পাশাপাশি একটি মহিমান্বিত আঙ্গিক আছে। কারণ সত্য ও ন্যায়, সাম্য ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরাচারী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন রা: যেভাবে বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ত্যাগ চিরকাল এই জাতীয় সঙ্কট ও সমস্যা ও উত্তরণে অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে। কারবালার ময়দানের ঘটনার পরই, ইয়াজিদের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মুসলিম জাতি পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। মুসলমানেরা আবার ঘুরে দাঁড়ায়। এই ঘটনা মুসলিম জাতিকে তাদের ভেতরের শত্রু কারা, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে সাহায্য করে। পরবর্তীকালেও ইতিহাস সাক্ষী, মুসলমানেরা যখনই শত্রু আর মিত্র চিনতে ভুল করেছে তখনই তারা বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। কারবালার ঘটনাটির বড় প্রভাব হলোÑ খেলাফতের পর, গত প্রায় সাড়ে তেরো শ’ বছরের মুসলিম উম্মাহর ভেতর, দ্বীন ইসলাম রক্ষার যে চেতনা ও শৌর্য-বীর্য আপন মহিমায় ভাস্বর রয়েছে, তার পেছনে কুরআন ও সুন্নাহর পরে ইসলামের ইতিহাসের যে ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সক্রিয় হয়েছে, কারবালার ঘটনা তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। কারবালার ঘটনায় যুদ্ধ হয়েছিল মুসলমানদের মধ্যেই। এক পক্ষে তথা শক্তিশালী পক্ষে ছিল মুসলমান নামধারী মুনাফেক, স্বার্থপর, ভোগবিলাসী ও রাজতন্ত্রের অনুরাগী মানুষ। কারবালার ঘটনার মাধ্যমে শাসকেরা বিজয়ী হয়েছিল; কিন্তু নন্দিত হতে পারেনি। অন্যায় করে বিজয় অর্জন করলেও যে ধিকৃত হতে হয়, কারবালার ঘটনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আমার কারবালা সফর
একটি অনিন্দ্য সুন্দর ও মূল্যবান ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা না বললেই নয়। আমার চাকরিজীবনে এবং অবসর জীবন শুরু হওয়ার পরে ২০০১ পর্যন্ত সময়ে, অনেক দেশে গিয়েছি সরকারি কাজে, সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশ নিতে অথবা বেড়াতে। কিন্তু তখন পর্যন্ত ঐতিহাসিক দেশ ইরাকে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ২০০২ সালের মে মাসে একবার এবং অক্টোবর মাসে আরেকবার আমার সুযোগ হয়েছিল ইরাক সফর করার। মনের অভ্যন্তরে দীর্ঘ দিন ধরে লালিত ইচ্ছা বাস্তবায়ন হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো জিয়ারত করার এবং ইতিহাসের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকে মূল্যায়ন করার। দু’বারই আমাদের দলে মোট তিনজন ছিলাম। প্রথমবার গিয়েছিলাম ১২ রবিউল আউয়াল তথা ঈদে মিলাদুন্নবী সা: উপলক্ষে বাগদাদ নগরীতে সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম সাদ্দাম হোসেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটের দিন নির্বাচনী পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে। উভয়বারই হজরত ইউনুস আ:-এর সমাধি, হজরত আলী রা:-এর সমাধি, কারবালা নগরীসহ অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলাম। মহান আল্লাহর কাছে অফুরন্ত শুকরিয়া। শুধু পাঠকের মনের ভেতরে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা সচল রাখার জন্য মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, আমাদের সফরের ছয় মাস পরে, ২০০৩ সালের শুরুর দিকেই আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করেছিল।

(পূর্ব প্রকাশিত : ২১ অক্টোবর ২০১৫ নয়া দিগন্ত )

Loading

Comments are closed.