
35 জন পড়েছেন
অসার যুক্তির একটি হচ্ছে বৃত্তাকার যুক্তি বা সার্কুলার লজিক। এই যুক্তি ও তার দলিল সে নিজেই। এটা এভাবে:
ক: অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ।
খ: কে বলেছে?
ক: অভিযুক্তই বলেছে।
বিষয়টিকে আরেকভাবে দেখানো যায়। প্রায় দুই দশেক আগে ইংল্যান্ডে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে বাড়ি কেনার এক হিড়িক পড়ে। লোন আনতে ব্যাঙ্ককে আয়ের পরিমাণ দেখানো জরুরি ছিল –অর্থাৎ মাসে আপনার আয়ের পরিমাণ কত। কিন্তু কোন কারণে ব্যাঙ্ক সেই নিয়মটি শিথিল করে ফেলে এবং মার্কেটে একটি নতুন ধারা শুরু হয় আর সেটির নাম হয়: ‘সেলফ সার্টিফাইড ইনকাম’ – অর্থাৎ আপনি মাসিক একটি আয়ের পরিমাণ বললেন, তারপর এর প্রমাণ আপনি নিজেই তৈরি করে নেবেন। একখানা চিঠিতে বলবেন আমার আয়ের পরিমাণ হচ্ছে এই। বস এটাই আপনার এডিডেন্স বা প্রমাণ।
এভাবে যেকোন অঙ্গনেই যখন ঘুরে-ফিরে প্রমাণ নিজ-কেন্দ্রিক থেকে যায় তখন সেটিকে বলা হয় সার্কুলার লজিক বা বৃত্তাকার যুক্তি, বা প্রমাণ। এবারে বাইবেল বিষয়ে একটি সার্কুলার লজিক দেখানো যাক।
ক: ঈসা আল্লাহর পুত্র।
খ: আপনি কীভাবে জানেন?
ক: বাইবেল বলেছে।
খ: বাইবেল বললেই এটা মেনে নেয়া বা গ্রহণীয় হবে কেন?
ক: কারণ বাইবেলে আল্লাহ নিজেই বলেছেন তাই মানা হবে।
খ: আপনি জানলেন কী করে যে আল্লাহই তা বলেছেন?
ক: কারণ বাইবেলই বলেছে।
ঈসার প্রতিপক্ষের দাবী বাইবেল ঈসার কালাম এবং ঈসার কালাম দিয়ে ঈসার কালামের সত্যায়ণ হচ্ছে।
-দুই-
এবারে পীর দিয়ে বৃত্তাকার যুক্তির আরেকটি উদাহরণ নেয়া যাক। কোন পীর ভণ্ড হলেও তাকে কেন্দ্র করে অনেক ভাল ভাল কথা ও ভাল কাহিনী থাকে। এটা পীরের প্যাকেজেরই একটি বিষয় এবং এখানেও থাকে সেলফ-রেফরেন্সিং (self-referencing) সমস্যা বা সার্কুলার লজিক। আপনি যখন কোন পীরের প্যাচ ও প্রতারণার বিষয়ক উত্থাপন করবেন, তখন পীরের মুরিদগণ আপনাকে পীরের পক্ষ থেকে ভাল ভাল নৈতিক কথা শুনিয়ে দেবে। এটাও বলবে, ‘পীর নিজেই বলে থাকেন প্রতারণা একটি খারাপ জিনিস।’ তো পীর প্রতারণা করেই যদি বলেন যে ‘প্রতারণা একটি খারাপ জিনিস’ এতে কি মূল সমস্যার কোন সমাধান হয়?
এই ধরণের বিষয় বিশ্বাসের বাজার সংস্কৃতির বিষয়। এর প্যাচালো ভাষা থাকে। এর ইতিহাস থাকে, পদ্ধতিগত বিষয় থাকে, এবং সার্বিক সংস্কৃতির শক্তির প্রাবল্যেই তা অনন্তকাল চলতেই থাকে। আর মানব প্রকৃতিতে এটাও রয়েছে যে তারা দেখেও দেখে না, শুনেও শুনে না, বুঝেও বুঝে না।
-তিন-
সার্কুলার লজিকের তৃতীয় উদাহরণ
কোনো বিষয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তির ক্লেইম (দাবী) থাকতে পারে। একটি কেস (case) যখন কোর্টে উত্থাপিত হয়, তখনও দাবীর বিষয় থাকে। কারো দাবী হয় সে নির্দোষ, আর প্রতিপক্ষের দাবী হয় সে ‘দোষী’। কিন্তু মূল “সত্য” কোথায় পাওয়া যাবে, এবং কীভাবে নির্ধারণ করা হবে?
চলুন আমরা কোন এক অভিযুক্ত ব্যক্তির উদাহরণ নেই। সে যখন অভিযুক্ত হয়ে আদালতে যায়, তখন তার নির্দোষিতা দেখিয়ে একটি এফিডেভিট রচনা করে। ধরুন আপনার হাতে তার এফিডেভিট।
এখন আপনি কী করবেন? এফিডেভিটখানি পাঠ করেই কি বলবেন সে নির্দোষ, কারণ ‘সে বলেছে’ সে নির্দোষ, তার এফিডেভিটে নির্দোষিতা ‘লেখা’ রয়েছে? আপনি কি এভাবে উদ্ধৃতি টানবেন: দ্বিতীয় পৃষ্ঠার তৃতীয় প্যারাগ্রাফে লেখা আছে, ‘আমি একজন নামাজি মানুষ, আমি সততা অবলম্বন করি, আমি ভাল কাজ করি।’ তারপর পঞ্চম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফের তৃতীয় লাইনের উদ্ধৃতি আনবেন এই বলে, ‘আমি ঐ অন্যায়ের সাথে জড়িত নই, আমি সর্বদা পড়াশুনায় ব্যস্ত-থাকা একজন লোক।’ তারপর কি আপনি এই সিদ্ধান্তে যাবেন যে সে একজন নামাজি, সৎ লোক, জ্ঞানী ব্যক্তি, তার পক্ষে অন্যায় কাজ হতে পারে না, সে অবশ্যই নির্দোষ কেননা তার এফিডেভিটই সেই সত্যের সাক্ষ্য বহন করে?
সত্য কি এভাবে নির্ণীত হয়? না। বিষয়টা এভাবে নয়। এখানে যে দলিল উদ্ধৃত করা হচ্ছে সেটা দাবীদারেরই এফিডেভিট। আদালতের বিচারক এই এফিডেভিট দেখে কোন রায় দেবেন না। এই এফিডেভিট থেকে যতই উদ্ধৃতি দেয়া হোক না কেন, তা হবে নিছক সেফ-রেফরেন্সিং। সার্কুলার যুক্তি।
ঠিক এভাবে আপনি যদি দেওয়ানবাগীর বক্তব্য ও তার অনুসারীদের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের সত্য নির্ধারণ করতে যান, তবে তা কি সঠিক হবে?
আপনাকে মনে রাখতে হবে, পীর তার নিজের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেই, তারপর তার নিজ হাতে মাথা ধুলাই-করা শাগরেদগণও তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। তার আঙ্গিনায় যে বাজার রয়েছে সেটা তারই অর্কেস্ট্রা, তারই বেহালার সুর। সুতরাং আপনাকে ময়দান অধ্যয়ন করতে হবে, অবস্থান (circumstance) বিবেচনা করতে হবে, নিরপেক্ষ সাক্ষ্য দেখতে হবে, সেই আঙ্গিনায় কী হতে পারে, কী পারে না সেটা বিবেচনায় গ্রহণ করতে হবে, নিরপেক্ষ ও শাস্ত্রীয়ভাবে যুক্তিজ্ঞান ব্যবহার করতে হবে, কথাবার্তার বৈপরীত্যের প্রতি ঘন-নিবেশ করতে হবে, এসবের জন্য অনেক স্কীল ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। তবে আদালতে যে ব্যক্তির ১০ কথায় ৩ কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়, তার আর কেস থাকে না।
35 জন পড়েছেন