মুসলমানদের অধঃপতন : শত্রুদের ষড়যন্ত্র নাকি নিজেদের কৃতকর্মের ফল হিসেবে আল্লাহর শাস্তি?

উত্তর:

মুসলমানদের অধঃপতন : শত্রুদের ষড়যন্ত্র নাকি নিজেদের কৃতকর্মের ফল হিসেবে আল্লাহর শাস্তি?মুসলামানেরা প্রায় এক হাজার বছর জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা-দক্ষতা, রাজনীতি ও সম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে পৃথিবীর সুপার পাওয়ার হিসেবে ছিল। এই রাজত্ব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন, আবার আল্লাহই তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন।

দুনিয়ার জাতিগুলোর উত্থান-পতনে আল্লাহর নীতি হচ্ছে– মর্যাদার আসনে আসীন করবার জন্যে তিনি নিজের পরীক্ষাবিধি অনুসারে যাকে ইচ্ছা তাকে নির্বাচিত করেন। কিন্তু যখন একবার নির্বাচিত করে ফেলেন, তখন তার এই অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না সে জ্ঞান ও চরিত্রে নিজেকে চূড়ান্ত অধঃপতনে নিয়ে যায়।

মুসলমানদের সঙ্গে আরেকটি ব্যাপার ঘটেছে। তাদের মূল সর্বদাই আরব ছিল৷ আরবেরা অধিকাংশই ইসমাইলি বংশধারার, যা ইবরাহীমি বংশের একটি শাখা। অতএব তাদের ওপর আল্লাহর এই নীতিরও প্রয়োগ হয়, যা কুরআনে ইবরাহীমি বংশের ব্যাপারে বলা হয়েছে। তা এই যে, তারা যদি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে বিশ্বের নেতৃত্ব তারা দেবে। আর যদি সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়, তাহলে অপমান ও পরাধীনতার শাস্তি তাদেরকে দেওয়া হবে।

অতএব মুসলামানদের বর্তমান অবস্থার জন্য শত্রুদের ষড়যন্ত্র দায়ী নয়, যেমনটি অনেকে মনে করে। বরং তাদের কৃতকর্মই এখানে মূল দায়ী। দুনিয়ার জাতিগুলোর উত্থান-পতনে আল্লাহর নীতি এবং ইবরাহীমি বংশের ব্যাপারে বিশেষ নীতির আলোকে মুসলামানদের অধঃপতনের কারণ মোটাদাগে আমরা তিনটি ধরে নিতে পারি–

১. বিগত কয়েক শতাব্দী থেকে মুসলামানেরা তাদের মতবিরোধের মীমাংসায়, হক-বাতিলের ফায়সালায় ও ধর্মীয় গবেষণায় কুরআনকেই মানদণ্ড এবং সব কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রক হিসেবে নেয় নি৷

২. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকে দূরে সরে থেকে মুসলমানদের অধিকাংশ মেধাবীরা দর্শনশাস্ত্র ও তাসাউফশাস্ত্র নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। অথচ দর্শন ও তাসাউফ যে প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করে, আল্লাহর কিতাব অকাট্য প্রমাণ হয়ে সেগুলোর জবাব নিয়ে নাযিল হয়ে গিয়েছে। দর্শন ও তাসাউফ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে একদিকে তারা কুরআনের আধ্যাত্মিক আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অপরদিকে বিজ্ঞানের পার্থিব উন্নতি থেকেও বঞ্চিত হয়েছে।

৩. মুসলমানেরা তাদের চরিত্র গঠনে সীমাহীন উদাসীনতা দেখিয়েছে৷ যে কারণে মুসলমানদের সমাজে আজ মিথ্যা, অসততা, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা, চুরি, ডাকাতি, দুর্নীতি, সুদখোরি, ওজনে কম দেওয়া, অপবাদ, ওয়াদাখেলাপি, যাদু-টোনা, একে অন্যকে কাফের-ফাসিক-গোমরাহ বলা, কবরপূজা, শিরকি প্রথা, অনর্থক বিনোদন এবং এ জাতীয় অপরাধগুলো এত বেশি ব্যাপক হয়েছে যে, বিস্মিত হতে হয়৷ বনী ইসরায়েলের এই সব অপরাধ ছিল, যেগুলোর কারণে আল্লাহর নবীরা তাদের ওপর লানত করেছেন এবং স্থায়ীভাবে আল্লাহর রহমত থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ মুসলমানেরাও এই সীমায় পৌঁছে গিয়েছে।

মুসলামানদের পতন এ সব কারণে হয়েছে এবং এটা আল্লাহর শাস্তি। এই শাস্তি থেকে তাদের মুক্তি পেতে হলে প্রতিরোধ আন্দোলন বা সশস্ত্র যুদ্ধ দিয়ে কিছু হবে না৷ কেননা তা হবে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সঙ্গে লড়াই, যিনি তাঁর প্রচণ্ড যুদ্ধবাজ বান্দাদেরকে তাদের ওপর নিয়োজিত করে দিয়েছেন। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে বরং তাদেরকে ওই সব অপরাধ দূর করতে হবে, যেগুলোর কারণে আল্লাহ তাদেরকে এই শাস্তি দিচ্ছেন৷

কুরআন মেলে দেখুন, বাবিল শহরে বনী ইসরাইলের বন্দিত্বের যুগে যখন নবী এসেছেন, রোমান শাসকদের সময়ে যখন নবী এসেছেন, কখনও নবীগণ বনী ইসরায়েলকে সশস্ত্র যুদ্ধ বা প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা বলেন নি। বরং বনী ইসরায়েলের অপরাধতালিকা তাদেরকে শুনিয়েছেন। বাবিল ও রোমের শাসকদের ব্যাপারে একটি নিন্দাসূচক কথাও কুরআনে নেই। এই অপরাধতালিকা মুসলমানদেরকেও শোনানোর আজ সময় হয়েছে। কেননা আল্লাহর যে প্রতিশ্রুতি বনী ইসরায়েলের প্রতি ছিল, সেই প্রতিশ্রুতি মুসলমানদের প্রতিও রয়েছে– ‘তোমরা আমার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কর, আমি তোমাদের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করব।’ ‘যদি সে রাস্তায় আবার চলো, আমিও ওই রাস্তায় চলব৷’

মূল : উস্তাদ জাভেদ আহমদ গামেদি। সংক্ষিপ্তকরণ ও অনুবাদ : শাইখ উমর ফারুক

Loading

উড়ন্ত পাখি

About উড়ন্ত পাখি

আমি কোন লেখক বা সাংবাদিক নই। অর্ন্তজালে ঘুরে বেড়াই আর যখন যা ভাল লাগে তা সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *