যুদ্ধে বারবার পরাজিত, গণতন্ত্র হত্যায় জয়ী


মোহাম্মাদ মুরসি ও আবদুল ফাতাহ সিসি – ছবি : সংগৃহীত

‘The Egyptians could run to Egypt, the Syrians into Syria. The only place we could run was into the sea, and before we did that we might as well fight’. –গোল্ডা মেয়ার, ১৯৭৩-এর আরব-ইসরাইল যুদ্ধকালীন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী

মুসলমানদের যেমন ঈদ, ইহুদিদের তেমন ‘ইয়োম কিপ্পুর’। ওই দিন তারা ছুটি কাটায়, উৎসব করে। ইসরাইলের নারী প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারও সেদিন তার নাতি, নাতনী নিয়ে ‘ইয়োম কিপ্পুর’ উপভোগ করছিলেন। তার পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত গুপ্তচর সংস্থা-মোসাদ ওই দিন সকালেও তাকে কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি। অথচ দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন মিসরের প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আনোয়ার সাদাত ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ। ইসরাইলিদের হতবাক করে দিয়ে সেদিন সম্মিলিত আরব বাহিনী সুয়েজ খাল অতিক্রম করে দুর্ভেদ্য ‘বারলেভ লাইন’ আক্রমণ করে বসে।

শত শত কামান একসাথে গর্জে ওঠে। বারলেভ লাইনে মোতায়েন অনেক ইসরাইলি সৈনিক ইতোমধ্যেই ছুটি কাটাতে চলে গেছে, বাকিরা ছুটির আমেজে মাতোয়ারা। মিসরীয় সেনাবাহিনী খুব দ্রুত দখল করে নেয় বারলেভ লাইনের দুর্ভেদ্য বাংকারগুলো। সিনাই মরুভূমিতে ঝটপট বসিয়ে ফেলে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে সংগৃহীত ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইল। সুয়েজ পার হয়ে শত শত ট্যাংক ঢুকে পড়ে ইসরাইল অধিকৃত এলাকায়। এর মধ্যে বেশ কিছু ছিল তখনকার সবচেয়ে আধুনিক টি-৭২ মডেলের সোভিয়েত রাশিয়ার তৈরি ট্যাংক। এ ছাড়া দুই দেশের কাছেই সোভিয়েত ইউনিয়ন সে সময়ের সর্বাধুনিক ও কাঁধে বহনযোগ্য বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, দূরপাল্লার কামান, জঙ্গি ও বোমারু বিমান সরবরাহ করেছিল। মিসর-সিরিয়া মিলে ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি।

অন্য দিকে, ইসরাইলের ট্যাংকগুলো ছিল পুরনো মডেলের ও সংখ্যায় অনেক কম। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, ইসরাইলের সমরশক্তি মিসর ও সিরিয়ার ধারেকাছেও ছিল না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ইয়োম কিপ্পুরের দিন অকস্মাৎ আক্রমণ করায় ইসরাইল হকচকিত হয়ে গিয়েছিল। কারণ যুদ্ধে সারপ্রাইজ একটি বড় ফ্যাক্টর। ওই দিনের মধ্যে মিসরের সেনাবাহিনী ঝড়ের গতিতে সিনাই মরুভূমিতে এগিয়ে চলে, অন্য দিক থেকে ধেয়ে আসে সিরিয়ানরা। ইসরাইলের তখন ত্রিশঙ্কুু অবস্থা। গোল্ডা মেয়ার উৎসব পালন বাদ দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ও মোসাদ প্রধানকে নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসলেন। নিজ দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যা যা করা দরকার, তা নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সবাই তখন দিশাহারা। সবদিক থেকেই খারাপ খবর আসছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলোÑ বেশির ভাগ সৈন্য তখন ছুটিতে, কোনো কিছুই যুদ্ধাবস্থায় মোতায়েন নেই।

সৈন্যদের জড়ো করে, সেনানিবাস থেকে ট্যাংক, কামান বের করে তবেই না শত্রুর মোকাবেলায় যেতে হবে! সে সময়ই মেয়ার কঠোর, কঠিন স্বরে বলেছিলেন- ‘মিসরীয়দের তো বিস্তর ভূমি আছে দৌড় দেয়ার, সিরিয়ানরাও পারবে সিরিয়ার ভূমিতে পিছু হটতে। কিন্তু পিছু হটলে আমাদের তো একমাত্র সমুদ্র ছাড়া যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। সমুদ্রে ডুবে না মরে, আমরা তাই যুদ্ধ করব’। ইসরাইল করেছিল ঠিক এটাই। এত শক্তি ও সমরাস্ত্র নিয়ে এগিয়ে গিয়েও যুদ্ধে পরাজিত হতে হয় মিসর ও সিরিয়াকে। মিসরকে পিছু হটাতে হটাতে সেই সুয়েজ খাল পার করে ছাড়ে ইসরাইলিরা। কায়রো ও দামেস্ক দখল হয়ে যায় যায় অবস্থা। সে সময় শুধু এক রাতের যুদ্ধেই মিসরীয় সেনাবাহিনীর সেকেন্ড আর্মি (তাদের কয়েকটি আর্মি ছিল) এবং কয়েক শ’ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান হারায় ইসরাইলের পুরনো ট্যাংকের কাছে। পরদিন সকালে খবর পেয়ে ওই আর্মির কমান্ডার জেনারেল সাদ মামুন হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং তাকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দিতে হয়।

এটাই ছিল মিসরীয় বাহিনীর ‘বীরত্ব’! এতগুলো অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে তাদের কাপুরুষের মতো পিছু হটে আসায় সোভিয়েত ইউনিয়ন হতবাক হয়ে যায়। তারা ভেবেই পায়নি, দুই দেশের এমন বিশাল শক্তি কিভাবে ছোট্ট একটি দেশের কাছে এভাবে মার খেতে পারে? অবশ্য আরবদের পিটুনি খাওয়া নতুন কিছু নয়। এর আগে ১৯৬৭ সালে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে অবস্থা হয়েছিল আরো ভয়াবহ। ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত চলা ওই যুদ্ধে ইসরাইল মিসরের কাছ থেকে দখল করে নেয় গাজা উপত্যকা ও সিনাই উপদ্বীপ। সিরিয়া হারায় গোলান মালভূমি এবং পূর্ব জেরুসালেম হারায় জর্দান। ওই বছর যুদ্ধের প্রথম দিনেই ইসরাইলি বিমানবাহিনী মিসরীয় বিমান বাহিনীর প্রায় ৩৩৮টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে এবং ১০০ পাইলট নিহত হন। এর বেশির ভাগ বিমান ঘাঁটিতে থাকাকালেই ধ্বংস হয়, যা অপেশাদার মিসরীয় বৈমানিকেরা উড়াতে পর্যন্ত পারেননি। আধুনিক যুগে কোনো যুদ্ধে এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই।

এমন ‘বীরত্ব’ কেবল মিসরের সশস্ত্রবাহিনীরই আছে! বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ১৯৬৭ সালের ৫ জুন যখন ইসরাইলি বিমানবাহিনী ১৮৮টি যুদ্ধবিমান নিয়ে মিসরের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে হামলা করে, তখন ইসরাইলের সীমান্তবর্তী এলাকায় মিসরের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। মিসর ও সিরিয়ার যৌথ সামরিক কমান্ডের কমান্ডার ইন চিফ ও নাসেরের পর সবচেয়ে ক্ষমতাধর মিসরীয় ফিল্ড মার্শাল আব্দেল হাকিম আমের ওই পথে বিমানে যাবেন বলে ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ এমনটি করা হয়েছিল! মিসরের গোয়েন্দা বাহিনী ওই নির্দেশ দিয়েছিল যাতে কোনো ‘বিদ্রোহী সৈনিক’ ফিল্ড মার্শালের বিমান ভূপাতিত করতে না পারে। ইসরাইলি গোয়েন্দারা এ তথ্য জানতেন এবং ঠিক ওই সময়টি বেছে নেয়া হয় নিরাপদে বিমান আক্রমণ করার জন্য। স্বৈরশাসক ও একনায়কদের আসলে ওভাবেই নিরাপত্তার দরকার হয় নিজ দেশের সৈনিক ও মানুষের কাছ থেকে। তারা কাউকেই বিশ্বাস করতে পারেন না। উল্টো চার দিকেই তৈরি করেন ‘শত্রু’। তাই আসল শত্রু যখন আসে, তখন রানওয়েতে থাকা বিমান আর উড়তে পর্যন্ত পারে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে- যুদ্ধের শুরুতেই এই ফিল্ড মার্শাল আমের ইসরাইলি আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সিনাই থেকে পুরো সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর তাকে কর্নেল নাসের ক্ষমতাচ্যুত করেন। পরে তিনি কাপুরুষের মতো আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

পরাজিত সশস্ত্রবাহিনী হতাশা ও অপমানে জর্জরিত থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু একনায়ক বা সামরিক স্বৈরশাসক যুদ্ধের আগে থেকেই তার জনগণকে হত্যা, গুম, নির্যাতনের মাধ্যমে অপমান করেন ধারাবাহিকভাবে। তাই জনগণ ফুঁসে ওঠে পরাজিত সেনাবাহিনীর ওপর। তখন সেই সেনাবাহিনী তার রাগ বা ক্ষোভ ঝাড়ে নিরস্ত্র জনতার ওপর, বিরোধী জনমতের ওপর। মিসর এর নিকৃষ্ট উদাহরণ মাত্র।

এক সময় এই মিসরের বিমানবাহিনীর প্রধান ছিলেন হোসনি মোবারক। আনোয়ার সাদাতের পর তিনি মিসরের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ দিনের এক ‘ঐতিহ্যবাহী’ স্বৈরাচারীতে পরিণত হন। এদেরকে আবার শুধু ‘স্বৈরশাসক’ বললে হবে না, এরা একেকজন রাজা-বাদশাহ, প্রাচীন যুগের ক্যালিগুলা। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার কথা বলে এরা লৌহমানব হিসেবে জেঁকে বসেন। সব বিরোধী মত তো বটেই, নিতান্ত জনস্বার্থমূলক ইস্যুতে কথা বললেও রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বুনো ষাঁড়ের মতো। আড়ালে চলতে থাকে নিরাপদ দুর্নীতির মহোৎসব। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, ভাতিজা, শ্যালক সবাই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। হোসনি মোবারক খুবই দক্ষতার সাথে এসব করেছেন। মিসরে কোনো রাজনৈতিক আদর্শকে তার সময়ে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। স্বাভাবিক রাজনীতি বন্ধ থাকলে স্বাভাবিকভাবেই লিবারেল জাতীয়তাবাদ মূল টার্গেটে পরিণত হয়।

মিসরের গোয়েন্দাবাহিনী নাসেরের সময় থেকে আরব জাতীয়তাবাদের নাম নিয়ে সব ধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে নির্মূল করেছে। মোবারকের সময় টেকনোলজির উন্নয়ন হওয়ায় তা আরো সহজ হয়ে যায়। এর ফলে মিসরের মতো এত পুরনো একটি সভ্যতায় সৃষ্টি হয় ব্যাপক শূন্যতা। আর সেই স্থানটিই দখল করে নেয় ধর্মকেন্দ্রিক একটি দল- মুসলিম ব্রাদারহুড। কমিউনিস্টদের মতো ধর্মকেন্দ্রিক দলগুলো গোছানো থাকে ও দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে পারে, ব্রাদারহুডও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। মিসরে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়; তত দিনে সামরিক স্বৈরশাসকরা বিশ্বে তাদের ‘হালাল’ করার জন্য মোক্ষম প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আলট্র্রা সেকুলারদের একটি বিশাল গোষ্ঠী সৃষ্টি করে ফেলেছেন। এরা আবার রাষ্ট্রের সব সুবিধাভোগী, ব্যবসায় তাদের হাতে, সব গুরুত্বপূর্ণ পদে তারাই আসীন আর সাংস্কৃতিক অঙ্গন তাদের পদচারণায় মুখর। মুসলিম দেশগুলোয় এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়।

সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মুসলমানেরা তখন অনিরাপদবোধ করতে শুরু করেন। তাদের মনে ভয় ঢুকে যায় যে, আলট্র্রা সেক্যুলার সংস্কৃতি মুসলিম পরিচয়ে আঘাত হানছে। লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক একটি পক্ষ থাকলে হয়তো এটা হতো না। তারা পশ্চিমা ভাবধারার সাথে মুসলিম কালচার মিশিয়ে এক রকম ভারসাম্য তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু এই শক্তিটি না থাকায় ওই মুসলমানেরা ধর্মকেন্দ্রিকতার দিকে আরো বেশি ঝুঁকে পড়েন। মিসরে তাই মুসলিম ব্রাদারহুড সমাজের সব ক্ষেত্রেই তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নির্যাতন, নিবর্তনে অতিষ্ঠ সাধারণ মিসরবাসী তাই যখন আরব বসন্তের সাগরে ঝাঁপ দেয়, তখন সেখানে একমাত্র সংগঠিত শক্তি হিসেবে আবিষ্কার করে ব্রাদারহুডকে।

ধর্মাশ্রিত রাজনৈতিক দল হলেও ব্রাদারহুডের সদস্যরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের আদর্শের ব্যাপ্তি মিসর ছাড়িয়ে আরো কয়েকটি মুসলিম দেশে ছড়িয়ে গেছে। তুরস্কে এরদোগান ও মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের দল ব্রাদারহুডের সমান্তরাল আদর্শের ধারক। এ হিসাবে ব্রাদারহুড একটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কংলোমারেট বা বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। এখানেই অনেকের ভয়। অপর দিকে এই ‘ভয়’ ওই দলগুলোকে আরো সংরক্ষণবাদী করে তোলে। তুরস্কে বহু সংগ্রামের পর এরদোগানের দল ক্ষমতায় এসেছে। সেখানে জনসমর্থনের কোনো কমতি নেই। অর্থনৈতিকভাবে প্রায় ধসে পড়া তুরস্ককে এরদোগান একটি মহাশক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।

আধুনিকতার সাথে ইসলামী ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে দেশটিকে বিশ্ব দরবারে সম্মানের আসনে বসিয়েছেন। ইউরোপসহ এক সময়ের তুর্কি খেলাফতের অধীনস্থ আরব রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে সৌদি আরব আজ তুরস্কের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তুরস্ক চাচ্ছে, আশপাশের আরব দেশগুলোয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক এবং ব্রাদারহুডের মতো দলগুলো যতগুলো দেশে সম্ভব, ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব দেশ এই পদক্ষেপকেই ভাবছে মুসলিম বিশ্বে তাদের নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে। ড. মোহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরিতে সচেষ্ট হলে তাই সৌদি আরবের ‘মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে’। এটা তাদের জন্য প্রেস্টিজ ইস্যু। একসময় সৌদি আরব ইবনে সৌদের নেতৃত্বে ব্রিটিশদের সহায়তায় তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই অনেকের মতে, তারা কখনোই চাইবে না আবারো তুরস্ক তেমন প্রভাবশালী হয়ে উঠুক আরব বিশ্বে। মুরসির বিরুদ্ধে মিসরের সেনাবাহিনীকে উসকে দিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির নেতৃত্বে ক্যু মূলত ওই কারণেই ঘটেছিল। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন।

মিসরের হাজার বছরের ইতিহাসে মুরসি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসক ছিলেন, তা তার শত্রুও অস্বীকার করতে পারবে না। তিনি গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তিনি ক্ষমতায় এসেই সংরক্ষণবাদী হয়ে উঠেছিলেন। অভিযোগ, বিভিন্ন পদে ব্রাদারহুডের লোক বসাতে শুরু করেছিলেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন মিসরীয় সমাজ দীর্ঘ দিন একটি ভিন্ন ধারায় পরিচালিত হয়েছে, সবস্তরে আলট্রা সেক্যুলারদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তার রয়ে সয়ে পথচলা উচিত ছিল। তার মনে রাখা উচিত ছিল, তিনি ‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ নন। তার ও তার দলের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। তিনি আরো ভুলে গিয়েছিলেন যে, মিসরে রয়েছে লিবারেল ডেমোক্র্যাট বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী।

তুরস্কে এরদোগানের দল ক্ষমতায় এসেই হুট করে সবকিছু পরিবর্তন করেনি। নাইট ক্লাবে যারা যেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তাদের যেতে দেয়া হয়েছে। যারা সেকুলারিজম আঁকড়ে থাকতে চেয়েছেন, তাদের তা থাকতে দিয়েছেন। তবে প্রতীয়মান হয়, ব্রাদারহুডের মতো ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির সীমাবদ্ধতা তুরস্ককেও ধীরে ধীরে চেপে বসছে। ২০১৬ সালে এরদোগানের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক অভ্যুত্থানপ্রক্রিয়া জনগণের প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ার পর তুরস্কে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বহু সরকারি পদ থেকে বিরোধী মতের লোকজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এটা হয়তো এরদোগানের বিশাল সাফল্য ও ব্যক্তিত্বকে যেকোনো সময় ঘূর্ণিঝড়ের মতো আঘাত হানতে পারে।

যদি তা হয়, তাহলে সেটা অনাকাক্সিক্ষত হলেও অস্বাভাবিক হবে না। কারণ, তুরস্ককে ‘খেয়ে ফেলতে পারলে’ই আরব বিশ্বের গণতন্ত্রমুখী প্রবণতাকে নিশ্চিন্তে ‘দাফন করতে পারে’ ওই অঞ্চলের রাজতান্ত্রিক সরকারগুলো। এদের এই ভয় থেকেই লিবিয়ায় গণতন্ত্র আসতে গিয়েও আসতে পারেনি। আলজেরিয়ায় চলছে নৈরাজ্য। সুদানের সেনাবাহিনীকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে গণ আকাক্সক্ষা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার জন্য। মোহাম্মদ মুরসি এসব সমীকরণ বুঝতে পারেননি। অবশ্য কমিউনিস্ট ও ধর্মকেন্দ্রিক দলগুলো ক্ষমতায় এসেই সবকিছু এলোমেলো করে ফেলে। মুরসিও হয়তো এর ব্যতিক্রম নন।

মুরসির আদর্শ অনেকের কাছেই অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। হয়তো যেকোনো সময় তার দল মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও পড়ে যেতে পারে। কিন্তু ওই মানুষটিই যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। আদর্শের প্রতি গভীর মমতা ও দেশের প্রতি অসাধারণ ভালোবাসা না থাকলে কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত প্রকৌশলী এটা করতে পারেন না। অন্তত মিসরের মতো নিবর্তনবাদী একটি দেশে ফিরে গিয়ে যাযাবর জীবনকে বরণ করে নেয়ার মতো সংগ্রামী খুব কম মানুষই হতে পারেন। মোহাম্মদ মুরসিকে সময় দেয়া উচিত ছিল মিসরের সেনাবাহিনী ও জনগণের। হয়তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দুই তিন টার্ম নির্বাচন সম্পন্ন হলে মিসর আধুনিক গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসতে পারত। কমিউনিস্টরা যে গণতন্ত্রকে ‘সাম্রাজ্যবাদী ও বুর্জোয়া শাসনব্যবস্থা’ বলে কটাক্ষ করে থাকেন, তারা যদি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারেন, তাহলে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলোকেও একই সুযোগ দিতে হবে। এতে বাধা দিলেই উগ্রবাদ আরো চাঙ্গা হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

মুরসি চে গুয়েভারা ছিলেন না। তা হতেও পারলেন না। তবে চে’র যে একাগ্রতা ছিল আদর্শের প্রতি, মুরসির মধ্যেও তেমন একাগ্রতা লক্ষ করা গেছে। সামরিক স্বৈরশাসক সিসি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে থেমে গেলেই পারতেন। নিয়মতান্ত্রিক বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালেও কোনো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু মুরসির বিচার প্রক্রিয়া, অসুস্থাবস্থায় তার চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি ও পরিণতিতে তার মৃত্যু এগুলো মেনে নেয়া যায় না। তার রাজনৈতিক আদর্শের বিরোধী হলেও তার মৃত্যুকে মেনে নেয়া হবে অনৈতিক। কারণ, স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যই হলো অপরের মতকে সম্মান করা এবং আইনের শাসনের প্রতি অনুগত থাকা। সিসি মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে, অস্বাভাবিক বিচারের সম্মুখীন করে এবং অবশেষে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে মিসরের কোনো উপকার করেননি বরং তিনি এক সমৃদ্ধ সভ্যতাকে আরো বিপদাপন্ন করে তুলেছেন। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিবর্তনবাদের বিজয় ধ্বংসের বার্তাই ডেকে নিয়ে আসে। যুদ্ধে মিসরীয় সেনাবাহিনীর কোনো সাফল্য নেই, মুরসির আরোপিত মৃত্যু তাদের ব্যর্থতার তালিকাটি আরো দীর্ঘ করেছে মাত্র।

লেখক : বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *