শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব

আজ রুপার জন্মদিন। এবার দিনটাকে একটু ভিন্ন ভাবে ইনজয় করার প্লান করেছে। প্রথমে ভার্সিটিতে যাবে। দুপুর পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ইনজয় করবে। আর আজকের বিকেলটা শুধু শুভর জন্য। শুভর সাথে সারা শহর ঘুরে বেড়াবে। ভাবতেই কেমন যেন ভাল লাগার শিহরন বয়ে যাচ্ছে রুপার রক্তের প্রতিটি কনিকায়।

আয়নায় অণিদ্য সুন্দরী রুপাকে দেখা যাচ্ছে, সাজতে গিয়ে নড়াচড়ার কারনে মাঝে মাঝে আয়নার বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। আবার ধরা দিচ্ছে। আয়নাও যেন আজ রুপাকে ওর বুক থেকে ছাড়তে চাচ্ছে না। রুপা আজ খুব সুন্দর করে সেজেছে। লাল শাড়ী, কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ, লাল টিপিস্টিকে রাঙ্গা ঠোট, চোখে কাজল, মুখে হালকা মেকাপ। রুপা এমনেই খুব সুন্দরী তার উপর এই বিশেষ দিনের বিশেষ সাজ। অপূর্ব লাগছে রুপাকে। শুভ নিশ্চয়ই আজ ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকবে। রোমান্টিক কবিতা শুনিয়ে রুপার রুপের বর্ননা করবে। ও খুব ভাল কবিতা আবৃত্তি করে। বলতে গেলে ওর আবৃত্তি শুনেই রুপা প্রেমে পরেছে। শুভর কথা উদস মনে ভাবছে আর চুল ব্রাশ করছে। মোবাইল ফোনের রিংটোনের শব্দে ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে  রুপা।
“কিরে তোরা সবাই চলে আইছস?” ফোন রিসিভ করে রুপা বলল।
“হ। তুই কই। তাড়াতাড়ি আয়। আমরা কেক লইয়া বইসা আছি” মোবাইলে রাজুর কন্ঠ।
“আমি একক্ষুনি বের হচ্ছি।” বলে পাশ থেকে ব্যাগ হাতে নিয়ে দ্রুত পায়ে বের হয়ে যায়।

গেট থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে রুপা। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে। আজকের আকাশটা খুব সুন্দর। মাঝে মাঝে হালকা মেঘ উড়ছে। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার মত মেঘ না। মেঘের কোল থেকে রোদ উঁকি দিচ্ছে। হালকা বাতাস বইছে। অতি প্রশান্তিময় একটা পরিবেশ। হঠাৎ বিজলী চমকালো। যেন সুন্দর প্রকৃতি স্মৃতির ফ্রেমে বেধেঁ রাখার জন্য আপরুপা রুপার ছবি তুলে নিল।

রুপা রিক্সায় যাচ্ছে। একটি মটর সাইকেল পিছু নিয়েছে রিক্সাটির। মটর সাইকেল আরহী ওর পরিচিত। ছেলেটি ওদের এলাকায় থাকে। বড়লোকের বাউন্ডেলে ছেলে। লেখাপড়া নেই, কোন কাজও করে না, সারাদিন রুপাদের বাসার সামনে তিন রাস্তার মোড়ে বসে থাকে। মেয়েদের দেখলেই আজে বাজে কথা বলে, সিস দেয়, বেসুরে কন্ঠে গান গায়। অসহ্য একটি ছেলে, নাম রকি। অনেক দিন হল ওর পিছু নিয়েছে। সুযোগ পেলেই বিরক্ত করে। ছেলেটি এখন রিক্সার পাশ দিয়ে মটর সাইকেল চালাচ্ছে আর অদ্ভুত চোখে রুপার দিকে তাকিয়ে গান গাচ্ছে। চোখে বাজে ইশারা করছে। রুপা প্রচন্ড অস্বস্থি ফিল করছে। এত সুন্দর একটি মুডে বাসা থেকে বের হয়ে এখন খুব অসহ্য লাগছে। রাস্তার অনেকেই রুপার সাথে রকির অশালীন ব্যবহার দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছে। কোন উপায় না দেখে রুপা নিচের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। রিক্সাওয়ালা রকির আচরণ লক্ষ করে জোরে প্যাডেল মেরে চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠে সমনে তাকাল রুপা। রিক্সা হার্ড ব্রেক করেছে। অল্পের জন্য রিক্সা থেকে ছিটকে পরেনি রুপা। সামনে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।

হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগের সামনে ছোট্ট একটি টুলের উপর বসে আছে রুপা। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। মোবাইল স্ক্রীনে শুভর নম্বর ভাসছে। সেদিকে কোন খেয়াল নেই। অনেক গুলো কল মিস কলে পরিনত হয়েছে। কান্নাভেজা চোখে রকির ব্যাকুল বাবা, মা ইমাজেন্সির সামনে ছোটাছুটি করছে। কিছুক্ষন হল তারা এসেছেন। ভিতরে মোটর সাইকেল এক্সিডেন্ট করা রকির চিকিৎসা চলছে।
“চিন্তার কোন কারন নেই আপনাদের পেসেন্ট এখন ভাল আছে “ঘড়ি যব রং ড়ঁঃ ড়ভ ফধহমবৎ”। কিছুক্ষনের মধ্যে বেডে পাঠিয়ে দিব।” ডাঃ মাসুদ রকির বাবা হাজী করিম সাহেবর দিকে এগিয়ে  বললেন।
“আংকেল আমি তাহলে এখন যাই। পরে আবার আসব।” রকির বাবাকে রুপা বলল।
“আইজকা তুমি না থাকলে কিযে হইত মা। তুমি আমাগো পোলারে হাছপাতালে আনলা। ফোন দিয়া আমগো খবর দিলা। এতক্ষণ বইছা থাকলা। দোয়া করি আল্লায় তোমার ভালা করুক মা।” হাজী সাহেব রুপার মাথায় হাত দিয়ে কৃতজ্ঞ কন্ঠে কথাগুলো বললেন।

রাত বারটা পয়ত্রিশ মিনিট। রুপা শুভর কাছে ফোন করেছে, রিং হচ্ছে। অনেক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করছিল। পাচ্ছিল না। মোবাইল বন্ধ ছিল।
“তুমি আমাকে ফোন দিয়েছো কেন? ” কঠোর কন্ঠে অপর প্রান্ত হতে শুভ বলল।
“দেখ আমি আসলে তোমার সাথে দেখো করার জন্যই বের হয়েছিলাম। হঠাৎ একটা এক্সিডেন্টের কারনে আর যেতে পারিনি। তোমাকে ফোনে বলব সেরকম পরিস্থিতি তখন ছিল না। যখন ট্রাই করলাম তখন দেখি তোমার মোবাইল বন্ধ।” এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলল রুপা।
“এসব তোমার কথার কথা। তুমি হয়ত অন্য কারও সাথে বের হয়েছিলে। আমাকে এভোয়েড করার জন্য ফোন ধরনি।” শুভ বলল।
“ছিঃ তুমি আমাকে এরকম ভাব!” রুপা রেগে বলল ।
“হ্যাঁ ভাবি। তোমাকে আমার আর দরকার নেই। তুমি তোমার নতুন প্রেমিককে নিয়ে থাক। আমিও নতুন একজন খুঁজে নিব।” শুভ বলল।
“ছিঃ তোমার মানুষিকতা এত নিচু? তুমি আমাকে এ রকম বিশ্বাস কর? ঠিক আছে তোমার সাথে আমি আর কোন দিন যোগাযোগ করব না।” কান্নাভেজা কন্ঠে কথাগুলো বলে লাইন কেটে দিল রুপা। রুপার চোখ এখন বাঁধ ভাঙ্গা নদী। একজন ভূল মানুষকে ভালবাসার কষ্টে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে হৃদয়।

দুই দিন পর। হাসপাতালের বেডের পাশে বসে আছে রুপা। মুখে কোন কথা নেই। পিন পতন নিরবতা। মনে মনে ভাবছে যে মানুষটি ওকে এত বিরক্ত করত তার এক্সিডেন্টে ওই কিনা সেই শত্র“কে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। এখন আবার তাকে দেখতে এসেছে! মানুষের মন আসলে বড়ই রহস্যময়। রকির এক্সিডেন্টের পর রুপা ইচ্ছা করেও ওকে রাস্তায় ফেলে চলে যেতে পারেনি। একজন মানুষ এভাবে চোখের সামনে মারা যাবে আর ও স্বার্থপরের মত চলে গিয়ে বন্ধু বান্ধবের সাথে জন্মদিন পালন করবে সেটা কিভাবে হয়? হোক না সে ওর চিরশত্র“। এদিকে শুভর ভূল ভাঙ্গাবার জন্য কয়েক প্রহর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি।

রকি লজ্জায় রুপার দিকে তাকাতে পারছে না। এতদিন যাকে দেখলে বেসুর কন্ঠে গান গেয়ে উঠত, সিস বাজাত, র্নিলজ্জের মত চোখ মারত, কত আজে বাজে কথা বলত। অথচ আজ তার দিকে লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। স্মৃতির পাতা উল্টে বেরিয়ে আসছে রুপার সাথে ওর ব্যাবহারের কিছু খন্ডচিত্র। নিজেকে এখন মানুষ ভাবতে অনেক কষ্ট হচ্ছে ওর।
“এখন আপনি কেমন আছেন?” নীরবতা ভেঙ্গে রুপা বলল।
“ভাল” রকির সংক্ষিপ্ত জবাব।
“ভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আপনাকে দেখে যাই। আচ্ছা আমি এখন যাই।” বলে উঠে দাঁড়ায় রুপা।
“তুমি আমারে মাফ করে দাও। আমি আসলে মানুষ না আমি একটা পশু। তোমার মত এই রকম একটা মাইয়ার লগে আমি কত অন্যায় করছি।” রুপার হাত ধরে কান্না ভেজা কন্ঠে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল রকি। রকির এই আচরনে অপ্রস্তুত হয়ে যায় রুপা। রুপার চোখ সজল হয়ে চিকচিক করছে। রকি অবুজ শিশুর মত কাঁদছে, চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আর সেই জলে খড় কুটার মত ভেসে যাচ্ছে মনের যত কালিমা, অন্যায় আর পাপ।

Loading


Comments

শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব — 3 Comments

  1. ভাইজান,
    আপনার গল্পটা পড়ে খুবই ভাল লেগেছে।
    আসলে মানুষ ভাল কাজ করে যেতে থাকলে কখন যে কিভাবে শত্রু তার পরম বন্ধু হয়ে যাবে সে টেরই পাবে না। এটা আমার কথা নয় আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন তাই বললাম।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *