ইতিহাস ও মডেল

ইরানে ইসলামী বিপ্লব হয়েছিল। তারা কতটুকু  সফল তা আল্লাহই জানেন।  তুর্কীতে ইসলামী বিপ্লব হয়েছে তারা সফল -তাও আল্লাহ জানেন। কিন্তু কোথাও ‘ইরানি-মডেল’, ‘তুর্কী-মডেল’ বলে কিছুই প্রতিষ্ঠিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি সেই আন্দোলনগুলো কীভাবে তাদের ঐতিহাসিকতায় এবং নিজেদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাধাগ্রস্ততা অতিক্রমের জন্য কোন কোন সুষ্টু নিয়ম-পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল, সেই আলোচনা না করবেন। তারপর আপনাকে দেখাতে হবে কীভাবে তা ‘মডেল’ হয়।

আমাদের দেশের কিছু লোক অন্য দেশের কিছু একটা সফলতা দেখলেই সেটাকে ‘মডেল’ ভেবে এর পিছনে দৌড় দিতে থাকেন। কালের প্রবাহে এই লোকদেরকে কখনো ‘এটা’ কখনো ‘সেটা’ এর পিছনে দৌড় দিতে দেখা যায়।

প্রত্যেক দেশের মানুষের কিছু বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য থাকে। ইবন খালদুনের পরে, ফরাসী দার্শনিক মন্টেস্কিই (Montesquieu, 1689-1755) ইউরোপীয় সমাজ বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের প্রথম ব্যক্তি যিনি সামাজিক বৈশিষ্ট্যের আলোচনায় দেশের আবহাওয়া, ভূমি-বৈশিষ্ট্য ও খাদ্যদ্রব্যের প্রভাবকে সামনে আনেন। মানুষ কোন ধরনের খাবার বেশি খায়, সেই খাবারের উপাদানগুলো কী, সেই খাবার ভূমি থেকে কোন ধরণের পদার্থজাত পুষ্টি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং সেই পুষ্টিসমগ্র শরীর ও মানসিকতা গড়তে যে ভূমিকা পালন করতে পারে -সেটাও তিনি আলোচনার অংশ হিসেবে দেখেন। তার অবলোকন ছিল বহুমাত্রিক পদ্ধতিগত (taxonomic)। আজ মুসলিম দেশের সংগঠনগুলোকে নিজ নিজ দেশের বৈশিষ্ট্যের আলোকে আন্দোলন দেখতে হবে এবং সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে সেইসব উপাদান ও বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দিতে হবে -চিন্তা করতে হবে। ইরানীরা যা করতে পারবে, বাঙ্গালও কী তা’ই করতে পারবে? অথবা তুর্কীরা যা পারবে, সেটি কি তারাও পারবে? প্রত্যেক দেশের নিজ ঐতিহাসিকতা রয়েছে, ব্যক্তি ও সামাজিক ভিন্নতা রয়েছে –সমাজ পরিবর্তনে এসব বিবেচনা আসতে হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে দু/চারটি দেশের কিছু আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনার নাম সেই আন্দোলনের ‘মডেল’ হয়ে পড়ে না। ইতিহাস হচ্ছে অতীতের ঘটনাবলীকে দেখার একটি প্রেক্ষিত, আপনি যেভাবে দেখছেন অন্যজন হয়ত অন্যভাবে দেখতে পারে, অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। এই দেখাতে কোন ‘মডেল’ প্রতিষ্ঠিত হয় না। মডেল হচ্ছে একটি সিস্টেমেটিক রূপ। যেমন, আমরা কোন কিছু তৈরির আগে একটা মডেল তৈরি করি এবং পরবর্তীতে এই মডেলের প্রেক্ষিতে, একই কায়দায়, অপরাপর বস্তু নির্মাণ করি। এই উপমায় আমরা নানান সামাজিক প্রকল্প গড়ি এবং এই ধরণের মডেলসমূহের রূপ ও তাদের কর্ম-পরিণতির ভিন্নতাও আলোচনা করতে পারি। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে দেখা ও ব্যাখ্যা করার বিষয়। কোথাও ত্রুটি হলে আমরা সেই মডেলের আলোকে তা নিরূপণ করতে পারি। দুই বা ততোধিক ভিন্ন মডেলের পার্থক্য সুষ্ঠুভাবে আলোচনা করতে, দেখাতে পারি।
আজ মুসলিম সংগঠনগুলোতে কিছু আত্মপ্রতারিত ব্যক্তিত্ব ‘এনার্কি-তাড়িত পরিস্থিতিতে’, নেতা সেজে, নিজেদের ভুল চিন্তা ইসলামের নামে সাজিয়ে দিচ্ছে। এতে এনার্কির মধ্যে আরও এনার্কি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার কথাটি যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে টেনে আনেন তবে এখানে যে কোনো আন্দোলনের চিন্তা এই দেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য, তাদের মানসিকতা, তাদের চিন্তার পরিধি ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে এই দেশের মানুষ, শিক্ষিত হলেও, জ্ঞানের পরিবর্তে হুজুগঘেষি, আস্ফালনপ্রবণ, অহংকার-প্রভাবিত, কর্মকুণ্ঠ হয়েও বীরত্ব প্রদর্শক, প্রোপাগান্ডা-ভাসিত, জাতিসত্তা না বুঝেও জাতীরতাবাদী দাম্ভিক এবং ব্যক্তি-পুজক। এমন ক্ষেত্রে, হনুমানের ল্যাঞ্জায় কীভাবে অগ্নি-সংযোগ করবেন, সেই ভাবনাই ভাবতে হবে।”

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

Comments are closed.