মিথ্যার তেলেসমাতি

মিথ্যা। মিথ্যা আবার কি? যা সত্য নয় – অসত্য। মিথ্যা কে বলে? মিথ্যাবাদী। মিথ্যা কেনো বলা হয়? কার্যোদ্ধারের জন্য। মিথ্যা ছাড়া কি কার্যোদ্ধার হয় না? হয়, তবে দেরীতে। মিথ্যা ফৌজদারী আর সত্য আদালত। অর্থাৎ মিথ্যা ব্যবহার করলে যতো তাড়াতাড়ি কাজ সমাধা হয়, সত্য দ্বারা তা হয় না। কাজেই মিথ্যা এ্যালোপ্যাথিক ঔষধ আর সত্য হোমিওপ্যাথিক। অনেক সময় সত্য দ্বারা কার্যোদ্ধার হয় না মিথ্যা দ্বারা অতি সহজেই হয়। প্রয়োগ কৌশল জানলে মিথ্যা সত্যের চেয়ে অধিক কার্যকরী হয় এবং শিঘ্র ফল লাভ সম্ভব হয়। সত্যের মাথা ন্যাড়া। কারণ তার তেলের একান্ত অভাব – তেল সংগ্রহ করাও তার পক্ষে দুঃসাধ্য। সে জন্য সে অন্যকেও তেল দিতে পারে না বলে তার সমূহ বিপদ। অপরদিকে মিথ্যার মাথা তৈলাক্ত – সে সহজে তেল সংগ্রহ করতে পারে এবং প্রবল বাধা থেকেও সে সহজে পিছলে পড়তে পারে। তাই সত্যবাদী যেখানে মার খায়, অপদস্ত হয়, মিথ্যাবাদী সেখানে সফল হয়, বাহাদুরী দেখায়। সত্যবাদী ঘৃণ্য  – মিথ্যাবাদী বরেণ্য।

 এটা মিথ্যারই রাজত্ব। তাই বলে আমি রাজদ্রোহী বা দেশদ্রোহী কোনটাই নই এবং তা হওয়াও আমার অভিপ্রায় নয়। আমি যা বলছি সবই মিথ্যা। আমি নিজেই মিথ্যাবাদী। তাই বলে এ নয় যে, আমি মিথ্যা বলছি।  আমি নিজে মিথ্যাবাদী হতে পারি, কিন্তু আমি যা পরিবেশন করছি, তা সবই সত্য কথা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন, “তৈল দ্বারা যতো কাজ হয়, অন্য কিছুতে তা নয়।“ কিন্তু কেউ কি বলতে পারে সে তৈল কোথায় পাওয়া যায়? সে তেলের উৎপাদন স্থল এই মিথ্যা নামক ঘানীতেই।

 মিথ্যা স্তোত বাক্যে বশীভূত করে যে কোন লোকের নিকট হতে যে কোন কার্য উদ্ধার করা যায়। মিথ্যা আশায় সূর্যের চারদিকে অবিরাম গতিতে ঘুরছে এ পৃথিবী – যুগ যুগান্ত থেকে প্রদক্ষিণ করছে চাঁদ পৃথিবীকে। লাভের কি কিছু সম্ভাবনা আছে বা হয়েছে? না, তবু ঘুরছে। আশায় আশায় ঘুরতে ঘুরতে এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, সে অভ্যেস আর ত্যাগ করতে পারছে না এখনও। তাই এ কথা সত্য যে, মিথ্যাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে সারাটি জগত।

 যে সমস্ত গল্প-কাহিনী রচিত হয়েছে সব কিছু এই মিথ্যাকে আশ্রয় করেই। মিথ্যার শক্তি প্রখর, আর সত্যের  শক্তি স্তিমিত। তাই সত্যের জ্যোতি দিনে দিনে নিস্প্রভ হতে চলেছে এবং সেখানে মিথ্যার দীপ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে তার পরিপূর্ণ দীপ্তি নিয়ে।  

মিথ্যা মুখরোচক। সকলের মন আকৃষ্ট করবার ক্ষমতা এর আছে। সকলকে পূর্ণ আনন্দ দেয়ার ক্ষমতাও এর রয়েছে। কিন্তু সত্য নিঃরস, কর্কশ, কটূভাষী – সকলের কাণে যেন বিষের মত লাগে। চাটুকারের  চাটুকারিতায় আমরা সহজেই বিমোহিত হই – যতোই শুনি শোনার আকাঙ্খা ক্রমেই বেড়ে চলে – মার্শালের ‘ক্রম হ্রাস বিধি’ এখানে খাটে না। কিন্তু সত্য কথায় রস নেই বলে স্বল্প সময়েই আমরা বিষিয়ে উঠি – মন বসে না, আনন্দ দিতে পারে না বলে। আরব্য উপন্যাস পড়ে যতো আনন্দ মেলে ধর্ম গ্রন্থ পড়ে তার সিকিও নয়। ধর্ম গ্রন্থে আছে পারলৌকিক একঘেঁয়ে আশা-আকাঙ্খার কথা; অন্যদিকে উপন্যাসে আছে ইহলৌকিক আনন্দ-উল্লাস ও পাওয়া না-পাওয়ার আনন্দ-বেদনার কথা। আমার মনে হয়,মানুষ বাস্তবকে যতোটা ভালবাসে  অবাস্তবকে ততোটা নয়। এজন্যই বোধ হয় বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ স্বর্গের অমৃতের চেয়ে মর্তের ধূলি, তৃণ, লতাগুল্মকেই ভালবেসেছিলেন বেশী করে। মানুষ রস সন্ধানী – রহস্যের দুয়ারের ভিখারী।  মিথ্যাকে  মিথ্যা জেনেও তা ত্যাগ করতে পারে না – আরও দৃঢ় আলিঙ্গন পাশে আবদ্ধ করে। অন্যদিকে মানুষ সুযোগ সন্ধানী – বড় হওয়া তার স্বভাবজাত ধর্ম। কিন্তু অন্যকে বশ না করে বড় হওয়া যায় না। আবার অন্যকে বশ করতে হলে মিথ্যা স্তোত বাক্য দ্বারা তাকে নিজের চাইতে এমন কি সবার চাইতেও বেশী বড় করে তুলে ধরতে হবে – যাতে সে তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তার প্রার্থনা মনজুর করে। স্তোত বাক্য ছাড়া কারো সর্বনাশ করা যায় না। যদিও করা যায় তাতে বিপদের সম্ভাবনা থাকে ও বেগ পেতে হয়।

টাকা দিয়ে যে কাজ না হবে, মিথ্যা দিয়ে তার চাইতে বেশী কাজ হয়। শুধু কথায় চিড়া ভিজে না এ কথাও সত্য। তবু দেখা যায় সমাজের নিম্ন স্তর থেকে অফিস- আদালত পর্যন্ত মিথ্যা প্রশংসা এবং তাতে কাজও ত্বরান্বিত হয়। বড় লোক হতে হলে অন্যকে ধোকা দেয়া শিখতে হবে এবং শত মুখে মিথ্যা দ্বারা নিজেকে সত্যবাদী করে তুলতে হবে – নচেৎ কেউই তাকে বিশ্বাস করবে না। কারণ মিথ্যাবাদীকে কেউ বিশ্বাস করে না। তাই বলে এ কথা সত্য নয় যে, যাঁরা বড় লোক আছেন বা হচ্ছেন, তাঁরা ধোকা দিয়ে হয়েছেন বা হচ্ছেন।

  শেক্সপীয়রের ‘ম্যাকবেথ’ এ দেখতে পাই ম্যাকবেথ রাজ্যের লোভে রাজা ডানকানকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করে এনে রাতে গলায় কৃপাণ বসিয়ে দিয়েছে। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’তেও এর প্রমাণ মেলে। আব্দুল্লাহ বিন জেয়াদ এজিদের টাকার লোভে নবী-দৌহিত্র মহাবীর হোসেনকে মিথ্যা পত্র লিখে কারবালায় ডেকে এনে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। সিরাজ সেনাপতি মীর জাফর মিথ্যা অজুহাতে যুদ্ধ না করে বাংলার স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়েছে পলাশীর আম্র কাননে লর্ড ক্লাইভের কাছে। মিথ্যার যে এতো ক্ষমতা অতীত                                         

কারো সাথে ঝগড়া বা কলহ বাধাতে চাইলেও মিথ্যার প্রয়োজন। কাউকে জব্দ বা অপমানিত করতে হলে এর আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। সত্যবাদীকে অপদস্থ করতে এর ক্ষমতা অপরিসীম। মিথ্যা না থাকলে পৃথিবীতে ঝগড়া-বিবাদ থাকতো কিনা এতে সন্দেহের অবকাশ আছে। মিথ্যার ক্ষমতা বৈদ্যুতিক শক্তির চাইতেও বেশী। কোন মহাপুরুষ বলেছেন, ‘একটি মিথ্যা কথা একশ’ বার বললে সেটা সত্যে পরিণত হয় এবং একটি জ্বলন্ত বাস্তব সত্যকে একশ’ বার মিথ্যা বলে মিথ্যায় পর্যবেশিত করা যায়। জার্মান নাজী রাজনীতিবিদ এডলফ হিট্‌লারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী যোসেফ গোয়েবেল্‌স তার বাস্তব উদাহরণ। এখানেও  অনুমিত হয় যে, মিথ্যার ক্ষমতা অপরিমেয়। অনেক সময় সৌজন্যের খাতিরে মিথ্যা ভাণ করে পরিস্থিতি অনুসারে শোক বা আনন্দ প্রকাশ করতে হয়। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ রাষ্ট্রীয় ব্যাপার। কারো উপর কাজের বাহাদুরী  দেখানের প্রকৃষ্ট উপায় এই মিথ্যা। মিথ্যা রটনা, মিথ্যা গালি, মিথ্যা অপবাদ, মিথ্যা লাঞ্ছনায় সমাজ ভরপুর। দুর্বলের উপর সবলের মিথ্যা অভিযোগ রাষ্ট্রে বা গ্রাম বাংলায় বিরল নয়। মিথ্যাচারটাও বোধ হয়  আধুনিক সভ্যতার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। কাল যাকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলাতে যাচ্ছি, আজও তাকে মিথ্যা ভাণ করে বন্ধু বলে পরিচয় দিয়ে এক থালিতে বসে খাচ্ছি। কি নির্দয়তা!

ইতিহাস এর জ্বলন্ত প্রমাণ। আমার মনে হয় ব্যাপক অর্থে মানুষের আশাই মিথ্যা। মিথ্যা আশা মানুষ পোষণ করে – যা পুরণ করা যাবে না, তাও। অর্থনীতি যেমন বলে,অভাবের শেষ নেই, তেমনি মানুষের আশারও  শেষ নেই। এই অফুরন্ত আশা নিয়ে মানুষ সংসার ধর্মে আবদ্ধ হয়। আশা পুরণ কদাচিৎ যদিও হয়, যদি সে পৃথিবী জয় করতে সমর্থ হয় তবু মৃত্যুকে সে জয় করতে পারছে না বলে সে সুখী নয়। কারণ তার জীবনটা মৃত্যু দ্বারা সীমাবদ্ধ। সে মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেতে পারে না। যেদিন সে বুঝতে পারে মিথ্যা আশা সে পোষণ করেছিলো, তখন সে তার বাকী আশাটুকু মৃত্যুর কোলে ছেড়ে দিয়ে নিজেও তাতে আশ্রয় নেয়। তবে একথাও সত্য যে, মৃত্যু জীবনকে আলিঙ্গণ না করলে জীবনটা এমন মধুময় হতো না।

যাক সে কথা। শুনতে যদি কারো আপত্তি না থাকে সমাজে নিরীহ ব্যক্তির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কি ভাবে তাকে অপদস্ত করা যায় এখানে এমনি একটা বাস্তব ঘটনার অবতারণা করছি। ‘কোন এক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান পৃষ্টপোষক সেবার নামে শোষণ চালিয়ে যাচ্ছিলো। স্থানীয় কতিপয় শিক্ষিত জনসাধারণের তাতে সইলো না। তারা উপযুক্ত স্থানে একখানা দরখাস্ত হাঁকিয়ে দিলো। কিন্তু উপরোক্ত পৃষ্টপোষক একজন নিরীহ লোককে এর মধ্যে জড়িয়ে বসলো এবং তাকে অপদস্ত করতেও কসুর করলো না। পরিশেষে দেখা গেলো সে এর মধ্যে মোটেই জড়িত নয়।‘ এমন ঘটনা গ্রামবাংলায় নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। শুধু গ্রামেই মিথ্যার প্রভাব বেশী একথা আমি মানতে রাজী নই। আমার মতে এবং শুধু আমার মতে হবে কেন, সবার মতেই মিথ্যার প্রধান উৎস আদালত। আমার ধারণা এক আদালতে বা এজলাসে যতো মিথ্যার অবতারণা হয় সারা পৃথিবীর মিথ্যা জড় করলেও বোধ করি অতো হবে না।

যুদ্ধের সময় তো মিথ্যার ছড়াছড়ি। জনমত স্বপক্ষে আনার জন্য মিথ্যার কি সুকৌশল ব্যবহার! প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে মিত্রশক্তির প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিশ্ব জনমত স্বপক্ষে আনার জন্য সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন যে, এ যুদ্ধে মিত্রশক্তির জয় হলে পৃথিবী হতে উপনিবেশবাদ চিরদিনের মত দূরীভূত হবে। কিন্তু তা কি হয়েছিলো? যুদ্ধে মিত্রপক্ষের জয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি জয়ী শক্তিগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছিলো বিজিত রাষ্ট্রগুলোকে এবং তারই পরিণতি ঘটানোর জন্য আবির্ভূত হতে হয়েছিলো হিটলার ও মুসোলিনীকে। তবু কি মিথ্যার প্রবাহে কোন ভাটা পড়েছে?

  যুগে যুগে সভ্যতার উৎকর্ষের সাথে সাথে মিথ্যারও উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে তালে তালে। কিন্তু সত্যের কি কোন উন্নতি হচ্ছে? আগেকার দিনে মিথ্যাকে মিথ্যা বলা হতো, কিন্তু সে মিথ্যাকে মানুষ ঘৃণা করতে শিখেছে বলে তার নাম আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। মিথ্যার বর্তমান নাম ‘গুল’ বা অসত্য। তাই নয় কি? আজিকার  যুবকদের মতে মিথ্যা বলায় দোষ আছে, কিন্তু ‘গুল’ বা অসত্য দোষ মুক্ত – নির্দোষ। এগুলের উৎপত্তি স্থল যথা সম্ভব স্পেনের বা পশ্চিমাবিশ্বের এপ্রিল ফুল এবং আমরা অনুকরণ প্রিয় বলে আমরাও গ্রহণ করেছি এটাকে সাদরে – কিন্তু বিকৃত ভাবে।  খ্রীস্টান জগত এটা ব্যবহার করে বছরে একদিন আর আমাদের ব্যবহার  প্রাত্যহিক জীবনে। ভেবে দেখিনি আদৌ এটা আমাদের জন্য আত্মঘাতী কিনা।   

 মিথ্যার উৎকর্ষ যতোই হউক  আর তার ক্ষমতা যতোই থাকুক তা মানুষের মন জয় করতে পারে না। মিথ্যা মুখরোচক হলেও শান্তিদায়ক নয়। মিথ্যা দিতে পারে সাময়িক শান্তি কিন্তু সত্য দিতে পারে চিরন্তন শান্তি –অন্তরের প্রশান্তি। মিথ্যার স্থান মুখে – কার্যোদ্ধারের নিমিত্ত আর সত্যের স্থান প্রাণের গভীরে – তৃপ্তি লাভের  নিমিত্ত। মিথ্যায় কার্যোদ্ধার হলেও তা মনকে পীড়ণ করে – সারা জীবনকে অনুশোচনায় ভরে তোলে।  মিথ্যার জয় ক্ষণস্থায়ী আর সত্যের জয় চিরস্থায়ী। মিত্রপক্ষ মিথ্যা প্রচার করে জয়ী হয়ে উপনিবেশ লাভ করলেও তা আটকিয়ে রাখতে পারেনি – বরং এখন কোণ ঠাঁসা হয়ে পড়েছে। আমার বিশ্বাস, এমন একদিন আসবে, হয়তো সেদিন দূরে নয়, যেদিন পৃথিবী থেকে মিথ্যার প্রলয় ঘটবে; সত্যের পূণর্দীপ্তি জ্বলে উঠবে সবার ঘরে ঘরে, গোটা বিশ্বে। এ আশা নিয়েই এর জের টানলাম।

পারগোপালপুর, সাঁথিয়া, পাবনা।

জৈষ্ঠ্য ২৩, ১৩৭৫                                                              

Comments are closed.