আমেরিকার ভুলে হাসছে ইরান

এটা লক্ষণীয় যে, তিন দশকের ব্যাপক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ সত্ত্বেও ইরান শুধু ‘সরকার পরিবর্তন’ (Regime change) ব্যর্থ করে দিতেই সক্ষম হয়নি, বরং বর্তমানে পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার প্রভাবশালী খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ইরান জাতীয়ভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে কঠোর ও কঠিন কর্মশক্তি প্রয়োগ করে, কুশলী কূটনীতি এবং সৌভাগ্যের মাধ্যমে এই পর্যায়ে এসেছে।

দীর্ঘ ও অতি কষ্টের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরানের স্থিতিস্থাপকতা ব্যাপকভাবে প্রদর্শিত হয়েছে এবং পশ্চিমাদের বহুবিধ নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মুখেও ইরানের বশ্যতা স্বীকার না করা এবং ধৈর্য ও টিকে থাকার প্রচেষ্টা দেখা গেছে।
প্রতিপক্ষ বা শত্রুর বিরুদ্ধে নির্মম ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে তেহরানের সামর্থ্যও সমানভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষত ইরান কর্তৃক লেবাননে হিজবুল্লাহর সৃষ্টি ও ‘সন্ত্রাসী’ হামলা চালানোর অভিযোগ, মোল্লা ওমরের অনুগত তালেবানদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে ‘উত্তরাঞ্চলীয় জোটের’ প্রতি সমর্থন, সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে ইরাকের প্রধান তিনটি শিয়া দলের পৃষ্ঠপোষকতা এবং সর্বত্র শিয়া গ্রুপগুলোর প্রতি আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তা প্রদান ইত্যাদির উল্লেখ করা যায়।

তেহরানের কুশলী কূটনীতির সাথে অঙ্গীকার মিলে গেছে। ইরানের দৃঢ় অঙ্গীকারের সাথে তার অনুপম কুশলী কূটনীতি দেশটিকে চমৎকারভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ইরান আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে মুজাহিদদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সরাসরি সমর্থন না দিলেও সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর দেশটি পাকিস্তানের সাথে সেখানে প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি ভাগাভাগি করে নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিল। স্বাধীনতার দাবিতে ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মিরে বিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে, এই আন্দোলন ভারতের কাছ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা আদায় করে না নেয়া পর্যন্ত ইরান কাশ্মিরি স্বাধীনতাকামীদের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছিল। ‘৯/১১’-এর পর সরকারিভাবে পরস্পর বিদ্বেষ বা বিরোধিতা সত্ত্বেও তালেবানদের বের করে দিতে উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে ব্যবহার করার জন্য ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করেছিল। বন সম্মেলনে তেহরান উত্তরাঞ্চলীয় জোটের যুদ্ধবাজ নেতাদেরকে সম্মত করিয়েছিল তৎকালীন ক্ষমতাহীন পাখতুন হামিদ কারজাইকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে।
ছয় বিশ্বশক্তির সাথে পরমাণু চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ ও জটিল আলোচনার সময় ইরান তার কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। এক সময় জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ অনুমোদিত একটি যৌথ উপলব্ধির ক্ষমতাসম্পন্ন সমঝোতা তেহরানকে জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমা অত্যন্ত কষ্টদায়ক অবরোধ থেকে রক্ষা করে। অপর দিকে, ইরান ভবিষ্যতে চাইলে যাতে পরমাণু অস্ত্র তৈরির যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয় সে জন্য তার অন্যাবশ্যকীয় কারিগরি অবকাঠামোর সংরক্ষণ করতেও সক্ষম হয়েছে।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় ইরান নিজের প্রভাব ও কর্তৃত্ব অর্জনে সক্ষম হয়। বিশেষত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমেরিকার কৌশলগত ভুলের মাধ্যমে ইরানের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন তেহরানের দু’টি আঞ্চলিক শক্তিকে শেষ করে দিয়েছে। এর একটি হলো আফগানিস্তানে তালেবান এবং ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের সুন্নি নেতৃত্বাধীন সরকার। উভয় দেশেই প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইরানের বন্ধুপ্রতিম সরকার। আফগানিস্তানে উত্তরাঞ্চলীয় জোট এবং ইরাকে শিয়া দলগুলোর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ওবামার শাসনামলে পশ্চিমাদের মারাত্মক ভুল অব্যাহত ছিল। সিরিয়ায় হাফিজ আল আসাদের আলাভি সরকারের বিরুদ্ধে প্রধানত সুন্নি বিদ্রোহকে পৃষ্ঠপোষকতা দানের ব্যাপারে পশ্চিমাদের একটি বড় লক্ষ্য ছিল : ইরাক ও সিরিয়ার মধ্য দিয়ে লেবানন ও হিজবুল্লাহর কাছে তেহরানের সরাসরি ভূমিপথে প্রবেশ করাকে বিচ্ছিন্ন করা। হিজবুল্লাহ হচ্ছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য, সরাসরি সামরিক হুমকি। যাই হোক না কেন, সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে ইরাকে ইসলামিক স্টেটের নামে আলকায়েদার পুনরুত্থান ঘটতে দেখা গেছে। ইসলামিক স্টেট বা আইএস ইরাক ও সিরয়ায় ইরান এবং পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

সিরিয়ায় আমেরিকার প্রাথমিক শত্রু হিসেবে রাতারাতি আইএসের উত্থান কেন ঘটেছে, সে ব্যাপারে হয়তো ইতিহাস সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারবে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বে চতুর্দিক আচ্ছন্ন। দুই বছর ধরে ওমানে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যে গোপন আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে কি শুধু পরমাণু ইস্যুই প্রাধান্য পেয়েছে? নাকি পর্দার আড়ালে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনায় সিরিয়া ও ইরাক নিয়েও সমঝোতা হয়েছে? যে কোনো ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য কৌশলগত সামরিক সহযোগিতা বিদ্যমান ছিল এবং এই সহযোগিতা সম্ভবত সিরিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে।

আগে তাদের অবস্থা যাই থাকুক না কেন, পরমাণু চুক্তি এবং ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে আমেরিকার কৌশলগত দিককে সুসজ্জিত করে যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরব ও তার জিসিসি মিত্রদের মধ্যে একটি নজিরবিহীন কৌশলগত বিপথগামিতা সৃষ্টি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সামরিক হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে দূরে থেকে তেহরান ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অনানুষ্ঠানিক মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আলেপ্পো এবং সাম্প্রতিক যুদ্ধক্ষেত্র মসুলে আনুষ্ঠানিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার পর শিয়া মিলিশিয়ারা বিজয় উল্লাস করেছে। অপর দিকে চরমপন্থী সুন্নিরা (আইএস এবং আলকায়েদা) বেআইনি ঘোষিত হয়েছে। ‘উদারপন্থী’ গ্রুপগুলো সিরিয়ায় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে এবং ইরাক থেকে বেরিয়ে গেছে। অব্যাহতভাবে সৌভাগ্যের হাসি হাসছে তেহরান। ইউক্রেন ও ক্রিমিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রাশিয়ার সঙ্ঘাত ইরানের সাথে প্রকৃত প্রস্তাবে রাশিয়ার সম্পর্ককে জোরদার করেছে। ইরানের বিপ্লবী গার্ড, হিজবুল্লাহ এবং শিয়া মিলিশিয়াদের সাথে সমন্বিতভাবে রাশিয়ার বিমানশক্তি ও বিশেষ বাহিনীকে ব্যবহার করে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধকে আসাদের পক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা সিরিয়ায় তাদের প্রক্সিযুদ্ধে হয় যথার্থ সমর্থন দিতে ব্যর্থ হয়েছে অথবা দামেস্ক ও তার পৃষ্ঠপোষকদের সাথে বাস্তবে সমঝোতা করতে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে।

আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সিরিয়ান ও ইরাকি কুর্দিদের প্রতি পশ্চিমা সমর্থনের ব্যাপারে তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার তীব্র মতপার্থক্য থেকেও ইরান ফায়দা হাসিল করেছে।

তুরস্কের কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে সিরিয়া ও ইরাকের সাথে তার সীমান্তসংলগ্ন এলাকার পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী কুর্দি প্রজাতন্ত্র গড়ে উঠতে না দেয়া। কুর্দিদের এ ধরনের শক্ত ঘাঁটি বা ভূখণ্ড গড়ে উঠলে তা তুরস্কের কুর্দি বিদ্রোহীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তুরস্কের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে ওয়াশিংটনের সমর্থনদানের অভিযোগ ওঠায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঙ্কারার সন্দেহ বৃদ্ধি পায় এবং উভয় দেশের সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি আরোপ করার ব্যাপারে রাশিয়া আর ইরানের সাথে যোগ দিয়ে তুরস্ক অত্যন্ত ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। চাপিয়ে দেয়া এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে আসাদ সরকারকে টিকে থাকতে সহায়তা এবং ‘উদারপন্থী’ সুন্নি বিদ্রোহীদের ত্যাগস্বীকারে বাধ্য করা হয়েছে। আলেপ্পোর পরাজয়ের একটি অনিচ্ছাকৃত ফল হতে পারে এই ‘উদারপন্থী’ তথা মধ্যপন্থীদেরকে আইএস এবং আলকায়েদার হাতে তুলে দেয়া, তথা তাদেরকেও আইএস হিসেবে চিহ্নিত করা।

ইরান ইয়েমেনের শিয়া হুতিদের প্রতি সতর্ক সমর্থন দিয়ে সৌদি আরবের দুঃখকে বাড়িয়ে দিতে চায়। এই হুতিরা সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহর সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। হুতিরা সানায় সৌদি সমর্থিত প্রেসিডেন্ট হাদির সরকারকে উৎখাত করেছে। এ পর্যন্ত সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব কোয়ালিশন ব্যাপক বোমা হামলা ও সামরিক অভিযান চালিয়েও বিদ্রোহী বাহিনীকে পরাজিত করতে পারেনি। রিয়াদ এখন উত্তরাঞ্চলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত থেকে সরাসরি হুমকির মুখে পড়েছে।

কিছু ভাষ্যকার মনে করেন, নতুন প্রেসিডেন্ট তীক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন রিপাবলিকান এবং ইসরাইলিদের ইচ্ছা অনুযায়ী, ইরানের সাথে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তির ঢাকনা বন্ধ করবেন। প্রকৃতপক্ষে, ট্রাম্পের প্রস্তুতিবিহীন অবস্থান ইরানের সাথে উত্তেজনা পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদে তিনি যাদের মনোনীত করেছেন তারাই ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তিকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছেন। ট্রাম্প সিরিয়ার আসাদের বিপক্ষে থাকার চেয়ে বরং আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রাশিয়ার সাথে যোগদান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। এটা মার্কিন নীতিকে ইরানের অগ্রাধিকারের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। তাই পশ্চিমা এবং আরব বিশ্লেষকেরা পূর্বাহ্ণে যে অনুমান করেছিলেন তার তুলনায় বর্তমানে হয়তো যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক কম উত্তেজনাপূর্ণ হতে পারে।
যাই হোক না কেন, ইরান পশ্চিম এশিয়া ও উপসাগরীয় অঞ্চলে তার আধিপত্য বিস্তারের জন্য এখনো খুব ক্ষমতাবান বা শক্তিশালী নয়। ইরান আধিপত্য বিস্তার করতে চাইলে এই অঞ্চলের ভেতর ও বাইরে থেকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে এবং এতে আরো সঙ্ঘাত ও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে। আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোকে সংলাপের মাধ্যমে একটি নতুন নিরাপত্তা শৃঙ্খলার সূচনা করতে হবে। এই শৃঙ্খলাব্যবস্থার মাধ্যমে সব আঞ্চলিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডগত সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে।

এ ধরনের একটি সমদর্শী বা ন্যায়বিচারপূর্ণ সামষ্টিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানকে নিজেদের স্বার্থেই এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : জাতিসঙ্ঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত,
ডন থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

পূর্ব প্রকাশিত : নয়া দিগন্ত

Comments are closed.