রাষ্ট্রশক্তির মিথ্যাচার ও দম্ভের পরিণতি

ঘটনাগুলো খুব বেশি আগের নয়। একটি ঘটেছিল আজ থেকে তিন হাজার তিন শ’ বছর আগে এবং আরেকটি ঘটেছিল মাত্র এক হাজার চার শ’ বছর আগে। প্রথম ঘটনাটির বর্ণনা রয়েছে সব আসমানি কিতাবে এবং দ্বিতীয়টির বর্ণনা রয়েছে পবিত্র আল কুরআনে। উভয় ঘটনাই ঐতিহাসিক। আসমানি কিতাবগুলো ছাড়াও সমসাময়িক ইতিহাস, গল্প-কবিতা এবং লোকগাথায় কাহিনীগুলোর চমৎকার ও জীবন্ত বর্ণনা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, উভয় ঘটনার নিদর্শনই পৃথিবীবাসীর জন্য রেখে দেয়া হয়েছে। কোনো শাসক যদি অত্যাচারী হয়ে ওঠেন, অহরহ মিথ্যা বলেন এবং মিথ্যার বেসাতির ওপর বসতবাড়ি নির্মাণ করে সীমাহীন দম্ভ করে বেড়ান, তাহলে তাদের ওপর কী ধরনের খোদায়ী গজব কিরূপে নাজিল হয় তা বোঝানোর জন্য উপরল্লিখিত ঘটনা দু’টি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজে দৃষ্টান্তস্বরূপ রেখে দিয়েছেন।
সম্মানিত পাঠিক হয়তো ইতোমধ্যে বুঝে ফেলেছেন, আমি হজরত মুসা আ:-এর জমানার ফেরাউন রামেসিস দ্য সেকেন্ডে এবং পবিত্র কাবা শরিফ ধ্বংস করার জন্য সসৈন্যে মক্কা আক্রমণকারী ইথিওপিয়া বা আবিসিনিয়ার সেনাপতি এবং দক্ষিণ আরবের রাজা আবরাহা আল আসরামের কথা বলছি। উভয় ব্যক্তি সম্পর্কে বহু ঐতিহাসিক দলিল এবং একই সাথে কেচ্ছাকাহিনী প্রচলিত রয়েছে। পবিত্র কুরআনের একাধিক সূরায় তাদের সম্পর্কে বর্ণনা থাকার কারণে শিক্ষিত মুসলমানেরা যেমন ঘটনাগুলো সম্পর্কে কমবেশি জানেন, তেমনি নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকেরাও বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কারণে ঘটনাগুলো মূল্যায়ন করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।
আজকের আলোচনায় ঘটনা দু’টির কাহিনীর দিকে সামান্য আলোকপাত করে ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যাবো। প্রথম ঘটনার নায়ক তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী, সম্পদশালী আর বনেদি সম্রাট ছিলেন। মানবসভ্যতার আদি ভূমি মিসরেই সর্বপ্রথম গড়ে উঠেছিল সুশৃঙ্খল রাষ্ট্্রব্যবস্থা, যেখানে দ্বিতীয় রামেসিসের জন্ম হয়েছিল ১৩০৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে এবং মৃত্যু হয়েছিল ১২১৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে। অর্থাৎ তিনি ৯০ বছর জীবিত ছিলেন। তিনি রাজত্ব করেছিলেন ১২৭৯ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে ১২১৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত। মিসরের পাঁচ হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে দ্বিতীয় রামেসিসের মতো প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি মিসরবাসীকে উন্নয়নের চরমে নিয়ে গিয়েছিলেন ও সমসাময়িক দুনিয়ার এক নম্বর সুপার পাওয়ার হিসেবে মিসরকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন ১৯তম রাজবংশের তৃতীয় ফেরাউন বা সম্রাট। তার পিতা সম্রাট প্রথম সেটি এবং মা সম্রাজ্ঞী তুইয়া ছিলেন ইতিহাসের নন্দিত রাজ দম্পতি।
শাসক হিসেবে অমিতবিক্রম এবং সম্রাট হিসেবে হাজারো উপাখ্যান থাকার পরও দ্বিতীয় রামেসিস আল্লাতায়ালার গজবের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন সিংহাসনে বসে নির্বিচার মিথ্যাচার এবং মিথ্যার বেসাতির জন্য দম্ভ করার কারণে। তিনি যখন বিত্ত-বৈভব এবং ক্ষমতার স্বর্ণশিখরে আসীন, ঠিক তখনই নিজেকে আল্লাহ বলে ঘোষণা করে বসলেন। হজরত মূসা আ:-এর নবুয়তপ্রাপ্তি এবং ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের সাগরে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করার কাহিনীর মাধ্যমে মিথ্যাবাদী ও অত্যাচারী শাসকের পরিণতির যে উপাখ্যান রচিত হয়েছে, তা কিয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের লাশ সংরক্ষিত রয়েছে জাদুঘরে। আল্লাহ ঘোষণা করেছিলেন, তার লাশ সংরক্ষিত রাখা হবে। আসমানি কিতাবগুলোর মধ্যে কেবল পবিত্র কুরআনেই তার লাশ সংরক্ষণের কথা বর্ণিত হয়েছে। কুরআনের মোজেজার উল্লেখযোগ্য একটি দৃষ্টান্ত সবার কাছে প্রমাণিত হয়েছে দ্বিতীয় রামেসিসের লাশের মাধ্যমে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ফেরাউনের লাশ পৃথিবীবাসী খুঁজে পায়নি তার মৃত্যুর কয়েক হাজার বছর পরও। অবশেষে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে ১৮৯৮ সালে ফেরাউন রামেসিস দ্য সেকেন্ডের লাশ আবিষ্কৃত হয়।
ফেরাউনের লাশ নিয়ে পৃথিবীবাসী আরো একবার চমকে ওঠে ১৯৮১ সালে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরার সময়ে পরিপূর্ণ রাজকীয় মর্যাদায় লাশটি ফ্রান্সে আনা হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য। গবেষণা দলটির প্রধান ছিলেন মরিস বুকাইলি নামে একজন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী। গবেষণায় দেখা যায়, লাশের শরীরে লোহিত সাগরের লবণাক্ত পানির লবণের নমুনা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে, ৯০ বছর বয়স্ক ফেরাউন সমুদ্রের পানিতে ডুবেই মরেছিলেন। গবেষণা দলের প্রবীণ বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলি যখন জানতে পারলেন যে, ফেরাউনের মৃত্যুর ১৮২৩ বছর পর নাজিলকৃত আল কুরআনে তার লাশের সংরক্ষণ এবং মারা যাওয়ার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, তখন তিনি সব কিছু ছেড়ে কুরআনের অন্তর্নিহিত সত্য উদঘাটনে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তিনি কুরআন শরিফ নিয়ে যতই গবেষণা করতে থাকলেন, ততই ঐশী জ্ঞানের কাছে নিজেকে অসহায় ও অসম্পূর্ণ মনে করতে থাকেন। একসময় তিনি কুরআনের মালিকের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেন। কুরআন, বাইবেল এবং বিজ্ঞান নিয়ে তিনি একনাগাড়ে দশ বছর গবেষণা করে রচনা করলেন তার অমূল্য গ্রন্থ ‘দি বাইবেল, দি কুরআন অ্যান্ড সায়েন্স।’
রামেসিস দ্য সেকেন্ডের পর এবার আমরা কাবা আক্রমণকারী বাদশাহ আবরাহা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করে আজকের প্রসঙ্গে আলোচনা করব। আবরাহা যে বছর কাবা শরিফ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মক্কা আক্রমণ করেছিলেন, সে বছরটিকে আরববাসীরা ‘হস্তি বছর’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আবরাহার সৈন্যবাহিনীর সাথে এক বা একাধিক হাতি ছিল। মরুবাসী বেদুইন কিংবা মক্কা নগরীর অধিবাসীরা কোনো দিন হাতি দেখেনি। ফলে তারা আবরাহার বাহিনীর সাথে হাতি নামক বৃহৎ প্রাণী দেখার পর অতীব আশ্চর্য এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের এমন একসময় যখন আল্লাহর শ্রেষ্ঠ রাসূল সা: মাতৃগর্ভে ছিলেন। পবিত্র কুরআনের সূরা ফিলের মাধ্যমে আল্লাহ বাদশাহ আবরাহা এবং তার সৈন্যবাহিনীর ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছেন।
আবরাহার পতনের সূচনা হয়েছিল মিথ্যার বেসাতি এবং সেই বেসাতি নিয়ে দম্ভ করে সত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার অপরিণামদর্শিতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে। তিনি পবিত্র কাবা শরিফের আদলে তার রাজধানীতে নকল একটি কাবা তৈরি করেন এবং প্রজাসাধারণকে হুকুম করেন তার সৃষ্ট কথিত কাবাকে কেন্দ্র করে মক্কার কাবার মতো হজ, তাওয়াফ, মেলা, গান-বাজনা ইত্যাদি করার জন্য। ফলে ইথিওপিয়া, ইয়েমেন এবং হেজাজসহ দক্ষিণ আরবের বিপুল লোক আবরাহার নকল কাবাঘরে ভিড় করতে থাকে। এতে মক্কার খানায়ে কাবার দর্শনার্থীদের সংখ্যা অনেক হ্রাস পায়। কাবাকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে তেমনি কাবার দায়িত্বে থাকা কুরাইশ বংশীয় লোকজন আরবভূমিতে নিজেদের শত শত বছরের আদি আভিজাত্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং মানসম্মান হারানোর ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। এ অবস্থায় জনৈক কুরাইশ আবরাহা নির্মিত নকল কাবাঘরে গিয়ে মনের দুঃখ, রাগ ও অভিমানে অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসেন। তিনি গভীর রাতে সঙ্গোপনে নকল কাবার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন এবং সেখানে মলত্যাগ করে নিরাপদে সটকে পড়েন।
নকল কাবার তীর্থযাত্রীরা সকালবেলা কথিত কাবাঘরের অভ্যন্তরে দুর্গন্ধযুক্ত মল দেখতে পেয়ে হইচই আরম্ভ করে। তাদের বিশ্বাস এ ঘটনায় মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহর ঘরে কোনো মানুষ মলত্যাগ করে পালিয়ে যেতে পারে, এটা তারা কিছুতেই মানতে পারেনি। তারা আবরাহা নির্মিত নকল কাবার জারিজুরি বুঝতে পেরে সদলবলে মূল কাবার পানে ছুটতে আরম্ভ করল। বাদশাহর গোয়েন্দা বাহিনী খবর দিলো, মক্কার কুরাইশরা এহেন কুকর্ম করেছে। বাদশাহ রাগে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। কুরাইশদের ‘সমুচিত’ জবাব দেয়ার জন্য এবং আল্লাহর ঘর ধ্বংস করার মানসে তিনি বিপুল সৈন্য এবং এক বা একাধিক যুদ্ধহাতি নিয়ে মক্কা আক্রমণ করলেন। মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত ুদ্রকায় আবাবিল পাখির দল আবরাহার সমুদয় সৈন্য সামন্ত এবং হস্তি ধ্বংস করার কাহিনী কমবেশি সবারই জানা।
ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস এবং বাদশাহ আবরাহার ধ্বংস হওয়ার কারণ ও ধরনের মধ্যে দুনিয়াবাসীর জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অসাধারণ সব শিক্ষণীয় বিষয় সন্নিবেশিত করেছেন। আমরা প্রথমে ধ্বংসের কারণ নিয়ে আলোচনা করব। এরপর ধ্বংস করার ধরন নিয়ে কিছু বলে উপসংহারে চলে যাবো। পৃথিবীর সব মানুষ একই রক্ত, মাংস, আবেগ-অনুভূতি, জন্ম-মৃত্যু, ুধা প্রভৃতি দ্বারা সমগোত্রীয় বিবেচিত হলেও জ্ঞানবুদ্ধি, বংশ মর্যাদা, পদ-পদবি এবং রাজকীয় ক্ষমতা দ্বারা মানবমণ্ডলী একজন অন্যজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য লাভ করে থাকেন। এসব বিষয় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার বান্দার জন্য অতি উত্তম ও উৎকৃষ্ট নিয়ামত হিসেবে স্বীকৃত। আল্লাহর দয়ায় মানুষ যখন ভালো বংশে জন্ম নেয়, বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হয় অথবা রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করে, তখন তার উচিত নিজের প্রতি ইনসাফ করা। উত্তম আচরণ, সত্যের পথে অবিচল থাকা, জমিনের তামাম মাখলুকের প্রতি ন্যায়বিচার করা, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং তার হুকুম-আহকাম পালনের মাধ্যমেই মানুষ নিজের প্রতি ইনসাফ করে থাকে।
রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রাপ্ত মানুষের ওপর আল্লাহর একটি বিশেষ হুকুম কার্যকর থাকে। মানুষের রূহ বা আত্মাও আল্লাহর একটি হুকুম মাত্র। আল্লাহ তার হুকুমটি উঠিয়ে নিলে মানুষের দেহ থেকে যেমন রূহ চলে যায়, তেমনি তার হুকুমেই মানুষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয় এবং একইভাবে ক্ষমতা হারিয়েও ফেলে। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাজা-মহারাজা, বাদশাহ বা সম্রাটরা যখন আল্লাহপ্রদত্ত ক্ষমতাকে আল্লাহর নিরীহ বান্দাদের বিরুদ্ধে জুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, তখন খোদায়ি গজব তাদের পাকড়াও করার জন্য তাদের আশপাশে যেন টহল দিতে থাকে। ক্ষমতাধর মানুষের জুলুম-অত্যাচার তাদেরকে প্রতিনিয়ত জাহেলিয়াতের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাদের জ্ঞানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। বোধশক্তি ভোঁতা হয়ে যায় এবং বিবেক মরে যায়। এ অবস্থায় রাজা-বাদশাহরা অকারণে মিথ্যাচার শুরু করেন এবং তার চেয়েও অকারণে আনন্দ-উল্লাস তথা বালখিল্যময় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে থাকেন।
দ্বিতীয় ধাপে এসে মিথ্যাবাদী শাসক তার নিত্যদিনের মিথ্যাচার নিয়ে গর্ব করতে শুরু করেন এবং নিজের বোধবুদ্ধি এমন স্তরে নিয়ে যান যাতে তার সর্বদা মনে হতে থাকে যে, সব প্রাণী বোকা এবং কেউ তার মিথ্যাচার ধরতে পারছে না। তৃতীয় ধাপে এসে মিথ্যাবাদী শাসক বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেন যে, তার মিথ্যাচারই হলো প্রকৃত সত্য ও বাস্তব ঘটনা। চতুর্র্থ ধাপে সে মিথ্যার বড়াই ও অহঙ্কার প্রদর্শন শুরু করে দেন। পঞ্চম ধাপে এসে নিজেকে খোদা অথবা খোদার প্রতিভু ভাবতে শুরু করেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যে নিজেকে খোদা দাবি করে বসেন কিন্তু বেশির ভাগই মনে মনে নিজেকে খোদার সাথে তুলনা করতে শুরু করেন।
ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস এবং বাদশাহ আবরাহা নিজেদের অধঃপতনের পঞ্চম স্তরে নামিয়ে এনেছিলেন। তাদের ধ্বংস করার আসমানি কৌশল তাদের চার দিক থেকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলেছিল। পৃথিবীতে তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।
ফলে সমাজ-সংসার এবং রাষ্ট্রে তারা দিনকে দিন বেপরোয়া, বেহায়া বা নির্লজ্জ হয়ে পড়েছিলেন। কোনো কাজ করতে তারা ভয় পেতেন না কিংবা সঙ্কোচ বোধ করতেন না। তারা নিজেদের সব কিছুর ওপর বিবেচনা করতেন। বিবেক মরে যাওয়ার কারণে তারা নিজেদের মন্দ কাজের জন্য অনুশোচনার পরিবর্তে আনন্দ অনুভব করতেন। তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা রহিত হয়ে যাওয়ার কারণে তারা নিজেদের পতনের লক্ষণগুলো বুঝতে পারতেন না।
ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস এবং বাদশাহ আবরাহাকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ার মধ্যে মহান আল্লাহ পাকের অপূর্ব কর্মকৌশল এবং নান্দনিকতা ফুটে উঠেছে। তাদের এমন আশ্চর্য ও অদ্ভুত উপায়ে ধ্বংস করা হয়েছে যা নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ার তাবৎ মাখলুককে কেবল বিস্ময় প্রকাশ করতে হবে। পৃথিবীর কোনো নাফরমান, নাস্তিক কিংবা অবিশ্বাসীরা শত চেষ্টা করেও বলতে পারবে না যে, দ্বিতীয় রামেসিস বা আবরাহা কোনো মানুষ দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছেন। ফলে এই দু’টি প্রসঙ্গ উপস্থাপিত হওয়া মাত্র, যে কেউ আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তার ক্ষমতা মেনে নিতে বাধ্য। অন্য দিকে, দুইজন মহা জালিমের ধ্বংস হওয়ার ঘটনার মধ্যে আল্লাহর কর্মকুশলতার শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে। ফেরাউন যখন দেখলেন, তার সামনে সাগরের পানি ভাগ হয়ে গেছে এবং সেখান দিয়ে রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে তখন তার জন্য দু’টি খোদায়ি কৌশল মারণফাঁদ হয়ে দেখা দিলো। প্রথমত, তার মনমস্তিষ্ক এই অদ্ভুত ঘটনার কার্যকারণ এবং পরিণতি চিন্তা করতে ব্যর্থ হলো। দ্বিতীয়ত, তাকে বহনকারী গাড়ির ঘোড়াগুলো তার হুকুমের অপেক্ষা না করে আল্লাহর হুকুমে সমুদ্রের মধ্যে তৈরি হওয়া পথের দিকে ছুটে চলল। অন্য দিকে, তার অনুগামী সৈন্যবাহিনীও গাফেল হয়ে তাকে অনুসরণ করে ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে নিজেদেরকে সঁপে দিলো।
আবরাহার পতনের ঘটনাও সাধারণ মানুষের মনমস্তিষ্কে ঢুকবে না। হাজার হাজার ুদ্রাকার পাখি মটরশুঁটির মতো ছোট ছোট পাথরের টুকরোর সাহায্যে প্রায় ত্রিশ হাজার সৈন্য এবং তাদেরকে বহনকারী হাতি, ঘোড়া, গাধাকে ধ্বংস করে দেবে বা দিতে পারে-এমন পরিণতির কথা আবরাহা যেমন চিন্তা করতে পারেননি, তেমনি যুগ যুগান্তরে তার উত্তরসূরি কিংবা পূর্বসূরি জালেম শাসকেরাও কল্পনা করতে পারেননি এবং পারবেনও না। এখন প্রশ্ন হলো জালিমরা কিভাবে তাদের পতনের ক্ষেত্র তৈরি করে থাকে? তারা সবার আগে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের শেষ করেছে। তারপর নিরীহজনদের ওপর অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার করতে করতে মানুষ হিসেবে নিজেদের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। পরের ধাপে তারা অকারণে দ্বন্দ্ব-ফাসাদ, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টির পথ খুঁজতে থাকে। সবশেষে ছুতা পাওয়ার পর তারা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে করতে আল্লাহর গজবের মৃত্যুকূপের দিকে পা বাড়ায় এবং সদলবলে ধ্বংস হওয়ার মাধ্যমে ইহজাগতিক পর্ব শেষ করে।

পূর্ব প্রকাশিত- নয়া দিগন্ত

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *