সিরিয়া-লিবিয়ায় তুরস্কের ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল ও পুত্রাজায়ায় পরিবর্তন

গত সপ্তাহে মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তিনটি কেন্দ্র ছিল সিরিয়ার ইদলিব, লিবিয়ার ত্রিপোলি ও মালয়েশিয়ার পুত্রাজায়া। সিরিয়ার বিরোধী পক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা একমাত্র প্রদেশ ইদলিবে বাশার আসাদ বাহিনীর হামলায় ৩৩ তুর্কি সেনা নিহত হওয়ার পর তুরস্ক আসাদ বাহিনীর ওপর সর্বাত্মক অভিযান চালিয়েছে। এ নিয়ে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। অন্যদিকে ত্রিপোলিতে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে রাজনৈতিক সমাধান প্রচেষ্টা কার্যত ভেঙে পড়েছে। এরপর হাফতার বাহিনী আবার রাজধানীর ওপর আক্রমণ জোরদার করেছে। এতে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্বার্থে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে।

মালয়েশিয়ায় রাজা মাহাথিরের দল বারাসাতুর দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি মুহিউদ্দিন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের সুযোগ দিয়েছেন। তিনি সাবেক ক্ষমতাসীন দল উমনু ও ইসলামিস্ট পাসকে সাথে নিয়ে সরকার গঠনের চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে চলছে সেখানে উত্তেজনাকর এক পরিস্থিতি।

এক : ইদলিবে এরদোগানের ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান
সিরিয়ায় বেশখানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ সর্বাত্মক ধরনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে তুরস্ক। এই যুদ্ধে ব্যর্থতার পরিণতি এরদোগানের জন্য দেশটির বাইরের পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ হারানো পর্যন্ত সীমিত থাকবে না। একই সাথে তুর্কি বাহিনীর যেকোনো পরাজয় দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের কারণও হতে পারে। ফলে এরদোগানকে এখন প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে ভেবেচিন্তে। এই পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সাথে সম্পর্কের বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনিভাবে রয়েছে রাশিয়ার সাথে কয়েক বছর ধরে গড়ে ওঠা সহযোগিতার সম্পর্ক এগোবে নাকি তাতে অচলাবস্থা তৈরি হবে সেই প্রশ্নও।

এ লেখাটি যখন লিখছি সেদিনই রাশিয়ায় রুশ প্রেসিডেন্টের সাথে তুর্কি নেতা এরদোগানের বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এই বৈঠকের ফলাফলের ওপর সিরিয়ায় শান্তি ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনেকখানি নির্ভর করে। এই বৈঠক ব্যর্থ হলে রাশিয়ার কাছ থেকে এস৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় এবং পরমাণু বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা অব্যাহত থাকার বিষয়টি সামনে চলে আসবে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে অনেকের ধারণা, পুতিন অথবা এরদোগান কেউই চান না দুই দেশ প্রত্যক্ষ কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক অথবা চলমান সমঝোতার সম্পর্ক ভেঙে পড়ুক। যদিও ইদলিবে তুর্কি সেনা নিহত হওয়ার পর দুই নেতার মধ্যে টেলিফোনে নজিরবিহীন উত্তপ্ত ভাষায় কথাবার্তা হয়েছে। এ সময় এরদোগান পুতিনকে বলেছেন, আসাদ বাহিনীর কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে, তুরস্ক তাকে শায়েস্তা করবে। আর পুতিন জবাবে বলেছেন ইদলিব থেকে সরে যেতে। এর পর আসাদ বাহিনীর অবস্থান থেকে রাশিয়া কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেছে আর তুরস্ক সিরিয়ান সরকারি অবস্থানে ব্যাপক হামলা চালিয়ে দুই সহস্রাধিক সরকারি সেনা ও হিজবুল্লাহ মিলিশিয়াকে হত্যা করেছে। কিন্তু ইদলিবকে সিরিয়ার সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগে রুশ বিমান সহায়তা অব্যাহত রয়েছে।

সিরিয়ার বাস্তবতা হলো, সেখানে আরব বসন্তের জের ধরে বাশার আসাদের সরকারকে উচ্ছেদ করার প্রথম গণবিক্ষোভ এবং এরপর সশস্ত্র লড়াইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তিগুলো আসাদবিরোধীদের কাছ থেকে নিজেদের আস্তে আস্তে গুটিয়ে নেয়। রাশিয়া বাশার আসাদ বাহিনীর সহায়তায় সর্বাত্মকভাবে মাঠে নামে। সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে সাথে থাকে ইরান। অন্য দিকে সিরিয়ার সাথে ভৌগোলিকভাবে সংলগ্ন তুরস্কের সামনে সিরিয়া থেকে হাত গোটানোর মতো অবস্থা থাকেনি। প্রায় ৪০ লাখ সিরীয় শরণার্থী আশ্রয় নেয় তুরস্কে। এত বিপুল শরণার্থীর বোঝা তুর্কি অর্থনীতি এবং সামাজিক অবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে থাকে। এরদোগানের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার ফলে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারা দু’টি সিটি করপোরেশনে একসাথে ক্ষমতাসীন দল একে পার্টি হেরে যায়।

এ অবস্থায় এরদোগানের কৌশল থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বলয়ে থেকেই রাশিয়ার সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রেখে সিরিয়ায় একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ বের করা। এই কৌশলের অংশ হিসেবে এক দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী দেশগুলোর সাথে সিরীয় পরিস্থিতি নিয়ে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে তুরস্ক। অন্য দিকে রাশিয়া ও ইরানের সাথে আস্তানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় সোচি চুক্তি হয়েছে রাশিয়ার সাথে আর তুর্কি সীমান্তবর্তী কুর্দি অঞ্চলগুলোতে বাফার জোন প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে চুক্তি করেছে আঙ্কারা।

তুরস্কের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য সিরীয় পরিস্থিতি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়ে আসছিল এক দশক ধরে। দেশটি আরব বসন্তে গণতন্ত্রকামীদের পক্ষে ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আরব বসন্তের গণবিক্ষোভ কয়েকটি দেশে শান্তিপূর্ণ না থেকে সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়। সিরিয়া হলো তেমন একটি দেশ, যেখানে জনসংখ্যার প্রতি ২০ জনে একজন গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছে এবং অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছে। এই পরিস্থিতির নতুন করে অবনতি ঘটেছে বাশার আসাদের বাহিনী ইদলিব দখলে নতুন পর্যায়ের অভিযান শুরু করার ফলে।

ইদলিব হলো আসাদবিরোধী পক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ। যেটি ভৌগোলিকভাবে তুরস্কের সাথে সংযুক্ত। ইদলিব সরকারি বাহিনীর দখলের অর্থ হবে কয়েক লাখ মানুষের জীবন হানি এবং ২০ লাখ মানুষের নতুন করে শরণার্থী হওয়া। এর মধ্যে ১০ লাখ সিরীয় জীবন বাঁচাতে তুরস্ক সীমান্তে সমবেত হয়েছে। তুরস্ক চেয়েছিল রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ইদলিবে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে। এই স্থিতাবস্থার জন্য তুরস্ক সোচি চুক্তির আওতায় তার সামরিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে।

সর্বশেষ ইদলিবে যে সঙ্ঘাত দুই পক্ষের মধ্যে হয়েছে, তাতে সোচি চুক্তির ব্যাখ্যা নিয়ে বেশ ব্যবধান লক্ষ করা যাচ্ছে। রুশ বিশ্লেষকরা বলছেন, সোচি চুক্তি অনুসারে কোনো সশস্ত্র গ্রুপের কাছে হস্তচালিত বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের কথা নয়। একটি সিরীয় সরকারি বিমান ভূপাতিত করার ক্ষেত্রে এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আর সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হামলায় যেসব তুর্কি সেনা নিহত হয়েছে তারা সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর অবস্থানের সাথেই ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে। অন্য দিকে তুরস্কের বক্তব্য হলো, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছার আগে ইদলিবে বাশার বাহিনীর সামরিক অভিযানের অর্থ হবে সেখানে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় ঘটানো এবং নতুন করে ৩০-৪০ লাখ শরণার্থীর তুরস্কের দিকে যাত্রা করা। ৪০ লাখ শরণার্থীর বড় বোঝার পাশাপাশি এই সমস্যার সমাধান না করে নতুন সঙ্কট চাপিয়ে দেয়া কোনোভাবেই তুরস্ক মেনে নিতে পারে না। আর সোচি চুক্তি অনুসারে তুর্কি যেসব পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে, সেখানকার সেনা সদস্যদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনা সুস্পষ্টভাবে লাল রেখা লঙ্ঘন। কোনোভাবে এটি আঙ্কারা মেনে নিতে পারে না।

এ ঘটনার পর তুরস্ক সিরীয় বাহিনীর ওপর যে আঘাত ও প্রতিজবাব দিয়েছে, তাতে এরদোগান এখন পর্যন্ত জয়ের ধারায় রয়েছেন। তবে সেখানে সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণ ভারসাম্য এখন আর নেই। সিরিয়া এবং তুর্কি বাহিনীর সামরিক অবস্থান এখন একে অন্যের জন্য বৈধ টার্গেট হিসেবে বিবেচনা করছে। এ নিয়ে এরদোগান-পুতিন বৈঠকে কোনো সমঝোতা না হলে সিরিয়া একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। আর এটি হলে তুরস্কের সাথে ন্যাটোও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ হোক অথবা পরোক্ষভাবে হোক তুরস্কের পেছনে দাঁড়াবে। রাশিয়া এবং ইরানের সাথে তুরস্কের সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্ক আর থাকবে না। এর পরিণতিতে একটি সর্বাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধ এমনকি বিশ্বযুদ্ধেরও সূচনা ঘটতে পারে।

এ ধরনের একটি পরিণতি সম্ভবত রাশিয়া অথবা তুরস্ক- কেউ চাইছে না। আর এ কারণে অধিকতর বিপর্যয়ের আগেই রাশিয়া ও তুরস্কের দুই নেতা বৈঠকে মিলিত হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।

দুই : ত্রিপোলির নতুন মেরুকরণ ও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া
লিবিয়ায় যুদ্ধরত জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত সররাজ সরকার ও যুদ্ধবাজ সেনাপতি খলিফা হাফতারের মধ্যে রাশিয়া ও তুরস্কের আলোচনার মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল তা রাশিয়া ও জার্মানিতে কয়েক দফা আলোচনার পরও স্থায়ী চুক্তিতে পরিণতি পায়নি। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে অনেকগুলো ঘটনা ঘটছে। যেগুলো লম্বা সময় ধরে মধ্যপ্রাচ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। এসব ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সিরিয়ার বাশার আসাদ সরকার ও সিরিয়ার দক্ষিণের যুদ্ধরত মিলিশিয়া প্রধান জেনারেল হাফতারের সাথে তুরস্কবিরোধী সহযোগিতার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সিরিয়ার বাশার সরকার লিবিয়ার দূতাবাস খুলে দিয়ে সেটি হাফতার বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছে। তুরস্কের ৩৩ জন সেনাসদস্যকে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে তুর্কি বাহিনীর সর্বাত্মক বিমান হামলায় দুই সহস্রাধিক সিরীয় সরকারি সৈন্য নিহত ও সামরিক অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির পর ইরানপন্থী হিজবুল্লাহ সদস্যরাও ইদলিব যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছে এবং তাদের দুই শতাধিক মিলিশিয়া সদস্য নিহত হয়েছে বলে আঙ্কারা দাবি করেছে। রাশিয়া সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে, তারা সিরিয়ায় কোনো সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িত হতে চায় না তবে সিরীয় আকাশ সীমায় তুর্কি বিমানের নিরাপত্তা গ্যারান্টি তাদের পক্ষ থেকে থাকবে না। এসব ঘটনার পর লিবিয়া ফ্রন্টেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, রাশিয়া হাফতার বাহিনীর সাথে আরো ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হতে চলেছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় অবস্থা থেকে জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত সরকারের পক্ষে সক্রিয় হতে শুরু করেছে।

এর মধ্যে লিবিয়ায় জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত সরকারের নিয়ন্ত্রিত তেলক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শেয়ার করেছে আর এরপর হোয়াইট হাউজ থেকে বলা হয়েছে, যে তিনটি মিশন নিয়ে হাফতার বাহিনী লিবিয়ায় অভিযান শুরু করেছে সামরিকভাবে তা অর্জন করা যাবে না, আলোচনার মাধ্যমে তা অর্জন করতে হবে। এর মধ্যে লিবিয়ার ১১টি গোত্র প্রধানের সমর্থন আদায়ের জন্য সৌদি আরব হাফতারের পক্ষে এবং কাতার জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত সরকারের পক্ষে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এই প্রচেষ্টায় তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়ার অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। এ দু’টি দেশের ভূমিকা এখন পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে নির্ণিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় হলে সমঝোতা আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি না করে যুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিপোলি দখল করা সৌদি-আমিরাত-মিসর সমর্থিত হাফতার বাহিনীর পক্ষ থেকে সম্ভব হবে না। হোয়াইট হাউজের পক্ষে হাফতার বাহিনীকে বার্তা দেয়া হয়েছে, তারা যে অবস্থানে আছে সেখানে থেকেই যেন আক্রমণ বন্ধ এবং যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনা শুরু করে। একই সাথে ত্রিপোলির মার্কিন দূতাবাসকেও এ ব্যাপারে সক্রিয় হতে বলা হয়েছে। নতুন এই উন্নয়ন লিবিয়ার মাঠ পরিস্থিতিকেও প্রভাবিত করতে পারে।

সিরিয়ার পরিস্থিতির মতো লিবিয়ায় এখন যে অবস্থা চলছে তার ওপরও পুতিন-এরদোগান আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়তে পারে। তুরস্ক এবং এর নেতা এরদোগানের জন্য লিবিয়া-সিরিয়ায় সাফল্য তার নিজ দেশে অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সিরিয়া-লিবিয়ায় যে ভূমিকা নিচ্ছেন, তার ব্যাপারে দেশটির সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে মোটাদাগে সম্মতি রয়েছে। কিন্তু এই দুই অভিযানে ব্যর্থতা এবং সামরিক বিপর্যয় তার ও দলের জন্যও বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। তেমন পরিস্থিতিতে সমারিক অভ্যুত্থান ঘটার বিষয় নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। যদিও এ ধরনের শঙ্কার কথা দেশটির রাজনীতিবিদরা উড়িয়ে দিয়েছেন আর এটিকে বিপক্ষ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রচারণা বলেই চিহ্নিত করা হচ্ছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এরদোগান এখন তুরস্কের নিরাপত্তা অখণ্ডতা রক্ষার জন্যই একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নন একই সাথে মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম বিশ্বে মধ্যপন্থী এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হয়েছেন। তার উত্থান-পতনের সাথে মুসলিম দুনিয়ার আদর্শিক উত্থান ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বেশখানিকটা যুক্ত হয়ে পড়েছে।

তিন : পুত্রাজায়ার রাজনৈতিক অভ্যুত্থান
মালয়েশিয়ায় সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে একের পর এক অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। এর সর্বশেষ ঘটনা হলো, ডা: মাহাথির মোহাম্মদ প্রতিষ্ঠিত দল বারাসাতুর দ্বিতীয় প্রধান নেতা মুহিউদ্দিন ইয়াসিন সাবেক শাসক দল উমনু এবং ইসলামী দল পাসের সাথে মিলে এক রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এর জের হিসেবে দেশটির রাজা মুহিউদ্দিন ইয়াসিনকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে মালয় দলগুলোর নতুন জোট সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে কাজ চলে আসছিল তার পরিণতি দিয়েছেন। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়ে চূড়ান্ত নাটকটি মঞ্চস্থ করেছেন মাহাথিরের দ্বিতীয় প্রধান নেতা মুহিউদ্দিন ইয়াসিন আর আনোয়ার ইব্রাহিমের দ্বিতীয় প্রধান নেতা আজমিন আলী। এর মধ্যে প্রথমজন মাহাথিরের সামনে পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার মুলা ঝুলিয়েছেন আর আজমিন আলী মাহাথিরের দৃশ্যত পক্ষ নিয়ে দলের ভেতরে আনোয়ারের সাথে প্রকাশ্য লড়াইয়ে নেমেছেন। এর সাথে মালয় ভূমিপুত্রা রাজনীতির বিশিষ্ট ধারক রইস ইয়াতিম, দায়েম জয়েন উদ্দিনসহ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন। তাদের সাথে সুলতানদের কারো কারো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।

এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রধানত যে বক্তব্য সামনে আনা হয় তা হলো চীনা দলগুলো মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে প্রভুত্ব বিস্তার করতে শুরু করেছে আর আনোয়ারের নেতৃত্বে পাকাতান হারাপান ক্ষমতায় থাকলে সেই নিয়ন্ত্রণ আরো শেকড় বিস্তার করবে। সুতরাং মালয়দের যেভাবেই হোক রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হবে।

মালয়েশিয়ায় যে জাতিগত ভারসাম্য রয়েছে তাতে ৬০ শতাংশ হলো মালয়, ২৭ শতাংশ চীনা এবং ৮ শতাংশের মতো ভারতীয় বংশোদ্ভূত; যারা প্রধানত তামিল। চীনারা বরাবরই দেশটির অর্থনীতি শিল্প ও বাণিজ্যের ওপর আধিপত্য বজায় রেখে আসছিল। মালয়রা প্রভাব বজায় রেখে আসছিল রাজনীতির ওপর। ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা সব সময় চীনাদের সাথে থাকত। এ অবস্থায় স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কোনো সরকারে মালয় আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো কোনো দল বা নেতা ক্ষমতায় আসেনি। ২০ মাস আগে মাহাথিরের নেতৃত্বে যে পাকাতান হারাপান দল ক্ষমতায় আসে, সেই সংসদে শাসক জোটের মালয় এমপির প্রায় কাছাকাছি ছিল অ-মালয় এমপি। এই জোট ক্ষমতায় আসার পর মালয় একাধিপত্য কিছুটা ক্ষুণ্ন হয় বলে মনে করা হয়। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী মালয় হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় যায় অ-মালয়ের হাতে। অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ করা হয় অ-মালয় থেকে। প্রচারণা চালানো হয় যে, মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী থেকে বিদায় হওয়ার পর আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী হলে সেই ভারসাম্য একেবারেই থাকবে না। আর এই ভীতি সামনে রেখে অভ্যুত্থানের বিষয়টি মঞ্চস্থ করতে উমনু পাস মুহিউদ্দিনের বারসাতু আর আজমিনের পিকেআর গ্রুপ বিকল্প সরকারের গঠনের চেষ্টাকে এগিয়ে নেয়। শেষোক্ত দুই গ্রুপ মিলে হারাপান থেকে বেরিয়ে এসে জোট সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ভারসাম্য দুটোই ভেঙে দেয়। এ ধরনের একটি বিষয় মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে মাহাথিরের নাম ব্যবহার করা হলেও তিনি বিষয়টির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে মনে হয় না। তিনি যখন পুরো বিষয়টি জানতে পারেন তখন সব কিছু তার হাত থেকে বেরিয়ে যায়।

উমনু পাস তার পেছন থেকে সরে গিয়ে মুহিউদ্দিনকে রাজার সামনে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করে আর পাকাতান হারাপান প্রথমে আনোয়ারকে এবং পরে মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য রাজার সামনে প্রস্তাব দেয়। মালয়েশিয়ার সুলতানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরও মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী না করে মুহিউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন রাজার মাধ্যমে। তারা মনে করেছেন, ভেঙে যাওয়ার পরে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন পাকাতান সরকার গঠন হলে সেখানে অ-মালয় এমপিরা হবেন সংখ্যাধিক এবং বিকল্প জোটকে ক্ষমতায় আনা হলে মালয় আধিপত্য বজায় থাকবে। এই অভ্যুত্থানের পুরো ঘটনাকে মাহাথির তার সাথে মুহিউদ্দিনের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আগামী ৯ মার্চ ছিল নতুন সরকারের আস্থা ভোট করার দিন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থন না থাকায় এই তারিখ মে মাসের শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। নতুন সরকার গঠনও নানা টানাপড়েনের কারণে খুব সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। নতুন সরকারের সাথে দল ভাঙার ষড়যন্ত্রকারীরা এক হওয়ায় সবাই যার যার স্বার্থ নিশ্চিত করতে চাইবেন। আজমিন আলী উপপ্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন। উমনু থেকে বলা হচ্ছে, তারা সরকারে সবচেয়ে বড় দল, তাদের দল থেকে উপপ্রধানমন্ত্রী করতে হবে। এ নিয়ে উমনুর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরকার গঠনের পর বিরোধ-বিসম্বাদ আরো বাড়তে পারে। বঞ্চিতরা হাত মেলাতে পারে বিরোধী পক্ষের সাথে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থন লাভ চ্যালেঞ্জের হতে পারে মুহিউদ্দিনের জন্য। আবার মাহাথির বা আনোয়ারের নেতৃত্বে সরকার গঠন হবে কি না, সেটিও অনিশ্চয়তায় ভরা। মুহিউদ্দিন সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে মালয় শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা সুলতানদের কাছে নতুন নির্বাচন দেয়ার প্রস্তাব দিতে পারে। আর তাতে উমনু-পাস যে জোট গঠন হয়েছে তারা ভালো করার ব্যাপারে আশাবাদী। তবে এসব রাজনৈতিক ক্ষমতার নোংরা খেলা রাষ্ট্রের স্থিতি গণতন্ত্র ও অর্থনীতি সুখকর হয় না।

সৌজন্যে : নয়া দিগন্ত

Comments are closed.