মুসলমান

 

আমরা মুসলমান। আমরা সেই মুসলমান। যারা একদা পৃথিবীর বুকে শির চির উন্নত করে তুলেছিলো –  আমরা তাদেরই বংশধর – আমরা সেই মুসলিম। যে মুসলিমের হুঙ্কারে থর্‌ থর্‌ করে কাঁপতো ব্রক্ষ্মান্ড,  ভীত   সন্ত্রস্থ হতো ধরণীর শাসক-মন্ডলী, শির নোয়াত আরবের দুর্দন্ত তস্কর। কিন্তু আজ? আজ আমাদের স্থান কোথায়?  

  ইসলাম। ইসলাম শব্দের বাংলা অর্থ শান্তি, সমর্পণ। কিন্তু আজ আমরা শান্তিকে পরিত্যাগ করে অশান্তিকে আঁকড়ে ধরেছি। অথচ এই শান্তি জগতের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে ভোগ করতে হয়েছে কত লাঞ্ছনা, কত প্রতারণা, কত অত্যাচার, অনাচার-অবিচার, কত নিমক-হারামী, কত বিশ্বাস-ঘাতকতা, কত আঘাত – বিধর্মীর রোষ ও হিংসা। সে সমস্ত লোমহর্ষক কাহিনী শ্রবণ করলে আজও সারা শরীর শিউরে উঠে। কিন্তু তারা কারো নিকটে কাপুরুষের মত মাথা নত করেনি। বলতে কি তারা কারো কাছে মাথা নত করতে শেখেনি। বিশ্বের যে কোন হিংসুক জাতির উপর চোখ রাঙ্গাতে দ্বিধা বোধ করেনি। নিজেদের বিরুদ্ধে গঠিত যে কোন ষড়যন্ত্রকারীদের শায়েস্তা বিধানে কখনও পশ্চাদপদ হয়নি। তারা দুর্গম পৃথিবীতে বুক ফুলায়ে,  শির উঁচু করে চলতে শিখেছিলো। কত সুদৃঢ় পরাক্রমকে দৃঢ় করে পরাভূত করে বিশ্বের বুকে একচ্ছত্র সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলো এবং এক অভিনব পদ্ধতিতে শাসন করেছিলো । মুষ্টিমেয় মুসলমান অবনীর বুকে এত বড় সাম্রাজ্য গঠন করলো –সে কিসের জোরে? শুধু ঈমান বা তাওহীদের বলে – মহাগ্রন্থ কুরআনের নির্দেশে। তাই মহাবীর তারীক বলেছেন – আমরা মুসলমান বা আল্লাহর ধর্মাবলম্বী আর সমগ্র বসুন্ধরাটা আল্লাহরই তৈরী। সুতরাং সারা বসুধাই আমাদের নির্মুক্ত বাসস্থান। তারা যে শুধু মুসলিম নামের জোরেই পৃথিবীতে আদর্শ স্থান অধিকার করেছিলো, তা নয়। তাদের ছিল উন্নত মনোভাব, পবিত্র আচার- ব্যবহার, উন্নত মস্তিস্ক প্রসূত রীতি-নীতি। শুধু নামের জোরে অনন্তায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না। পূর্ব পুরুষদের আদর্শ গুণাবলী নিজের জীবনে রূপায়িত এবং কার্যে পরিণত করে উন্নত মনোভাব আর উদার মনোবৃত্তি নিয়ে প্রগতিশীল বিশ্বে উন্নত হওয়া যায় – ইহা জগৎ স্বীকার করতে বাধ্য।  

  মুসলমান ধর্মের আদি জন্মস্থান আরবদেশে। সেখান থেকেই পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে এটা বর্ধিষ্ণু ধর্ম।  পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই যেখানে মুসলমান নেই। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী হযরত মহম্মদ (ﷺ)। স্মরণ করো তাঁর বেদনাহত জীবনী এবং তাঁর চারদিকের রুদ্র  পরিবেশ। কত কষ্ট তাঁকে তিলে তিলে সহ্য করতে হয়েছে, কত অত্যাচার-অনাচার, উৎপীড়ন, প্রতারণা, লাঞ্ছনা, হত্যা প্রচেষ্টা, আঘাত, ইট-পাথর নিত্য-নৈমিত্তিক সহ্য করেছেন তার ইয়াত্তা নেই। আপনার হৃদয়-শোণিতে পুষ্ট করেছেন এই ইসলাম। আল্লাহর আদেশ বা কুরআনের নির্দেশ নিজের জীবনে রূপদান করে জগতের মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন আদর্শ জীবন যাপন পদ্ধতি। তাইতো তিনি রাহমাতুল্লিল  আলামীন। তাঁর মত ধৈর্যশীল মহাপুরুষ পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। বলতে কি তিনি ধৈর্য বলেই এমন দায়িত্ব সুনিপুনভাবে সম্পাদন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর জীবনী থেকে এই শিক্ষাই পাই যে, একজন অসহায় দরিদ্র লোকও পৃথিবীতে যুগান্তর আনতে পারে। তবে তাকে পদে পদে নানা প্রকার কষ্ট ও দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়। এমন কি জীবন পর্যন্তও বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু দয়াময় আল্লাহ তাকে সর্বদাই সাহায্য করতে প্রস্তুত থাকেন।

