মৃত্যুদণ্ড একটি বিচারবিভাগীয় হত্যাকাণ্ড – ভারতীয় এক বিচারপতি

[১৯৯৯ সালে রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ড মামলায় যে বেঞ্চটি তিন ঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন সাবেক সুপ্রিম কোর্ট জজ কে টি থমাস সেই বেঞ্চের প্রধান ছিলেন। সম্প্রতি খালিস্তান সন্ত্রাসী দেভিন্দরপাল সিং ভুলারের মামলায় এই মর্মে আবেদন জানানো হয় যে, তিনি ইতোমধ্যে যেহেতু ১০ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন তাই তাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হোক। কিন্তু এই আবেদনটি অগ্রাহ্য হয়। তবে এই মামলার তিনজন বিচারকের মধ্যে একজন ভিন্ন মত পোষণকারী বিচারক ছিলেন বিচারপতি এম বি শাহ, যিনি ২০০২ সালে ঘোষিত ভুলার মামার রায়ে আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দানের বিরোধিতা করেছিলেন।

১৯৯৩ সালে যুব কংগ্রেস নেতা এম এস বিটাকে লক্ষ্য করে গাড়িবোমা হামলা চালানোর দায়ে ভুলারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বিচারপতি কে টি থমাস এ ক্ষেত্রে বিচারপতি এম বি শাহর সাথে একমত পোষণ করতে আগ্রহী, যদিও তিনি রাজিব গান্ধীর খুনিদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। আজকের এই দিনে বিচারপতি থমাস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, যেসব আসামি ২০ বছরের অধিক কারাদণ্ড ভোগ করেছেন তাদের মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দেয়া উচিত।]

চন্দ্রানী ব্যানার্জিকে দেয়া সাক্ষাৎকারের সারসংক্ষেপ নিম্নে দেয়া হলো :
প্রশ্ন : আপনি কি সর্বদা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী ছিলেন?
উত্তর : হ্যাঁ। আমি মনে করি এটা এক ধরনের জুডিশিয়াল মার্ডার তথা বিচার বিভাগীয় হত্যাকাণ্ড। শাস্তিকে সংশোধনধর্মী, প্রতিশোধমূলক নয়। মৃত্যুদণ্ডে আসামির কোনো ফায়দা হয় না। আইন এমন হতে হবে যাতে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মানসিক সংস্কারসাধন করা যায়। এর দ্বারা ক্ষমা করা বোঝায় না। কোনো ধরনের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা কোনো কাম্য বিষয় নয়।

প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন যে, এ পর্যায়ে দেবিন্দর সিং পালকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ঘোষণা করা উচিত?
উত্তর : তিন বিচারকের একটি বেঞ্চ এই মামলার রায় দিয়েছিলেন। এই বেঞ্চের সবচেয়ে সিনিয়র বিচারক এম বি শাহ একটিমাত্র মানদণ্ডে ভিন্ন মত পোষণ করেন। সেটি হচ্ছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী পুলিশের কাছে দেয়া হয়েছে। বিচারপতি শাহ এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ইতিহাস সাক্ষী, পুলিশের কাছে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী কখনো কোনো জোরালো সাক্ষ্য বলে প্রতীয়মান হয়নি। তার মতে, স্বীকারোক্তি জোরজবরদস্তি করে আদায় করা যেতে পারে। বিচারপতি শাহের ওই মতের পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি যে, রাষ্ট্রপতির কাছে যদি একটি নতুন মার্সি পিটিশন দেয়া হয় তাহলে তিনি এসব বিষয় নতুন করে বিবেচনায় আনতে পারেন।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন যে, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী পর্যালোচনা করে দেখার দরকার আছে?
উত্তর : স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে রেকর্ড করা হয়নি। একজন পুলিশ অফিসার তা রেকর্ড করেন। আইনানুযায়ী এটা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, যদি না ওই পুলিশ অফিসার একটি বিশেষ পদমর্যাদার অধিকারী না হন কিংবা অতি অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতিতে তিনি সেটা করে থাকেন। ভুলারের ক্ষেত্রে যদি অপর একজন বিচারক ভিন্ন মত পোষণ করতেন তাহলে তিনি খালাসই পেতেন। এ ধরনের ক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্ত সংশোধনের সামান্যই সুযোগ থাকে। তাই বিচারপতি শাহ যে পয়েন্ট উত্থাপন করেছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সেটা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে নতুন করে মার্সি পিটিশন দেয়া হলে তিনি সেটাকে পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। এটা একজনের জীবনমৃত্যুর প্রশ্ন; এখানে সিদ্ধান্ত সংশোধন করার দ্বিতীয় কোনো সুযোগ নেই।

প্রশ্ন : রাজিব গান্ধী হত্যা মামলার ব্যাপারে এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন যে, ‘মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে এমন একটি বেঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত হওয়াটা আপনার জন্য একটি দুর্ভাগ্যের বিষয়।’ আপনি কি এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেন?
উত্তর : আমি এখানে এর একটি ব্যাখ্যা দিতে আগ্রহী। রাজিব গান্ধী হত্যা মামলাসহ অন্য আরো যেসব মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, সেসব বেঞ্চে সম্পৃক্ত থাকাটা আমার জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয়। আমি সে সিদ্ধান্তের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। কেননা একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। তবে আইন মান্যকারী একজন নাগরিক হিসেবে এবং সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক হিসেবে আমি বহু আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। কেননা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে আমি যে শপথ নিয়েছি সে অনুযায়ী আমি তা করতে বাধ্য।
প্রশ্ন : আপনি আরো বলেছেন যে, রাজিব গান্ধী হত্যা মামলার আসামিকে ফাঁসি দেয়াটা সংবিধান পরিপন্থী….।
উত্তর : ২০ বছর জেল খাটা মানে একটা লোকের প্রায় দু’বার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করা। এত দীর্ঘ সময় কারোভোগ করার অর্থ কারান্তরালে গোটা জীবনটা কাটিয়ে দেয়া। অতএব, এত বছর কারান্তরালে কাটানোর পর কাউকে ফাঁসি দেয়াটা অসাংবিধানিক। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বিকল্প সাজা দেয়া উচিত। বিকল্পটি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

ফৌজদারি কারাবিধি (CrPC) ৪৩৩(এ) ধারার অধীনে একটা বিধান আছে যেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো দণ্ড হ্রাস বা লাঘব করতে পারেন। আমার প্রস্তাব হচ্ছে যারা ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন তাদের ক্ষেত্রে এ ধারাটা প্রয়োগ কেন করা হয়। আমি আবারো বলছি, শাস্তি হতে হবে সংশোধনধর্মী।

 

Loading

উড়ন্ত পাখি

About উড়ন্ত পাখি

আমি কোন লেখক বা সাংবাদিক নই। অর্ন্তজালে ঘুরে বেড়াই আর যখন যা ভাল লাগে তা সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *