বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সীমান্তে ভারতের ড্রোন মোতায়েনের সিদ্ধান্তের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সীমান্তবর্তী মানুষ ও বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে চরম হুমকির মধ্যে ফেলবে। এতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। যদি ড্রোন মোতায়েন করতেই হয় তবে বাংলাদেশের সাথে ভারতকে বসতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করা না হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরুতেই প্রতিবাদ না হলে পাত্তাই পাওয়া যাবে না। এ দিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, এই মুহূর্তে এ বিষয়ে কনসার্ন হওয়ার কিছু নেই। পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার এই বিষয়ে নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিএসএফের মহাপরিচালক সুভাষ জোশির বরাত দিয়ে ভারতের একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, সীমান্তে নজরদারি জোরদারের উদ্দেশ্যে শিগগিরই এ ড্রোন মোতায়েন করা হবে। গতকাল বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে বিষয়টি ফলাও করে প্রচার হয়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এ সংক্রান্ত খবরে আরো বলা হয়েছে, ভারতীয় বিমানবাহিনী (আইএএফ) ড্রোন ব্যবহার ও পরিচালনা পদ্ধতির খসড়া চূড়ান্ত করছে। সুভাষ জোশি জানান, পাইলটবিহীন ড্রোন সীমান্ত এলাকার ১০ থেকে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় উড্ডয়ন করবে। আকাশসীমা ব্যবহারসংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা থাকায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর সহায়তা নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। ভারতীয় সীমান্তে কেউ অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করলে বা এসংক্রান্ত গতিবিধি চালালে তার চিত্র ড্রোন থেকে ধারণ করা হবে এবং তাৎণিকভাবে সেসব তথ্য সংশ্লিষ্ট স্থানে জানিয়ে দেয়া হবে। তিনি বলেন, ড্রোন মোতায়েনের পরিকল্পনা নিয়ে দ্রুত কাজ করা হচ্ছে। শুধু ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত নয় বরং পূর্বাঞ্চলীয় বাংলাদেশ সীমান্তেও ড্রোন ব্যবহারের কথা সক্রিয়ভাবে ভাবছে বিএসএফ। বিএসএফের অপর এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, ড্রোন ব্যবহার করা হলে সীমান্তে আরো কার্যকরভাবে নজরদারি সম্ভব হবে। বিএসএফের উচ্চ পর্যায় থেকে দাবি করা হয়েছে, আকাশ থেকে নজরদারির ব্যবস্থা করা হলে তাতে এসংক্রান্ত তৎপরতায় সহায়তা করার পাশাপাশি কোনো প যদি অনুপ্রবেশসংক্রান্ত গতিবিধির কথা অস্বীকার করতে চায় তারও প্রমাণ তুলে ধরা যাবে। সীমান্তরী বাহিনীর তৎপরতা জোরদারে ভারত এরই মধ্যে দূরপাল্লার নজরদারি ও পর্যবেণব্যবস্থা (এলওআরআরওএস), যুদ্ধত্রে নজরদারি রাডার (বিএফএসআর) এবং নাইট ভিশন ব্যবহার শুরু করেছে। সীমান্তে ড্রোন ব্যবহারের বিষয়ে গত বছর ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি প্রস্তাব পেশ করেছিল বিএসএফ। এ দিকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলেছেন, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে ড্রোন মোতায়েন করলে তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। একই সাথে সীমান্তবর্তী মানুষও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গতকাল নয়া দিগন্তকে অনেকেই বলেছেন, এই বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। প্রখ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীরপ্রতীক নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অনেক অমীমাংসিত বিষয় থাকা সত্ত্বেও ভারত কেন আরেক নতুন বিষয়ের জন্ম দিয়ে নতুন উত্তেজনা ও বিতর্কের সৃষ্টি করল সেটাও প্রণিধানযোগ্য। দু’টি আঙ্গিক বিবেচ্য। নিরাপত্তার দিক থেকে সম্ভাবনা এই যে, আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘিত হবে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার অবৈধ ছবি তোলা হবে এবং ভারতবিরোধী জঙ্গি আস্তানা আছে এই অজুহাতে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ড্রোন হামলা চালানো হতে পারে। সর্বক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। অতএব ভারতের পক্ষ থেকে এই একতরফা পদক্ষেপ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করছি। রাজনৈতিক আঙ্গিকে আমার মন্তব্য নিম্নরূপ। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণশক্তি প্রখর ও শক্তিশালী। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা কার্যক্রম সর্বাধিক শক্তিশালী, বিস্তৃত ও সক্রিয় বলেই আমি মনে করি। যে যে কারণে এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে, স্থান অভাবে এখানে আলোচনা করছি না। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দার মূল্যায়নে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসন্ন। আগামী দিনের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সরকারের আমলে সীমান্তকে বিতর্কিত ও উত্তেজনাময় রাখার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু। উদাহরণস্বরূপ, এখন থেকে ছয় মাস বা নয় মাস পরে সম্ভাব্য বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বলতে পারবে যে, আমাদের আমলে সীমান্ত স্থীতিশীল ছিল। এখন গণ্ডগোল। আমার মন্তব্য শেষ। আশা করি বাংলাদেশের সুশীলসমাজ ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ, দলমত নির্বিশেষে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় উদ্বেগ ও মত গঠন করে ভারতের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে।’ বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব:) আলম ফজলুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, কোনোভাবেই বাংলাদেশ সীমান্তে ড্রোন মোতায়েন করতে দেয়া উচিত হবে না। এটা অবশ্যই আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা জানি না ওই ড্রোনে কী যন্ত্রপাতি থাকবে। ওগুলো দিয়ে সীমান্তসংলগ্ন বিজিবি ক্যাম্প ও ক্যান্টনমেন্টগুলোর তথ্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে পারবে। এ কারণে সীমান্তে ড্রোন মোতায়েন করতে দেয়া উচিত নয়। আর যদি করতেই হয় তবে ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশের সাথে বসতে হবে। বিষয়টি যাতে এক পক্ষের না হয় সেদিকটি দেখতে হবে। সেখানে উভয় পক্ষের মনিটরিংব্যবস্থা থাকতে হবে। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি যেভাবে তারা দেখবে, তেমনি আমাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে। ড্রোন মোতায়েনের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার গতকাল বিকেলে নয়া দিগন্তকে বলেন, বিষয়টি তিনি কেবল শুনলেন। এ বিষয়ে পর্যালোচনা ছাড়া তিনি কিছু বলতে পারবেন না। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ডিজি মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্টটি আমি পড়েছি। ওখানে বলা হয়েছে পাকিস্তান সীমান্তে ভারত ড্রোন মোতায়েন করবে। যদি সেখানে ইফেকটিভ কিছু পাওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশ সীমান্তেও ড্রোন মোতায়েনের জন্য ভবিষ্যতে চিন্তা করবে।’ তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ওই বিষয়ে কনসার্ন হওয়ার কিছু নেই। যদি এরকম কিছু ঘটে তখন দেখা যাবে ওই ড্রোনের ক্যাপাসিটি কত। আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি কিনা তখনই কনসার্ন হবো। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত পরিস্থিতি আর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পরিস্থিতি এক নয়।
পুর্ব প্রকাশিত: নয়া দিগন্ত