বাংলাদেশে সুশাসনের প্রস্তাব

বাংলাদেশে সুশাসনের প্রত্যাশা যদিও সবার মনে কিন্তু সে সুশাসন আদৌ আসবে কিনা তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি অবিচার, নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো বহু বছর ধরে চলে আসা বিভিন্ন সরকারে আমলের অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কুসংস্কৃতির ধারাবাহিকতা সেই হতাশাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সবাই না হলে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ একমত হবেন যে, এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আইনের শাসন, মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেশটি সঠিক পথে এগোচ্ছে না। উপরন্তু স্বৈরাচারী রাজনীতি এবং রাস্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির অপসংস্কৃতি এখন দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। স্পষ্টতই, এটি একটি দেশের জন্য সুখবর নয়।

অতএব, যদিও দেশের মানুষ একটি পরিবর্তন দেখতে চায় কিন্তু কেউ নিশ্চিত নয় যে সরকার পরিবর্তন করলেই সত্যিকার অর্থে কোন পার্থক্য হবে কি না। এর কারণ হল বিকল্প কোন সিস্টেম বা দিকনির্দেশনা নেই  কিংবা  সে ব্যাপারে কেউ সঠিক কোন রোড ম্যাপ দেখাতে পারছেন না যা মানুষ দেখতে পারে এবং তা অর্জন করতে সবাই সচেষ্ট হতে পারে।

একটি দূরদর্শী নেতৃত্বের অনুপস্থিতি মানুষকে কোন পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করতে নিরুৎসাহিত করছে, যদিও সবাই পরিবর্তন দেখতে চায়।

দুর্ভাগ্যবশত, ক্ষমতাশীন কিংবা বিরোধী শিবিরের নেতাদের কেউ এটি উপলব্ধি করছেন বলে প্রমান মিলে না। যদিও আমরা তাদের মনে খবর জানিনা, কিন্তু বাস্তবতা থেকে বোঝা যায় যে রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় গুনগত পরিবর্তনের চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতার আসনটি ধরে রাখাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।

আর সে হিসাবে বিরোধী দলের নেতাদেরও অগ্রাধিকার হচ্ছে শুধু সরকারের সমালোচনা করা এবং শাসক দলের হোমড়া চোমড়া বা অলিগার্কিদের বিভিন্ন কেলেঙ্কারী ছড়ানোর ক্ষেত্রে সোচ্চার হওয়া।

অবশ্য, এটি শাসক দলের জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। যে কারণে তাঁদের হাজারো ভুলভ্রান্তি ও অন্যায়  সত্বেও এ সবের বিরুদ্ধে কোন প্রকার গণআন্দোলনের ভয় ছাড়াই তাঁদের শাসন চালিয়ে যেতে পারছেন। তদুপরি, সরকার এমন একটি ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করছে যে, সরকারী নীতি বা কেলেঙ্কারীর বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে রাষ্ট্র-বিরোধী প্রচারনা এবং ইতিমধ্যে তাঁরা এর জন্য “স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি” হিসাবে একটি ট্যাগ শব্দ তৈরি করে নিয়েছেন। 

এর সমাধান কি?

এর সমাধান হচ্ছে সংবিধানে নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুলির দাবি করা যা একটি সিস্টেম/প্রক্রিয়া তৈরি করতে পারবে এবং তা দিয়ে উপরে বর্ণিত বর্তমান জগাখিচুড়ি অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করতে পারবে। অবশ্যই, সংবিধানে কেবল পরিবর্তনই যথেষ্ট হবে না যদি মানুষ সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ না করে।

আমাদের পাঠকদের অনুরোধ করব যে নীচের প্রস্তাবগুলি একবার দেখুন এবং চিন্তা করুন যা প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তন বা আরো উন্নত করা যেতে পারে। আমরা এখানে ব্যাখ্যা করব কীভাবে প্রতিটি পয়েন্ট বর্তমান কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় সৃষ্টিকৃত অনেকগুলি সমস্যার সমাধান করতে পারে। তবে এটি কেবল তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের দ্বারাই অর্জন করা সম্ভব হবে, পুরানো নেতৃত্বের উপর নির্ভর করা উচিত হবে না কারণ তাদের নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি তরুণ নেতৃত্ব তাঁদের দৃঢ়সংকল্প এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এই বিষয়গুলিতে শীঘ্রই একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে পারবেন।

প্রস্তাবসমূহ:

১.   কোন ব্যক্তিকে দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত থাকার অনুমতি দেওয়া হবে না।
মনে রাখতে হবে আল্লাহর এ জগতে কেউই অপরিহার্য নয়। সব কিছুরই একটি বিকল্প আছে, অন্যথায় বিশ্ব এগিয়ে যেতে পারত না। আমাদের নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার সুযোগ দিতে হবে। এভাবেই সভ্য সমাজ সমৃদ্ধ হয়। এই দুই মেয়াদের সীমাবদ্ধতা রাজনৈতিক অঙ্গনে খারাপ নেতৃত্বকে ফিল্টার করতে পারবে। তাছাড়া যিনি ক্ষমতায় যাবেন তিনি বুঝতে পারবেন যে তিনি দুই মেয়াদের পর সেখানে থাকবেন  না। সুতরাং, তিনি যখন ক্ষমতায় থাকবেন তখন মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ার আগে দু’বার ভাববেন যা স্বৈরাচারী হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক হিসাবেও কাজ করবে।

