আফ্রিকান মুসলিমদের বিস্মৃত ইতিহাস

ভূমিকা

ইতিহাস (History) বিষয়ে কথা বললে মনে পড়ে স্কুল জীবনে ইতিহাস (History) ছিল সবচেয়ে বোরিং সাবজেক্ট। বিশেষ করে,  History যখন His+Story= History অর্থাৎ “রাজার কাহিনী” হয়ে যায় তখন তা আরো বেশী বোরিং অনুভূত হয়। বুঝতে হবে যে এই কাহিনী যদি কারো কাছে Our Story “আমাদের কাহিনী” (বা আমাদের ইতিহাস) -এমন ধরণের কিছু হয়, তবে সেই ইতিহাস পাঠে অন্য রকমের আগ্রহ জেগে থাকবে। তবে অনেক সময় কোন রাষ্ট্রে ইচ্ছা করেই অপর কোন পক্ষ “আমাদের ইতিহাসের” নামে “তাদের ইতিহাস” পড়িয়ে দেয়, তাদেরই এজেন্ডা বাস্তবায়নে। ঠিক এমনিভাবে আমরা বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাপনায় এক ঐতিহাসিক শিক্ষাধারা ও ধরণের মানসিকতায় উপনীত হয়েছি। ধরুন আফ্রিকার কথা। আমরা যখনই আফ্রিকার নাম শুনি তখন আমাদের মনে যে ছবি ভেসে উঠে, তাহল আফ্রিকা মানে দাসত্ব, গণহত্যা, অপরাধ, যুদ্ধ বিধ্বস্ত, ভাইরাস ইত্যাদি যাবতীয় খারাপ ও অসভ্যতায় পরিপূর্ণ কৃষ্ণবর্ণের  তথা কালো চেহারার মানবে পরিপূর্ণ দেশ। এ নেগেটিভ ছবি আঁকার পিছনে রয়েছে শত শত বছর ব্যাপী আফ্রিকার উপর ইউরোপিয়ানদের সম্মিলিত দাস-ব্যবসা,  উপনিবেশবাদ আক্রমণ, সাম্রাজ্যবাদ, জাতিবিদ্বেষ, ধর্ষণ, নির্যাতন, শোষণ এবং “ডিভাইড এন্ড রুল” পলিসি। ফলশ্রুতিতে এসেছে আজকের আফ্রিকা নিয়ে আমাদের ধারণা। ঐপনিবেশিক শাসন-শোষণের কলঙ্ককে অদৃশ্য করে রাখতে এবং আফ্রিকানদের অতীত গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে কবর ছাপা দিতে তাদেরকে অঞ্চলকে একটি অসভ্য অঞ্চল হিসাবে বিশ্বে প্রচারিত হয়েছে। এই একই মৌলিক কায়দায় মুসলিমদের মনেও জাতিবিদ্বেষ বা রেসিজমের সংক্রমন ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যদিও তা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী! আর আফ্রিকার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে ইসলামী সভ্যতা যে সুগভীরভাবে জড়িত এই কথাটি মুসলমানেরা ভুলে গিয়েছে। আফ্রিকার ইতিহাসকে বিশ্বের বাকী মুসলিমদের কাছে “ওদের কাহিনী” হিসাবে ব্যাখ্যাপ্রাপ্ত হয়েছে। আর এজন্য মুসলিম সমাজেও আফ্রিকার ইসলামী ইতিহাস চর্চা সবচেয়ে বেশী অবহেলিত!

বিশ্বের সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি ও সম্পদের  ইতিহাস সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে ইউরোপ ও এশিয়া থেকে কোন অংশে কম না হওয়া সত্ত্বেও আফ্রিকায় মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের মনে কোন আগ্রহ নেই, এমনকি মুসলিমদেরও নেই। এটা ভাবতে বিস্ময়কর মনে হয়।  আজকের এ পোষ্টটির উদ্দেশ্য হল এই বিষয় নিয়ে সম্মানিত পাঠকদের মাঝে কিছুটা সচেতনতা জাগানো। তবে বর্ধিত ধারণা পেতে লিঙ্ক-করা ভিডিও ও তথ্যগুলো সবাইকে আগ্রহ নিয়ে শুনার ও পড়তে অনুরোধ করব।

আফ্রিকা মহাদেশে মুসলিম জনসংখ্যা

বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আফ্রিকায়। আর আফ্রিকার মোট জনসংখ্যায় মুসলিম জনসংখ্যার হার শতকরা ৫৩.০৪%  বিশ্বের ১.৭ বিলিয়ন মুসলিমদের প্রায় বিশ শতাংশ মুসলিমের বাস হচ্ছে আফ্রিকায়।

ইতিহাস সাক্ষী দেয় ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিমদেরকে সহায়তা দিতে এবং বিশ্বে ইসলামের ঝাণ্ডাকে বিস্তৃত করতে আফ্রিকার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ইসলামের শুরুতের  আফ্রিকান কানেকশন বা সম্পর্কের কথা বলতে প্রথমেই চলে আসে রাসুল (স:)এর সময়ের দীপ্তিমান্  কয়কজন  আফ্রিকান সাহাবীর নাম। তাদের জীবনী পড়তে পারেন এ লিংক থেকে। যেমন,
১)  বারাকাহ ( রাদি আল্লাহহু আনহা) যিনি  উম্মে আইমান নামেও পরিচিত ছিলেন।  উম্মে আয়মান (রাদি আল্লাহহু আনহা) ছিলেন মোহাম্মদ (স:) এর পিতা  হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্দিল মুত্তালিবের আফ্রিকান তথা হাবাশি সেবিকা। উম্মে আয়মান একমাত্র সাহাবী যিনি রাসুল (স:) এর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দেখার বয়স পেয়েছিলেন। রাসুল (স:) শিশু বয়স থেকে বিশেষকরে রাসুল (স:) মা, আমিনা মারা যাবার পর   উম্মে আয়মানই  তাকে দেখাশোনা ও সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলেন পরিবারের খাদিমা হিসাবে। তাই উম্মে আইমানকে রাসুল (স:) খুবই শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন।

২) ৩) 
৪) 
৫) সা’দ আল আসওয়াদ
৬) 

৭) আয়মান বিন উবায়ে

তাছাড়া ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন  বিলাল বিন রাবাহ (রা:) এর কাহিনী কম বেশী আমরা অনেকেই জানি।

আফ্রিকায় মুসলিমদের প্রথম হিজরত

ইসলামের শুরুতে মক্কায় কাফেরদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে আফ্রিকার  আবু সিনিয়া তথা বর্তমান  ইথিওপিয়ায় কিছু সংখ্যক মুসলিমরা আল্লাহর রাসুল মোহাম্মদ (স:) এর নির্দেশে  হিজরত করেন। সে দেশের বাদশাহ হাবাশী মুসলিমদেরকে আশ্রয় দান করেন।

যদিও কাফিরদের সর্দাররা মুসলিমদেরকে ফিরিয়ে আনতে দূত পাঠিয়েছিল কিন্তু বাদশাহ তাদের কথা শুনেন নাই।  নিচের ভিডিওগুলাতে সে ইতিহাস খুবই সুন্দরভাবে  তুলে ধরা হয়েছে। সময় সাপেক্ষে শুনতে পারলে অনেক কিছু জানতে পারবেন।

ইসলামী সভ্যতায় আফ্রিকার ভূমিকা

দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপে মুসলমানদের রাজনৈতিক সামরিক শক্তি বিস্তারে জনবল প্রদান করা সহ  ক্রুসেডারদের এবং মোঙ্গলদের সঙ্গে ঐতিহাসিক সংগ্রামে অর্থ ও জনবল দিয়ে সাহায্য আসত আফ্রিকা থেকে। আর বিশ্বের সঙ্গীত, শিল্প, সংস্কৃতির ইতিহাস সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে ইউরোপ ও এশিয়া থেকে কোন অংশে কম না হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে আফ্রিকায় মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে বিশ্বের মানুষের বিশেষকরে মুসলিমদের মনোযোগ হারিয়ে গিয়েছে ভাবতে বিস্ময়কর মনে হয়।

নিচের আফ্রিকা মহাদেশের মানচিত্রে মুসলিম দেশগুলা দেখানো হয়েছে।


আফ্রিকার ইসলামী সভ্যতা:

আফ্রিকার ইসলামী সভ্যতার লেগেসি বিষয়ে আলোচনা করতে আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্যের ইতিহাস আলোচনা করতেই হবে। সে সাম্রাজ্যের সম্রাট মানসা মুসা মধ্যযুগীয় আফ্রিকান শাসকদের মাঝে আফ্রিকা বহির্বিশ্বে সবচেয়ে বেশী পরিচিতি লাভ করেন। ১৩২৪ সালে তাঁর মক্কার উদ্দেশ্য পবিত্র হজ যাত্রা এবং তখনকার সময় সফর পথে তাঁর দানের উদাহরণ ইতিহাসে এক অতুলনীয় কাহিনী হিসাবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মানসা মুসাকে বলা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী ধনী ব্যক্তি। নিচের ভিডিওটা শুনেন তাহলে ইতিহাসের এই অসাধারণ মুসলিম বাদশাহের কাহিনী শুনতে পাবেন।

মানসা মুসার নেতৃত্ব তার রাষ্ট্রের সীমানা আটলান্টিক মহাসাগর থেকে দুই হাজার মাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং যা বর্তমানের মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, বুরকিনা ফাসো, মালি, নাইজার, নাইজেরিয়া, এবং চাদ দেশগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল । তার সাম্রাজ্য পশ্চিম আফ্রিকায় শান্তি ও সমৃদ্ধির দশক নিশ্চিত করেছিল।

টিম্বাকটু জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র

ইসলামী স্বর্ণযুগে আফ্রিকার টিম্বাকটু শহরটি গড়ে উঠে ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান অন্নেষনের একটি সমৃদ্ধিশালী কেন্দ্রে । প্রায় ২৫০০ ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছিল সে শহরে যা ১৩ থেকে যে ১৬ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল জ্ঞানের প্রবাহ। আফ্রিকার ইসলামী সভ্যতার সময় বিভিন্ন আফ্রিকান সাম্রাজ্য অধীনে ইসলামী জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল টিম্বাকটু শহর। ইসলামের মহান শিক্ষা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিত থেকে শুরু করে মেডিসিন এবং আইন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের কয়েকশ হাজার পাণ্ডুলিপির অমূল্য সংগ্রহন ছিল সেখানে।

আফ্রিকান মুসলিম হেরিটেজ বা ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করতে তখনকার মুসলিম স্কলারদের অবদান যে সব বিষয়ে পাওয়া যায় তার মধ্যে ছিল গণিত, দর্শন, অনুবাদ কাজ, আর্কিটেকচার,সুশাসন প্রতিষ্ঠা শিখার অনুপম শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপনে।

১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় টিম্বাকটুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । টিম্বাকটুর পাণ্ডুলিপির উপর একটি ডুকুমেন্টারী ভিডিও নিচে দেয়া হল

পরিশেষে রাসূলুল্লাহ্’র (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণ থেকে  কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করছি।

হে মানবমন্ডলী! মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “হে মানবমন্ডলী! আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং পরে তোমাদেরকে বিভিন্ন দল ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে আল্লাহ’কে বেশী ভয় করে চলে। সুতরাং কোন আরব যেমন অন্য কোন অনারব বা আজমী ব্যক্তির তুলনায় মোটেও শ্রেষ্ঠ নয়, তেমনি কোন অনারব বা আজমী ব্যক্তিও কোন আরব ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়। কালো ব্যক্তিও সাদা ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়, তেমনি সাদা ব্যক্তিও কালো ব্যক্তির তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়। হাঁ, মর্যাদা ও সম্মানের যদি কোন মাপকাঠি থাকে, তবে তা হলো একজন ব্যক্তির তাকওয়া বা পরহেজগারী। সমগ্র মানবজাতি একই আদমের সন্তান এবং আদমের প্রকৃত পরিচয় এটাই যে, তাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে।

রেফারেন্স
West African Mosque Architecture – A Brief Introduction
Sub-Saharan Centres of Learning
The University of Sankore, Timbuktu
Architecture of Muslim Spain and North Africa

 

 

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *