
225 জন পড়েছেন
কোনো মন্ত্র বস্তুর উপর প্রভাবশীল নয়, অর্থাৎ মন্ত্র কোনো বস্তুকে এখান থেকে সেখানে সরাতে পারে না বা পরিবর্তিত করতে পারে না। কিন্তু যারা মন্ত্রে বিশ্বাস করেন তাদেরকে কেউ অন্য কিছু বুঝাতে পারবে না, ঘুরে ফিরে তারা মন্ত্রের বিশ্বাস খোঁজে পাবেন। আমাদের জৈবিক পদার্থ-জগতে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস রয়েছে যেমন ভাইরাস (অতি-আণুবীক্ষণিক সংক্রামক জীব কোষ), ব্যাকটিরিয়া অর্থাৎ এককোষী মাইক্রোস্কোপিক জীব (single-celled organism),জার্ম (আণুবীক্ষণিক কণা (germ: microscopic particle): এগুলো অতি ক্ষুদ্র হলেও জৈব-জগতের অংশ। এগুলো মন্ত্র-ফুঁৎকারে বাঁচে-মরে না। মন্ত্র পড়ে আম গাছের উপর ফুঁৎকার করলে তা কাঁঠাল গাছ হবে না, লোহার উপর ফুঁৎকার করলে তা স্বর্ণে পরিণত হবে না — মন্ত্র যা’ই হোকনা কেন।
সুদূর অতীতে এক সময় তান্ত্রিক যুগ ছিল। সব কিছুতে মানুষ রহস্য খুঁজত। রহস্যের রোগ রহস্য দিয়ে নিবারণের চেষ্টা হত। মুখের উচ্চারিত শব্দ বস্তুতে ক্রিয়াশীল ভাবা হত। তাই, রোগীকে লক্ষ্য করে বলা হত, ‘হে রোগ, তোমাকে বলছি তুমি শীঘ্রই চলেও যাও, না হলে তোমার জন্য খবর আছে‘ –এই বলে রোগীর গায়ে ফুঁক দেয়া হত। কখনো কোন জীনের বা ভুতের নাম করা হত, আবার একান্ত ধর্মীয় অঙ্গনে খোদার নামে কিছু উচ্চারণ করে ফুঁক দেয়া হত। মানুষের দেহের ইমিউন সিস্টেমের (immune system/ বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার) কারণে কেউ ভাল হয়ে গেলে ধরে নেয়া হত ‘মন্ত্র কাজ করেছে’, কিন্তু মারা গেলে ধরে নেয়া হত, ‘হায়াত নেই’, তাই ‘মউত হয়েছে’। আর এভাবে মন্ত্রের রহস্য বেঁচে থাকত এবং আজও আছে। এমন কাহিনী সংখ্যায় লক্ষ, লক্ষ রয়েছে। মন্ত্র-সার্থক কাহিনীসমূহ সংখ্যায় লক্ষ, লক্ষ রয়েছে। এইসব বর্ণনাই মানুষকে বাস্তবতার এহসাস দেয়, কেননা বর্ণনা এমন এক ভাষিক ক্যাটাগরি যা হাজার হাজার বছর ধরে এই ভাষিক মানব সত্তাকে জগত সম্পর্কে অবহিত করছে — ভুল-শুদ্ধ নির্বিশেষে।
তান্ত্রিক যুগ অতিক্রান্ত হলেও তান্ত্রিকতা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি। ধর্ম ও তান্ত্রিকতা এক সাথে চলতে পারে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে তার প্রচার ও প্রসার চলতে থাকে। এই শিক্ষার মাধ্যমে যেহেতু এক শ্রেণীর মানুষের পেট-পিট চলে তাই এটিকে টিকিয়ে রাখা শিক্ষার্থীদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং প্রক্রিয়াগত ধারায় প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রচার ও প্রসার হয়, এবং প্রজন্ম পরম্পরায় তা চলতে থাকে এবং থাকবেও। এর আরেকটি কারণ মানুষ পৈতৃকসূত্রে রহস্য ঘেরা জগতে দাখিল হয় এবং পৈতৃক-প্রথার পবিত্রতায় চালিয়ে নেয়।
এক সময় বড় বড় মহামারি রোগকে মানুষ জীব-জন্তুর আকারেও দেখত। আমার নানা কলেরার ‘বলা’কে দেখেছিলেন। এই ‘বলা’ সাদা-কালোর ফুটফুটে দেহধারী জন্তু ছিল, অনেকটা কুকুরের ন্যায়। কিন্তু বাস্তবে ফুটফুটে দেহধারী কোন ‘বলা’ ছিল না। ‘বলা’ শব্দটি আরবি থেকে এসেছে। আরবি উচ্চারণে সেটা হচ্ছে ‘বালা’ (بلاء) মানি সংক্রামক রোগ, বিপদ-মসিবত ইত্যাদি। আজ কেউ আর কলেরার ‘বলা’ দেখে না, কেননা বিজ্ঞান এই রহস্য ভেদ করে ফেলেছে, কিন্তু এখনো ‘পানি-পড়া’ও চলে, মন্ত্র পড়ে ফুঁৎকারও চলে। কারণ সেই ট্রিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রির প্রচারণা ও কেরামতি — কথায় আছে না ‘বিশ্বাসে মিলিবে বস্তু, তর্কে বহু দূর’। যারা দেহের ইমিউন সিস্টেমের কারণে বেঁচে যায়, তারা মন্ত্রপাঠের কার্যকারিতা প্রমাণ করে যায়।
করোনা-ভাইরাসের ব্যাপারে অনেকের বক্তব্য ছিল যে তা কাফিরদের উপর খোদার গজব, তারপর তা পরিবর্তিত হল, তারপর শোনা গেল যারা করোনার দোয়া পড়বেন, অজু করবেন, ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়বেন তাদের উপর করোনা ক্রিয়াশীল হবে না। অনেকে আবার অনেক নিশ্চয়তা ও প্রতিশ্রুতির কথাও বলেছেন –আমরা সেদিকে যাব না। কিন্তু যারা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে জড়িত, এবং যারা পারমানবিক জৈবিক জগত সম্পর্কে জ্ঞাত, তারা মানুষকে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, এবং এখনো যাচ্ছেন, কেননা তাদের জ্ঞান রহস্যের ঊর্ধ্বে। তাদের দৃষ্টিতে কোন মন্ত্র পদার্থের উপর ক্রিয়াশীল নয়। ক্যান্সার রোগের জার্ম মানুষের ভাষা বুঝে না, মন্ত্রের কারণে পালিয়ে যায় না। বস্তু জগত বস্তু জগতের আপন নিয়মে চলে।
225 জন পড়েছেন