সত্য-উত্তর যুগ

আমরা এমন এক যুগে এসে পৌঁছেছি যাকে বলা হচ্ছে Post-truth era বাংলায় যাকে “সত্য-উত্তর যুগ” বলা যায় অর্থাৎ এই যুগ সত্যের যুগ অতিক্রম করেছে, মিথ্যা চরমভাবে সামাজিক রূপ গ্রহণ করেছে। আজকাল এ বিষয়ে অনেক লিখা হচ্ছে এবং অলোচনা হচ্ছে।

আসলে অনেক আলোচনা, বিতর্ক, এবং গবেষণা্র পরে, ২০১৬ সালকে অক্সফোর্ড অভিধানে “সত্য-উত্তর” ( post-truth) শব্দ অভিধানে সংযোগের ঘোষণা দেয়।

“সত্য-উত্তর” যুগে আসলে কি হচ্ছে?

Oxford Dictionaries Word of the Year 2016 is “post-truth” – an adjective defined as ‘relating to or denoting circumstances in which objective facts are less influential in shaping public opinion than appeals to emotion and personal belief’.’ অর্থাৎ অক্সফোর্ড অভিধানে ২০১৬ সালের বছরে শব্দ “সত্য-উত্তর” কে একটি বিশেষণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে এই কথা বুঝাতে যে “কোন বিষয় সংক্রান্ত বা পরিস্থিতি-জ্ঞাপক বা তাৎপর্যে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য বিসর্জন দিয়ে কেবল মাত্র আবেগ এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে জনমত প্রভাবিত করা।

তবে সবচেয়ে মারাত্বমক হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব-রাজনীতিতে এর ব্যবহার চরম অনৈতিক আকারে বিস্তার করেছে। উইকিপিডিয়া বা উন্মুক্ত বিশ্বকোষ এব্যাপারে লিখছে ‘Post-truth politics (also called post-factual politics) is a political culture in which debate is framed largely by appeals to emotion disconnected from the details of policy, and by the repeated assertion of talking points to which factual rebuttals are ignored. Post-truth differs from traditional contesting and falsifying of truth by rendering it of “secondary” importance.

ঘটনার আসল সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্যকে পাশ কাটিয়ে আবেগ ইমোশন দিয়ে জনমত প্রভাবিত করার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। আর এ প্রতারণা পদ্ধতি সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতিতে।

তাই সত্য-উত্তর (Post-truth era) যুগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নৈমিত্তিক অসাধুতাকে পৃথিবীব্যাপী অনুপ্রাণিত করা। এক কথায় আমরা এখন মিথ্যার যুগে বাস করছি, এখানে মিথ্যাই সত্য।

দি ইন্সটিটিউট অফ আর্টস এন্ড আইডিয়া কর্তৃক আয়োজিত এক আলোচনায় বিভিন্ন পেশার বিজ্ঞ আলোচকরা তাদের আলোচনায় এই বিষয়টাকেই স্পষ্ট করেছেন। খুবই ইন্টারেস্টিং আলোচনা। শুনতে চাইলে নিচের ভিডিওটি দেখতে পারেন।

 

তবে এই পোষ্ট-ট্রুথ বা সত্য-উত্তর যুগের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে প্রচারণা শক্তি।

মিডিয়া বা গণমাধ্যমের ভূমিকা

গণমাধ্যম বা মিডিয়া সাধারণ জনসাধারণের কাছে বার্তা পৌছানোর বা যোগাযোগের একটি ব্যবস্থা। যার লক্ষ্য হতে পারে মানুষকে বিনোদন দেয়া, বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষামুলক আলোচনা, বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ দৃষ্টিকোন থেকে সংবাদ পরিবেশনা করা যার মাধ্যমে একটি সুস্থ জনমত সৃষ্টি করা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়না বরং সেখানে থাকে হিডেন এজেন্ডা! বাস্তবে যা হয় তা হল সংবাদ ও তথ্যকে এমনভাবে প্রচার করা যাতে সমাজের প্রভাবশালী, অভিজাত গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা হয়।

প্রখ্যাত লেখক ও চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের যৌথ প্রকাশিত “ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট” বইটিতে তাঁরা প্রমাণ করেছেন কিভাবে মুনাফা চালিত প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট মিডিয়া সমাজের প্রভাবশালী ও অভিজাত গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়। এ বিষয়ে তাদের একটি ডকুমেন্টারি ফ্লিমও প্রকাশিত হয়েছে। https://youtu.be/YHa6NflkW3Y

 

 

মুসলিম দেশে এর প্রভাব

বস্তুত এই “সত্য-উত্তর” যুগের কুফল থেকে মুসলিম দেশের অবস্থাও মুক্ত নয় বরং মুসলিম দেশগুলাতে এ প্রবণতা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে, কেননা দেশগুলোতে পশ্চিমা দেশের অন্ধ অনুকরণ করা হয়। রাজনীতিতে মিথ্যাচার, বিকৃত ইতিহাস, ব্যক্তি পূজা, দুর্নীতি ইত্যাদি যাবতীয় অনৈতিকতার বাধাহীন চর্চা পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আরো এক ধাপ এগিয়ে, এই শেষের বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের নিজেদের। যেমন,বাংলাদেশের উদাহরণ দেখলে দেখা যাবে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শহীদের মৃত্যু সংখ্যা, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান ও ঘটনার আসল সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ব্যবহার না করে শুধু আবেগ বা ইমোশন ভিত্তিক কথাবার্তা ও তথ্য দিয়ে জনমত প্রভাবিত করার অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে এবং এগুলোতেই দেশপ্রেমের মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়। তাই আজ অনেকেই মনে করেন যে এই অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তির উপায় নাই।

দু:খের ব্যাপার হচ্ছে এ পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থা যতই খোদা বিমুখ বস্তুবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে, এবং যত বেশি হবে, সেই সাথে ধর্মান্ধতা ও ধর্ম ব্যবসা ততই বৃদ্ধি পাবে এবং এই প্রতারণার প্রকোপও বাড়বে।

তবে এই সত্য-উত্তর বা সত্য বিসর্জিত যুগের মোকাবিলা একমাত্র ইসলামই করতে সক্ষম। ইসলামী আদর্শ কখনই সাদাকে কালো কিংবা কালোকে সাদা বলতে পারেনা। ইসলামী সভ্যতার সোনালি দিনগুলোর ইতিহাসে দেখা যায় তখনও বিজ্ঞানের চর্চা ছিল কিন্তু তাদেরকে নাস্তিক হতে হয় নি। অথচ আজ নাস্তিক হওয়া মানেই বিজ্ঞানমনস্ক! সেজন্য সত্য-উত্তর যুগের কারিগর অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থবাদী মহল ও নাস্তিকেরা  ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে শুরু করেছে “ইসলাম আতঙ্কের নব্য ক্রুসেড”।

এ প্রসঙ্গে মুসলিমদের জন্য আয়াতুল কুরসির পরের সে আয়াতটি (২: ২৫৬)  রয়েছে সেটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আল্লাহ বলেন,

“দীন সম্পর্কে জোর-জবরদস্তি নাই; সত্য পথ ভ্রান্ত পথ হইতে সুস্পষ্ট হইয়াছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করিবে ও আল্লাহতে ঈমান আনিবে সে এমন এক মজবুত হাতল ধরিবে যাহা কখনও ভাঙ্গিবেনা। আল্লাহ, সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়।”

এখানে তাগুতের অভিধানিক অর্থ সীমালঙ্গনকারী, দুষ্কৃতির মূল বস্তু, মিথ্যা প্রচারণা যাহা মানুষকে বিভ্রান্ত করে বলে তাফসিরকারিরা ব্যাখা করেন।

আসলে খোলা মন নিয়ে ও অন্তর্দৃষ্টিসহকারে  যারাই কোরআন বুঝার চেষ্টা করবেন তাদের পক্ষে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা কঠিন হবে না। আমার এক বাংলাদেশী বন্ধু, সঙ্গীতের প্রচুর ভক্ত নিজে গিটার বাজান, খুবই খোলা মনের একজন মানুষ। একদিন তাকে কথা প্রসঙ্গে কোরআন বুঝে পড়ার অনুরোধ করেছিলাম। দু-সপ্তাহ পরে দেখা হলে আমাকে বললেন, “ভাই, কেউ যদি কোরআন আধ ঘণ্টা বুঝে তেলায়ত করে তবে তার পক্ষে বাংলাদেশের ‘অমুক দলের’ রাজনৈতিক দর্শনের পক্ষে থাকা মোটেই সম্ভব নয়।” এখানে আমি ইচ্ছা করেই সেই দলের নাম ‘অমুক দল’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছি যাতে মূল আলোচনা অন্য দিকে না যায়। আমার পয়েন্ট হচ্ছে আমরা যদি সত্যিই ইসলামকে বুঝার চেষ্টা করি এবং পড়াশুনা করি তাহলে এ সত্য-উত্তর যুগেও আমরা নিজেদের চিন্তা চেতনা ও ঈমানকে সুদৃঢ় রাখতে পারব। এটাই হবে আমাদের জন্য এক মজবুত হাতল যার কথা মহান আল্লাহ উপরের আয়াতে উল্লেখ করেন।

Comments are closed.