সোনালী সূর্য উদয় হোক এই কামনা করি

বলা হয়,  বাংলাদেশের মানুষ এখন দুভাগে বিভক্ত- আওয়ামীলীগ- বিএনপি বা আস্তিক এবং নাস্তিক। যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়েও এই দুই দল পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কেউ বলছে –অত্যন্ত সাফল্যজনক ভাবে একটা চমৎকার বিচার চলছে বাংলাদেশে – বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধরে বিচার  আগামী প্রজন্ম গর্ব করতে পারবে – সন্দেহে নইে-”

অন্য দল বলছে; “এ বিচার প্রতিহিংসামূলক প্রহসনের বিচার, জুডিসিয়্যল কিলিং করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অপসারিত করার করার সাজানো নাটক।”

এই অবস্থায় আমরা তৃতীয় নিরপেক্ষ কোন মাধ্যম ছাড়া সঠিক এবং সত্য বিষয় জানার কোন উপায় নাই।

এ বিচার আরম্ভ হয়ার পর থেকে বিশ্বের অনেক সংবাদ মাধ্যম এই বিচারব্যবস্থা, বিচারের সুষ্ঠতা নিয়ে অনেক খবর প্রকাশ করে আসছে। বিশেষ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই বিচার নিয়ে অনেক মতামত দিয়েছে; তা সবারই জানা, তাই তা পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নাই। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদন্ডের রায় প্রকাশ করতে গিয়ে নিউইয়র্কের দ্য ফাইন্যানসিয়েল টাইমস “Flawed war crimes trials-” ত্রুটিপূর্ণ যুদ্ধাপরাধের বিচার-শিরোনাম দিয়েই খবর প্রকাশ করেছে। বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নাই ।
Lord Carlyal2

স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে আজ যদি এ প্রশ্ন করা হয় যে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য কি অর্জিত হয়েছে?
বিভিন্ন টিভি টকশোতে উভয় পক্ষের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা কথা বলেন। প্রসঙ্গক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য কি অর্জিত হয়েছে? এই প্রশ্ন আসলে সবাই এক বাক্যে মিউ মিউ করে উত্তর দিতে দেখি যে “ না তা হয় নাই”। তার পরই স্বাধীনতা যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার- জন্য শুরু হয়ে যায় একে অন্যকে দোষারোপ করার চিরন্তন কায়দায় পুথিপড়া।
আমি যদি প্রশ্ন করি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চল্লিশ বছর পর মানুষের জীবনের প্রধান প্রধান মৌলিক চাহিদা গুলি কি বাংলাদেশের মানুষ মিটাতে পারছে?
বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেয়ার পর একটি শিশু কি একজন উন্নতমানের মানুষ হওয়ার জন্য সর্ব প্রকার সুবিধা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছে?
বাংলাদেশের মাটিতে কি মানুষের জীবন আপদমুক্ত?
বাংলাদেশের মানুষ কি দেশে সুচিকিৎসার আশা করতে পারে কিংবা সে জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন নাই?
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ; যে দেশ নদীমাতৃক সে দেশ [নদীর উপর] সেতু-সর্বস্ব দেশও বটে। বাংলাদেশে কি নদীর উপর সেতু নির্মাণে জন্য এখনও স্বনির্ভর হতে পেরেছে?
বাংলাদেশ কি এখন স্বাধীনতা রক্ষায় তার প্রতিরক্ষা খাতে স্বনির্ভর?
বাংলাদেশ এখনও কি নিম্নমানের অদক্ষ শ্রমিক ছাড়া দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে সমর্থ হয়েছে?।
আজ বিতর্ক হয় বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষক কে?
সত্য কথা হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার জন্য কারো ঘোষণার অপেক্ষা করে- নাই। এহিয়া খান যখন পয়লা মার্চ ১৯৭১, বেলা দুপুর বারটায় ঘোষণা করেছিল যে, ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ ঢাকায় বসবে না; সাথে সাথে গোটা বাংলাদেশ ব্যাপী লাঠি-মিছিল বাহির হয়। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ঢাকাস্থ বিদেশী সকল কূটনৈতিক মিশন সমূহে বাংলাদেশী পতাকা উড়তে খাকে। (কেবল রাশিয়ার এমব্যাসি ছাড়া, কারণ রাশিয়ার এমব্যাসি দুর্ভেদ্য, প্রটেকটেড ছিল, এমব্যাসি কমপাউণ্ডে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না)
মাওলানা ভাসানীর যে কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানকে উদ্দেশ্য করে-
লাকুম দ্বীনুকুম- আচ্ছালামু আলাইকুম বলেছিলেন। এসবের মূল্যায়ন কি ভাবে করবেন? না, যেহেতু আমাদের উভয় পক্ষের- দুই নেতার মধ্যে কেউ এসব জাতীয় ঘটনায় জড়িত ছিলেন না, তাই তার মূল্যায়ন করাতো দূরে থাক; ইতিহাসের পাতায় তার স্থানই দেয়া যাবেনা।
বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা কে?
১৯৩৬ সালে সুভাস বসুর বড়ভাই ( নামটা এখন মনে পড়ছে না) এবং সরোওয়ার্দী মিলে তৎকালীন উভয় বাংলা, বিহার, আসাম, মেগালয়, ত্রিপুরা রাজ্য নিয়ে পৃথক একটি স্বাধীন দেশ যার নাম হবে বাংলাদেশ- যে প্রস্তাব করেছিলেন, মুসলিম লীগ নেতারা তা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু গান্ধীজী সহ কংগ্রেস নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করায় এ প্রস্তাব নিয়ে আর এগোনো যায় নি। ইতিহাসের এসব ঘটনা সমূহকে কি দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন?
যাক ইতিহাস থেকে যদিও কেউ শিক্ষা নেয় না, কিন্তু ইতিহাসকে তেমন মুছে ফেলাও যায় না। তবে এক দিন আসবে যারা শুধু মাত্র রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে নিজেদের সুবিধামত ইতিহাস বিকৃতি করছে তাদের আসল চেহারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রকাশ পাবে এবং সত্য ইতিহাস জন সমক্ষে আসবে।
সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে আজ পর্যন্ত কেন স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের সত্যকিার পরসিংখান করে নাই কোন সরকার? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর পর বাংলাদেশে চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে কথা বলার আগে একটি উদাহরণ দিচ্ছি সহজে বুঝানোর জন্য।
বাংলাদেশ পানির দেশ। তাই বর্ষার পানি মৌসুম দিয়েই উদাহরণটি বলা শুরু করি।
পূর্ণ বর্ষা কালে দিনের বেলায় প্রকাশ্যে পরিচিত বহু-লোকজন তাদের- পরিচিত বা আপনজনের গ্রামে গিয়ে ডাকাতি, লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ, সকল প্রকার জঘন্য মানবতা বিরোধী অপরাধ করলো। প্রতিবেশীদের- সহায়তায় সকল ডাকাত ধরাও পরলো। অপরাধী ডাকাতদেরকে- চিহ্নিত করে- তাদের নামের তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হল। এদের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করার জন্য বিশেষ আইনও তৈরি করা হল। হঠাৎ করে- একদিন এদের সকলকে ছেড়ে দেয়া হল। এমনকি এসব জঘন্য অপরাধের দোষে গ্রেফতারকৃত কোন ব্যক্তিকে শুধু মৌখিক ভাবেও ক্ষমা প্রার্থনা করতে শুনা গেলনা। তার মাত্র তিন বছরের মাথায় ডাকাতদের- বাড়ীতে গিয়ে দাওয়াত খেয়ে আসলেন যিনি তিনি হচ্ছেন — ঐ ডাকাতদের দ্বারা অত্যাচারিত শারীরিক ভাবে আক্রান্ত, লুণ্ঠিত, ধর্ষিতা ও নিহত সেই ছেলেমেয়েদের স্বয়ং পিতা। শুধু তাই নয়; ডাকাতের বাড়ীতে গিয়ে নিমন্ত্রণ খেয়ে এসে সেই ডাকাতকে নিজের নিজ বাড়ীতে আমন্ত্রণ দিয়ে যথাযথ মর্যাদায় আপ্যায়ন, মেহমানদারী করলেন এই মহান আত্মার পিতা।
এখন তার চল্লিশ বছর পর নিজ গ্রামের মাঝিদেরকে ধরলেন যারা সেই ডাকাতদের নৌকায় করে নিয়ে এসেছিল। আর এই মাঝিদেরও বিচার হবে সেই আইনে যে আইনে যা করা হয়েছিল তাদের জন্য যারা ডাকাতি করার সময় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছিল ।অর্থাৎ সেই ডাকাতদেরকে সসম্মানে মুক্তি দান, আর পাশের বাড়ীর মাঝিদেরে বলিদান!
কথা হল মাঝিদের- বলিদান করা হোক এতে আমার আপত্তি নাই যদি তা হয় ন্যায় বিচারের মাধ্যমে। আপত্তি হচ্ছে অন্যত্র্ উদুর পিন্ডি বুদুর ঘাড়ে দিয়ে আর স্বাক্ষীকে গুম করে ন্যায় বিচার হয়না হয় প্রহসন!
[youtube=http://www.youtube.com/watch?v=na-onnsUfLI]
যে কোন দেশে এরকম একটা বিষয়ে প্রয়োজন সর্বমহলে আস্থা প্রতিষ্ঠার। কিন্তু সে ব্যবস্থা গড়ার দূরতম কোন পদক্ষেপ কি নেয়া হয়েছে? বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির স্কাইপি কেলেন্কারি বিষয়ে বিবিসি সংলাপে জনৈক নুর মোহাম্মদ মজুমদার, দোহা, কাতার থেকে যথার্থই বলেছেন “আমি মনে করি যুদ্ধাপরাধ/মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ। আইনের ছাত্র ও ব্লগার হিসেবে এটা আমার পর্যবেক্ষণ। প্রথমত: বিচারক বিচার চলাকালীন সময় তা কারো সাথে শেয়ার করতে পারবেন না। বিচারপতিরা কোনো মামলায় আইন বিশেষজ্ঞের ব্যাখ্যার প্রয়োজন মনে করলে সেই বিষয়ে অভিজ্ঞদের অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগের রেওয়াজ রয়েছে। এর বাইরে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা পক্ষভুক্ত কোনো ব্যক্তির সাথে আলোচনা বা পরামর্শ নেয়ার সুযোগ নেই।“
অনুসন্ধানী মন নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার- পর থেকে একটি ইস্যু থেকে আর একটি ইস্যু নিয়েই গোটা জাতিকে ব্যস্ত রাখা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ভাবপ্রবণ বাঙ্গালী জাতিকে একটার পর আর একটা ইস্যুর-মধ্যে ভাবপ্রবণাসক্ত করে রাখা হচ্ছে ; যাতে মুক্তিযুদ্ধের- লক্ষ্য অর্জন তথা স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে বাঙ্গালীর মনে সুস্থ চিন্তার সুযোগ না আসে। দেখা যাবে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ইস্যু শেষ হলে পরের ইস্যু হবে –বাংলাদেশে তালিবান- বাংলাদেশ এখন আফগান এই ইস্যুটি তুলে বাঙ্গালি জাতিকে দীর্ঘস্থায়ী ভাবাচ্ছন্ন করে রাখা এবং সে জন্য যে সর্ব প্রকার প্রস্তুতি যে চলছে তা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধিনতার পর দেশের সবাই আশা করেছিল যে, আর কাউকে রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের মাটিতে আর কাউকে হত্যা করা হবে না। বাংলাদেশের মানুষ নিরাশ হয়েছে।
বলা হয় রক্ষীবাহিনীর হাতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার জাসদ কর্মি-মুক্ত যোদ্ধা নিহত হয়েছে। শেখ মুজিবের মত হিমালয় সম নেতা সপরিবারে নিহত হয়েছেন বাঙ্গালিদের হাতে। স্বাধিনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সেক্টর কামান্ডার বীরমুক্তি যোদ্ধা খালেদ মুশারারাফ, কর্নের তাহের, জেনারেল মনজুর, জেনারেল জিয়া সহ শত শত বীর মক্তি যোদ্ধা নিহত হয়েছেন আপনজন সহ মুক্তিযুদ্ধদের হাতে। আজ অবদি বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যার চিত্র ভয়াবহ। এই রাজনৈতিক হত্যা সংস্কৃতির অবসান কবে হবে?
একটি গল্পের মৌলিক শিক্ষা উদৃতি দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি: যুদ্ধে একজন পরাজিত সম্রাট তার মৃত্যুর সময়ে তার ছেলেকে উপদেশ দিলেন;
“Be not shortsighted, Be not longsighted. Not by violence is violence ended; Violence is ended by NONVIOLENCE.”
(Ref: Magazine The PARABOLA, Pring Eddision 1996, Page-49)
পরিশেষে সকল কালরাত্রি পেরিয়ে বাংলাদেশের আকাশে- উন্নয়নের, দেশ গড়ার, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার ও সর্বোপরি দেশকে স্বনির্ভরশীল করে তুলার মাধ্যমে মুক্তি যুদ্ধের চেতনার – সোনালী সূর্য উদয় হোক এই কামনা করি সর্বশক্তিমান প্রভুর দরবারে।
নুরুল ইসলাম, টরন্টো

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *