আপন

আপন। মানে নিজ। যা একান্ত নিজস্ব, অন্য কারো নয়। আপন কে? সাধারণ চোখে আমরা যাদেক আপন বলে ভাবি তারাই কি আপন? এ দুনিয়ায় আপন কে কার? আপন কেউ কাউকে ভাবে না ভাবার ভাণ করে মাত্র।

আমার হাত, আমার পা, আমার নয়। আমার কাণ, আমার চোখ, আমার দাঁত, তারাও আমার নয়। একটু বয়স হলেই কাণ কথা শোনে না, চোখ সেও দেখে না, দাঁত আমাকে যন্ত্রণা দেয়। আমার দেহ, সেও পর। আজ মরে গেলে দু’দিন পর পচে গলে নিঃশেষ হয়ে যাবে।

আত্মা? সেতো সুদিনের শুকপাখী – বসন্তের কোকিল। সুযোগ পেলেই কলা দেখাবে, এ তল্লাটে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানব জগতে যারা সৌজন্য দেখায় তারা আপনও নয় আত্মীয়ও নয়। যারা ডাল ভাতে তুষ্ট তারা আত্মীয় বটে, আপন নয়।

জন্মদাতা পিতামাতা? তাঁরা পুত্র-কন্যার বিপদে আপদে দুঃখিত হন মাত্র। অর্ধাঙ্গিণী? সে তো তিন কথায় উঠে বসে। পুত্রকন্যাদের মধ্যে যারা কর্মক্ষম তারা স্বার্থের আপন, যারা অক্ষম তারা নির্ভরশীলমাত্র – সুযোগের অপেক্ষারত।

বস্তু জগতে নিজের ঘরও নিজের নয় – নিজের মাল-মসলা পরে খাচ্ছে – চুরি যাচ্ছে, ডাকাতে লুটছে। যে যেমন পারছে নিয়ে যাচ্ছে – যেন হরিলুটের মাল।

ভোগ্য জগতে কেউ আপন আছে কি? সুখ? সেতো সুসময়ের সুদিনের বন্ধু। দুর্দিনে দুঃসময়ে সারা আত্রাবে তার ছায়াও মিলবে না।

দুঃখ? সেই আপন। সকলের আপন। আপনার চেয়েও আপন। এ পৃথিবীতে যারা জন্মগ্রহণ করেছিল, করেছে, করছে এবং করবে তাদের প্রত্যেকের আপন। তাকে ডাকার প্রয়োজন পড়ে না। সুদিনে দুর্দিনে সে সকলের ঘনিষ্ট সাথী – গলার হার, দেহের ভূষণ। কেউ ছাড়তে চাইলেও সে তাকে ছাড়ে না, গলা জড়িয়ে নিবিড় হয়ে থাকে। যাঁরা কোটীপতি, যাঁরা জোতদার, যাঁরা অট্টালিকায় বাস করেন, যাঁদের শত শত চাকর চাকরানী দাস-দাসী সে তাদেরও অন্তরের মণিকোঠায় জুজুর মত বাস করে দাবানলের মত দহন করে প্রতিনিয়ত। যাঁরা রাজ্যের মালিক – রাজা-বাদশা তাঁরাতো দুঃখের ডালি মাথায় করেই বেড়ান।

যাঁরা এই অজেয় অচ্ছেদ্য এবং অলঙ্ঘ দুঃখকে পরাভূত করতে পেরেছেন তাঁরা কাঙ্গাল হলেও মহাধনী রাজাধিরাজ। তাঁরাতো সাধারণ মানুষ ননই হয়ত মহাপুরুষ। সে বড় হিংসুক। তৃতীয় কারো বন্ধুত্ব সে আদৌ পছন্দ করে না। মানুষকে সহায়হীন, বন্ধুহীন ও সঙ্কীর্ণমনা করে তুলতে এবং তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিতে তার জুড়ি নেই। সে সর্বগ্রাসী সর্বনাশা। তার এই সর্বনাশা গ্রাস থেকে দুনিয়ার কেউ পরিত্রাণ পায়নি এবং পাবেও না কোনদিন।

অতীন্দ্রীয়  জগতে অলক্ষ্যে একজন আছেন যিনি সর্বাবস্থায় সর্ব সময়ে সকল মানুষের আপন এবং সাথী। তাঁকে আপন ভাবলেও আপন, না ভাবলেও তিনি আপন। তাঁকে ডাকলেও তিনি সাথে থাকেন, না ডাকলেও তিনি সাথেই থাকেন। সাথে থাকতে না বললেও তিনি সাথেই থাকেন। বিপদে আপদে দুঃখের করাল গ্রাস থেকে তিনি তাকে রক্ষা করেন। দুঃখ মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়, তিনি তা তুলে দেন।

দুঃখকে সর্বগ্রাসী সর্বনাশা বলে যতই দোষ দিই না কেন, দুঃখেরও প্রয়োজন আছে। প্রকারান্তরে সে মানুষের সেবা করে থাকে। সে ইহকালে শাস্তি দিয়ে পরকালের পথকে প্রশস্ত করে। মানুষ পৃথিবীতে এসেই স্রষ্টাকে ভুলে তাঁর দিকে পিছন ফিরে পার্থিব ভোগ বিলাসে ব্যাপৃত হয়। তাতে ইহজগতের সুখতো হয়ই না বরং তার জাহান্নামের পথ পরিস্কার হয় মাত্র। দুঃখ তার সব দ্রব্য নিঠুর হাতে কেড়ে নিয়ে স্রষ্টার দিকে আবার মুখ ফিরিয়ে দেয়। তখন সে দুঃখের দহনে কোন উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে স্রষ্টার স্মরণাপন্ন হয়। ইহজগতে ও পরজগতে তাঁর মত ঘনিষ্ট ও হিতৈষী বন্ধু আর কে আছে। সেইতো পরম আপন।

পারগোপালপুর

শ্রাবণ ২৯, ১৩৮০ বাংলা

 

Comments are closed.