মিসরে সেনা শাসনের মুসাবিদা

মিসরে সামরিক বাহিনী আবারও মিসরের গণতান্ত্রিক টুপি খুলে সামরিক টুপি পরিয়ে দিয়েছে।মিসরিয় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মেদ মুরসি কে বুধবারের ক্ষমতাচ্যুত করে মিশরের সামরিক বাহিনী তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বারে মত নিজেদেরকে মিসরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে নিজেকে জাহির করেছে।বলা বাহুল্য,স্বাধীনতার পর থেকেই মিসর ও সামরিক বাহিনী  সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে।কথিত আন্দোলনকারী ও সরকার মুখোমুখি উছিলায়ে বুধবার সামরিক বাহিনী মুরসিকে ব্যর্থ ঘোষণা করে,এবং সফট ক্যু মাধ্যমে মুরসি সরকারকে উৎখাত(deposed) করে সামরিক বাহিনী।এদিকে,মোবারকে পতনের পর সামরিক বাহিনী নিজেদেরকে জাতীয় অখণ্ডতা তত্ত্বাবধায়ক (guardian) এবং মানুষের স্বাধীনতার নিরপেক্ষ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিজেকে চিত্রিত করার প্রচেষ্টায়ে লিপ্ত।কিন্তু মিসরের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,সামরিক বাহিনী নুন খেয়ে নেমক হারামি অভ্যাসটা বেশি এবং ক্ষমতার মসনদের দিকে তাদের শ্যোন দৃষ্টি বারবার আছড়ে পড়েছে।

 

মিসরের সামরিক বাহিনীর স্বাধীনতা, বিপ্লব এবং পরাজয়

মিসর ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও ব্রিটিশ সরকার আরও ২৫ বছর নিজেদের অধিকৃত করে তার সামরিক বাহিনী জন্য।সে সময় মিসরের মোহাম্মদ আলী পাশা ইউরোপীয় আধুনিকতা ও সেক্যুলার আদর্শের রাজনীতির বাস্তবায়ন শুরু হলে তার প্রভাব পড়ে মিসরের সামরিক বাহিনীর উপর।তথাপি সে সময় মিসরে সামরিক বাহিনী সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল এবং রাষ্ট্রই কার্যে তাদের ভূমিকা ছিল সীমিত।এ সম্পর্কে স্ট্যানফোর্ড উনিভাসিটির মিডল ইস্ট হিস্টরি প্রফেসর জোয়েল বেনিনি বলেন “ মিশরীয় সেনাবাহিনী, দুই বিশ্ব যুদ্ধ মধ্যে সময়কালে একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিষ্ঠান ছিল”।দ্বিতীয় বিশ্বে যুদ্ধে অল্প সংখ্যক মিশরীয় সৈন্য  ব্রিটিশ বাহিনীর পাশাপাশি অংশগ্রহণ খাতা নাম লিখায়ে।

কিন্তু মিসরের সামরিক বাহিনী এই ভূমিকা এবং অবস্থান সম্পূর্ণ ভাবে পরিবর্তিত হয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল হাতে পরাজিত হওয়ার পর থেকে।এ যুদ্ধের পরাজয় জের ধরে ১৯৫২ সালে জামাল আবদেল নাসের নেতৃতে সামরিক বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা সামরিক অভ্যুত্থান মাধ্যমে বাদশাহ ফারুককে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন।এই অভ্যুত্থান মধ্যে দিয়ে আধুনিক মিশরের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সহজাত দক্ষতা সম্পন্ন এবং জনপ্রিয় নাসের এর অধীনে, মিশরীয় সেনাবাহিনীর একটি যোগ্য সামরিক বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠে।নাসের ক্ষমতার গ্রহণ করে ইসলামি ব্রাদারহুডসহ সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় ব্যবস্থা করেন।নাসের সেসময় ব্রাদারহুডের নেতা বিশ্বখ্যাত ইসলামি পণ্ডিত সাইয়েদ কুতুব ও আবদুল কাদের আওদাহসহ ছয় জনকে ফাঁসি দেন এবং ব্রাদারহুড হাজার হাজার নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করেন।
এদিকে নাসের ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে ব্যয়বহুল অভিযান পরিচালনা কর পর,নাসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আরব জোট ১৯৬৭ সালে ইসরাইল বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।এ যুদ্ধে মিসর সামরিক বাহিনী কাছ থেকে সমগ্র সিনাই উপদ্বীপ নিয়ন্ত্রিন নিয়ে নেয় ইসরাইল সামরিক বাহিনী।এ যুদ্ধে মিশরীয় সেনাবাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা ব্যাপক মাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যু হলে তার উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট হন আনোয়ার সা’দাত।আনোয়ার সা’দাত সাময়িক বাহিনীকে সংস্কার দ্বারা ইসরাইল সাথে ছয় দিনের যুদ্ধের ক্ষতটা সারিয়ে তোলেন।অক্টোবর ১৯৭৩ সালে সা’দাত নেতৃত্বাধীন তৃতীয় আরব জোট  সিনাই উপদ্বীপ পুনরুদ্ধার অভিযান শুরু করে ইসরাইলে বিরুদ্ধে।তিন সপ্তাহ ধরে চলা এ যুদ্ধে মিসর সামরিক বাহিনী উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে এবং ফলশ্রুতিতে মিশর পরে ১৯৭৮  ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি মাধ্যমে সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পায়।সিনাই উপদ্বীপ পুনরুদ্ধার মিশরে সামরিক বাহিনীকে রক্ষাকর্মী হিসেবে সুনাম পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।এখানে উল্লেখ্য যে,সা’দাত আবার,১৯৭৭ সালে দেশটি আবার বহুদলীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেন।

ইসরাইলের সাথে শান্তি চুক্তির পর আততায়ীর হাতে সা’দাত নিহত হলে ১৯৮১ সালে জেনারেল হোসনী মোবারক সাদাতের স্থলাভিষিক্ত হন।মোবারক ক্ষমতা গ্রহণ করার পর,সামরিক বাহিনীকে, আমেরিকান সাহায্য দ্বারা  আধুনিকায়ন ও প্রসারিত করতে থাকেন।মোবারক সা’দাতের মৃত্যুর জন্য ব্রাদারহুডকে হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার ও নির্যাতনের করেন এবং ব্রাদারহুড নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করতে পারে সে জন্য বিভিন্ন আইন পাস করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন।এদিকে ব্রাদারহুড ২০০৫ সালে মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৮৮টি আসন লাভ করে।সেই সাথে ব্রাদারহুড উপর নেমে আসে গ্রেফতার, নির্যাতন ও হয়রানি।

২০০৫ সালে সংবিধান সংশোধন করে জনগণের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ২০০৭ সালের আরেক সংশোধনীর মাধ্যমে সেক্যুলার ভিত্তিতে রাজনীতি দল ব্যতীত অর্থাৎ ধর্ম,লিঙ্গ বা জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তিতে কোনও রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না।এই আইনের বেড়া জ্বালে ব্রাদারহুডের নির্বাচনে অংশ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করাই মূল লক্ষ্য ছিল।কিন্তু ২০০৫ সালে নির্বাচিত সেক্যুলার সরকার এবং সেক্যুলার মতবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল গুলো মধ্যে মিসরের জনগণের মতামতের প্রতিফলন না হওয়া এবং গণতন্ত্রায়নে কার্যকর ভূমিকা না রাখার দরুন মিসরের রাজনৈতিক সমাজের কাছে দূরআত্মিয় বলে গণ্য হতে থাকে ।অন্যদিকে মুসলিম ব্রাদারহুডের ইসলামিক মূল্যবোধের চিন্তা ঐতিহ্যের সাথে সমন্বয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড,দিনে দিনে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ২০১১ আরব বসন্তের ঢেউয়ে মিসরের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছড়ে পড়ে পরিবর্তনের নবদোল। হোসনি মোবারক অধ্যায়ের ইতি ঘটে,এবং মিসর নতুন করে সামরিক বাহিনীর হাতে সোপর্দ হয়।দুবছরের শাসনে মিসরকে লুটপাটে কারখানায়ে পরিণত করে সামরিক বাহিনী।নতুন করে মিসর জনগণের প্রতিবাদ বিক্ষোভের জ্বলন্ত কড়াইতে পরিণত।পরবর্তীতে নির্বাচনে সফল গণতান্ত্রিক শাসনের উত্তরণ ঘটে মিসরে।সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়ে  মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি জয়লাভ করে এবং সরকার গঠনের এক বছরের মাথায়ে কথিত বিপ্লবের নামে মিসরের সামরিক বাহিনী তাদের ভোল পাল্টে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত মুরসি সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে,এবং মিসরের প্রধান বিচারপতি আদলি আল-মনসুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে।

তথ্য আহরণ: তুরস্ক মিসর ও বাংলাদেশ : সেক্যুলার-ইসলামপন্থী দ্বন্দ্ব-নরুল আজিম
The Egyptian Military’s Huge Historical Role by Anna    Kordunsky and Michael Lokesson

Loading


Comments

মিসরে সেনা শাসনের মুসাবিদা — 1 Comment

  1. অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ। আমরা ভয় হয় শেষ পর্যন্ত মিশরও কি সিরিয়া, ইরাকের অবস্থায় পড়বে?

মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *