যেসব কারণে ২০১৬ সাল ছিল নিকৃষ্ট বছর

ডাবলিন: মৃত্যু, ধ্বংস ও বিভাজন। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই অনুমান করতে পেরেছেন এটাই হচ্ছে ২০১৬ সাল।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রতি বছর আমাদেরকে অসংখ্য অনাকাঙ্খিত ঘটনা মোকাবেলা করতে হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। এ বছর বিভিন্ন বিশৃঙ্খলাপূর্ণ রাজনৈতিক বিরোধ, অসংখ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যু এবং অব্যাহত পরিবেশগত সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে ২০১৬ সাল সত্যিকার অর্থেই অন্যতম খারাপ একটি বছর আমাদের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে থাকবে।

কেন খারাপ বছর গেল এখানে তার ১৪টি কারণ উল্লেখ করা হলো:

১. ডেভিড বোয়ে’র মৃত্যুবরণ

বছরটা খারাপভাবেই শুরু হয়েছিল। ডেভিড বোয়ের ২৫তম স্টুডিও অ্যালবাম প্রকাশ ও ৬৯তম জন্মদিনের মাত্র দুই দিন পর এই কৃষ্ণাঙ্গ তারকা ১০ জানুয়ারি নিউইয়র্কে তার নিজ অ্যাপার্টমেন্টে মারা যান। তিনি টানা ১৮ মাস ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করার এই তথ্য ভক্তদের কাছে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

এই ব্ল্যাক স্টারের মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী তার অসংখ্য ভক্ত শোকে মোহ্যমান হয়ে পড়েন।

২. অ্যালান রিকম্যানের মৃত্যুবরণ

ডেভিড বোয়ে’র মৃত্যুর চারদিন পর জনপ্রিয় তারকা অ্যালান রিকম্যান লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি টার্মিনাল ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তার এ তথ্যটিও গোপন রয়ে যায়।

হ্যারি পটারসহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করা এই তারকা ২০১৫ সালের আগস্টে একটি মাইনর স্ট্রোকে ভোগেন। যা পরবর্তীতে তাকে অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের দিকে নিয়ে যায় এবং তার ঠিক পাঁচ মাস পরে তার জীবন প্রদীপ নিবে যায়।

৩. ব্রাসেলসে ভয়াবহ বোমা হামলা

২২ মার্চ সকালে বেলজিয়ামের রাজধানীতে বসবাসকারী সন্দেহভাজন কয়েকজন চরমপন্থী ব্রাসেলসের ‘জাভেন্টেম’ বিমানবন্দরে এক অনুভূতিহীন বোমা হামলা চালায়।

এর কয়েক ঘন্টা পরে শহরে প্রাণকেন্দ্র ‘মেট্রো স্টেশনে’ দ্বিতীয় বোমা হামলা চালানো হয়। এতে ২২ জন লোক নিহত হয় এবং দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে তীব্র সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় মন্ত্রীদের মধ্যে অশান্তির লড়াই শুরু হয়।

৪. ইস্তাম্বুলে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা

১৫ জুলাই তুর্কি সামরিক বাহিনীর একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী দেশটিতে অভ্যুত্থানের প্রয়াস চালান। তারা সরকারি ভবনসহ আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দরে হামলা চালান।

২৪ ঘন্টার মধ্যেই এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও তুরস্কের ভিতরে এটি ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। এই সংঘাতে ৩০০ জনেরও বেশি লোক মারা যায়।

৫. হারামবি হত্যাকাণ্ড

মে মাসে ‘সিনসিনাটি’ চিড়িয়াখানায় ‘হারামবি’ নামে ১৭ বছর বয়সী একটি পুরুষ সিলভারব্যাক গরিলাকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই ঘটনা পশু পরিবেষ্টন এবং তাদের যত্নের মান সম্পর্কে প্রকাশ্যে উত্তপ্ত আলোচনার জন্ম দেয়।

তিন বছর বয়সী একটি ছেলে শিশু চিড়িয়াখানার বেড়ার নিচ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে গরিলার কাছে চলে গেলে চিড়িয়াখানার কিপারগণ শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এসময় কৌতূহলী হারামবি শিশুটিকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলে রক্ষীদের একজন তাকে গুলি করে হত্যা করে; যা পশুপ্রেমিদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা যুক্তি তুলে ধরেন যে, এই হত্যা অপ্রয়োজনীয় ছিল এবং এজন্য ওই ছেলেটির বাবাকেই দায়ী করা উচিত ছিল।

৬. জিকা ভাইরাস

বছরের শুরুতেই জিকা ভাইরাস বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রোগটি ল্যাটিন আমেরিকায় উদ্বেগ হারে ছড়িয়ে পড়ে।

অসুস্থতার উপসর্গ যতক্ষণ না নিজেরাই ধ্বংস হয় ততক্ষণ এর ঝুঁকি থাকে বিশেষকরে গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এর প্রভাবে অনাগত শিশু অস্বাভাবিকভাবে ছোট মাথা এবং অনুন্নত মস্তিষ্ক নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। এছাড়াও, দুর্বল দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও খিঁচুনি হতে পারে।

৭. অরল্যান্ডোয় গুলিবর্ষণ

২৯ বছর বয়সী ওমর মতিন নামে এক ব্যক্তি একটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে ‘পালস গে ক্লাবে’ প্রবেশ করে উপস্থিত জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ৪৯ জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়। অরল্যান্ডোর গুলিবর্ষণের ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোর অন্যতম একটি নিকৃষ্টতম ঘটনা।

৮. ব্রেক্সিট

রাজনৈতিকভাবে ইইউ ত্যাগ করার জন্য ব্রিটেনে একটি গণভোটের আয়োজন করা হয় যা ‘ব্রেক্সিট’ নামে পরিচিত। ‘ব্রেক্সিটের’ পক্ষে দেশটির জনগণ ভোট দিলে ডেভিড ক্যামেরন সরকারের পদত্যাগ করে। ভোটের পর কয়েক সপ্তাহজুড়ে দেশটিতে ঘৃণা অপরাধ বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪২ শতাংশ।  পক্ষে-বিপক্ষে এসময় জনগণ রাস্তায় নেমে আসেন।

দেশটিতে এই যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এর পক্ষে-বিপক্ষে তর্কযুদ্ধ এখনো অব্যাহত আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে আসতে ব্রিটেনকে সক্রিয়ভাবে আরো দুই বা ততোধিক বছর সময় লাগতে পারে। আমরা কেবল একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি আর তা হলো সেখানে কলহ বা দ্বন্দ্বের আরো অনেক কিছুই বাকি আছে।

৯. মোহাম্মদ আলীর জীবনাবসান

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মুষ্টিযোদ্ধা হিসেবে মর্যাদা পাওয়া মোহাম্মদ আলী শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে গত ৪ জুন অ্যারিজোনার ফিনিক্স-এরিয়া হাসপাতালে মারা যান। তিনি ছিলেন একাধারে একজন মুষ্টিযোদ্ধা, একজন নাগরিক অধিকার কর্মী এবং একজন সাংস্কৃতিক আইকন।

মোহাম্মদ আলীর আসল নাম মার্সেলাস ক্লে। তিনি ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আলী ইসলামে ধর্মান্তরিত হন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে তিনি আপত্তি জানান। মার্কিন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।

তার পরে বছর আলী দুরারোগ্য ‘পারকিনসন’ রোগ আক্রান্ত হন। কিন্তু তারপরেও রাজনীতি ও নাগরিক অধিকার আদায়ে তিনি তার সক্রিয় ভূমিকা অব্যাহত রাখেন। তার মৃত্যু বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১০. গ্রেট বেরিয়ার রিফ ‘মৃত’ ঘোষণা

গত অক্টোবরে ‘গ্রেট বেরিয়ার রিফ’ মৃত ঘোষণা করা হয়। আমাদের সমষ্টিগত অব্যবস্থাপনার জন্যই পৃথিবী বিখ্যাত এই দ্বীপটির মৃত্যু ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার উপকূলীয় শহর কুইন্সল্যান্ডের কোরাল সাগরের গ্রেট বেরিয়ার রিফ ২ হাজার ৯০০টিরও বেশি প্রবাল প্রাচীর এবং কয়েকশ’ দ্বীপ নিয়ে গঠিত।

লাখ লাখ বছর ধরে অগণিত জীবন্ত প্রাণী একত্র হয়ে বিশাল প্রবাল প্রাচীর গঠিত হয়েছে যা পৃথিবীর সবচাইতে বিচিত্র বাস্তুতন্ত্রের একটি এবং অস্ট্রেলিয়ার দর্শনীয় স্থানগুলোর অন্যতম ছিল এটি।

 

১১. ট্রাম্পের বিজয়

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। কারো কাছে এটি আন্ডারডগ ব্যক্তির জয়জয়কার। আবার কারো কাছে ইট একটি রাজনৈতিক প্রহসন।

নেতিবাচক প্রচারণা চালানোর জন্য ট্রাম্প বছরজুড়েই সমালোচনার পাত্রে পরিণত হন। তিনি মেক্সিক্যান অভিবাসীদের উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার হুমকিসহ নারীবিদ্বেষী বিভিন্ন মন্তব্য সারা বছরই তাকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে।

নির্বাচিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিউইয়র্কে অবস্থিত ট্রাম্প টাওয়ারসহ আমেরিকাজুড়ে বিভিন্ন শহরে জনগণ রাস্তায় নেমে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ করেন। প্রতিবাদকারীরা ঘোষণা দেন ‘তিনি (ট্রাম্প) আমার প্রেসিডেন্ট না’।

১২. আমেরিকান পুলিশের গুলিবর্ষণ

২০১৪ সালে আমেরিকার মিসৌরির ফার্গুসনে ১৮ বছর বয়সী মাইকেল ব্রাউন পুলিশের গুলিতে নিহত হলে তার মৃত্যুতে দেশব্যাপী তুমুল বিক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এই আন্দোলন ২০১৬ সালে আরো তীব্র আকার ধারণ করে। এই আন্দোলনে বছরজুড়ে অনেক বেশি সংখ্যক নিরস্ত্র  কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের মৃত্যু হয়।

পুলিশের নৃশংসতার কারণে এ বছর ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার মুভমেন্ট’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে। পুলিশের গুলিবর্ষণে ওকলাহোমা, শারর্লট, উত্তর ক্যারোলিনা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোতে সবচেয়ে বেশি নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গরা নিহত হন।

১৩. লিওনার্ড কোহেনের মৃত্যুবরণ

গেল নভেম্বরে জনপ্রিয় সংগীত আইকন লিওনার্ড কোহেন মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ১৪টি স্টুডিও অ্যালবাম এবং অসংখ্য গানের সংকলন করেন।

 

কোহেন তার গানে একটি ‘মরমী’ ধারা বজায় রাখেন। তার এসব গানে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক ভক্ত-অনুরাগীর জন্ম হয়।

১৪. জর্জ মাইকেলের মৃত্যুবরণ

ডিসেম্বরের শেষ দিকে এসে এবং ক্রিসমাসের দিনে ঘোষণা করা হয় যে পপ তারকা জর্জ মাইকেল আর নেই। ৫৩ বছর বয়সী জর্জ মাইকেল শান্তিপূর্ণভাবে নিজ বাড়িতেই মারা যান। তিনি ছিলেন বিশ্বের জনপ্রিয় পপ তারকাদের অন্যতম।

চার দশক জুড়ে এই সুপারস্টার দারুন জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে সংগীতশিল্পী জর্জ মাইকেল ও অ্যান্ড্রু রিজলি গড়ে তুলেছিলেন ‘হোয়াম’। ১৯৮৬ সালে হোয়াম ভেঙে যাওয়ার পর তিনি একক ক্যারিয়ার গড়ে তোলেন। সারাবিশ্বে তার অ্যালবামের ১০০ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। তার মৃত্যুতে বিশ্ব সংগীতাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে।

এত কিছুর পরেও আমরা আশা করছি ২০১৭ সাল একটু হলে সহনীয় হবে।

আইরিশ এক্সামিনার অবলম্বনে মো. রাহুল আমীন

সৌজন্যে : আরটিএনএন

উড়ন্ত পাখি

About উড়ন্ত পাখি

আমি কোন লেখক বা সাংবাদিক নই। অর্ন্তজালে ঘুরে বেড়াই আর যখন যা ভাল লাগে তা সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।

Comments are closed.