“সাকিবের অহংকার আর বিসিবির পা”— ব্যক্তি সাকিব বনাম রোল মডেল সাকিব। পর্ব ২

সাকিব আল হাসানের শাস্তির পরে প্রতিক্রিয়ায় পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, এই শাস্তির ব্যাপারে দেশের জনগণ আজ দুই ধারায় বিভক্ত। সাকিব আল হাসানের কঠোর শাস্তিতে বাংলাদেশের অনেক ভালো ভালো মানুষও উল্লসিত হয়েছেন।

শাস্তির পক্ষে যারা আছেন, তাদের অবস্থান হলো দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় যদি তাকে বহিষ্কার করতে হয়, তাও করতে হবে। তাদের অনেকের আরো একটা ভাবনা হলো সাকিব অহংকারী হয়ে গেছেন এবং অর্থের লোভে তার দেশপ্রেমে ঘাটতি হয়েছে।

প্রথম যুক্তিতে তাদের সাথে একমত। শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে সাকিবকে যদি বহিষ্কার করতে হয়, করা হোক। কিন্তু, আমরা আলোচনায় দেখেছি শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়টা দোহাই মাত্র। এবং তিলে তিলে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে ধ্বংসকারী এবং স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং অযোগ্যতার দায়ে অভিযুক্ত এই প্রতিষ্ঠানটির সকল বক্তব্য বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করা নির্বুদ্ধিতা মাত্র। বরং আমরা দেখেছি সাকিব বারে বারে ক্ষমা চেয়েও তাদের প্রতিশোধের খড়্গ থেকে বাঁচতে পারেন নাই। ফলে এই যুক্তি খাটে না। এই যুক্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় দলের সকল খেলোয়াড়কে বহিষ্কার করা যাবে ।

কিন্তু অর্থের লোভ আর দেশপ্রেমের বিষয়টা মানলাম না।

সাকিব আল হাসান ব্যক্তি হিসেবে ত্রুটিমুক্ত নন। তার ব্যক্তিগত সংযম নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা আছে। তিনি যদি দেশের আইন ভাঙেন বা বিসিবির আইন ভাঙেন তবে বিধি মোতাবেক তার শাস্তি হতেই পারে।

বিশেষত, তার স্ত্রীকে ইভটিজিং করার কারণে কিছু ছেলেকে উত্তমমাধ্যম দেয়ার ঘটনাটিতে অনেকেই সাকিবের সমালোচনা করেন। আমিও করি। কিন্তু, এটাও আমাদের দেখতে হবে সাকিব আল হাসান একজন মানুষ। আপনার স্ত্রী , মা বা কন্যাকে কেউ যদি টিজিং করত আপনি কি করতেন?

দেশের মানুষের কাছে সাকিবের একমাত্রা পরিচয় হওয়া উচিত, তিনি একজন ক্রিকেটার। খেলার মাঠে তার পারফরমেন্সসাকিব খেলার সময়ে দেশের জন্যে ১০০% দিচ্ছেন কিনা সেটা নাগরিকের জন্যে, দেশের জন্যে জরুরী বিষয়। কিন্তু, খেলার বাইরে ব্যক্তি সাকিবের ব্যক্তিগত আচার, সে কাকে বিয়ে করল, সে শাহরুখ খানের সাথে কখন কোন পার্টিতে গেল, তার স্ত্রী কোন ধরনের পোশাক পড়ল সেটা সাকিব আল হাসানের একদম ব্যক্তিগত বিষয়অন্য কারো বিবেচ্য নয়

আমি আবার বলছি, আমি সাকিবের এই কার্যক্রম সমর্থন করছি না এবং আমি মনে করি, সাকিবসহ যে কারো এই ধরনের কাজের জন্যে আইনি শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু আমি বলছি, গণমানসের কথা। যেই গণমানস ইভটিজারদের শাস্তির কথা বলে, যেখানে বাংলাদেশের ৯৯% মানুষ সুযোগ পেলে একই শাস্তি দিত। সেখানে কেন সাকিব আল হাসানকে আলাদা স্ট্যান্ডার্ড মেইন্টেন করতে হবে? এটা কি ভেতো বাঙালির ট্রিপল স্ট্যান্ডার্ড না ?

এই গণমানস আরও বুঝতে চায় না, সাকিব বিনয়ী না অহংকারী হবেন সেইটা সাকিবের ব্যক্তিগত অধিকার। সেইটা কারো বিবেচ্য বিষয় না। অবশ্যই রোল মডেল হিসেবে সাকিবের কাছ থেকে আমরা ভালো ব্যবহার আশা করি, কিন্তু সেইটা পূর্ণ করতে সাকিব ব্যর্থ হলে কারো কিছু করার নাই। কারণ সেটা প্রত্যাশা মাত্র, সেই প্রত্যাশা পূর্ণ না করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ না।

দেশের মানুষের কাছে সাকিবের একমাত্রা পরিচয় হওয়া উচিত, তিনি একজন ক্রিকেটার। খেলার মাঠে তার পারফরমেন্সসাকিব খেলার সময়ে দেশের জন্যে ১০০% দিচ্ছেন কিনা সেটা নাগরিকের জন্যে, দেশের জন্যে জরুরী বিষয়। কিন্তু, খেলার বাইরে ব্যক্তি সাকিবের ব্যক্তিগত আচার, সে কাকে বিয়ে করল, সে শাহরুখ খানের সাথে কখন কোন পার্টিতে গেল, তার স্ত্রী কোন ধরনের পোশাক পড়ল সেটা সাকিব আল হাসানের একদম ব্যক্তিগত বিষয়অন্য কারো বিবেচ্য নয়।

আমরা জানি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে একজন খেলোয়াড় যদি ১০০% দিয়ে থাকেন, সে হল সাকিব আল হাসান। এর মধ্যে অনেক খেলোয়াড় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে আসছে গেছে, হারিয়ে গেছেকিন্তু সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের একমাত্রা খেলোয়াড় যে তার পারফরমেন্স ধরে রেখেছেন। সেটাও নিশ্চয়ই অটোমেটিক হয় নাই। তার মানে তিনি খেলার বাহিরেও প্রচুর পরিশ্রম করে তার পারফরমেন্স ধরে রেখেছেন। দেশের মানসম্মান ধরে রেখেছেন, আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতাপূর্ণ টুর্নামেন্টে সবচেয়ে হাই লেভেলে পারফরমেন্স করেছেন। আমাদেরকে গর্বিত করেছেন।

কিন্তু, আমরা প্রায়ই সাকিবের এই প্রফেশনাল অংশটুকু খেয়াল না করে, সাকিবের ব্যক্তিগত অংশটুকুকে গুরুত্ব দেই। এটা আমাদের অন্যায়।

সাকিব হাতুরাসিংহকে বলেছেন, তিনি টাকার জন্যে খেলতে গেছেন। প্রয়োজনে তিনি জাতীয় দল ছেড়ে দিবেন। সাকিব যে এটা রাগের মাথায় বলেছেন সেটা প্রমাণিত হয়, যখন আমরা দেখি সাকিব এটা বলার জন্য বার বার ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু দেশের অনেক মানুষ সেটা গ্রহণ করে নাই।

তাদের প্রতি প্রশ্ন হচ্ছে, আজকে বেনেফিট অফ ডাউট আপনি কাকে দিবেন? একটা পরীক্ষিতভাবে অযোগ্য এবং রাজনৈতিক যোগ্যতায় ক্ষমতায় বসা প্রশাসন এবং তাদের নেতাদেরকে, নাকি একজন কঠোর পরিশ্রমী প্রফেশনালকেযে শত শত বার তার যোগ্যতা, মেধা এবং পরিশ্রম দিয়ে বিশ্বের কাছে নিজের এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।

ধরে নেই, সাকিব আল হাসান সত্যিই জাতীয় দলের পক্ষে খেলতে আসলেই অস্বীকার করেছেন। সেই ক্ষেত্রে সাকিবের দেশপ্রেম নিয়ে আপনি প্রশ্ন তুলতে পারেন, কিন্তু তবুও দুইটা কথা থাকে।

সাকিব আল হাসান, অতিমানব নন। তিনি একজন তরুণ। তার ভুল করার অধিকার আছে। তার বয়সটা ভুল করার বয়স। আমরা অনেকেই বুঝি না, বিশ্ব জয় করে আসা সাকিব আল হাসান ২৬ বছরের একজন তরুণ মাত্র। সাফল্যে তার কিছুটা মাথা বিগড়ে যেতে পারে। এবং খুব অল্প বয়স থেকেই সেলেব্রিটি হওয়াতে তার সমপর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন সমবয়সীর স্বাভাবিক জীবন সে পায়নি। সারা জাতির প্রত্যাশার যে চাপ তাকে নিতে হয় এবং পরাজয়ের যে গ্লানি তাকে মাথায় নিতে হয়সেটাও বাংলাদেশের আর কারো সাথে তুলনীয় নয়। এবং যারা সে রকম উচ্চতায় গেছেন, তারা জানেন, এত উপরে জীবন খুব একলা। তাই তার উপরে মানসিক অনেক ধরনের চাপ থাকতে পারে যার জন্যে সাকিবের কাউন্সেলিং প্রয়োজন

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, তিনি সত্যি দেশের পক্ষে তিনি আর খেলবেন না তাহলে, সেটাকে আমাদের শ্রদ্ধা করতে হবে। কারণ, ব্যক্তি সাকিবের অধিকার রয়েছে বেছে নেয়ার, তার অর্থ উপার্জনের রাস্তা যদি বিসিবি বন্ধ করে দেয়, তবে তার পরিবারের এবং তার ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে বিদেশি লিগে খেলারযেখানে তার উপার্জনের সুযোগ বেশি। গেইলস একই কাজ করেছেন।

এই কথায় অনেকে আহত হতে পারেন। কিন্তু, বুয়েটের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের টাকায় পড়ে কোনো ছাত্র যখন চাকরি নিয়ে আমেরিকা, কানাডায় চলে যায় আমরা কি তার সমালোচনা করি?

তাহলে সাকিব আল হাসানের জন্যে কেন অন্য নিয়ম। সাকিব তো দেশকে অনেক কিছু দিয়েছেন। কিন্তু, দেশকে কিছু না দিয়ে যারা দেশের বাহিরে চলে যান তারা দেশকে দিয়েছেন?

দেশের সকল প্রফেশনে মানুষ নিজের সর্বোচ্চ অর্থ উপার্জনের মাধ্যমটাকেই বেছে নিচ্ছে। সাকিব আল হাসান যদি বেছে নেন তাহলে সমস্যা কি? ১৬ কোটি মানুষের জন্যে এক নিয়ম, সাকিবের জন্যে কেন আরেক নিয়ম? সাকিব এই বামনদের দেশে অতিমানব বলে কি তার জন্যে সব কিছুতে আলাদা মান?

তাছাড়া, সাকিব যদি দেখেন রাষ্ট্রের শোষণ যন্ত্রের একটি অংশ, তাদের ব্যক্তিগত লাভালাভ এবং আত্মশ্লাঘাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তার ব্যক্তিসম্ভাবনাকে ধ্বংস করছে শুধু মাত্রা স্বেচ্ছাচারিতার জন্যে এবং এর ফলে তারা রাষ্ট্রের স্বার্থকেও হানি করছে তবে ব্যক্তি সাকিবের অধিকার আছে, তাদের সেই নির্দেশ অমান্য করার। এটা দেশপ্রেমের প্রশ্ন না, এটা নৈতিকতারও প্রশ্ন বটে। যে সাকিব দেশকে এত দিয়েছে, তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন করার আগে, আমাদের কয়েক শ বার চিন্তা করতে হবেযেই ব্যক্তি দেশকে এত দিয়েছে সে কেন এমন একটা সিদ্ধান্ত নিবে, যার ফলে তার জেতার কিছুই নাই। বরং অনেক কিছু হারাতে হবে।

আমরা এগুলো ভাবি না। আমরা আমাদের বাইনারি দৃষ্টিতে পেপারের একটা রিপোর্টের ভিত্তিতে এবং পরীক্ষিতভাবে অযোগ্য ব্যক্তিদের সংবাদ সম্মেলনের মিসরিমাখা কথায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে সাকিব আল হাসান দেশদ্রোহী, অহংকারী ইত্যাদি ইত্যাদি। তার এতবছরের ঘন্টার পর ঘন্টা পরিশ্রম, সাধনা, আত্মত্যাগকে আমরা তখন বাতিল করে দেই এক লহমায়। এটা ভুল।

সাকিব আল হাসান, অতিমানব নন। তিনি একজন তরুণ। তার ভুল করার অধিকার আছে। তার বয়সটা ভুল করার বয়স। আমরা অনেকেই বুঝি না, বিশ্ব জয় করে আসা সাকিব আল হাসান ২৬ বছরের একজন তরুণ মাত্র। সাফল্যে তার কিছুটা মাথা বিগড়ে যেতে পারে। এবং খুব অল্প বয়স থেকেই সেলেব্রিটি হওয়াতে তার সমপর্যায়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন সমবয়সীর স্বাভাবিক জীবন সে পায়নি। সারা জাতির প্রত্যাশার যে চাপ তাকে নিতে হয় এবং পরাজয়ের যে গ্লানি তাকে মাথায় নিতে হয়সেটাও বাংলাদেশের আর কারো সাথে তুলনীয় নয়। এবং যারা সে রকম উচ্চতায় গেছেন, তারা জানেন, এত উপরে জীবন খুব একলা। তাই তার উপরে মানসিক অনেক ধরনের চাপ থাকতে পারে যার জন্যে সাকিবের কাউন্সেলিং প্রয়োজন। নিশ্চিত প্রয়োজন।

তিনি যা অর্জন করেছেন, বাস্তবতা হল, বাংলাদেশের ক্রিকেটে কেউ সেই পরিমাণ অর্জন করেন নাই। তিনি যদি অহংকারী হয়ে যান, তার যদি অ্যাটিচিউড প্রবলেম থাকে তবে তাকে কাউন্সেলিং করে শোধরানো সম্ভব। এবং তাতে তিনি না শোধরালে বিধি মোতাবেক শাস্তি দেয়া যেতে পারে ।

কিন্তু, কোনো নিয়মকানুন না মেনে একটা অথর্ব প্রতিষ্ঠানের অযোগ্য কর্ণধারদের প্রতিশোধস্পৃহা মেটানোর জন্যে দেশের সব চেয়ে প্রতিভাবান ক্রীড়াব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করে দেয়াটা চোখের সামনে দেখে আমাদের চুপ থাকা উচিত নয়।

 

সাকিবের অহংকার ও বিসিবির পা” ব্যক্তি সাকিব বনাম রোল মডেল সাকিব ১ম পর্ব 

পূর্ব প্রকাশিত: বাংলা ট্রিবিউন

Loading

জিয়া হাসান

About জিয়া হাসান

লেখক: প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : শাহবাগ থেকে হেফাজত: রাজসাক্ষীর জবানবন্দি -

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *