ধর্ম বিশ্বাস আর নিঃশ্বাস বড়ই মূল্যবান

ধর্ম বিশ্বাস আর নিঃশ্বাস বড়ই মূল্যবান একবার চলে গেলে আর ফিরে আসে না। সে যতই মনে করুক না কেন তার আছে বিরাট জ্ঞানের ভাণ্ডার কিংবা শক্তিশালী দেহের আকার!  ইসলামের দৃষ্টিতে  বলা যায় সে বড়ই হতভাগা ও অসহায়!

God consciousness বা তাকওয়ার অর্জনকারী ও নবী প্রেমিক বলে আজ যারা দাবি করেন তাদের অনেকের মাঝেও আবার খুঁজে পাওয়া যায় না রহমান ও রহিম নামের মহান আল্লাহর ন্যূনতম করুণার গুণাবলী একইভাবে পাওয়া যায় না যে নবী ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন মানে সমস্ত জগতের জন্য করুণা, দয়া, প্রশান্তি বিজড়িত উত্তম চরিত্রের উদাহরণ তার ন্যূনতম নিদর্শন।

কেউ ইসলামকে সত্য ধর্ম হিসাবে বিশ্বাস না করতেই পারেন।  তবে ইসলামে বিশ্বাস তথা ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা শেষ নবী মোহাম্মদ (স:) জানতেন বলেই আপন চাচা আবু তালিবের মৃত্যুশয্যায় তাকে ঈমান গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। এখানে একটি বিষয় খেয়াল করা খুবই জরুরী ইসলাম যদি নবীর মনগড়া কোন ধর্ম হত তাহলে আপন চাচার মৃত্যু শয্যায় এসব করার তথা মনগড়া ধর্ম গ্রহণ করতে বলার কোন মানে হয়না অর্থাৎ ঈমান নেয়ার অনুরোধ করার কোন দরকার ছিল না। এখানে একজন চিন্তাশীল বিশ্বাসীর কাছে তার ঈমান ও আনুগত্য বাড়ানোর জন্য এ ইশারাই যথেষ্ট। আমরা যারা কুরআনকে কম বেশী বুঝে পড়ার সক্ষমতা অর্জন করেছি তারা জানি কুরআনেও আল্লাহ বলেছেন মুসলিম তথা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ না করে যেন মারা না যাই।  আসলে এরকম আরো অনেক ঘটনা আছে যা কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না এবং নগণ্য মনে হলেও তার গুরুত্ব অপরিসীম চিন্তাশীলদের কাছে।

সমস্যা হচ্ছে ইসলামের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে ধর্মের নামে যারা উগ্রবাদী খারিজি জঙ্গি তারা এবং যারা ইসলাম বিদ্বেষী ও অবিশ্বাসী এই উভয় দলই মনে করে ইসলাম হচ্ছে যুদ্ধ করে বা জবরদস্তি করে প্রতিষ্ঠিত করার একটি ধর্ম!

অথচ ইসলামের মূল সূত্র (Source) যে কুরআন ও রাসুলের সুন্নাত তাতে কোথাও বলা হয়নি যে যুদ্ধ করে ইসলাম কায়েম করতে হবে । ইসলামের মূল নীতির কোথায়ও এসবের উল্লেখ নাই। কেননা আল্লাহ বলেছেন لَآ إِكْرَاهَ فِى ٱلدِّينِ
মানে ধর্মে বা দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। (বাকারা আয়াতঃ ২৫৬)

মুসলিম সমাজে এমন লোকদের অভাব নাই যারা আল্লাহকে শুধু ক্বাহহার আর নবীকে জাব্বার তথা কড়া মেজাজি অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে খুবই কঠিন দেখাতে নিয়ে আসতে পারে “খবরে ওয়াহিদের রেওয়াত” বা বিশেষ কোন ঐতিহাসিক ঘটনার এবারত। (ব্যাখ্যা নিচে আসছে) তবে এসব তথ্যের কারণে “মুরতাদ” টাইপের কিংবা সংশয়বাদী লোকেরাও যে আরো বিভ্রান্ত হতে পারেন তাতে কোন সন্দেহ নাই।

মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় অঙ্গনে বিশেষ করে উপমহাদেশীয় মাদ্রাসাগুলোতে বিভিন্ন মতের ইখতেলাফি মাসআলা এবং তাদের মাজহাবী তত্ত্ব নিয়ে যে পরিমাণ রিসার্চ ও বিতর্ক করা হয় তার এক দশমাংশও যদি কোরান এবং রাসুলের সুন্নাহকে জ্ঞানের উৎস হিসাবে অধ্যায়ন ও রিসার্চ করা হত তা হলে সেটি মুসলিম বিশ্বে ইসলামী চেতনা পুনরুদ্ধারের জন্য এক বিস্ময়কর অবদান রাখত। বিশেষ করে একে অন্যের সাথে একমত হওয়ার মত যে “কমন বিষয়” আছে সেটিকে পুঁজি করে নিজেদের মাঝে ঐক্য গড়ার পথে হাটলে মানুষ ধর্মকেও সহজভাবে বুঝতে পারত এবং শিরক, বেদায়াত ও এত কুসংস্কারের জন্ম হত না।

মনে রাখতে হবে কোন নীতি বা আদর্শ নিজেই ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেনা তবে সে আদর্শ অনুসরণ করে বাস্তবে সেটি করতে হয় মানুষকে। তাই ইতিহাসের রচয়িতা হচ্ছে মানুষ। আর মানুষ তার নিজস্ব মানবিক দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা এবং যুগের সাংস্কৃতিক প্রভাব থেকে সব ক্ষেত্রে এমন কি ধর্ম ব্যাখ্যার ব্যাপারে যে মুক্ত থাকতে পারবে তা আশা করা যায় না।

দু:খের ব্যাপার হল মানুষের বিশ্বাস একবার চলে গেলে তার অবিশ্বাসকে দৃঢ় করতে সে ইসলামের অতীত ইতিহাসের সবকিছুতেই ছিদ্র অন্বেষণে ব্যস্ত থাকবে এটাই স্বাভাবিক কেননা আল্লাহ বলেছেন যে ইসলামকে ধরে রাখতে চাইবে না তাকে আল্লাহ ইসলামের পক্ষে থাকতে সাহায্য করেন না।

আমরা অনেকই জানি যে ইসলামের ইতিহাসে এমন মানুষও ছিল যারা নিজেদেরকে অতি ধার্মিক দাবী করে ধর্মের বা নবীর নামে অনেক বানোয়াট কথা বলাটা তাদের কাছে কোন দুষের কাজ ছিলনা যদি সেটি ধর্ম প্রচারে সুবিধা হবে ভাবত! অনেকে এর অনুকূলে ফতোয়াও রাখতেন! এ প্রকৃতির লোক আজও পাওয়া যাবে। অবশ্য এসব বেদাতি প্রবণতার কট্টর বিরোধী ছিলেন ইমাম মুসলিম।

“খবরে ওয়াহিদ” হচ্ছে সেই কথা যা নবী কখনও কোন ব্যক্তিকে কিছু বলেছেন বা কোথায় কিছু করেছেন বলে কেউ  বা যারা শুনেছেন  বা দেখেছেন সেই কথা যে যতটুকু মনে রেখেছেন তার বর্ণনা।  যা পরবর্তীতে বিভিন্ন “রাবিদের” কাছ থেকে সংগ্রহ করে হাদিস গ্রন্থ লিখা হয়েছে অনেক অনেক বছর পরে। অর্থাৎ রাসুল (স:) সম্পর্কে ঐতিহাসিক রেকর্ড যা  লোকেরা বর্ণনা করেছেন।  অবশ্য যে কথাটা কেউ শুনেছেন বলে বর্ণনা করেছেন সেটি কোন প্রেক্ষিতে কেন বলা হয়েছিল এবং নবী কি বুঝাতে চেয়েছিলেন আর বর্ণনাকারী কি বুঝলেন? আর কথাটি কি কারণে শুরু হয়েছিল এবং কোথায় শেষ হল সে সকল বিষয় বর্ণনাকারী কতটুকু স্মরণ রাখতে পেরেছিলেন ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন আসতেই পারে যেহেতু বর্ণিত বাক্যের যথার্থতা বা নিহিতার্থ ( implication/ synthesis) বিবেচনার পরিবর্তে হাদিস লেখক “রাবিদের” তথা বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা এবং একজন থেকে আরেকজনের যোগাযোগে ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করাকেই বেশী অগ্রাধিকার দিতেন।

কিন্তু আমাদের ধর্মীয় অঙ্গনে অনেকের পড়াশুনা যেহেতু সীমিত তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও সংকীর্ণ । অতএব, ঐতিহাসিক রেকর্ড বিশেষ করে অতীত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত বিষয়গুলো বর্তমান যুগের বাস্তবতায় কতটুকু বাস্তবসম্মত হতে পারে কিংবা গ্রহণযোগ্যতা, সম্ভাব্যতা (feasibility) আছে তা নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন করলে তাকে “মুনকারে হাদিস” বলে আক্রমণ না করে মানব সভ্যতা ক্রমবিকাশ কিভাবে ঘটে তার জ্ঞান অর্জন দরকার।

মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশ একটি স্বাভাবিক ক্রমাগত প্রক্রিয়া তা কিছুতেই বন্ধ করা সম্ভব নয় এবং ধর্মের কাজও এটি নয় যে এ প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে হবে। তবে কারো ধর্ম বুঝার বিশেষ অবস্থানে তিনি এ প্রতাশা করতেই পারেন কিন্তু বাস্তবে এ প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার নয়। যেমন, বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বৃহত্তর কর্ম ক্ষেত্রে মহিলারা কেন যুগ দিয়েছেন? তা নিয়ে অনেক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের দু:খের সীমা নাই! আক্ষেপেরও অন্ত নাই, আগের যুগে এরকম ছিলনা, সমাজ কত ভাল ছিল কারণ সেটি ধর্মীয় সমাজ ছিল স্বর্ণযুগ ছিল ইত্যাদি নানা কথা।
কিন্তু মানব সভ্যতায় উৎপাদনের পদ্ধতি ( Mode of production) পরিবর্তনে সমাজে যে বাস্তবতা দেখা দেয় মানুষের সামাজিকভাবে বেঁচে থাকার ও উন্নতি করার জন্য সম্মিলিতভাবে জীবিকা নির্বাহের উপায় উৎপাদন করতে সেটি  বুঝা খুবই দরকার।

আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে এ পর্যন্ত মানব সভ্যতার সীমানা প্রক্রিয়াটিকে মানবজাতির জন্ম থেকে একবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি ৪টি কাল এবং ১৬টি ধাপে বিভক্ত করা যায়।
এই চারটি কালক্রমে হচ্ছে
১) আদিম সংস্কৃতি,
২) কৃষি সভ্যতা  ,
৩) শিল্প সভ্যতা এবং
৪) জ্ঞান সভ্যতার

আর এ প্রতিটি পিরিয়ডে চারটি পর্যায় অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা হচ্ছে তার শুরু, বিকাশ, পরিপক্ব এবং ক্রমান্বয়ে রূপান্তর পর্যায়ক্রম (Transition period)।

পৃথিবী সভ্যতার বৃহত্তর সময়টি বোঝায় আদিম সংস্কৃতি থেকে জ্ঞান সভ্যতার উত্তরণ পর্ব। তার পরবর্তীটি হচ্ছে মহাকাশ সভ্যতার বড় সময়টি যা শুরু হবে মহাকাশচারী সভ্যতার সাথে।

আধুনিক সভ্যতার প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছে সনাতন কৃষি সভ্যতা থেকে আধুনিক শিল্প সভ্যতার যুগান্তকারী বৈপ্লবিক পরিবর্তনে। যখন মানুষ কাজ না করে মেশিন দিয়ে কাজ করার বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল এবং তারপরে আধুনিক শিল্প থেকে উচ্চতর আধুনিক জ্ঞানের সভ্যতাতে দ্বিতীয় আধুনিকায়নের যুগে পৌঁছে এখন যেথায়  কম্পিউটার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র  (AI technology)  পর্যন্ত সৃষ্টি করতে সক্ষম হচ্ছে।

কোরআনের দৃষ্টিতে বুঝতে চাইলে এটি হচ্ছে মানুষ যে আল্লাহর খলিফা তার প্রমাণ। কেননা এ ধরণের সৃষ্টির যোগ্যতা ও সক্ষমতা মানব ছাড়া আর কোন সৃষ্টির নাই।

মধ্য যুগে মুসলিম নামের রাজা বাদশারা রাজ্য দখল করেছেন তাদের নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে। সেটি ছিল ‘জোর যার মুল্লুক তার’ জমানা। সে যুগে তা বেআইনী ছিল না। তবে আজকের যুগে তা সম্ভব নয়। আজকের যুগ আর মধ্যযুগ এক নয়। তখন সাম্রাজ্য বিস্তার শুধু মুসলিমরা নয় অন্যরাও করেছে। ইউরোপিয়ানরাও করেছে।
বলা হত “ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সূর্য কখনো অস্ত যায় না।” (“The sun never sets on the British Empire.”) আর এখন যুক্তরাজ্যে অনেক দিন সূর্যই দেখা যায় না। সময়ের সাথে অনেক কিছুই বদলে যায়।

আমাদের পূর্বপুরুষেরা আগে অনেক কিছু করেছেন তাদের যুগের প্রেক্ষিতে ও প্রয়োজনে। সাহাবিদের মাঝেও যুদ্ধ হয়েছে। নবীর প্রিয় নাতিদেরকেও হত্যা করা হয়েছে। পুরানো ইতিহাস নিয়ে গ্লোরিফাই করাতে ব্যস্ত না হয়ে বর্তমান দুরাবস্থার কারণ কি তা দূর করে ভবিষ্যতের দিকে  তাকানো উচিত।

প্রশ্ন হচ্ছে আজকের বিশ্বে যে কোন ধর্মের নামে যুদ্ধ করা, জীবন দেয়া ও জীবন নেয়ার সে অধিকার কার আছে?  এক মাত্র নবী রাসুলদের জীবদ্দশায় এবং রাসুলের সাথে আল্লাহর ওহির নির্দেশ ছাড়া পরবর্তী যুগে ধর্মের নামে যুদ্ধের যৌক্তিকতা ও বৈধতা আনা হচ্ছে এখতিয়ার বর্হিভুত কাজ এবং বর্তমান সভ্যতার আন্তর্জাতিক আইনেও সেটি নিষেধ।। আজ মানুষ সেটি বুঝতে পেরেছে বলেই ধর্মের নামে ইউরোপিয়ানদের ক্রুসেড যুদ্ধের বর্বরতাকে মানুষ ধিক্কার দেয় এবং তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে রাসুল (স:) এর যুগে ইসলামের বিরুদ্ধে যারা ছিল তাদের সাথে কেন একাধিক যুদ্ধ করতে হয়েছিল?
অবশ্য সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজার আগেই হয়তবা কেউ বলতে চাইবে “যেহেতু অবিশ্বাসীদের সাথে সে সময় যুদ্ধ করতে হয়েছিল তাই আমাদেরকেও আজ সেভাবে যুদ্ধ করতে হবে এবং এটিই ঈমানের দাবী হওয়া উচিৎ।”

তবে এ চিন্তা মাথায় তখনই আসে যখন কুরআনের আলোকে ইসলামকে না বুঝে কিছু অতীত ঘটনা ও কারো ব্যাখ্যার মারপ্যচে ইসলামকে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে দেখতে চাইলে।  আর তা করতে গিয়ে যে সংঘর্ষ ও সংঘাত আসবে কখনও নিজেদের ভুল পদক্ষেপে কিংবা অন্য কোন কারণে তখন সেটিকেও তারা সত্য মিথ্যার সংগ্রাম বলে বিশ্বাস করতে চাইবেন এবং প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দিতে শহীদি কাফেলায় যুগ দিবেন। তবে সময়ই একদিন বলে দিবে যে এসব চিন্তা সঠিক না সিলেবাস বহির্ভূত পণ্ডশ্রম।

মানুষের সমাজের কিছু প্রথা বিশেষ করে ধর্ম বিষয়ের অনেক কিছু চালু হয়ে হয়ে যায় এক ধরনের ব্যাখ্যার মারপ্যচে যার পিছনে সত্যিকার কোন প্রমাণ নাই এবং বাস্তব ভিত্তিক যুক্তিও নাই। অতীতের যে কোন সংঘর্ষ ও সংঘাতের উদাহরণ যে যুগে ঘটেছে সেখানে রেখে দেয়াটাই উত্তম।

আল্লামা ইকবাল মুসলমানদেরকে ইসলামের ইতিহাসের প্রখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ইবনে খালদুনের “আল মুকাদ্দিমাহ” পড়ার জন্য  বলেছিলেন অনেক আগেই। চৌদ্দ শতাব্দীর প্রখ্যাত সেই মুসলিম পণ্ডিত ইবনে খালদুনের প্রচুর সংখ্যক যুগান্তকারী জ্ঞানগর্ব লেখার অন্যতম পুস্তকটিকে হচ্ছে “আল মুকাদ্দিমাহ” ( যার অর্থ “পরিচিতি” বা ইনট্রোডাকশন)। তার এ পুস্তকে বর্ণিত তথ্যকে বলা হয় আধুনিক বিশ্বের ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃতাত্ত্বিকতা এবং অর্থনীতি দর্শন সহ জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

ইসলামী স্কলার জাবেদ আহমেদ ঘামিদি যথার্থই বলেন যে যারা আজ ইসলামী রাজনীতি করে বিপ্লব ঘটাতে চান তাদের উচিত আল মুকাদ্দিমাহ পড়ার এ ছাড়াও  Arnold J. Toynbee সহ পশ্চিমা বিশ্বের বড় বড় দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ এবং সমাজ বিজ্ঞানীদের বই পুস্তক পড়াও দরকার যাতে জানা যায় সভ্যতার বিকাশ কিভাবে ঘটে? সমাজ কিভাবে পরিবর্তন হয়?  শহরের জীবন গ্রামের জীবন থেকে কেন পৃথক হয়? সামন্তবাদ কিভাবে সমাজকে ধ্বংস করে, শিল্প বিপ্লব কিভাবে কর্ম ক্ষেত্রে নারী পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে এবং কিভাবে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে, কিভাবে দেশে পুঁজিবাদ গড়ে উঠে ইত্যাদি বিষয়ে পরিষ্কার জ্ঞান ছাড়া আপনি স্বপ্ন দেখতে পারেন কাজের কাজ কিছুই হবে না। মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশে যে প্রক্রিয়া কাজ করে সেই  বাস্তবতা বুঝতে হবে। সমাজ পরিবর্তনে বিপ্লব ঘটাতে ধর্মীয় আবেগপ্রবণ প্রত্যাশা  খারাপ কিছু নয় তবে অবশ্যই তা বাস্তবতার নিরিখে হতে হবে।

মুহাম্মদ ইবনে খালদুন (১৩৩৭) তার কিতাব মুকাদ্দিমাহতে ফার্সী ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মতো প্রাচীন সভ্যতার উত্থান ও পতনের বর্ণনা দিয়েছেন।
ইবনে খালদুনের মতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় যখন যাযাবর উপজাতিরা এক জায়গায় বসতি স্থাপন করে । তখন তারা তাদের সভ্যতা এবং শহরগুলি তৈরি করার সাথে সাথে, সেটির অবক্ষয় শুরু হয়। তারা যখন তাদের গীর্জা এবং প্রাসাদগুলি নির্মাণ করার সময় এবং তাদের বই এবং কবিতা লেখার সময়, নগরবাসী আস্তে আস্তে অবশ্যই কিন্তু তাদের সেই যুদ্ধাংদেহী বর্বর পেশী শক্তি এবং প্রাণশক্তি হারাতে থাকে।

তবে প্রথম দিকে, নতুন সাম্রাজ্য সহজেই এই আক্রমণগুলি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলেও পরে ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের নাগরিকদের যুদ্ধের শক্তি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাওয়ার কারণে বাহিরের আরেকটি একটি নতুন উপজাতি সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীকে জয় করতে, তার নেতাদের হত্যা করতে, তার শহরগুলিকে পোড়াতে এবং নিজস্ব সাম্রাজ্য গড়ার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নতুন উপজাতি বসতি স্থাপন করার সাথে সাথে এবং নতুন সাম্রাজ্য বাড়ার সাথে সাথে এর নাগরিকরা নগরবাসীতে পরিণত হয় এবং এক সময় তারাও দুর্বল হয়ে যায়। বেশ কয়েক শতাব্দী পরে, নতুন সাম্রাজ্য খুব ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যায় এবং বর্বর একটি নতুন প্রজন্মের দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায় – এবং চক্রটি আবার শুরু হয়।
মুহাম্মদ ইবনে খালদুনের মতে, মানবজাতির সর্বজনীন ইতিহাস হ’ল “মরুভূমির যাযাবর এবং নগরবাসীর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার অবিরাম পুনরাবৃত্তি” । (সুত্র)

সে যাক ফিরে যাই সেই প্রশ্নে রাসুল (স:)কে কেন যুদ্ধ করতে হয়েছিল?

এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য প্রথমেই দেখা দরকার আল্লাহ যখন কোন জনপদে নবী রাসুল পাঠান তখন আল্লাহর সিদ্ধান্ত বা আল্লাহর আদালতের রায়টি কি থাকে? অবশ্য তা জানতে আমাদেরকে ইতিহাস দেখতে হবে তবে মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ হল সে তথ্য আল্লাহ কোরআনেই বর্ণনা করে দিয়েছেন।

কোরআনের শিক্ষা হচ্ছে  কোন জনপদে যখন রাসুল সশরীরে বিদ্যমান থাকেন এবং মিথ্যার বিপরীতে সত্য প্রকাশিত হয় তখন আল্লাহ সে অবিশ্বাসী জাতির উপর কখনও গায়েবী শাস্তি পাঠান কখনও তার রসুলদের অনুসারীদেরকে দিয়ে সেটি সম্পন্ন করেন এবং তার দ্বীনকে কামিয়াব করেন। সেটিই আল্লাহর সিদ্ধান্ত। যা অবিশ্বাসীদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয় এর প্রমাণ শেষ নবী রাসুল (স:) সহ অন্যান্য রসুলদের বেলা যেমন নুহ,মুসা (আ:) থেকে আ’য়াদ সামুদ ইত্যাদি বিভিন্ন জাতির ব্যাপারে বাস্তবায়িত হয়েছে।

“হুওয়াল্লাযী আর্সালা রাসূলাহূ বিল্ হুদা ওয়া দীনিল্ হাকক্বি লিইয়ুজ্ হিরাহূ ‘আলাদ্দীনি কুল্লিহী ওলাও কারিহাল্ মুশরিকূন্।”

অর্থাৎ তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি সকল দ্বীনের উপর তা বিজয়ী করে দেন। যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।” (সুরা ৬১.৯)” এবং সেটি আরবের বুকে বাস্তবায়িত হয়েছিল  এবং ইসলাম  আজও পৃথিবীর  বুকে একটি জীবন্ত ধর্ম  হিসাবে প্রতিষ্ঠিত আছে লক্ষ কোটি মানুষের মাঝে। 

তাই রসুলদের সে যুগ পেরিয়ে ইসলাম নিয়ে এখন সশস্ত্র যুদ্ধ বা রাজ্য বিস্তারের বৈধতা নাই, খিলাফত গড়ার সে সুযোগ ও পরিবেশ নাই।  মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বড় জোর বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের  সমন্বয়ে একটি  কমনওয়েলথ (commonwealth) করা যেতে পারে।

আজকের যুগে ইসলামকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে সেটি হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ (Intellectual war) দিয়ে এবং ইসলামকে যারা প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতার উদাহরণ দিয়ে।كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولاً مِّنكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ যেমন, আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে একজন রসূল, যিনি তোমাদের নিকট আমার বাণীসমুহ পাঠ করবেন এবং তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তাঁর তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না। [ সুরা বাকারা ২:১৫১ ]


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *