শবে বরাত আছে, না নাই? পর্ব ১

ইংল্যান্ডে শবে বরাত নিয়ে হানাফী আলেম ওলামাদের মধ্যে তেমন কোন বিতর্কমূলক আলোচনা দেখিনি। তাছাড়া যেসব হানাফী আলেম উলামাদের সাথে ওঠা বসা করেছি তাদের সবাইকে ওই রাতে আল্লাহ-বিল্লাহ করতে দেখেছি এবং এই রাতের গুরুত্বের উপর ওয়াজ নসিহাত করতে দেখছি। গত দশক থেকে দু একজন আলেম এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করছেন। তাদের কথার সার নির্যাস যতটুকু বুঝি তা হল, শবে বরাতের তেমন কোন গুরুত্ব নেই। ইদানিং বেশ কিছু লেখা প্রিণ্ট মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। সকলের মত আমিও বিষয়টি নিয়ে দুটি কথা বলতে প্রয়াস পাচ্ছি। কারো ভাল লাগতে পারে, আবার কারো নাও লাগতে পারে -এই সম্ভাবনা জেনে বুঝেই লিখছি।

(যদিও সবার জানা কথা, তবুও বলে রাখতে দোষ নেই  যে ফার্সি ভাষায় ‘শব’ শব্দের অর্থ হয় রাত। আমরা পাক-ভারত-বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের আমল থেকে এই শব্দটি ফার্সি থেকে আমাদের ভাষায় গ্রহণ করেছি এবং ঐ রাতকে ‘শবে বরাত’ বলে আসছি। আরব জগতে এটাকে লাইলাতুল বারাআত (ليلة البراءة) এবং মধ্য শাবানের রাত (ليلة نصف شعبان/ليلة منتصف شعبان) বলে উল্লেখ করা হয়।)

যারা লাইলাতুল বারাহ  বা শবে বরাতের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চান না, তাদের প্রথম কথা হয় যে এই বিষয়ে বর্ণিত হাদিসে দুর্বলতা রয়েছে। লক্ষণীয়, হাদিস নেই নয়, বরং ‘দুর্বলতা’ই হচ্ছে তাদের “যুক্তির” স্থান। কিন্তু হাদিসে দুর্বলতা আছে -এমন কথায় এত সহজে কিল্লা ফতেহ হয়ে যায় না। কেননা, হাদিস শাস্ত্রে ‘দুর্বল’শব্দটি একটি পরিভাষা এবং এদিক থেকে এখানে শাব্দিক অর্থের দুর্বলতা মূল বিষয় হতে পারে না, পারিভাষিক স্থান না দেখা পর্যন্ত।

হাদিসের অঙ্গনে ‘দুর্বল’ শব্দটি ইসনাদ বা বর্ণনা-সূত্রে (narrative chain-এ)  প্রোথিত বিষয়। কোনো একটি বর্ণনা-সূত্রে বর্ণনাকারীর অবস্থান হাদিস বিশেষজ্ঞের মানদণ্ডে ‘দুর্বল’ অনুভূত হলে সেই ক্ষেত্রে তিনি এই পরিভাষা ব্যবহার করেন। কিন্তু মূল বিষয়টি যখন অন্যান্য বর্ণনাসূত্রের ধারা বিচরণ করে একই বিষয় বার বার বর্ণিত হয় তখন উল্লেখিত দুর্বলতা অনেকাংশে সবল হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া একটি বর্ণনা একজন হাদিসবেত্তার মূলনীতির আলোকে দুর্বল হতে পারে কিন্তু অন্য হাদিসবেত্তার মানদণ্ডে তা ততটুকু নাও হতে পারে। অপর দিকে, বর্ণনার আধিক্যে অন্য ধরনের মর্যাদাও লাভ করতে পারে। মাওলানা নূর মুহাম্মাদ আজমী (১৯৭৮) বলেন যে রাবীর জোফ বা দুর্বলতার কারণে কোন হাদিসকে জঈফ (দুর্বল) বলা হয়, অন্যথায় (নাওজুবিল্লাহ) রাছূলের কোন কথাই দুর্বল হয় না। দুর্বল হাদিছের জো’ফ (দুর্বলতা) কম ও বেশী হইতে পারে। খুব কম হইলে উহা হাসানের নিকটবর্তী থাকে। আর বেশী হতে হতে তা এক সময় একেবারে ‘মাওজুতে’ (দুর্বলতায়) পরিণত হতে পারে। প্রথম পর্যায়ের জঈফ হাদিছ আমলের ফযীলত বা আইনের উপকারিতার বর্ণনায় ব্যবহার করা যাইতে পারে, আইন প্রণয়নে নয়। [১]

সংক্ষেপে, রেওয়াতের সূত্রের রাওয়ী (راو) যদি ‘দাবত/ضبط ’ (দৃঢ় স্মতি শক্তির) গুণ সম্পন্ন হন অর্থাৎ যদি তার স্মৃতিশক্তি এমন হয় যে তিনি শ্রুত বা লিখিত বিষয় স্মৃতিতে সুচারুরূপে ধারণ করতে সক্ষম হন, তাহলে এই বর্ণনাকারীকে ‘দাবেত’ বলা হয়, (এই শব্দদ্বয়কে ফারসির উচ্চারণি কায়দায় বাংলায় যথাক্রমে জবত ও জাবেত বলা হয়) এবং বর্ণনাকারীর গুণ দাবতের কম হলে হাদিসকে ‘হাসান’ বলা হয় [প্রাগুক্ত ১, এবং ২]।  কিন্তু, বর্ণনাকারীর গুণ হাসানের নিচে হলে, বর্ণিত হাদিসে দুর্বল পরিভাষাটি আসে। ‘দুর্বল’ পরিভাষা প্রয়োগের আরও কারণাদি রয়েছে। ইমাম হাফিজ ইবন হাজর আল-আসক্বালানীর (৭৭৩-৮৫২ হি.) দৃষ্টিতে একটি হাদিসের ইসনাদের সূত্রের ধারাবাহিকতায় বিচ্ছেদ ঘটলে বা কোন রাওয়ীর ব্যাপারে সমালোচনা থাকলে শাস্ত্রীয় আলোচনায় ‘দুর্বলতার’ কথা আনা হয়।

ঘটনা এমনও হতে পারে যে একটি সূত্রে (narrative chain-এ) একজন বর্ণনাকারীর (রাওয়ীর) সামান্য স্মৃতি বিস্মৃতি লক্ষ্য করা গেছে, কিন্তু বর্ণনার সমষ্টিগত বিচারে বর্ণিত বিষয় (মতন) হাদিসবিশেষজ্ঞের কাছে ঠিকই আছে। তাই হাদিস বিশেষজ্ঞ ঐ বর্ণনার অর্থগত বিষয় বর্জন করেন না। এমন হাদিস নেক আমল বা আখলাক গঠন সম্পর্কিত হলে তার সঠিক ব্যবহার করেন। অধিকন্তু, এমন হাদিসের প্রচার ও প্রশিক্ষণে আগ্রহীও থাকেন।

মাওলানা ফাজলুর রহমান আজমী (২০০০:৪-৫) শবে বরাত সম্পর্কিত হাদিসের ব্যাপারে বলেন, “The narrations are quite numerous and the weakness in many is not severe. The virtue of this night will be considered authentic due to the sheer number of these narrations. This is the general consensus of the scholars in the field. অর্থাৎ শবে বরাত সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে। তবে অনেক হাদিসের দুর্বলতা তীব্র নয়। তাই এমন হাদিসের ব্যাপক বর্ণনার প্রেক্ষিতে শবে বরাতকে প্রামাণিক বিবেচনা করা হবে। এটাই হচ্ছে হাদিস বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সাধারণ ঐক্যমত।” [৩]

 

রেওয়ায়েত বা বর্ণনা সম্পর্কিত কিছু কথা

রেওয়ায়েত বা বর্ণনা বিদ্যা (narration) হচ্ছে জ্ঞান বাহনের একটি মাধ্যম। কোনো বর্ণনা কোনো বিশেষ বিদ্যার প্রেক্ষিতগত বা অঙ্গন ঘিরে বর্ণিত হয়ে বিশেষজ্ঞ আকার ধারণ করুক অথবা সাধারণ আকারেই থেকে থাকুক, এই উভয় ক্ষেত্রেই বর্ণনা (narrative) এক জ্ঞানতাত্ত্বিক-শ্রেণী বা পদ্ধতি (epistemological category) হিসেবে কাজ করে যায়। আবার, বর্ণনা হচ্ছে এক ধরণের নির্বস্তুক মাধ্যম যার প্রেক্ষিতে আমরা বিশ্ব জগতের ধারণা লাভ করে থাকি। বর্ণনার একেক অঙ্গন বা শ্রেণী একেক ধরণের জ্ঞান উপস্থাপন করে।

আবার মনে রাখতে হবে, এই বর্ণনা (narrative) মূলত সকল বিদ্যার পরিসর আবেষ্টন করে আছে -তা ধর্ম হোক, বিজ্ঞান হোক, সাহিত্যে হোক অথবা অন্য কোনো অঙ্গন। অণুতে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন কীভাবে অবস্থান করে অথবা কোয়ার্ক (quark) কীভাবে অস্তিত্বশীল হয়ে আছে –তা পদার্থ বিজ্ঞানের বিষয় হলেও ‘বর্ণনার’ মাধ্যমেই আমরা সেই জাগতিক জ্ঞানে প্রবেশ করি। উল্লেখিত পদার্থগুলো চোখে দেখার মত কিছু নয় এবং এগুলো নিজেরাই টেলিপ্যাথির মতো কোনো পদ্ধতিতে আমাদেরকে তাদের ব্যাপারে অবগত করাতে পারে না। এসব বিষয়ে আমাদের জ্ঞান হচ্ছে যান্ত্রিক অবলোকনের মাধ্যমে, যন্ত্রে উদ্ভাসিত তথ্যের ভাষিক ব্যাখ্যা-বর্ণনায় প্রাপ্ত। তবে বিজ্ঞান ‘যেভাবে’ জগতকে যান্ত্রিক উপায়ে বুঝার চেষ্টা করে ‘সেই বর্ণনা’ (that narrative) ‘সেই সমঝের’ প্রেক্ষিত বহন করে। এভাবে প্রত্যেক বর্ণনা শ্রেণী (narrative category) একেক ধরণের জ্ঞান বহন করে। প্রত্যেক অঙ্গনে বর্ণনার ‘ভাষিক প্রকৃতি’ তার আপন শব্দ, বাক্য ও বর্ণনা ভঙ্গিতে ভিন্ন চেহারা প্রদর্শন করতে পারে, আর তার ব্যাখ্যার পারিভাষিক রূপ ভিন্ন হতে পারে। শবে বরাতের রেওয়াতে (বর্ণনায়) ধর্মীয় মহাত্ব, পাপ-মোচন ও পরিত্রাণের সেই সব কথা রয়েছে যা ধর্মীয় জ্ঞান-শ্রেণীর সাথে সংগতিশীল। আমাদের ধর্মে কোরান হচ্ছে এক ধরণের বর্ণনা এবং হাদিসও হচ্ছে আরেক ধরণের বর্ণনা। এই উভয় উৎস থেকে আমরা বিশ্ব জগতের ধারণা লাভ করি। এখানে বৈজ্ঞানিক অবলোকনের মতো কোনো যন্ত্র নেই। এই জ্ঞান-শ্রেণী ও এর বাহণ ভিন্ন। এখানে জ্ঞান অহীর মাধ্যমে আসে এবং এই তথ্যসূত্রেই আমরা গাইবিয়্যাত সম্পর্কে অবগত হই। এখানে অত্যাধিকভাবে “যুক্তি বিদ্যা” টেনে আনলে এই গোটা অঙ্গনে নানান সমস্যার সৃষ্টি করা যাবে। কেননা গাইবিয়্যাতের জ্ঞান,  অদৃশ্য জগতের জ্ঞান একান্ত যুক্তিসর্বস্ব জ্ঞানাঙ্গন নয়। এই অহীতে লব্ধ জ্ঞানের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহ, ফেরেস্তা, বেহেস্ত দোজখ, পরকাল, সৃষ্টি তত্ত্ব, পাপ, পুণ্য, শাস্তি পুরষ্কার ইত্যাদি।

শবে বরাত সংক্রান্ত বর্ণনাগুলোতে আমরা যে ধারণা পাই তা ওহীলদ্ধ অপরাপর পরিত্রাণ, ক্ষমা ও রহমত সংক্রান্ত মৌলিক ধারণার সাথে সঙ্গতি রাখে। কোনো বর্ণনা সূত্রের বর্ণনাকারীর কিছু দুর্বলতা দৃষ্ট হলেও গোটা তাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে সেটি তেমন কোনো বিরোধ আনতে দেখি না। আমরা শবে বরাতের বর্ণনাতে পরিত্রাণ (নাজাহ) সম্পর্কিত বর্ণনা পাই, আল্লাহর করুণা ও মহত্তের বর্ণনা পাই -এগুলো ‘বিশ্বাসের’ ব্যাপার (যুক্তিবাদ বা যান্ত্রিক অবলোকনের ব্যাপার নয়)। এই ধারণা সামনে রেখে সূত্রস্থ (within the narrative chain) কোনো এক বর্ণনাকারীতে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে তা মূল বিষয়বস্তুতে বিঘ্নতা সৃষ্টি করে না। কেননা ঐ বিষয়গুলোর সংযোগ ও সম্পর্ক অন্যান্য সূত্রে সুগভীরভাবে প্রোথিত। শবে বরাতে অর্থাৎ ঐ রাতে আল্লাহ ধরার আসমানে অবতরণ করাতে কোনো সমস্যা দেখি না, আল্লাহ মানুষকে ব্যাপকভাবে মার্জনা করতে কোনো সমস্যা দেখি না, মানুষকে পূণ্যদানে ধন্য করতেও সমস্যা দেখি না। অনেক কথাতে রূপকতার ব্যবহার দেখি, যেগুলো যুক্তি ও আক্ষরিক অর্থে আলোচনার বিষয় নয়। আল্লাহ তো সব রাতের শেষার্ধেই ধরার আকাশে অবস্থান করেন, এমন কথা ‘সহীহ’ হাদিসে প্রমাণিত, এমন বর্ণনা রূপক।

আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে আল্লাহ প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়ার্ধে জগতের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন কেউ কি আছ আমার কাছে প্রার্থনা করবে, আমি তোমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করব। কেউ কি আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাদের দান করব। কেউ কি আছ ক্ষমা প্রার্থী, আমি ক্ষমা দান করব। (বোখারী)

হাদিসে মধ্য শাবানের রাত ইবাদতের মাধ্যমে যাপন করাতে অনেক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ যদি ছোট কাজের বিনিময়ে বড় নেয়ামত দেন, তবে এতে কারো যুক্তি তোলার কি আছে? আল্লাহর ভাণ্ডার থেকে আল্লাহ দান করবেন, এতে সমস্যার কিছু নেই। সব চেয়ে বড় কথা হল ঐ রাতে ইবাদত বন্দেগী করাতে তাওহীদী বিশ্বাসে কোন ব্যত্যয় নেই। সুতরাং ভাল কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করাতে কোন লাভ নেই। কোরান ও হাদিসের অনেক বিষয়াদি আক্ষরিক (literal) অর্থে নিহিত নয়। আমাদের মৌলিক সূত্রের (কোরান/হাদিসের) ভাষা ও বাক্যকে ‘বিমূর্ত’ আকারে নেয়া উচিৎ নয়, এটা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ভয়ানক। আমরা কোরান ও হাদিসের ইবাদত করি না; বরং এক নিরাকার আল্লাহর ইবাদত করি। শবে বরাতের ক্ষেত্রে আমরা যা আলোচনা করি তা হচ্ছে বিশ্বাসের জগতের বিষয়; মনের জগতের বিষয় -যা ঈমানে ধারিত হয়। তাওহীদ ও শিরক মনের জগতে অবস্থান করে। সুতরাং কোরান ও হাদিসের ভাষা ও বাক্যিক ঝোঁক যেন তাওহীদকে অতিক্রম করে আক্ষরিক প্রবণতাসুলভ গোপন শিরকের দিকে ধাবিত না হয় –আমরা যেন সে দিকেও খেয়াল রাখি।

যারা শবে বরাতের ইবাদতি কার্যক্রমে, এদিকে-সেদিকে, শিরকের প্রশ্ন উত্থাপন করেন, তাদেরকে মনে রাখতে হবে যে যে ব্যক্তির বিশ্বাসে শিরক জড়িয়ে আছে সে তা শবে ক্বদরেও প্রকাশ করতে পারে। কবর জিয়ারতের প্রথায় যাদের মধ্যে ভুলভ্রান্তি রয়েছে তারা তো সবদিনই সেই কাজ করে থাকে। এর সাথে শবে বরাতকে জড়িয়ে কী লাভ? আবার যে ব্যক্তির আচরণে শিরক নেই, তার জন্য মধ্য-শাবানে কবর জিয়ারত করা নিষেধ হবে কোন দুঃখে? কোরান হাদিস কী মধ্য শাবানে ইবাদত করা অথবা কবর জিয়ারত করা ‘হারাম’ঘোষণা করেছে? ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে ক্ষমা, মার্জনা ও তাওবা, ইস্তেগফারের যেসব অবলম্বন তৈরি করে দিয়েছেন, ধর্মের নামে সেই সেব সুযোগের পথ কমিয়ে আনাতে ধর্ম লাভবান হয়, কী হয় না –তা বিবেচচনায় থাকা দরকার।

মাওলানা ফাজলুর রহমান আজমী (২০০০:১৩) শবে বরাতের ব্যাপারে আল্লামা তাক্বী উদ্দীন ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহর (র.) একটি মত উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে দুর্বল বর্ণনাদি অগ্রাহ্য করার প্রবণতায় যে আলেম সব চেয়ে সুপরিচিত, সেই ইবন তাইমিয়্যাহ (র.) বলেন, “এত অধিক সংখ্যক হাদিস মধ্য শাবানের রাতের মহাত্ব নিয়ে বর্ণিত হয়েছে যে এগুলো ঐ রাতের গুরুত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য করে।” [৪]  এর পর আর কোনো কথা বলার অবকাশ রাখে বলে মনে হয় না।

তবে আমাদের সকলেরই দায়িত্ব এই হওয়া উচিৎ যে যারা ঐ রাতে এখানে-সেখানে আলো জ্বালায়, আতশবাজি করে, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে প্রার্থনা করে, কবরে জিয়ারতে গিয়ে আলো জ্বালায়, মৃতদের জন্য দোয়ার পরিবর্তে ওদের কাছে প্রার্থনা করে, উরোশবাজি করে –এগুলো বন্ধ করতে তৎপর হওয়া। ঐ রাতে নফল নামাজ, কোরান তেলায়াত, জিকির-আযকার, তসবীহ তাহলীল ব্যতীত যেন অন্য কোন ধরণের আগড়া-বাগড়া না করা হয়।

 

কয়েকটি হাদিস

১। মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিলোকের দিকে দৃষ্টি দান করেন এবং সবাইকে মাফ করে দেন কেবল মুশরিক ব্যক্তি ছাড়া ও যার মধ্যে ঘৃণা বিদ্বেষ রয়েছে তাকে ছাড়া।  বর্ণনায়, মুয়ায বিন্ জাবাল। ((আল-মুনযিরী তাঁর আত-তারগীব ওয়াত-তারহীবে (২/১৩২)বলেন, “সহিস হাদিস”। আল-আলবানীর দৃষ্টিতেও হাদিসটি সহিহ। আস-সিলসিলাহ আস-সাহীহাহ (৩/১৩৫))

২। আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে (দুনিয়ার আসমানে) আসেন এবং সকলকে মাফ করে দেন কেবল সেই ব্যক্তি ছাড়া যার হৃদয়ে ঘৃণা বিদ্বেষ রয়েছে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরিক সাব্যস্ত করে (অর্থাৎ মুশরিক)। বর্ণনায়, আবু বাকর (রা.)। ((ইবন হাজর আল-আসক্বালানী তাঁর  আল-আমাল আল-মুথলাক্বাহ  গ্রন্থে (ক্রম, ১২২) বলেন, “হাদিসটি হাসান যদিও কাসেম তাঁর চাচার সূত্র থেকে বর্ণনা করেছেন।”))

৩। আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে দুনিয়ার আকাশে নামেন এবং কালব গোত্রের ভেড়িগুলোর লোমের সংখ্যার পরিমাণের চেয়ে বেশি লোকজনকে মাফ করে দেন। বর্ণনায়, আয়েশা বিনত আবি বাকর (রা.)।  ((আল-আলবানী বলেন,“হাদিসটি অন্য সূত্রে সহীহ।”তাখরীজ মিশকাত আল মাসাবীহ, (ক্রম, ১২৫১), প্রণয়নে আল-আলবানী ।))

৪। এক রাতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নামাজ পড়তে দাঁড়ালেন। তাঁর সেজদা এতই দীর্ঘ হল যে আমার মনে হল তিনি নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছেন। অবস্থা এমন মনে হওয়ার আমি উঠলাম কিন্তু (পরক্ষণে) তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলির সঞ্চালন অনুভব করলাম এবং তাঁর নড়াচড়াও পেলাম। তাই আমি শুয়ে পড়লাম।তারপর তিনি যখন সেজদা থেকে মাথা তুললেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন বললেন, “আয়েশা,  তুমি কি মনে করেছিলে আমি অন্য কোথাও চলে গেছি?” আমি বললাম, “তা নয়, হে আল্লাহর রাসূল। তবে আপনার সেজদার দীর্ঘতার কারণে মনে হয়েছিল আপনার প্রাণ-বায়ু বেরিয়ে গেল কিনা।” তিনি বললেন, “তুমি কি জান আজ কোন রাত?” আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। তিনি বললেন, “আজ মধ্য শাবানের রাত। মহান আল্লাহ এই মধ্য শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং যারা তাঁর মার্জনা চায় তাদেরকে মার্জনা করেন, আর যারা তাঁর রহমত প্রত্যাশা করে তিনি তা তাদেরকে দান করেন। তবে হিংসা বিদ্বেষীরা যেভাবে আছে তাদেরকে সেভাবেই রেখে দেন।” বর্ণনায়, আয়েশা বিনত আবি বাকর (রা.)। ((বাইহাক্বী বলেন, “হাদিসটি উত্তম মুরসাল।” [মুরসাল হচ্ছে এমন হাদিস যার সনদে/সূত্রে শেষের দিকে কেউ বাদ পড়েছেন।] বাইহাক্বী প্রণীত, শুয়াবুল ঈমান, ৩/১৪০/৫ ))

৫। যখন মধ্য শাবানের রাত্র আসবে তখন তোমরা রাতের বেলায় ইবাদত কর এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ। কেননা আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আসমানে আসেন এবং বলেন কেউ কি ক্ষমা প্রার্থী আছ, আমি তাকে ক্ষমা করব। কেউ কি রিজিক প্রার্থী আছ, আমি তাকে রিজিক দেব। কেউ কি বিপদে আপদে আছ, আমি তার পরিত্রাণ করব। এভাবে আল্লাহ আহবান করতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত না ফজরের সময় হয়। বর্ণনায়, আলী (রা.)।  ((আশ-শাওকানী বলেন, “হাদিসটির সূত্র দুর্বল।” তুহফাতুজ জাকিরীন, (ক্রম ২৪১) প্রণয়নে আশ-শাওক্বানী))

৬। আল্লাহ তা’আলা মধ্য শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তিনি বিশ্বাসীদেরকে মাফ করেন ও অবিশ্বাসীদের ক্ষমা স্থগিত করেন এবং হিংসা-বিদ্বেষীদেরকে তাদের নিজ অবস্থায় রেখে দেন (সেদিনের জন্য যখন তারা সংশোধিত হয়ে তাঁকে ডাকবে)। বর্ণনায়, আবু সা’বাহ আল খাশানী (রা.)। (আল-মুনযিরী বলেন, ‘হাদিসটির সূত্র সহীহ বা হাসান বা এই দু’য়ের কাছাকাছি।  আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব, ৩/৩৯২)

[নোট: হাদিসগুলো আমার অনুবাদ, তাই কোন ত্রুটি থেকে থাকলে সেটা আমার। আরবী সূত্র রেফারেন্সের ৫ম নম্বর।] [৫]

 শবে বরাত আছে, না নাই ২য় পর্ব এখানে

 

রেফারেন্সেসঃ

__________________________________

[১] আ’জমী, নুর মোহাম্মদ, (১৯৭৮), মেশকাত শরীফ, ১ম খণ্ড, (বাংলা), ঢাকাঃ এমদাদিয়া লাইব্রেরী। [ভূমিকা, পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রদর্শিত নয়]

[২] আব্দুল-হালিম, তারিক, (২০১০), টারমিনোলজি অফ হাদিস এণ্ড মেথডলজি অফ মুহাদ্দিসীন, [ইংরেজি], টরোন্টো: দার আল-আরক্বাম পাবলিকেশন [অনলাইন] প্রাপ্তিস্থান, http://www.islamicstudent.net/eBooks/hadith/Hadeeth_Terminology.pdf

[৩] আযমী, ফজলুর রহমান, (২০০০) শবে বরাত [ইংরেজি], দিল্লি: ইদারা ইশাআতে দ্বীনিয়াত (পি) লিমিটেড।

[৪] প্রাগুক্ত, পৃ ১৩, ইবন তাইমিইয়্যার ফাওজুল ক্বাদীর, ২য় খণ্ড, পৃ,৩১৭ থেকে উদ্ধৃত

[৫] উইকিপিডিয়া, লাইলাতু মিনতাসিফি শাবান [আরবী], অনলাইন। প্রাপ্তিস্থান: http://ar.wikipedia.org/wiki/%D9%84%D9%8A%D9%84%D8%A9_%D9%85%D9%86%D8%AA%D8%B5%D9%81_%D8%B4%D8%B9%D8%A8%D8%A7%D9%86 [Accessed on 18/06/2012]

Loading

About এম_আহমদ

প্রাবন্ধিক, গবেষক (সমাজ বিজ্ঞান), ভাষাতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন ও ইতিহাসের পাঠক।

Comments

শবে বরাত আছে, না নাই? পর্ব ১ — 8 Comments

  1. কর্মসূত্রে আমি ও আরববিশ্বে বাস করি।এ কথাটা বলার কারণ-আমাদের দেশে ইদানিং কোন ইসলামী উপলক্ষের বিরূধীতা করতে প্রথম যা বলা হয়,তা হলো এটা আরব বিশ্বে নেই,যেন কোরান-হাদীস নয় আরব বিশ্বই তাদের জন্যঅণুকরণীয়।তাদের উদ্দেশ্যে বলি-আরব বিশ্ব এখন প্রকৃত ইসলামের ঝান্ডাধারী নয়,আমেরিকান দালালীর ঝান্ডাধারী।মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশে আমি বসবাস করি,এখানে আমার আশেপাশে এমন আরবী খুজে পাওয়া দুস্কর যে মদ্যপায়ী নয়,কিছুদিন আগে ও এক বাঙ্গালী নারী পরিচারিকা আরবীর ঘর ছেড়ে পালিয়েছে মালিকের যৌন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে।
    এরা শবে ক্বদর ও ঠিকমত পালন করেনা,জুমার দু’রাকাত ফরজ পড়ে আপনার কাধঁএর উপর দিয়ে চলে যায়।
    তবে বয়স্করা অনেকে পালন করে,শবে বরাতের দিন বয়স্ক মহিলারা বাচ্চাদের মধ্যে মিষ্টান্ন,দিরহাম বিতরণ করে।

  2. ভাই খামতাশ সাবান নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন। তবে এই রাতকে আমরা উপমহাদেশীয়রা যে ভাবে পালন করে আসছেন সেই ভাবে আরব দুনিয়ার একমাত্র দেশ মিশর ছাড়া আর কোন দেশে তা পালন করেন বলে আমি দেখিনাই।
    আর বিশ্বে এই রাত লায়লাতুল মেরাজও নিঃশব্দে চলে যেতে আমি প্রত্যক্ষ্য দর্শী।
    আমার প্রশ্ন আরবরা কি নিজ ভাষায় লেখা কিতাব গুলো পড়েনা? বা তারা রাসুল সাঃ এত বড় নির্দেশ তা মান্য করে না?
    ২য় যে প্রশ্ন আমার মনে হানা দেয়, উপরের বর্ণিত সব হাদিসের বর্ণনা দ্বারা কি আমরা নিকার আল্লাহর শানকে দলিত করছিনা।
    আপনি যদি নিরাকার আল্লাহকে মানেন তাহলে এই কথা অবশ্য মানতে হবে আল্লাহ তার সৃষ্ট মানুষের মত কার্য সম্পাদন করতে পারেন না। মানে- আমরা যদি বিশ্বাস করি যে এই বিশ্বে সৃষ্টি থেকে যা ঘটেছে এবং অনাদি অন্তকালে যা ঘটিবে তা মানব স্বভাবের মত আল্লাহর আদেশ নিষেধের দ্বারা ঘটছে না। তা শুধু আল্লাহর ইচ্ছা শক্তির ধারা ঘটছে।

    আল্লাহ নেমে আসা বাক্যকে মেনে নিলে বা আল্লাহ শুধু আকাশে অবস্থান করেন বলে বিশ্বাসে পৌত্তলকিতার গন্ধ পাওয়া যায় না?

    তবে হ্যা বিশেষ রাতে বা দিনে বিশেষ ভাবে প্রাথর্না জারি রাখতে আমি কোন অন্যায় দেখিনা। ধন্যবাদ।

    • ভাই, পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। তবে সব প্রশ্নের tenor বুঝতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে না। তাছাড়া প্রশ্নের জন্য প্রশ্ন, না উত্তরের জন্য, তাও বুঝছি না। মধ্য শাবান নিয়ে অনেকের অনেক ধারণা আছে। অসংখ্য লেখার জগতে আমার এই ক্ষুদ্র লেখা। আমি শুধু আমার কথাই বলতে চেয়েছি। সব দেশের আমলের পার্থক্য এবং কারণ ব্যাখ্যা দুরূহ ও সময় সাপেক্ষ। তবে একটি প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে দিতে পারব। আর তা হল ঐ হাদিসগুলো নিঃসন্দেহে নিরাকার আল্লাহর শানকে অমর্যাদা করছে না। রূপক ব্যবহার কোরানে ভরপুর, হাদিসে ভরপুর। এমন কোন ধর্ম নেই যেখানে এইরূপ ভাষার ব্যবহার নেই। ২য় পর্ব পড়ে দেখতে পারেন কোন পার্থক্য আসে কী না। তারপরে সময় করতে পারলে হয়ত কিছু বলতে পারি।

  3. আমরা কোরান ও হাদিসের ইবাদত করি না; বরং এক নিরাকার আল্লাহর ইবাদত করি। শবে বরাতের ক্ষেত্রে আমরা যা আলোচনা করি তা হচ্ছে বিশ্বাসের জগতের বিষয়; মনের জগতের বিষয় -যা ঈমানে ধারিত হয়। তাওহীদ ও শিরক মনের জগতে অবস্থান করে। সুতরাং কোরান ও হাদিসের ভাষা ও বাক্যিক ঝোঁক যেন তাওহীদকে অতিক্রম করে আক্ষরিক প্রবণতাসুলভ গোপন শিরকের দিকে ধাবিত না হয় –আমরা যেন সে দিকেও খেয়াল করি “

    সহমত!

  4. শবেবরাত পালনে মুসলিম সমাজে ইদানিং যে বিতর্ক চলছে তার অবসানে আপনার এ লিখাটির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। তবে শবেবরাত পালনে কাউকে আতশবাজী করতে দেখলে কেন জানি আমার কাছে হিন্দু সম্প্রদায়ের দেওয়ালী পুজার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *