কোরানের আলোকে ইসলামের ইতিহাস (৫)

প্রাচীন সময়ের নীল নদের অববাহিকা

ইজিপ্ট গবেষকরা প্রাচীন ইজিপ্টের ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করেছেনঃ ঐতিহাসিক যুগ ও রাজবংশের যুগ। ঐতিহাসিক যুগে এই ভূমি ছোট ছোট স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। পর্যায়ক্রমে একিভূত হতে হতে দুটি বড় রাজ্যে পরিনত হয়। ভিতরের অংশগুলো নিয়ে গঠিত হয় আপার ইজিপ্ট , নীল ব-দ্বীপ সহ উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে লোয়ার ইজিপ্ট। এই অবস্থা চলতে থাকে ৩০২০ খৃঃপূঃ পর্যন্ত , যখন রাজা নারমার প্রথমবারের মতো আপার ও লোয়ার ইজিপ্টকে এক করতে সমর্থ হন এবং শুরু হয় রাজবংশের যুগ।নারমার থেকে শুরু হয়ে একে একে ৩০টি রাজপরিবার ইজিপ্ট শাসন করে এবং এই শাসন শেষ হয় ৩৩২ খৃঃপূঃ আলেক্সান্ডার দি গ্রেট কর্তৃক ইজিপ্ট জয়ের মাধ্যমে। শুরু হয় টলেমি যুগ।

ঐতিহাসিক যুগে দেশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত ছিল বিধায় ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই নীল ব-দ্বীপের কোন নাম খুজে পায়নি। রাজা নারমার সকল অঞ্চলকে নিয়ে এক দেশ বানানোর পরে এই দেশের নাম দেন কেমেট বা কেমে , যা হিয়েরোগ্লাফিক বর্ণে লেখা। (হিয়েরোগ্লাফিক বর্ণে লেখা নাম নিচে দেয়া হলো) কেমেট অর্থ – কাল ভূমি। কেউ কেউ “খেমে” উচ্চারন ও করেন। সেই সময়ের অধিবাসীদের ডাকা হতো “Remetch en Kemet” / কাল ভূমির লোক।

পরবর্তিতে এই দেশটির নাম নিয়ে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ববিদদের মাঝে মত পার্থক্য আছে। কারো মতে বিখ্যাত দেবী ” প্তাহ ” র নাম অনুসারে দেশটির নাম হয় ” হেট-কা-প্তাহ” অর্থাৎ প্তাহর কার রাজত্ব। কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন এই নামটি পুরো দেশের নয় , বরং রাজধানি মেম্ফিস ও পার্শবর্তি এলাকার নাম। আবার ৩য় এক পক্ষ মনে করেন নীল নদ রেড সীর সবচেয়ে নিকটবর্তি হয়েছে যেখানে , সেই অঞ্চলের নাম এটি।

আমাদের ও মনে হয় সম্ভবত “হেট-কা-প্তাহ” নামটিই সঠিক , কারন এটারি গ্রীক অপভ্রংশ Aegyptos/ ইজিপ্ট। যাই হোক না কেন , আমরা ৩টি নাম পেয়েছি এপর্যন্তঃ- “কেমেট , খেমে ও হেট-কা-প্তাহ”। যার একটির ও সাথে “মিস্‌র/মিশর” নামের মিল নেই। বরং কিব্‌তের মিল পাওয়া যায়। হেট-কা-প্তা >Aegypto>ইজিপ্ট> ই-গিপ্ত>গিপ্ত>কিব্‌ত।

নীল নদ অববাহিকায় পারস্য/ইরানি শাসন

দুটি ভিন্ন সময়ে ইরানিরা এই দেশ শাসন করেছে। প্রথমবার ৫২৫ খৃঃপূঃ থেকে ৪০৪ খৃঃপূঃ পর্যন্ত ৫জন ইরানি রাজার অধীনে এই দেশ শাসিত হয়েছে , যাদের শেষ জন ছিলেন রাজা দ্বিতীয় দারিউস। দ্বিতীয়বার তারা শাসন করে ৩৪১ খৃঃপূঃ থেকে ৩৩২ খৃঃপূঃ পর্যন্ত এবং এই শাসনের অবসান ঘটে আলেক্সান্ডার দি গ্রেটের বিজয়ের মাধ্যমে। ইরানিদের শাসন আমলের এমন কোন রেকর্ড বা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় নি যাতে জানা যায় ইরানিরা দেশটির নাম পরিবর্তন করে মিস্‌র বা সাদৃশ্য কোন নাম রেখেছিল।

গ্রীক ও রোমান শাসন

টলেমিক যুগ শুরু হয় ৩৩২ খৃঃপূঃ লাগোস (১ম টলেমি) পুত্র রাজা টলেমির নীল অববাহিকার শাসনভার গ্রহনের মাধ্যমে এবং শেষ হয় রোমান সম্রাট আগস্টসের বিজয় দিয়ে ৩০ খৃঃপূঃ। গ্রীক ও রোমানরা কিছু কিছু শহর ও অঞ্চলের নাম পরিবর্তন করেছে তাদের জন্য উচ্চারনের সুবিধার্তে । যেমন বৃটিশরা বাংলাকে করেছে বেঙ্গল , কলিকাতাকে ক্যাল্কাটা , ঢাকাকে ড্যক্কা ইত্যাদি, তেমনি গ্রীক ও রোমানরা মেম-নোমেরকে মেমফিস এবং দেশটির নাম হেট-কা-প্তাহ থেকে Ae-gyp-tus /ইজিপ্ট করেছে। এবং তখনকার যত মানচিত্র পাওয়া যায় সব তাতেই এই Ae-gyp-tus বিদ্যমান। কোথাও মিস্‌র/মিশর নেই। এমনকি মিশর নামে কোন ছোট খাট শহরের নাম ও নেই। প্রাচীন দুটি মানচিত্র দিলাম , দেখুন তখন থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিমারা নীল নদের দেশকে ইজিপ্ট বলেই জানে। এমন কি কম গুরুত্বপূর্ণ পার্শবর্তি দেশ লিবিয়ার নামের ও কোন পরিবর্তন হয় নি। তাহলে কবে থেকে মুসলমানরা বিখ্যাত এই দেশ ইজিপ্ট/কিব্‌ত কে মিস্‌র /মিশর বলা শুরু করল?

মজার ব্যাপার হলো বর্তমানকালে পশ্চিমা দেশের লোকের সাথে আলাপকালে স্বতস্ফুর্তভাবে বলবে আমি ইজিপ্সিয়ান (কিব্‌তি) আবার সেই একি লোক আরবের লোকের কাছে বলবে আমি মিছ্‌রি। কখনো কি ভেবে দেখেছেন ইজিপ্সিয়ান খৃষ্টানদের কেন কপ্টিক (কিব্‌তি) খৃষ্টান বলে? এদের সাথে গ্রীক রাশান ও অন্যান্য খৃষ্টানদের বিশ্বাস বা ধর্মীয় রীতি নীতিতে কোন পার্থক্য নেই। আবহমান কাল থেকে চলে আসা এদের জাতীয় পরিচিতি তুলে ধরতেই কপ্টিক নামকরন।

আমরা দেখলাম আঁদিকাল থেকে মুহাম্মদ পরবর্তি সময় পর্যন্ত নীলনদের দেশকে সকলে কিব্‌ত/ইজিপ্ট নামেই জানত। আল্লাহ নিশ্চয় কোরানের মাধ্যমে ইজিপ্টের নাম পরিবর্তন করে মিস্‌র রাখেন নি , এমনটি হলে কোরানে তার উল্লেখ থাকত। এমন ও তো হোতে পারে , সম্ভবত আল্লাহ মিস্‌র দিয়ে ইজিপ্ট নয় , অন্য কোন দেশ বোঝাচ্ছেন।

ফেরাউন একজন নাকি অনেকজন

এখনকার সাধারন জ্ঞানমতে মিশরের রাজাদের টাইটেল ছিল ফেরাউন। এর অর্থ দাড়ায় রাজা নারমার থেকে শুরু করে ক্লিওপেট্রা পর্যন্ত প্রায় শত খানেক ফেরাউন ছিল। এসব আপাতত ভুলে, কোরানে বর্ণীত ফেরাউন সম্পর্কে জানার জন্য চলুন কোরানের আয়াতগুলো নিয়ে গভিরভাবে পর্যালোচনা করি।

যেটা আমাদের প্রথমেই নজর কেড়েছে, তা হলো কোরানে কখনোই বহু ফেরাউনের (ফারাইন) উল্লেখ করেনি। কোরানে শুধুমাত্র মুসার সমসাময়িক একজনই অত্যাচারী শাসক ফেরাউনের কথাই বলা হয়েছে। কোরানে প্রায় ৭০ জায়গায় ফেরাউনের কথা এসেছে কিন্তু কোথাও এমন ইঙ্গিত ও পাওয়া যায় না যে “ফেরাউন” নাম নয় , এটা টাইটেল এবং আরো অনেক ফেরাউন ছিল।

{আর যখন আমি তোমাদের জন্য বাহারকে (الْبَحْرَ) দ্বিখন্ডিত করেছি, অতঃপর তোমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছি এবং ডুবিয়ে দিয়েছি ফেরআউনের লোকদিগকে অথচ তোমরা তাকিয়েছিলে। ২:৫০} 

{আর মূসা বললেন, হে ফেরাউন, আমি বিশ্ব-পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত রসূল। ৭:১০৪} 

{ফেরাউনের নিকট যাও, সে দারুণ উদ্ধত হয়ে গেছে।২০:২৪} 

{অতঃপর ফেরাউন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল এবং ইয়াম ( الْيَمِّ ) তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জত করল২০:৭৮} 

এই আয়াতগুলো ফেরাউন নিয়ে কোরানের আয়াতের উদাহরন। ২:৫০ ও ২০:৭৮ আয়াতে “বাহার ও ইয়াম” শব্দদুটি খেয়াল করুন , আমরা এই শব্দদুটির অনুবাদ করিনি। এর তাৎপর্য পরে বলা হবে।

এতদিন পর্যন্ত আমরা জেনে এসেছি বা আমাদের জানানো হয়েছে যে, কোরানে যে মিস্‌রের কথা বলা হয়েছে তার রাজাদেরকে ফেরাউন বলা হতো এবং মুসার ফেরাউনের সমুদ্রে ডুবে মরার পরেও ক্লিওপেট্রা পর্যন্ত আরো অনেক ফেরাউন এই মিস্‌র শাসন করেছে। কিন্তু কোরান এটাকে অস্বীকার করে বলছে ভিন্ন কথা। কোরান বলছে ফেরাউনের ডুবে যাওয়ার পরে ইস্রাইলিরা মিস্‌র ও এর চারিপাশের উত্তরাধিকার/ মালিক হয়। অর্থাৎ মিশর শাসন করে ইস্রাইলিরা , অন্য কোন ফেরাউন নয়।

চলুন তাহলে চোখ খুলি ও পড়ি-

{অতঃপর আমি ফেরআউনের দলকে তাদের বাগ-বাগিচা ও ঝর্ণাসমূহ থেকে বহিষ্কার করলাম। এবং ধন-ভান্ডার ও মনোরম স্থানসমূহ থেকে।এরূপই হয়েছিল এবং বনী-ইসলাঈলকে করে দিলাম এসবের মালিক। ২৬:৫৭-৫৯}

{মূসা বললেন তার কওমকে, সাহায্য প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকট এবং ধৈর্য্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এ পৃথিবী আল্লাহর। তিনি নিজের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন এবং শেষ কল্যাণ মুত্তাকীদের জন্যই নির্ধারিত রয়েছে।৭:১২৮} 

{আর যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তাদেরকেও আমি উত্তরাধিকার দান করেছি এ ভুখন্ডের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের যাতে আমি বরকত সন্নিহিত রেখেছি এবং পরিপূর্ণ হয়ে গেছে তোমার পালনকর্তার প্রতিশ্রুত কল্যাণ বনী-ইসরাঈলদের জন্য তাদের ধৈর্য্যধারণের দরুন। আর ধ্বংস করে দিয়েছে সে সবকিছু যা তৈরী করেছিল ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় এবং ধ্বংস করেছি যা কিছু তারা সুউচ্চ নির্মাণ করেছিল। ৭:১৩৭}

তাহলে বোঝাই যাচ্ছে কোরানের মিস্‌র ও ফেরাউন আর আমাদের জানা ইজিপ্ট ও ফেরাউন এক নয়, কারন কোন ইতিহাস বা উৎস থেকে আমরা কখনো শুনিনি যে ইস্রাইলিরা কখনো মিশর /ইজিপ্ট শাসন করেছে বা মিশরের মালিক ছিল। কোরানের আয়াত বলছে ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় সুউচ্চ সহ যা কিছু তৈরি করেছিল ধ্বংশ হয়েছে। কিন্ত আমরা তো দেখি পিরামিড এখনো স্বমহিমায় দাড়িয়ে আছে।

চলবে••••

Comments are closed.