আলেপ্পো আর কত আঘাত সহ্য করবে

আবদুর রহমান আল রাশেদ
সিরিয়ার বাশার সরকার ও তার মিত্রবাহিনী বিমান হামলার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বারবার হাসপাতাল ও বেসামরিক এলাকাগুলোকেই লক্ষ্যস্থল হিসেবে নির্বাচন করছে। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই অনবরত বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে। কারণ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বাসিন্দাদের হাতে প্রতিরোধ করার মতো কোনো বস্তু নেই। অতি সম্প্রতি সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পোয় একটানা বোমাবর্ষণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন, ঘরবাড়ি ও ধ্বংসাবশেষ অপসারণ এবং লাশ দাফনের কর্মীরও সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বোমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ডাক্তার, নার্স, উদ্ধারকর্মী এবং সাধারণ নাগরিকও রয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই হচ্ছে নারী ও শিশু, যারা পালিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করতে পারেনি। আলেপ্পোতে কয়েক দিনের গোলাবর্ষণে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২১ মাস থেকে চলা সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৬০ হাজারের অধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নারী ও শিশু। প্রায় ৬ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘর্ষে ১০ লাখ মানুষ খাদ্যাভাব ও অসহায় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে এবং নারীদের ধর্ষণের ভয়াবহতা বেড়ে গেছে। বর্তমানে সিরিয়ার এ করুণ অবস্থা ১৯৪৫ সালের সিরিয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে সময় ফ্রান্সের চালর্স দ্য গল সরকার এ বাশার স্টাইলে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি করেছিল এবং হাজার হাজার মানুষকে নিমর্মভাবে হত্যা করেছে। কিন্তু এত প্রাণহানির পরও এ স্বৈরাচারী শাসকের পতন হচ্ছে না কেন? সমগ্র বিশ্ব এ অসহায় সিরীয়দের রক্ষা করার জন্য কিছুই করেনি। এ বাস্তবতা সত্ত্বেও গোটা সিরিয়া বিশেষত আলেপ্পো জাতিসংঘের অধীনে কৃত শান্তি চুক্তির ভেতরে পড়ে।
এটা কীভাবে সম্ভব যে, দৈনিক যেখানে নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে, সেখানে জেনেভা কনভেনশনের অধীনে সব রাষ্ট্রপ্রধানই সাধারণ বিবৃতি ছাড়া কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না! আলেপ্পোয় বোমায় হতাহতের দৃশ্য খুবই ভয়ানক। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রকৃত দৃশ্য বিশ্ববাসীর কাছে অস্পষ্ট। অথচ তারা বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারের পর্যবেক্ষণে সাম্প্রদায়িক গণহত্যা ও গৃহযুদ্ধের শিকার।
এ ধরনের ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ, মানব ইতিহাসে যার নজির মেলে নাÑ তারপরও উপসাগরীয় নেতাদের রহস্যজনক নীরবতা কিছুতেই বোধগম্য নয়। তুরস্ক ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে সিরীয়দের অসহায় ও অভিভাবকহীন ছেড়ে দেয়ার পর তাদের নিজেদের বাঁচানোর আর কোনো উপায় বাকি থাকল না। পশ্চিমা দেশেগুলোর নিষ্ঠুরতার অবস্থা এই যে, তারা ২ লাখ সিরীয় জনগণকে কয়েক হাজার আইএস জঙ্গির স্বার্থে মরার জন্য ছেড়ে দিয়েছে।
রাশিয়া সিরিয়ায় প্রবেশের পর থেকে আলেপ্পো ধ্বংসযজ্ঞের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। আলেপ্পো সিরিয়ার একটি বড় ও প্রধান শহর। গেল চার বছর স্বৈরাচারী বাশার সরকার বিশেষভাবে আলেপ্পোকে সামরিক ও বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। সাম্প্রতিক রাশিয়া এ শহরে ব্যাপক বিমান হামলা চালাচ্ছে। যার কারণে তার ব্যাপক ও অকল্পনীয় ক্ষতি হচ্ছে।
জাতিসংঘ ১৫০টি সামরিক বাহিনী আলহাসকা শহরে পাঠিয়েছে। অন্যদিকে তুরস্ক হুমকি দিয়েছে যে, সিরিয়া সীমান্ত অতিক্রম করে কুর্দি বিদ্রোহীদের শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কিন্তু এসব হুমকি-ধমকিতে সিরিয়ার বেসামরিক জনগণের জন্য কোনো আশার আলো বা বাণী নেই। তাদের বাশার সরকার ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একাই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আলেপ্পো এমনিতেই কয়েক মাস ধরে কঠোর অবরোধে আছে। সেখানে খাবার ও ওষুধ পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। যোগাযোগের সব ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তুরস্কের অভিবাসী কয়েক হাজার লোক ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় আটকা পড়ে আছে। কেননা তুরস্কের দিকে যাওয়ার সব সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ এ অঙ্গীকার পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেছে যে, যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবরুব্ধ এলাকায় আটকা পড়া লোকদের কাছে অপরিহার্য খাদ্য ও ওষুধ পাঠাবে এবং ত্রাণকর্মীদের ত্রাণ নেয়ার অনুমতি প্রদান করবে। কিন্তু তিক্ত বাস্তবতা হচ্ছে, যুদ্ধ চলাকালীন নিহতদের সংখ্যার চেয়ে যুদ্ধ বন্ধকালীন নিহতের সংখ্যা বেশি ছিল, যা এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, সিরিয়ার জনগণের ভাগ্যে কী হতে চলছে তা এ মুহূর্তে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। আসাদ সরকারের পতন দেখতে হলে বিদ্রোহীদের সামর্থ্য দেখতে হবে এবং বাইরের পক্ষগুলোকে সমর্থন দিতে হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাইরের শক্তিগুলোর সামরিক হস্তক্ষেপে অনীহা এবং বিদ্রোহীদের দুর্বলতা আসাদ সরকারকে আরও শক্তিশালী করছে। অন্যদিকে সিরিয়ায় যেভাবে হত্যা, ধর্ষণ, শিশু হত্যা, হাসপাতালে হামলা হচ্ছে, তাতে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কোনো স্বৈরাচারী সরকার এরূপ পরিস্থিতিতে কখনও স্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারেনি। এছাড়াও বিশেজ্ঞরা মনে করছেন, এরূপ পরিস্থিতিতে বৃহৎ শক্তিগুলো যদি সিরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে তাহলে মোটামুটি একটা পর্যায় যাওয়া সম্ভব হতো। তাই আমাদের প্রত্যাশা, বৃহৎ শক্তিবর্গ, আসাদ সরকার ও বিদ্রোহীদের স্বার্থকে বৃহৎ পরিসরে না দেখে সিরিয়ার জনগণের মানবিক দিকটি বিবেচনা করে দ্রুত একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান সিরিয়াকে উপহার দিক।
আশরাক আল আওসাত অবলম্বনে
মুহাম্মাদ শোয়াইব

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *