বাংলাদেশে একাধিক ইসলামিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে এটাই বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে ইসলামি পুনর্জাগরণে ইসলামিক রাজনৈতিক দল করাটাই যেন অপরিহায্য! কিন্তু এটি যে একটি ভ্রান্ত ধারণা বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বের ভূরাজনৈতিক পরিবেশে সে ব্যাপরে আজকের আলোচনাটিতে কিছু কথা রাখতে যাচ্ছি।
রাজনীতি মানব সভ্যতার একটি প্রয়োজনীয় বিষয়। এটি দিয়ে রাষ্ট্রের ও মানুষের উপকার করা সম্ভব। রাজনীতি দিয়ে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়, তাই রাজনীতির প্রতি সচেতন মানুষের আগ্রহ সবসময় থাকে। তবে কারো রাজনৈতিক কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা নির্ভর করে রাজনীতি কে করছে বা একটি দেশে রাজনীতিতে কারা আপার হেন্ডে আছে। এ কথা সত্য যে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কার্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা, তবে নেতৃত্ব কলুষিত হয়ে গেলে রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিবর্তে মানুষের ভাগ্যে নেমে আসে অবধারিত দুর্যোগ।
একজন ধর্ম প্রাণ মুসলিম যদি মনে করেন তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মানুষের কল্যাণ করবেন তাকে সাধুবাদ দেয়া যায়।
কিন্তু সে জন্য কি তাকে “ইসলামী রাজনীতি” করছেন বা করতে চান বলে একটি দল করতে হবে ?
যারা তা করতে বলেন তাদের এখানে যুক্তি হচ্ছে একটি দল গঠন করে সুশৃঙ্খল কর্মী বাহিনী তৈরি করতে না পারলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ভাল কথা। কিন্তু সেটি রাজনৈতিক দল কেন হতে হবে? আপনি একাডেমিক সংস্থা করতে পারেন, লিডারশীপ ট্রেনিং সেন্টার খুলতে পারেন যার মাধ্যমে একটি শিক্ষিত, ইসলামী আদর্শে দীক্ষিত দক্ষ যুব সমাজ গড়ার পরিকল্পনা করতে পারেন । যা দিয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা যায় দেশ ও জাতীর কল্যাণে।
রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হতে হয় রাষ্ট্রের সকল মানুষের সমান অধিকার, তাদের স্বার্থ রক্ষা ও নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু কোন বিশেষ ধর্মীয় নামের এ রকম একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে যখন আপনি মানুষের কাছে যাবেন তখন এটিকে ভারতের মুদীর দলের মত সাম্প্রদায়িক দল হিসাবেই তো সাধারণ মানুষ দেখতে পাবে। যেহেতু আপনার রাজনৈতিক দল হচ্ছে ইসলামী দল তাই সে দলে রাষ্ট্রের এক জন নাগরিক যদি সৎ এবং ভাল মানুষ হয় কিন্তু সে অন্য ধর্মের মানুষ তাকে রাখতে পারছেন না, তাহলে ভারতের হিন্দু জাতিয়তাবাদী রাজনীতিক দল “আরএসএস বা শিব সেনা” আর আপনার দলের মাঝে তফাৎ রইল কোথায়?
ইসলামের নামে যারা রাজনৈতিক দল করেন, তাদের কথা হচ্ছে তারা সেটি করছেন কারণ তারা দেশে ইসলাম কায়েম করতে চান। কি সুন্দর কথা! কিন্তু এখানে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সমস্যাটা দেখা দেয় সেটি তারা বুঝতে পারেন না। এখন কেউ যদি বলে আপনাদের দলে যেহেতু অন্য ধর্মের মানুষকেই রাখতে পারছেনা সেখানে আপনি ক্ষমতায় গেলে অন্য মানুষের বিশ্বাসের প্রতি আপনার কতটুকু শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা থাকবে তা তো বুঝাই যাচ্ছে!
আল্লাহ যেখানে রাসুলকে বলেন আমি চাইলে সবাইকে মুসলিম বানিয়ে দিতাম সে ক্ষমতা আমার আছে। হে নবী তোমার কাজ মানুষকে সত্যের দাওয়াত দেয়া। তারা বলবেন,”আরে ভাই, আপনি বোঝতে পারেন নাই আল্লাহ বলেছেন মহা বিশ্বের সব কিছুতে “আল্লাহর সার্বভৌমত্ব” আছে।
কিন্তু সার্বভৌমত্ব বলতে আপনি কি বুঝেন?
সার্বভৌমত্ব কথাটি এসেছে আধুনিক রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নীতি নির্ধারণ করতে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে। এটির সাথে আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ এর কোন সম্পর্ক নাই।
তথাকথিত এ সব ইসলামিস্টদের শ্লোগান হচ্ছে “আল্লাহর জমিনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম করতে হবে” । আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বলতে তারা কুরআনের কয়েকটি ‘নির্বাচিত’ আয়াত আনেন এবং তাদের মতো করে ব্যাখ্যা জুড়েন। যেমন, ‘লাহু মা ফিস-সামায়াতি ওয়ামা ফিল আরদ’ অর্থাৎ আল্লাহই দুনিয়া ও আসমানের সব কিছুর মালিক (সুরা বাকারা: ২৫৫), সুরা নাসের, ‘মালিকিন্নাস’ (যার অনুবাদ তারা করেন মানবজাতির শাসক, এটা ভুল অনুবাদ),তারপর ‘মালিকুল মুলক (রাজত্বের মালিক), এই ধরনের কয়েকটি আয়াত তাদের আস্তিনে থাকে।
কিন্তু এগুলো হচ্ছে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ ও সার্বিক অর্থের: আল্লাহ সবকিছুর মালিক, সারা জাহানের মালিক –এটা বুঝাতে। এতে ব্যক্তি-মালিকানা, জনগোষ্ঠীর মালিকানা, বা রাষ্ট্রের মালিকানা উড়িয়ে দেয়ার অর্থে নয়। রাজার দেশে রাজা মালিক, তিনি সার্বভৌম, কিন্তু আমরা আমাদের বাড়ি-ঘরের মালিক এবং আমাদের সম্পদের তদারকি আমাদেরই, এটাই স্পষ্ট অর্থ। আমাদের মালিকানা রাজার সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কিন্তু,এতদসত্ত্বেও, কেউ যদি শব্দের টানাটানি করে আল্লাহর ‘সার্বভৌমত্ব’ দেখাতে ‘মানুষের রাষ্ট্রকে’ মানুষের তদারকি বহির্ভূত করে আল্লাহর তদারকিতে নিয়ে আসতে চায়, তাহলে সে সমস্যারই সৃষ্টি করবে।
ইসলামি ইতিহাসে আইনের ব্যাখ্যা-সাপেক্ষতার কারণে ১৭৩ দলে মারামারি করছে, এই মারামারি হচ্ছে ‘ব্যাখ্যার’ যুদ্ধ। টেক্সট ও ব্যাখ্যা এক জিনিস নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ (স:) এসে ছিলেন সেই সপ্তম শতাব্দীর এমন একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ নিরক্ষর মানুষের একটি সমাজে যার প্রেক্ষিতে এমন কি নবী (স:) নিজেও বলেছেন, “আমরা হচ্ছি একটি উম্মী জাতী।” তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, সেই সমাজটি ছিল বিভিন্ন কাবিলা বা গোত্রীয় দল উপদলে বিভক্ত এবং তখনকার যুগটি ছিল পুরুষ শাসিত আভিজাত্য বর্বরতা মানসিকতার একটি যুদ্ধংদেহী (Warrior Nation) জাতীয়তাবোধের সমাজ।
আল্লাহর অশেষ কৃপায় রাসুল (স:) অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে তিনি সেখানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন এবং তার কর্ম প্রচেষ্টাকে জাহেলী যুগের সংস্কার এবং আল্লাহর একত্ববাদ বা তৌহিদ প্রতিষ্ঠার সফল দৃষ্টান্ত হিসাবেই ইতিহাস প্রমাণ করে। যার ধারাবাহিকতায় আজ বিশ্বে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন মানুষ এক আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষী দেয়! এত মানুষ এক আল্লাহকে সিজদা করে! এত বড় মুসলিম পরিবার! তবে এই পরিবারের ৬৬ শতাংশ সদস্যের বসবাস এশিয়ায়। যাক আমি সে দিকে যেতে যাচ্ছিনা।
আসল কথা হচ্ছে আজকের পৃথিবী অনেক পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। আজ মানুষ ধর্মকে বুঝতে যে ধরনের প্রশ্ন করে তার অনেক কিছুই সেই আগের যুগের মানুষের চিন্তা ভাবনা থেকে অনেক ভিন্ন ও জটিল! আজকের সমাজ সকল মতের ও ধর্মের মানুষের অধিকার চায় এবং সবাইকে নিয়ে শান্তিতে সহ-অবস্থানের দাবী করে। তাই এখানে যদি ধর্মীয় আদর্শকে সমাজে চালু করতে চান তা হলে সেটি যুগোপযোগী ধর্মীয় শিক্ষা ও জ্ঞান বিতরণ করেই সম্ভব। ধর্মের নামে রাজনীতি করে নয় তাতে মুসলিম ঐক্য যেমন হবে না তেমনি ধর্মকেও শক্তিশালী করা যাবে না। বাংলাদেশের একটি সাধারণ উদাহরণ দেয়া যায় যেমন ধর্ম প্রতিষ্ঠা তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার নামের একটি দল রাজনীতি করে তাদেরকে ভুলেও ভোট দিতে চাইবে না যারা তবলিগ করে ঠিক যে ভাবে সালাফিরা ভোট দেয়না মুসলিম ব্রাদারহুডকে।
তা হলে কি করতে হবে?
রাজনীতি করবেন সবাইকে নিয়ে, এবং সেখানে সকল ধর্মের ও লিঙ্গের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। সেকুলারিজমকে, গণতন্ত্রকে আপনি ব্যবহার করবেন আপনার ধর্মীয় অধিকার আদায় করতে – এতে অসুবিধা কোথায়? সমাজের সকল স্থরের মানুষের কথা, তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে আপনি ক্ষমতায় যাবেন। রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে ধর্মের বুলি আওড়ায়ে নয় বরং তা করতে হবে মানুষের দাবী আদায়ের কথা বলে।
রাজনীতি করে এ বিশ্বে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব আপনাকে কায়েম করতে হবে না। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অলরেডি প্রতিষ্ঠিত আছে এ বিশ্বের সর্বত্র। আল্লাহ যখন ঝড় তুফান দেন কেউ কি তা বন্ধ করতে পারে? মানুষকে যদি আল্লাহ নিজেই বিশ্বাস ও অবিশ্বাস করার কিংবা তার আইন না মানার ব্যক্তিগত অধিকার দিয়ে থাকেন তাহলে আমি, আপনি কে মুনশিয়ানা করার? আপনি ইসলামের বিশ্বজনীন ন্যায় বিচার বা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কথা বলতে পারেন এবং যুক্তি দিয়ে মানুষের সাথে উত্তম আচরণ ও ব্যবহার দিয়ে তাকে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে।
ইসলামি ইতিহাসে আইনের ব্যাখ্যা-সাপেক্ষতার কারণে ১৭৩ দলে মারামারি করছে, এই মারামারি হচ্ছে ‘ব্যাখ্যার’ যুদ্ধ। টেক্সট ও ব্যাখ্যা এক জিনিস নয়। আমরা সেই যুদ্ধ আর চাই না। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম তা চায় না।
এখন স্বল্প সংখ্যক লোকের ব্যাখ্যার টানাটানিতে আমাদের দেশে আরেক ধরনের যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ সকল জনগোষ্ঠীর। এখানে উলটাপালটা বক্তব্য মানুষের জীবনকে বিপন্ন করবে, মানুষ সেটা চায় না। সুতরাং স্পষ্ট অর্থকে নারিংবিরিং করে, আল্লাহর নামে রাজ্য হাতে নেয়ার যুদ্ধের প্রয়োজন নেই। আল্লাহর রাজ্যের কোন অভাব নেই, তার জন্য কোন দেশকে “আল্লাহর দেশ” করার দরকার নেই।
অতএব ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য ইসলামী রাস্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্য ইসলামিক রাজনৈতিক দল করা হচ্ছে ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়িয়ে দেয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা!