সরকার চায় সবাই মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে আসুক।

নির্বাচনের পূর্বের বছর ৭৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার রিপোর্টে সরকারের অকল্পনীয় দুর্নীতি হাতে নাতে ধরা খাওয়ার পরে, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে “নয়া বিতর্ক” সৃষ্টি করার মাধ্যমে, সেই লুটের সংবাদ আড়াল করতে পারার সাফল্যের জন্যে, আওয়ামী লীগের প্রপাগান্ডা সম্পাদকের কাছ থেকে, একটা ধন্যবাদ, বেগম খালেদা জিয়া পেতেই পারেন।
যেহেতু নাম গননা করে, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় নাই, সেহেতু প্রকাশিত শহীদের সংখ্যা নিয়ে অবশ্যই বিতর্কের সুযোগ আছে। কিন্তু, সেই বিতর্ক করে, পাকিস্তানের এপলজিস্টরা- যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের অকল্পনীয় নৃশংসতাকে আরো সহনীয় রুপ দিতে চায়।
বেগম খালেদার মত দুই দুই বারের প্রধানমন্ত্রী সেই দায়িত্ব নিয়েছেন, এইটা একটা সংবাদ এবং তার যথাযোগ্য ট্রিটমেন্ট তিনি পাচ্ছেন।
অবজেক্টিভিটির কথা যদি বলেন, তবে বলবো, পৃথিবীর কোন যুদ্ধে দুই পক্ষের হতাহতের সংখ্যা অব্জেক্টিভ ভাবে হয় নাই। শুধু মাত্র ইয়োরোপে যেই খানে, প্রতিটা নাগরিকের বারথ রেকর্ড ঠিক মত মেন্টেন করা হয়, সেই খানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কত জন কে কে মারা গ্যাছে, তার একটা পরিষ্কার চিত্র আছে। কিন্তু, এই একই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষে কতজন মারা গ্যাছে তার কোন প্রপার রেকর্ড নাই। সেই সংখ্যাকে ধরা হয় ১৫ লক্ষ থেকে ৪০ লক্ষ। মনে করেন, আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের নিহতের সংখ্যা ধরা হয় ১৯ লক্ষ থেকে ৪০ লক্ষ। বেশি দিন আগের কথা না, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আক্রমনে প্রথম চার বছরে নিহতদের সংখ্যা বিভিন্ন সাইনটিফিক এস্টিমেট মতে, ১৫১,০০০ থেকে ১০ লক্ষ পর্যন্ত আসছে। ২০১১ সালের একটা রিসার্চে বলা হয়েছে, ৫ লক্ষ।
এবং আর সকল যুদ্ধের মত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নির্ণয়েও একটা মার্জিন অফ এরর আছে, স্ট্যাটিস্টিক্যাল প্রবেবিলিটি হিসেবে। কারণ, যুদ্ধের সময়ে গুম হওয়া, লাশ হওয়া, গনকবরে ঠাই হওয়া মানুষদের নাম পাওয়া সম্ভব না। আর, হিন্দু জনগোষ্ঠীদের মধ্যে যারা হত্যা নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন তাদের পরিবারের কাছ থেকে সঠিক সংখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। আবার শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার পথে, যারা প্রান হারিয়েছেন তাদের সংখ্যাও নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তাই, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা একটা স্টাটিস্টিটিকাল প্রবেবিলিটি।
বিভিন্ন স্টাডিতে যেই প্রবেবিলিটির হায়ার মার্জিনে আছে, ৩০ লক্ষ। লোয়ার মার্জিনে পাকিস্তানের হামুদুর রহমান রিপোর্ট তাদের সৈন্যদের পিঠ বাঁচাতে বলেছে, ২৪,০০০।
এখন আপনি যদি পাকিস্তানি আর্মির এপলজিস্ট হন, আপনি এই প্রবেবিলিটির লোয়ার মার্জিনটাকে ডিফেন্ড করবেন,আর নিজের এই দেশটাকে সৃষ্টির জন্যে যারা প্রান দিয়েছেন, তাদের প্রতি যদি ন্যুনতম ভালোবাসা থাকে তবে, আপনি হায়ার মার্জিনকে ডিফেন্ড করবেন।
এইটাকি অবজেক্টিভ হইলো?
স্ট্যাটিস্টিকসের মার্জিন অফ এরর এই খানে ইস্যু -অবজেক্টিভিটির না।
যারা বিভিন্ন এঙ্কডটাল রেফারেন্সের ভিত্তিতে বিভিন্ন মতামত দিচ্ছেন , তারাও কেউ অবজেক্টিভ না। ঠিক এই লোকগুলো আজকে পলিটিকালি আরামদায়ক হলে, উলটো কথা বলতেন।
আমাদের অকল্পনীয় ব্যর্থতা, মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছ তাদের জনে জনে নাম, ঠিকানা আমরা বের করিনি। কিন্ত করি যে নাই, সেইটাই আজকে ২০১৫ সালের রিয়ালিটি।
২০১৫ সালের আর একটা বাস্তবতা হচ্ছে, এখন ফিল্ডে ভিজিট না করে, গ্রামে গ্রামে শহীদদের সংখ্যা বের না করে, ভারতে পালিয়ে জাওয়া হিন্দু জনগোষ্ঠীর ডাটা না নিয়ে –বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের প্রবেবিলিটির উপরে ভিত্তি করে যতই রিসার্চ হক না কেন, সেই গুলোর মার্জিন অফ এরর অনেক হাই থাকবে। এবং আজকে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে সেই সংখ্যার রিভিশান করা অসম্ভব।
শহীদদের সংখ্যা নিয়ে এই মার্জিন অফ এরর নিয়েই আমাদের জাতিয় নেরেটিভকে, রিকন্সিল করতে হবে- জনগনকে এক কাতারে আনতে হবে। এইটা একটা বাস্তবতা যার অন্য কোন, অল্টারনেটিভ নাই। যেহেতু, সঠিক সংখ্যা জানার কোন সুযোগ নাই, যেহেতু সেই সময়ের প্রয়োজনীয় রেকর্ড রাখা হয় নাই এবং সকল রিসার্চ এখন এঙ্কডোটাল রেফারেন্স, এবং সম্পূর্ণ অনিভরজগ্য সোর্স বা পাকিস্তানি বাহিনীর ডাটা,যার অব্জেটিভ হওয়ার কোন সুযোগ নাই- সেই সবের উপরে নির্ভর করবে। তাই, যে যতই বিতর্ক সৃষ্টি করুক , এই ৩০ লক্ষেই আমাদের ক্লোজার। এবং এইটা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সৃষ্টি করা একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সব চেয়ে অপ্রয়জনিয় কাজ।তিনি তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে তার সমর্থকদেরকে এমন একটা নেরেটিভ বেছে নিতে বাধ্য করছেন, যা আমাদের দেশে আরও একটা অপ্রয়নিয় বিরোধ এবং ডিভিশান সৃষ্টি করবে।
মুল প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এত বছর ধরে, জনশ্রুতির মত যেই সংখ্যাটা আমাদের জাতিয় নেরেটিভের পার্ট হয়ে গ্যাছে। খুজে দেখলে দেখা যাবে, হয়তো প্রেসিডেন্ট জিয়ার বক্তব্যও ৩০ লক্ষ শহীদ শব্দটা আছে, এবং যুগে যুগে সকল নেতা মাঠে ঘাটে রাস্তায় ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলা বলেছে,কবিরা কবিতা লিখেছে, গল্প লিখেছে সেই – সেই সংখ্যা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার মত দুইবারের প্রধানমন্ত্রীর “মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে” –বিতর্ক তোলার দরকার কেন পড়লো?
বেগম খালেদা জিয়া দুই দুই বার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে শহীদদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ের যে দায়িত্ব নেন নাই, তার কেন এই রকম বক্তব্য দিতে হলো?
এর একটা উত্তর আছে। কিন্তু সেই উত্তরের থেকে বরং আর একটা প্রশ্ন আছে যা এই প্রশ্নের আরো ভালো উত্তর দেয়।
প্রশ্নটা হচ্ছে হচ্ছে কেন, বিএনপির জন্যে ৭৬,০০০ কোটি টাকা দুর্নীতি, বাচ্চাদের খেলার মাঠ না থাকা, খাদ্যে ফরমালিন, রোড এক্সিডেন্টে মানুষের নিয়মিত মৃত্যু, মৃত্যু পথযাত্রীদের সেবার অকল্পনিয় ব্যয় বৃদ্ধিতে লক্ষ লক্ষ পরিবারের ফতুর হয়ে যাওয়া বা সরকারের অবিম্রিশ্যকারিতায় মালেশিয়ার ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়া ইস্যু না? কিন্ত মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা একটা ইস্যু। কেন ?
এর কারণ, একটা দলকে রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালনা করতে হবে, তার অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক ভিশান কি সেইটা নিয়ে ভাবতে হয়। সময়ের যে নতুন চ্যালেঞ্জ সেই গুলোকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হয়। কিন্তু, অর্থনৈতিক ইস্যু, গ্যাস শেষ হওয়ার পরে এনার্জি কি হবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান সময়ে আস্তিক নাস্তিক ইস্যু, ভারতের নদী দখল এবং সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন, আন্তর্জাতিক পলিটিক্সে আইসিসের আবির্ভাব, মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক দুর্যোগে আমাদের শ্রমিকদের দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া, আইন শৃঙ্খলা বাহিনিতে শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পরা, বিচার বিভাগের রাজনইতিকায়ন সহ অনেক ইস্যুতে বিএনপির কোন পরিকল্পনা নাই এবং সরকারের কাজের কোন ধারাবাহিক সমালোচনা নাই। আওয়ামী লীগের নামকেওয়াস্তে বিরোধিতা করাই এখন বিএনপির পলিটিক্স।
এবং আওয়ামী যেহেতু এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তার রাজনৈতিক ঢাল বানিয়েছে বিএনপি এখন মনে করছে্‌ আওয়ামী লিগকে পরাজিত করতে হলে তাকে মুক্তিযুদ্ধকে টার্গেট করতে হবে। এই জন্যে, বিগত দিন গয়েশ্বর রায়কেও দেখলাম, বুদ্ধিজীবীদেরকে নিয়ে অশোভন মন্তব্য করতে। কয়েক দিন আগে, ফরহাদ মাজহার সাহেবও আমাদের বিজয় দিবস প্রকৃতপক্ষে ভারতীয়দের বিজয় বলে দেখাতে চেয়েছেন।
এই রাস্তা সরকারের বাতলে দেয়া রাস্তা। সরকার চায় সবাই মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে আসুক।
সরকার চায় বিএনপি সহ সারা দেশ এখন শহিদের সংখ্যা, পাকিস্তানি দুতাবাস, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাকিস্তানের সাথে সম্পরক এই সব ইস্যুতে মগ্ন থাকি যেন আমরা ভুলে যেতে পারি, আমাদের চোখের সামনেই এই দেশের প্রতিটা প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে এবং প্রতি নিয়ত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লোণ নিয়ে আমাদের ডেবট টু জিডিপির সক্ষমতাকে লুটে নেয়া হচ্ছে। গত দিনের পেপারে রাশিয়ার সাথে ১২ বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক চুল্লির চুক্তির খবর আসলো। এক অবিশ্বাস্য ভয়াবহ সংখ্যা যা দিয়ে, ১২ টা পদ্মা ব্রিজ হয়(প্রাথমিক ব্যয় হিসেব করলে) কিন্ত দেশে কোন আলোচনা হলো না।না বিএনপি না অন্য কেউ। দেশে এখন কি ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় যাচ্ছে তাকে উদ্ধার করতে পারতো তেলের মূল্যহ্রাস। কিন্তু, তাও সরকার কমাচ্ছেনা। পরশু দেখলাম, ৩৫ ডলারের তেল কেনা হয়েছে, ৬০ ডলারে যেখানে আর কয়েকশো কোটি টাকার দুর্নীতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এইসব অবিশ্বাস্য অনৈতিক কাজ জারি রাখতে সরকারের প্রয়োজন আর বেশি মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষের শক্তির বিতর্ক।
সরকারের সৃষ্টি করা সেই রাস্তা ধরেই, বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি হাঁটছে। যেই পথের শেষ মাথায় আছে, আদর্শিক ভাবে বিভক্ত, পরাজিত একটা জাতি- আর সব কিছু লুটে বিদেশে পাচার করার পর পোড়ামাটিতে অল্প সম্পদ নিয়ে কামড়া কামড়ি করে বেচে থাকা ১৮ কোটি অকিঞ্চিৎকর প্রান।
আওয়ামী লীগের এই দুঃশাসন এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রধান শক্তি হিসেবে অনেকে বিএনপিকে দেখে, কিন্তু বাস্তবতা হল একটা নামকেওয়াস্তে বিরোধিতার নামে, অনৈতিকতার রাজতিলকধারী একটা দুর্বল প্রতিপক্ষ হয়ে বিএনপি আওয়ামী লীগের এই অপশাসনের বৈধতা দিচ্ছে মাত্র।
শহীদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়ার এই অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক তার একটা বড় প্রমান।

Loading

জিয়া হাসান

About জিয়া হাসান

লেখক: প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত গ্রন্থ : শাহবাগ থেকে হেফাজত: রাজসাক্ষীর জবানবন্দি -

Comments are closed.