২.   বর্তমান সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির সরকার ব্যবস্থা চালু করা উচিত।
কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সংসদীয় ব্যবস্থা প্রায়শ:ই পরিবারতন্ত্র দিয়ে অপব্যবহার করা হয় যা রাষ্ট্রপতির সরকার ব্যবস্থা দিয়ে বন্ধ করা যেতে পারে। সেখানে প্রতিযোগিতা হবে প্রার্থীদের যোগ্যতা এবং দক্ষতার উপর ভিত্তি করে, পারিবারিক সর্ম্পক দিয়ে নয়।)   

3.   জবাবদিহিতা এবং ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে একটি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করা আবশ্যক।

৪.   গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অপরিহার্য। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা ও নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাতে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে।

৫.   গণভোট ছাড়া সংবিধানে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন আনা যাবে না এবং ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই সে ব্যাপারে জনগণকে অবহিত করতে হবে। এটা ক্ষমতাশীন দলেকে কেবল তাদের ইচ্ছা ও সুবিধামাফিক সংবিধান পরিবর্তন করা থেকে রক্ষা করবে।

৬   বিচার বিভাগকে কার্যনির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করতে হবে, বিচার বিভাগের দায়িত্ব হবে সংবিধানকে সমুন্নত রাখা এবং আইনের শাসন সকলের জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা যাতে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়। একটি স্বাধীন সৎ বিচার ব্যবস্থা হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মেরুদণ্ড।

৭.   সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র মেধা-ভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বিশেষ করে কারও সুপারিশের ভিত্তিতে অন্য কোনোভাবে নিয়োগ দেয়া যাবে না।

৮. সরকারি কর্মচারীকে তার আইনগত পেশাগত দায়িত্ব পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দিতে হবে এবং দায়িত্ব পালনের সময় যদি তিনি কোনো ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নেন তাহলে তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

৯.   অবৈধ অর্থ উপার্জনের হাতিয়ারের জন্য রাজনীতি বন্ধ করতে হলে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। এ জন্যই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় দলীয় প্রার্থীর মনোনয়নের যে নীতি প্রতিটি দলকে অনুসরণ করতে বাধ্য করা উচিত তা হবে দলীয় মনোনয়ন দিতে শুধু দলের এলাকাভিত্তিক তৃণমূল কর্মীরাই ওই এলাকার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেবেন। কেন্দ্রীয় নেতারা কেবল তাঁদেরকেই নমিনেশন দিবেন। উন্নত দেশে এভাবেই নমিনেশন দেয়া হয়।

১০. যদি কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক স্বার্থের সাথে রাষ্ট্রের স্বার্থের সংঘাত হয় তবে সেই ব্যক্তিকে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।

১১. সংসদ সদস্যকে তার এলাকার উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক লেনদেন, ঠিকাদার মনোনয়ন ও প্রকল্পের যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্মপ্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে হবে।   

১২. সাংসদ হওয়ার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা যোগ্যতার তালিকায় যোগ করতে হবে।

১৩. নৈতিক ভিত্তি একক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক। মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যম ইত্যাদির মতো বর্তমান বহুস্তরীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। 

১৪. বাংলাদেশের সংবিধানে ন্যায়পালের বিধানকে বাস্তবায়িত করতে হবে। 

১৫.   তবে সিস্টেম থাকলেও ষড়যন্ত্রকারী বা দুর্নীতিবাজ মানুষেরা যে সে ব্যবস্থা এডিয়ে যেতে বা ম্যানিপুলেট করতে করার চেষ্টা করবে না তা বলা যায় না। অতএব, সেই অনুযায়ী সে সমস্যার সমাধান করতে এবং সিস্টেমটিকে কার্যকর রাখতে যে সমস্ত বাধা আসতে পারে তা খুঁজে বের করার জন্য চলমান গবেষণার ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রয়োজনে যেসব দেশ এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে, তাদের মডেল অনুসরণ করতে হবে।

উপসংহার:

বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির রাজনীতি বন্ধ করতে উপরোক্ত বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে রাজনীতি ও রাস্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত দেশে কোন গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক উন্নত রাষ্ট্রে গড়তে যাবতীয় অব্যবস্থা, অনিয়ম এবং দুর্নীতি দূর করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। এটা তখনই সৃষ্টি হতে পারে যখন এই স্রোতে সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ শামিল হবে।

অতএব উপরোক্ত প্রস্তাবগুলোর দাবীতে যদি একটি গণজাগরন তৈরি করা যায় এবং জনসাধারণের দাবিতে পরিণত করা যায় তখন রাজনৈতিক দলগুলি বাধ্য হবে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে যে তারা এগুলি গ্রহণ করবে কি না।

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *