সিরিয়ায় মৃত্যুখেলা ও নতুন ভারসাম্য

মধ্যপ্রাচ্যের আগ্নেয়গিরি হয়ে ওঠা সিরিয়ায় এমন কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে, যা পুরো অঞ্চলকে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেন আকস্মিকভাবে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ রয়েছে। তবে পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলে আরো ধ্বংসযজ্ঞ এবং হানাহানি চলবে বলে মনে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এই ‘মৃত্যুখেলা’ নিয়ে ক্রেমলিনের সাথে ওয়াশিংটনের গোপন সমঝোতার কথাও শোনা যাচ্ছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়ে থাকলে তা এ অঞ্চলে ক্ষমতার নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করবে।সিরিয়ায় যখন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তখন নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের অধিবেশন উপলক্ষে বিশ্ব নেতাদের সমাবেশ ঘটে। তুর্কি প্রধানমন্ত্রী আহমেত দেভুতুগলু নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরার পথে সাংবাদিকদের বলেছেন, রাশিয়া সিরিয়ায় প্রবেশের জন্য প্রবেশ করেছে এমনটি নয়, তারা সেখানে কিছু সময়ের জন্য থাকবে। তারা বসফরাস অতিক্রম করার সময় কোথায় যাচ্ছে তা সবাই জানত। আমেরিকান প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাস্টন কার্টারের মতো তিনিও বলেছেন, আপনি আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, এতে আমি বিস্মিত হয়েছি কি না, তাহলে বলব, তা হইনি। সিরিয়ায় ক্রেমলিনের বিমান হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া যদি বিচার বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে রাশিয়ার এ কাজ কাউকে বিস্মিত করেনি। তবে এটি অত্যন্ত বিস্ময়কর যে, ওয়াশিংটনে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে রুশ নেতা পুতিনের পরস্পর গ্লাস উঁচিয়ে ধরার ছবিটি প্রকাশের পরপরই সিরিয়ায় ক্রেমলিনের বিমান হামলার ঘটনাটি ঘটেছে। পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এড়াবে না যে, রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর হোয়াইট হ্উাজের প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারে নিরাসক্ত। রাশিয়ার বেপরোয়া সামরিক অভিযান!রাশিয়া ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে বিমান হামলা শুরুর পর এ পর্যন্ত ১১২টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এই হামলা দিন দিন আরো জোরদার করা হচ্ছে। সর্বশেষ কাস্পিয়ান সাগর থেকে রাশিয়ার চারটি যুদ্ধজাহাজ সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে। আসাদবিরোধীদের অবস্থানের ওপর ২৬ দফা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়েছে বলে রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সোইগু জানিয়েছেন। লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য আড়াই হাজার কিলোমিটার পাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এর আগে রুশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে লাতাকিয়ার একটি বিমানঘাঁটি এবং তারতুসে পুরনো রুশ নৌঘাঁটিতে সরঞ্জাম এবং রসদ সরবরাহ করা হয়েছে। আসাদ বিরোধীদের ওপর সমন্বিত হামলা শুরুর পর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, সিরিয়ায় আইসিসের বিরুদ্ধে স্থল অভিযানে রুশ বিমান বাহিনী কার্যকরভাবে সমর্থন দেবে। এর আগে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস’ বলেছে, ইরান ও হিজবুল্লাহর সমর্থনপুষ্ট সিরিয়ার সরকারি সেনারা হামা প্রদেশে আসাদবিরোধীদের অবস্থানে হামলা চালিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো আসাদের সেনাবাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের স্থলযুদ্ধে রুশ বিমানবাহিনী সমন্বয় করে হামলা চালানো হলো। রাশিয়া এই হামলার লক্ষ্যবস্তু আইসিস বলে উল্লেখ করলেও আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সব পক্ষের বিরুদ্ধে এই অভিযান চালানো হচ্ছে। তুর্কি প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, রাশিয়ার পরিচালিত ৫৭টি বিমান হামলার মধ্যে কেবল দু’টির লক্ষ্যবস্তু ছিল আইসিস। বাকিগুলো পরিচালিত হয়েছে অন্যদের বিরুদ্ধে।সিরিয়াকে কেন্দ্র করে আরো কয়েকটি ঘটনা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। রাশিয়ার এই অভিযান সিরিয়ায় সীমিত থাকবে না, এটি বিস্তৃত হবে ইরাকে। রাশিয়া ঘোষণা করেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানালে ইরাকে আইসিসের বিরুদ্ধে বিমান অভিযান চালানোর বিষয়টি বিবেচনা করবে মস্কো। রুশ ফেডারেশন কাউন্সিলের স্পিকার ভ্যালেনতিনা মাতভিইনকো জর্ডান সফরের সময় এ ব্যাপারে আরো বলেছেন, ইরাক আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানালে দেশটিতে বিমান অভিযান চালানোর রাজনৈতিক ও সামরিক দিকটি ভেবে দেখা হবে। ইরাক এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আহ্বান জানায়নি বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তবে এর তিন দিন আগে ইরাকের অভ্যন্তরে আইসিসের অবস্থানে রাশিয়ার বিমান হামলাকে স্বাগত জানানোর জন্য তাকে মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন দিয়েছে বলে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-এবাদি ঘোষণা করেছেন। তুরস্কের আকাশে রুশ যুদ্ধবিমানবিস্ময়করভাবে সিরিয়ায় আসাদবিরোধীদের ওপর বিমান হামলা শুরুর পর রাশিয়ান যুদ্ধবিমান দু’দফায় তুরস্কের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়্যব এরদোগান বলেছেন, রুশ যুদ্ধবিমান বারবার তুরস্কের আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় তিনি মস্কোর ব্যবহারে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন। এর ফলে রাশিয়া আঙ্কারার বন্ধুত্ব হারাতে পারে। তিনি বলেন, তুরস্কের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের অর্থ হচ্ছে ন্যাটো জোটের বিরুদ্ধে আগ্রাসন। প্রধানমন্ত্রী দেভুতুগলু অবশ্য বলেছেন, আমরা রাশিয়ার সাথে কোনো উত্তেজনা চাই না। নিকটবর্তী প্রতিবেশী হিসেবে তুরস্কের আকাশসীমা, সীমান্ত ও সিরিয়ায় তাদের স্বার্থের বিষয়ে রাশিয়াকে দৃষ্টি দিতে হবে। তিনি এও বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী শাসনকে অভিযুক্ত করে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ না করে দেশটির সঙ্কটকে একটি আঞ্চলিক সঙ্কটে রূপ দিয়েছে। আর এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এ পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন বক্তব্যটি হলো মস্কো এবং ইরান তিন লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানির জন্য দায়ী সিরীয় প্রেসিডেন্ট আসাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে অব্যাহত রাখার জন্য ভূমিকা পালন করছে। সিরিয়া থেকে রুশ যুদ্ধবিমানের তুরস্কের আকাশসীমায় প্রবেশ নিয়ে ন্যাটো এবং তুরস্ক উভয়েই মস্কোর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। ন্যাটো বলছে, আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনাটি দেখে কোনো দুর্ঘটনা বলে মনে হয়নি। উভয়ে সিরিয়ার সরকারের সমর্থনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কঠোর বিরোধিতা করে এলেও এই বিরোধিতার মধ্যে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পাল্টা কিছু করার কোনো লক্ষণ এখনো পর্যন্ত নেই। তুরস্কের সীমানায় রুশ বিমানের অনুপ্রবেশ কাকতালীয় কোনো ঘটনা বলে মনে হয় না। এর মাধ্যমে রাশিয়া হয়তো সিরিয়ার ব্যাপারে আঙ্কারার ওপর বড় রকমের চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছে। যদিও রাশিয়া বলেছে, শনিবারের অনুপ্রবেশটি ছিল খারাপ আবহাওয়ার কারণে এবং খুবই স্বল্পসময়ের জন্য। রোববারের আরেকটি অনুপ্রবেশের অভিযোগ নিয়েও তদন্ত করছে বলে জানায় রাশিয়া। নিয়ন্ত্রকের আসনে রাশিয়া? আসাদের মিত্রদের ধারণা, বর্তমান পরিস্থিতিতে সিরিয়ার বিষয়ে নীতি পুনর্মূল্যায়ন করা ছাড়া ওয়াশিংটনের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। কারণ পুরো পরিস্থিতি মস্কোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। তবে আমেরিকার জন্য বিষয়টি অনেক জটিল হয়ে গেছে। এক দিকে সিরিয়ার বিষয়ে মস্কোর সাথে ওয়াশিংটনের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, অন্য দিকে বাশার আল আসাদ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য আরব মিত্রদের পক্ষ থেকেও প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছে মার্কিন প্রশাসন। এ অবস্থায় সিরিয়া সঙ্কটের ভবিষ্যৎ আরো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এটি এমন এক সঙ্কট যা কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয় বরং সারা বিশ্বের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। গত কয়েক সপ্তাহে মস্কো সিরিয়ার সঙ্ঘাতে শুধু একটি স্থায়ী নিকশচিহ্ন এঁকে দিয়েছে তাই নয়, একই সাথে বাশার আসাদকে বাদ দিয়ে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ ঠিক করা যাবে না এমন বার্তাটিও দিয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, ক্রেমলিনের সর্বসাম্প্রতিক পদক্ষেপ সিরিয়ার বিভক্তি সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ধারণা অনুযায়ী, পুতিন বাহ্যত বাথ শাসকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি ছোট রাষ্ট্র থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চান। যে রাষ্ট্রটিতে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটিটি থাকবে। রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপে রুশ বাহিনীর হাতে শুধু সিরিয়ার বেসামরিক নাগরিকই নিহত হয়নি, একই সাথে সিনেটর জন ম্যাককেইনের ভাষায় সিআইএ-প্রশিক্ষিত বিদ্রোহীরাও এর লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্তত সাতটি দেশ, ক্ষমতা থেকে আসাদের বিদায়ের জন্য খোলাখুলিভাবে আসাদবিরোধী বাহিনীর প্রতি সমর্থন দান করেছিল। অসহায় নাকি সমঝোতারুশ সরকার একক স্বচ্ছন্দ ও বেপরোয়াভাবে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের পুরো অবস্থার যখন পরিবর্তন করে দিচ্ছে, তখন বলা যায় এক প্রকার চুপচাপ হয়েই আছে আমেরিকা। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশটন কার্টার রাশিয়ানদের ‘আগুনে ঘি ঢালার জন্য’ যে অভিযুক্ত করেছেন, তা রেটরিকের বেশি কিছু বলে মনে হচ্ছে না। তুরস্ক ও অন্যান্য আরব মিত্র থেকে চাপ না আসা পর্যন্ত ওয়াশিংটন সামরিক অভিযানের সমালোচনায় একটি যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করতেও ছিল অনিচ্ছুক। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ওপর ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে একটি সমঝোতার খবর এর মধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। তুর্কি সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, প্রেসিডেন্ট ওবামা তুর্কি প্রধানমন্ত্রী আহমেত দেভুতুগলুকে বলেছেন, পুতিনের সাথে তার সাক্ষাৎটি অনেক ক্ষেত্রে মতবিরোধ সত্ত্বেও বেশ ফলপ্রসূ ছিল। সিরিয়ার সাম্প্রতিকতম উন্নয়নের আলোকে প্রতিবেশী তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেনÑ এর কারণ অনুসন্ধান করতে যে কেন রাশিয়ান আগ্রাসনের মুখে ওয়াশিংটন এভাবে নীরব হয়ে রইল। অনেকে বিশ্বাস করেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা আফগানিস্তান ও ইরাকের বিরুদ্ধে জর্জ ডব্লিউ বুশের সামরিক অভিযানের পর যে পরিণতি হয়েছে তার জন্য নিজেকে যেকোনো কিছুর বিনিময়ে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে রাখতে চান। ওয়াশিংটনের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, মধ্যপ্রাচ্যে একটি প্রক্সি যুদ্ধের মাঝখান দিয়ে শেষ পর্যন্ত হয়তো এই অঞ্চল থেকে মার্কিন সৈন্য বিদায় নেয়ার সম্ভাবনা হাজির হতে পারে। ওবামা বরং এ অবস্থায় পড়ার চেয়ে ইরানসহ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের মধ্যকার শিয়া জঙ্গিপক্ষ বাস্তবে আমেরিকান স্বার্থে আঘাত করতে পারে এমন ঝুঁকির পরও তা মোকাবেলার পরিবর্তে চোখ বন্ধ করে থাকতে চায়। আর হতে পারে এসব কারণেই রাশিয়ানরা যখন ইউক্রেন আক্রমণ করে তখন সামরিকভাবে হুমকি মোকাবেলার পরিবর্তে অন্য পথ বেছে নেয়। ওয়াশিংটন তখন তেলের দাম নিচে নামিয়ে এনে রাশিয়ান অর্থনীতিকে চাপের মধ্যে ফেলে শাস্তিদানে নিজেকে সক্ষম প্রমাণিত করে তৃপ্ত হতে চায়। অনেকে অবশ্য যুক্তি দেখান, ওবামা প্রশাসনের এই নিষ্ক্রিয়তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি গোপন সমঝোতার কারণেও হতে পারে। এটা ঠিক যে, মস্কোর সাথে ওয়াশিংটনের সমঝোতা কী হয়েছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা প্রায় অসম্ভব। তাদের মধ্যে আদৌ কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না এবং হয়ে থাকলে কেউ এ সম্পর্কে জানেন কি না তা স্পষ্ট নয়। তবে একটি জিনিস পরিষ্কার, মধ্যপ্রাচ্যে এর মাধ্যমে শক্তির একটি নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে এবং সমগ্র অঞ্চলে একটি নতুন ব্যবস্থার উত্থানের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অন্তত দুটো বিপরীতধর্মী শিবিরের ইতোমধ্যে আগমন ঘটছে। সিরিয়ায় আসাদকে রক্ষা করতে সাহায্যে ছুটে এসে ক্রেমলিন এ অঞ্চলের শিয়া শক্তির অভিভাবক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে। এর বিপরীতে আমেরিকার অবস্থান থাকে সুন্নি সম্প্রদায়ের সাথে। রাশিয়ার অবস্থান এখানে ক্রমেই আগ্রাসী হয়ে উঠছে অথচ এর বিপরীতে ওয়াশিংটন নিচ্ছে ম্রিয়মাণ ভূমিকা। তবে শেষ পর্যন্ত নতুন পরিস্থিতিতে স্নায়ু যুদ্ধকালের মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য ছিল সেটি অনেক মানুষকে মনে করিয়ে দেবে। তবুও প্রশ্ন রয়ে যায়, ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে একটি সমঝোতা যদি হয়েও থাকে তবে কিভাবে বর্তমান অবস্থায় আমেরিকান স্বার্থ মধ্যপ্রাচ্যে রক্ষিত হবে? এটা কারো অজানা নয় যে, ওবামা প্রশাসনের পূর্বসূরিদের তুলনায় ভিন্ন অগ্রাধিকার রয়েছে। পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষকদের মতে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাম্প্রতিক উন্নয়ন মধ্যপ্রাচ্য থেকে হোয়াইট হাউজকে অগ্রাধিকার পাল্টাতে উৎসাহিত করেছে। এখন ওয়াশিংটন বরং রাশিয়া ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে সাংহাই ফাইভকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে বেশি আগ্রহী হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র আসাদের ব্যাপারে রাশিয়া ও ইরানের অনমনীয়তার মুখে সুর নরম করলেও অন্তর্বর্তী সময়েই আসাদকে ক্ষমতায় রাখার কথা বলছে। এটি এমন এক অবস্থান যেখান থেকে প্রয়োজনে ওয়াশিংটন আইসিস মোকাবেলার জন্য আসাদের ক্ষমতায় থাকার দরকার আছে বলে নতুন অবস্থানে যেতে পারে। রাশিয়া সেই অবস্থানটি ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে আর চরমপন্থী মধ্যপন্থী নির্বিশেষে সব আসাদবিরোধীর ওপর আঘাত হানছে। পুরো সিরিয়ায় এভাবে আসাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মস্কো হয়তো মনে করছে না। তবে এর মাধ্যমে আসাদের নেতৃত্বে যে আলাবি রাষ্ট্রের আলাদা অস্থিত্বের বিষয়ে আমেরিকার নেপথ্য পরিকল্পনায় রয়েছে বলে ধারণা করা হয় সেটির সীমানাকে যথাসম্ভব বড় করার চেষ্টা থাকতে পারে। যাতে রাশিয়ার একমাত্র উষ্ণ পানির বন্দর ঘাঁটি তারতুসে শক্তিমান রুশ সামরিক অবস্থান অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া রাশিয়ার আইসিস ভীতির আরেকটি কারণ হলো দুই হাজারের মতো ককেসাস এলাকার রুশ নাগরিক আইসিসের হয়ে যুদ্ধ করছে। তারা নিরাপদে ফিরে গেলে তা মস্কোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। নতুন মেরুকরণএসব হিসাব-নিকাশ এবং আমেরিকার পলায়নপর ও ঝুঁকিহীন থাকার নীতি রাশিয়াকে আগ্রাসী অবস্থান নিতে উৎসাহিত করে থাকতে পারে। তবে এই অঞ্চলের পুরো কর্তৃত্ব রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেয়া শেষ পর্যন্ত আমেরিকার পক্ষে সম্ভব হবে না। মার্কিন অর্থনীতিও এর মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ফলে তাদের একটি সক্রিয় ভূমিকায় আসতে হবে মধ্যপ্রাচ্যে। সে ক্ষেত্রে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধ এই মধ্যপ্রাচ্য দিয়েই সূচনা হতে পারে। ইরানের সাথে পাশ্চাত্যের পারমাণবিক সমঝোতা হলেও দেশটি পশ্চিমা বলয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে না। ইরানি নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সর্বশেষ একটি মন্তব্যে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, নানামুখী অসুবিধার কথা চিন্তা করে আমেরিকার সাথে আলোচনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, চিন্তাহীনভাবে অথবা বাস্তবতা না বুঝে শুধু বিশ্বাসী হয়ে আমেরিকার সাথে আলোচনার পক্ষে অনেকে মত দিচ্ছেন, যাতে সাড়া না দিলে দেশ কোনো সমস্যায় পড়বে না। আমেরিকার সাথে আলোচনা হবে তাদের অনুপ্রবেশের সুযোগ দেয়া এবং তাদের ইচ্ছা চাপানোর পথ করে দেয়ার শামিল।শেষ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে স্নায়ুযুদ্ধের নতুন মেরুকরণে হতে পারে রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট ইরান ইরাক আসাদের সিরিয়া আর হিজবুল্লাহর লেবানন একটি পক্ষ। এই পক্ষটি ইয়েমেন ও বাহরাইন পর্যন্ত তাদের প্রভাববলয় বিস্তার করতে চাইতে পারে। আর অন্য দিকে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় দেশ মিসর, সুদান ও তুরস্ক নিয়ে একটি শিথিল বলয় থাকতে পারে। যার পেছনে সমর্থন থাকবে আমেরিকার। অন্তরালে ইসরাইলের পরিকল্পনা!এই মেরুকরণের অন্তরালে থাকতে পারে ইসলাইলের একটি নিজস্ব প্রভাব সম্প্রসারণ পরিকল্পনা। ’৮০-এর দশকে ইনোন পরিকল্পনা নামে এটি গ্রহণ করা হয়েছিল। এটাকে ভিত্তি করে ২০০৬ সালে আমেরিকান আর্মস ফোর্সেস জার্নাল এবং ২০০৮ সালে আটলান্টিক সাময়িকীতে মধ্যপ্রাচ্যের একটি নতুন মানচিত্র বিন্যাসের পরিকল্পনা ও নকশা প্রকাশ করা হয়। ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রথম দফা ক্ষমতায় থাকাকালে তার জন্য ১৯৯৬ সালে রিসার্ড পারলে (জরপযধৎফ চবৎষব) এবং একটি স্টাডি গ্রুপ ‘অ্যা নিউ ইসরাইলি স্ট্র্যাটেজি টুওয়ার্ডস ২০০০’ নামে একটি পলিসি দলিল তৈরি করে। এটি ছিল মূলত ইনোন পরিকল্পনাকে ক্লিন ব্রেক (ঈষবধহ ইৎবধপশ) নামে নবজীবন দান করার কৌশলগত পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার আওতায় আমেরিকান নিউ কন গ্রুপ জর্জ বুশকে দিয়ে ইরাকে সাদ্দাম শাসনের পতন ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আরব বসন্তকে বিপথগামী করে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিমান সব দেশকে বিভক্তির দিকে নিয়ে যাওয়ার কৌশলটি এই ক্লিন ব্রেকের একটি অংশ। ইরাক ও সিরিয়ায় আইসিসের আকস্মিক অভ্যুদয়ের বিপরীতে শিয়া শক্তির পেছনে বেপরোয়াভাবে রাশিয়ার দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং আমেরিকার নিজেকে সঙ্কুচিত করে ফেলার ঘটনার সাথে এই ক্লিন ব্রেকের যোগসূত্র থাকতে পারে। এর পেছনে মূল লক্ষ্যটি হলো ইসরাইলের প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোকে পরস্পর বৈরী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশে বিভক্ত করা এবং জাতিতাত্ত্বিক বিরোধগুলোকে উসকে দিয়ে এসব দেশের নিরাপত্তার জন্য ইসলাইলের প্রতি নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করা। এর মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ইসরাইলি রাষ্ট্রের সীমানা বাড়িয়ে বৃহত্তর ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। –

পূর্ব প্রকাশিত : নয়াদিগন্ত

Loading

Comments are closed.