  স্মরণ করো মুসলমানদের সাম্রাজ্য বিস্তারের চমকপ্রদ ইতিহাস। সামান্য মাত্র কয়েকটি খেজুর এবং এক মশক পানি সম্বল করে পাড়ি দিয়েছেন সুবিশাল দিগন্ত বিস্তীর্ণ মরুভূমি, দুর্বার দুর্লঙ্ঘ পর্বতমালা। মুষ্টিমেয়  মুসলমান বীর  বিরাট সুসজ্জিত সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন – কখনও ভ্রূক্ষেপ করেননি। যেখানেই  দিগ্বিজয়ে যেতেন, সেখানেই একরোখা হয়ে যেতেন – মরণকে পরওয়া করতেন না। পরের জন্য নিজের জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। তাঁদের একতা ছিল সুদৃঢ়। এই জন্যই তাঁরা দেশের পর দেশ জয় করেছেন – কোথাও পরাজিত হননি। মাত্র সতেরো জন বীর মুসলমান যোদ্ধা নিয়ে বিনা বাধায় বিশাল বঙ্গদেশ জয় করেছিলেন ইখতিয়ার উদ্দিন বিন্‌ বখতিয়ার খিল্‌জি  – অপরপক্ষে লক্ষ্মণ সেনের বিরাট বাহিনী থাকা সত্বেও যশোরের একডালা দূর্গে পলায়ে আত্মরক্ষা করলেন। ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন্‌ ইউসুফের আদেশে  মোহাম্মদ বিন্‌ কাশিম ৭১১ সালে সিন্ধু আক্রমন করেন। অত্যাচারী রাজা দাহিরের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজা দাহির  পরাজিত ও নিহত হন। মিশরের গভর্ণর মুসা বিন্‌ নুসাইরের আদেশে তরুণ সেনাপতি তারিক বিন্‌ জিয়াদ স্পেন আক্রমন করেন। অসম যুদ্ধে রডারিককে পরাজিত করে স্পেন দখল করে নেন। সুলতান সালাহ উদ্দিন আইউবী খৃস্টান সেনাপতি রিচার্ডকে উদারতা দিয়ে পরাজিত করে জেরুযালেম দখল করেন। মুসলমানদের  রীতি-নীতি  ব্রক্ষ্মান্ডের চারদিকে সাদরে গৃহিত হয়েছে।  বিনা যুদ্ধে বহু রাষ্ট্রপতি অধীনতা স্বীকার করেছেন।

  লোকে বলে বিজ্ঞান সম্পর্কে মুসলমানেরা অজ্ঞ। আমি বলি, তিনি মুসলমানদের সাথে পরিচিতই নন। যদি মুসলমানেরা বিজ্ঞানই না জানত তবে এ্যালজেব্রা এলো কোথা থেকে? কে তার উদ্ভাবক?  আলজাবেরের নাম কে না জানে। জ্যামিতির জন্মস্থান মিশরে। সেটা কি মুসলিম রাষ্ট্র নয়? ইবনে সিনার মত ডাক্তার আজও পৃথিবীতে জন্মেনি। আল বিরুনীর মত জগত বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আজও পৃথিবীর ইতিহাসে কিংবদন্তী হয়ে আছেন। তাঁর জন্ম স্থান ইরান আর তাঁর পুরো নাম আবু রায়হান আল বিরুনী। তিনি একাধারে ছিলেন বহু শাস্ত্রজ্ঞ (Poly math), ভারত বিষয়ক বিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা (Founder of Indology), তুলনামূলক ধর্মের জনক (Father of Comparative religion), আধুনিক ভূ-গণিতের জনক (Father of Geodesy), গণিতজ্ঞ (Mathematician), প্রথম নৃতত্ববিদ (Astronomist), জ্যোতির্বিজ্ঞানী (Astronomist), কালানুক্রমিকজ্ঞ (Chronologist) ও ভাষাবিদ্যাবিদ (Linguist)। আর পৃথিবীতে এমন জাতি নেই যারা জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া এত বড় বড় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মহাগ্রন্থ কুরআনের সাহায্য ব্যতীত এ পর্যন্ত ভুবনের বুকে একটি আবিষ্কারও সম্ভব হয়নি। হযরত মহম্মদ (ﷺ) একজন বড় বৈজ্ঞানিক। তাঁর সময়ে বিজ্ঞানের চর্চ্চা মোটেই ছিলো না। তবুও তিনি যে সমস্ত দ্রব্য হারাম বা অবৈধ করে গিয়েছেন তা এখন বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গিয়েছে যে, যে সমস্ত খাদ্য হারাম তা স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর।

  পূর্বের মুসলমানেরা ধনৈশ্বর্যের বা যশের জন্য লালায়িত ছিলেন না। তাঁরা কর্তব্য সম্পাদনের জন্য লালায়িত ছিলেন। যদি তাঁরা সম্পদের জন্যই আগ্রাহান্বিত হতেন তবে হযরত মহম্মদ(ﷺ), হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), দিল্লীর সম্রাট নাসির উদ্দিন প্রমুখ মনীষীগণ দরিদ্র থাকতেন না – বিশাল সম্পত্তির অভিভাবক হতেন। হযরত ওসমান (রাঃ), হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ) হাজী ও মহম্মদ মহসীনের মত সম্পদশালী লোক সমস্ত ধন-সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে  দীন-দরিদ্র সাজতেন না। তাঁরা ছিলেন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দীন-দুঃখীর দুঃখে ব্যথিত, ন্যায় নিষ্ঠের প্রতি  অনুগত, ভাল ব্যক্তির পরম মিত্র আর অরির প্রতি পাষাণের মত কঠিন। আগেকার দিনে মুসলমানেরা কোন বন্ধু বান্ধব, প্রিয়জন বা অন্য কাউকে উপহার দিতে হলে কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ভ্রমণ কাহিনী, বিজয় কাহিনী, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা, মহাপুরুষদের জীবনী প্রভৃতি কিনতেন। কিন্তু আজ? আজকের দিনে উপহার দেয়া হয় রাস্তা ঘাটের কদর্য প্রেমের কাহিনী। ভ্রমণ কাহিনী, আদর্শ পুরুষদের জীবনী, বিজয় কাহিনী, কুরআন- হাদীসের কোন কদর নেই। সেই জন্যই আজ মুসলমানেরা অবনতির অতল তলে হাবু ডুবু খাচ্ছে। মুসলমান জাতি পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্পকলায় হীন প্রতিপন্ন হয়েছে।

 ব্রাক্ষ্মণের ছেলে ব্রাক্ষ্মণ হয়, খৃস্টানের সূত খৃস্টান হয়, ইহুদী তনয় ইহুদী হয় কিন্তু মুসলমানের পুত্র মুসলমান হয় না, যদি না সে ইসলামের মূল স্তম্ভ ঈমান ও মুসলমানের আচার-ব্যবহার লালন করে। আজ আমরা কুরআন-হাদীসের   আদেশ-নিষেধ এবং মুসলমানের আচার-আচরণ ও রীতি-নীতি স্বীকার বা না মেনে আমরা এমন  একটি ধর্ম  পালন করছি যার কোন নির্দিষ্ট নাম নেই, পিছনে কোন অদৃশ্য শক্তি নেই – যার কোন প্রতিষ্ঠাতা নেই। কিন্তু আজ দুঃখের বিষয় যে, পৃথিবীর উন্নত দেশের পর্যায়ে মুসলিম রাষ্ট্র একটিও পড়ে না। 

 যতোদিন পর্যন্ত কুরআন-হাদীসের আদেশ নিষেধ মেনে না চলবো ততোদিন পর্যন্ত আমাদের প্রগতি প্রত্যাশা মাত্র। অথচ এক সময়ে এই মুসলিম রাষ্ট্রই জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার ছিলো।    

জোতপাড়া

জুলাই ৫, ১৯৬৪   

Comments are closed.