শুধু কঙ্কাল আর ধ্বংসস্তূপের নগরী

পাঠকের প্রতি অনুরোধ এ লিখাটি পড়ার আগে নিচের ভিডিওটি এক নজর দেখেন।                      

পরিবর্তনের প্রত্যাশায় সেই ২০১১ সালের মার্চ মাসে যখন আরব বসন্তের হাওয়া ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে সিরিয়ায় এলো তখন সিরিয়ার জনগণ ভেবেছিল তাদের আন্দোলন সিরিয়াকে স্বৈরাচারী আসাদের কবল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে এবং বয়ে আনবে দেশটির জন্য কল্যাণ। কিন্তু তাদের সে স্বপ্নের সাথে নিয়ে এলো পারস্পরিক বিদ্বেষ, ঘৃণা, দেশীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। সিরিয়ার রাজনৈতিক ফায়দা‍লোটা গোষ্ঠী ও বিশ্ব মোড়লরা পরস্পর বিভক্ত হলো আর নেমে এলো লোমহর্ষক গৃহযুদ্ধ। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, ৪০ লক্ষাধিক মানুষ গৃহহারা রিফিউজি, শহরের পর শহর ধ্বংস হয়ে গেল দেশটির অথচ বিশ্ব বিবেক তেমন কিছুই করলনা! মানব সৃষ্ট এই এত বড় দুরাবস্থা থেকে নিরাপরাধ মানুষকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসল না।
উপরের ভিডিওটি ড্রোন দিয়ে তোলা একটি শহরের ছবি। এই শহরটি হলো সিরিয়ার হোমস! আজ এ শহরের নাম হয়ে গিয়েছে কঙ্কালের শহর। কঙ্কাল বলতে আমরা মৃত মানুষের শরীরের অংশ বিশেষ বুঝে থাকি। এখানে এটি ভিন্ন। শুনতে অবাক লাগলেও এটিই সত্যি। এখানে শুধু বিল্ডিংয়ের কঙ্কালেরা দাঁড়িয়ে আছে। শুধু কঙ্কাল আর কঙ্কাল। একটির পর আরেকটি। সারিবদ্ধভাবে। এই শহরে কোনো মানুষ নেই। শব্দ নেই। কেবল সুনসান নীরবতা। যেন এক প্রকাণ্ড শূন্যতা পুরো শহরের কোলাহলকে গিলে খেয়েছে। অথচ এই শহরেই এক সময় ছিল ঘন জনবসতি। বাজার ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল, মাঠ ছিল, হাসপাতাল ছিল। ছিল সিনেমা হলো, কোলাহলকারী যানবাহন। আধুনিক জীবনের সব সুযোগ-সুবিধা ছিল, আনন্দ ছিল, উল্লাস ছিল। ছিল মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, সামাজিকতা সর্বোপরি শান্তি।
একদিন কিছু দৈত্য এই শহরে এল। এখনকার সব মানুষের শান্তি কেড়ে নিল। মানুষদের হত্যা করতে লাগল। নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই বাদ গেল না মৃত্যুর হাত থেকে। যারা বাঁচল প্রাণ ভয়ে ছুটে পালালো। লণ্ডভণ্ড করে দিল গোটা শহরকে। সেই দিনটি ২০১১ সালের ১৫ মার্চ। শুরু হলো গোলাগুলি, বোমা হামলা, বিমান হামলার মতো ভয়ঙ্কর দৈত্যদের পদচারণা- এক লোমহর্ষক গৃহযুদ্ধ। যুদ্ধে দেশটির অনেক ঐতিহ্যবাহী শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো। সেসব শহরের একটি হোমস। আপনি যখন হোমসের ধুলোময় এবং অধিকাংশ পরিত্যক্ত শহরের মধ্য দিয়ে হাঁটবেন আপনার মনে হবে আপনি হয়তো ভীতিকর কোনো কঙ্কালের শহরের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন।
শহরের অধিকাংশ ভবনই শূন্যগর্ভ। যেন একেকটা কঙ্কাল মুখ হা করে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের কঙ্কালের মতোই এসব ভবনের জানালা নেই, দরজা নেই, বুলেট-বোমার হাত থেকে অক্ষত নেই। কতটা ঘৃণা, কতটা বিদ্বেষ এই ধ্বংস ডেকে আনতে পারে! হোমসের সর্বত্র যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন। সব ধরনের গুলির আঘাতই এখানকার ভবনগুলোকে সহ্য করতে হয়েছে। একে বুলেট থেকে ক্ষেপণাস্ত্র কোনো কিছুই বাদ যায়নি। মনে হয় সৃষ্টিকর্তার মায়াবর্জিত এই শহরের ওপর সব ধরনের অত্যাচারই চালানো হয়েছে। এই কঙ্কালের শহরে যে জিনিসটি শুধু অক্ষত আছে, তা হলো কবরস্থান। মনে হচ্ছে দোজখের কিনারায় কেবল মৃতরাই শান্তিতে থাকতে পারছে।
শহরে একটি সংকীর্ণ সড়কের কিনারায় একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে একটি স্নাইপার তাক করে রাখা হয়েছে। স্নাইপারের পাশেই একটি পরিত্যক্ত চেয়ার। এক জোড়া জুতা ও স্নাইপারে লক্ষ্য নির্ধারণ করার আয়না। সবকিছুই আছে, তবে যে লোকটির স্নাইপার তিনি নেই। হয়তো বিদ্রোহীদের হামলায় মারা গেছেন কিংবা কোথাও পালিয়ে গেছেন। সেই কক্ষের সামনে আপনি গেলে সহসা দরজা সংলগ্ন বারান্দার অন্ধকার অংশে একটি বাচ্চার মুখ ভেসে উঠতে পারে। তার পেছনে হয়তো একটি ছোট্ট মেয়ে। তোমরা কি এই স্নাইপারের মালিককে চেন? এক বছরের বেশি নয়, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল? সে কি এখনো বেঁচে আছে?
আপনার এমন প্রশ্নে হয়তো তারা বিস্মিত হবে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য বাচ্চাদের মতো তারা নয়, যারা বিদেশি কাউকে দেখলেই নানা প্রশ্ন করতে থাকে, জ্বালাতন করে। তাদের নিরবতা আপনাকে বিচলিত করে তুলবে- ভূত নয়তো এরকম হাজারো ‘শিশু ভূত’ এর সঙ্গে আপনার পরিচয় হতে পারে, যারা শুধু এই হোমস শহরেই নিহত হয়েছে- মায়ের সামনে, বাবার সামনে কিংবা ভাই-বোনদের সামনে। সেসব নিষ্পাপ মৃত শিশুদের আত্মা হয়তো আপনার ক্ষতি করবে না, কেবল একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবে- ‘কেন আমাদের হত্যা করা হলো? আমরা কি অন্যায় করেছিলাম’। এই বাচ্চাগুলো কখনো হাসে না, একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। তারা কেবল সেই ধ্বংসস্তূপের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে যেখানে একসময় তাদের বাড়ি ছিল।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ হোমস শহরকে মৃতবাড়িদের কঙ্কালে পরিণত করেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত বাহিনী যখন দেশব্যাপী সরকারিবিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করতে শুরু করল, হোমস তখন অন্যতম ‘যুদ্ধময়দানে’ পরিণত হয়। শহরটির দখল নিতে দুই বছরের বেশি সময় ধরে সরকারিবাহিনী ও বিরোধীদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। ২০১৪ সালের মে মাসে জাতিসংঘের উদ্যোগে এখানে একটি শান্তি চুক্তি কার্যকর হয়। তবে তা সত্ত্বেও ২০ শতাংশ লোকজনও এখানে আর ফিরে আসেনি। পালিয়ে যাওয়া অধিকাংশ লোকই শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এ বিষয়ে হোমসের গভর্নর তালাল-আল-বারাজি জানান, হোমসকে পুনর্গঠন করার এবং লোকজনকে ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তিনি বলেন, ‘আমরা সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। সন্ত্রাসীরা যদি তাদের অস্ত্র ফেলে দেয়, আমরা তাদেরকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবো।’ যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার নজির আছে। এর আগে লেবাননের বৈরুত, বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সারায়েভো ও জার্মানির ড্রেসডেন যুদ্ধক্ষত কাটিয়ে সুস্থ শহরে পরিণত হয়েছে। তবে রাজধানী দামেস্কের খুব কাছে হওয়ায় হোমস কবে আবার পুনর্জীবন পাবে- সেটাই এখন দেখার বিষয়।

(কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত মূল লেখক জাফর ইকবাল)

উড়ন্ত পাখি

About উড়ন্ত পাখি

আমি কোন লেখক বা সাংবাদিক নই। অর্ন্তজালে ঘুরে বেড়াই আর যখন যা ভাল লাগে তা সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।

Comments are closed.