মানব সৃষ্টির ইতিহাস

কিভাবে বিশ্বজগতে মানব জাতির সূচনা হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাবে ধর্মগ্রন্থগুলো উপস্থাপন করে যে, মানব জাতি সৃষ্ট। উৎপত্তি গত দিক থেকে কথিত আছে ঈশ্বর আপন আকৃতি থেকে মানুষ তথা নর-নারী সৃষ্টি করেছেন। সাম্প্রতিক শতাব্দীকাল সমূহে একটা প্রশ্ন উঠেছে জীবনপ্রাপ্ত সমস্ত প্রজাতি উদ্ভিদ হোক  বা প্রাণী হোক তা হাজার হাজার বছরের ক্রম বিবর্তনবাদের উন্নতির ফসল। বিবর্তনবাদের সমস্যা হলো এই,  যা এখনও সঠিক ভাবে প্রমাণিত নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে এক প্রজাতিকে আরেকটা প্রজাতিতে রূপান্তর করা কখনই সম্ভবপর নয়। একটা কুকুরকে বিড়ালে একটি চারা গাছকে মাছে, একটি  গাছকে গরুতে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। অন্য কথায় বলা যায়, গাছ গাছই থাকে পাতা পাতাই থাকে যদিও এর গঠনে একটু পার্থক্য হতে পারে, কিন্তু  আমরা যতই পদ্ধতি প্রয়োগ করি না কেন, এক প্রজাতি থেকে  অন্য প্রজাতি কিছুতেই তৈরী করতে পারি না। 

  জীবন বিকাশে বিবর্তনবাদ কোন সমাধান নয়। যেখানে জীবন নেই তাতে জীবন দেয়ার ক্ষমতা বিজ্ঞানের নেই। মানুষ কিভাবে সৃষ্ট হয়েছে বাইবেলে তার সহজ, কার্যকরী ও পরিষ্কার ব্যাখ্যা রয়েছে। অধিকন্তু মানুষ সৃষ্টিতে স্রষ্টার আকার ও পছন্দ রয়েছে। কোন বিবর্তনবাদের উন্নতি কোন জীব এবং ঈশ্বরের আকারের সাথে যোগসূত্র রক্ষা করতে পারে। কলোসিয়ানস ১:১৬ অনুসারে কেবলমাত্র ঈশ্বর বাদে সব কিছুই ঈশ্বরের  সৃষ্ট; ঈশ্বর ছাড়া কিছুই সৃষ্ট নয়। আরো পরিষ্কার করে বলা যায়, তাঁর জন্য তাঁর দ্বারা স্বর্গে এবং পৃথিবীতে, দৃশ্য, অদৃশ্য, সিংহাসন বা ক্ষমতা বা শাসক বা কর্তৃপক্ষ সব কিছুই ঈশ্বরের সৃষ্ট।   

হিব্রু ১১:৩ অনুসারে কেবল মানুষ নয় সব কিছুই ঈশ্বরের সৃষ্ট। বিশ্বাসগত দিক থেকে আমরা জানি যে, বিশ্বজগত স্রষ্টার হুকুমে গঠিত। যদি কেউ বাইবেলকে ঈশ্বরের বাণী বলে বিশ্বাস করে তাহলে সে বিশ্বাস করবে যে, ঈশ্বরই সব কিছুর স্রষ্টা এবং উদ্ভাবক। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, অবিশ্বাসীরা যারা যীশুর পূনরাগমনকে অবিশ্বাস করে তারা মন্তব্য করে যে, আমাদের পিতারা যাঁরা মারা গেছেন তাহলে তাঁরাও কি আবার ফিরে আসবেন?  

  সৃষ্টির মূল উৎস জেনেসিস ১: ২৭ অনুসারে মানুষ ঈশ্বরের আকার ও পছন্দ মোতাবেক তৈরী। এর অর্থ এই যে, তার প্রয়োজনীয় ব্যক্তিত্ব আছে, বুদ্ধিগত বা মানসিক, সংবেদনশীল বা অনুভূতি সম্পন্ন এবং ইচ্ছা অর্থাৎ নৈতিক বাছাইয়ের সক্ষমতা তার আছে। এই সব গুণাবলী মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে নেই।  এর একমাত্র কারণ হলো ঈশ্বরের সাথে তার যোগাযোগ এবং তার কাজের জন্য নৈতিক দায়িত্বের কারণে। ধর্মগ্রন্থগুলো মানুষকে সংজ্ঞায়িত করে যে, মানুষ বস্তু ও অবস্তু দ্বারা গঠিত। তদনুসারে মানুষের দেহ আছে এবং জীবন আছে। এই বিবেচনায় প্রভু ঈশ্বর ধর্মগ্রন্থে ঘোষণা করেন যে, ভূমি থেকে কিছু ধূলি নিয়ে মানুষ তৈরী করেন ও তার নাসারন্দ্রে জীবনের নিশ্বাস ঢুকিয়ে দেন এবং এর ফলে জীবন্ত মানুষ তৈরী হয়।     

   জেনেসিস ২ : ৭ ধর্মগ্রন্থে মানুষ সম্বন্ধে আলোচিত হয়েছে এতে স্পষ্ট হয়েছে যে, মানুষ বস্তু ও অবস্তু দ্বারা গঠিত, তন্মধ্যে অবস্তুকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায় – তা হলো প্রাণ ও আত্মা। যখন মানুষকে সৃষ্টি করা হলো তখন সে হলো জীবন্ত প্রাণী। অথচ নতুন ও পুরাতন নিয়মে বাইবেলে কয়েক শতবার ঘোষণা করা হয়েছে মানুষের আত্মা আছে।

  বাইবেল দাবী করে যে, মানব জীবের প্রাণ আছে। হিব্রু ৪ : ১২ অনুসারে কথিত আছে যে, ঈশ্বরের শব্দ মানব চেতনায় প্রাণ ও আত্মা মর্মে বিদ্ধ করা আছে। স্বাভাবিকভাবে আত্মা শব্দটি মনে হয় মানুষের মনস্তাত্বিক বিষয় বা জীবনের প্রাকৃতিক অভিজ্ঞতা। প্রাণ শব্দটি মনে হয় তার ঐশ্বরিক সচেতনতা এবং তার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক রাজ্যে কাজ করার সামর্থ। বাইবেলে এই বিষয়গুলো কোন কোন সময় সমগ্র মানুষকে বুঝানের জন্য ব্যবহার হয়। যেমন – দেহ বা আত্মা বা প্রাণ। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ‘রোমানস  ১২ : ১’ তে বলা হয়েছে আস্তিকদিগকে তাদের দেহকে ঈশ্বরের প্রতি জীবন্ত কোরবানী বলে অনুপ্রাণিত করা  হয়েছে। আস্তিকের দেহের ব্যাপারে পৌল গোটা ব্যক্তিকে বুঝাতে চেয়েছেন। তদ্রুপ আত্মাকে কখনো কখনো গোটা ব্যক্তি আবার প্রাণকেও গোটা ব্যক্তি বুঝিয়েছেন।  

 মানুষের অন্য অবস্তুগত বিষয়গুলো যেমন – মন, ইচ্ছা, বিবেক এবং উল্লেখযোগ্য মানবিক ব্যক্তিত্বের বিষয়গুলো বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বলা হয় একজন খৃস্টানের দেহ পাপপূর্ণ অপর দিকে ধর্মগ্রন্থে বলা হয় ‘পবিত্র আত্মার মন্দির’। খৃস্টানের দেহগুলোকে নিয়ন্ত্রিত এবং মানবিক মনে জমা রাখা উচিত। খৃস্টানের দেহগুলো যা এখন কলুষিত এবং পাপপূর্ণ তা পরিবর্তিত করতে, পাপ থেকে পরিস্কার ও নতুন করতে খৃস্টের দেহের মত পুনরুত্থান বা আনন্দে আত্মহারা করতে হবে।    

  স্বর্গীয় অনুশাসনের ব্যাপারে খৃস্টীয় সমস্যার কথা এবং আদম-হাওয়ার সৃষ্টির পর খৃস্টবাদ যে ব্যাখ্যা করে তাহলো এই যে, মানুষ উন্মুক্তভাবে অন্যায়কেই বেছে নেয় এবং এভাবেই মানব সম্প্রদায়ে পাপ নিয়ে আসে। ঈশ্বর আদম ও ইভকে বলেছিলেন তোমরা নির্বিঘ্নে প্যারাডাইসের সব গাছের ফল খেতে পারো, কেবলমাত্র ভাল-মন্দ জ্ঞানের গাছের ফল খেতে পারবে না। আদেশ অমান্য করলে অবশ্যই মারা পড়বে। কিন্তু ইভ তাতে জড়িয়ে পড়লেন, ঐ নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে ফেললেন এবং আদমও তাঁর সাথে অংশীদার হলেন। ফল হলো এই গোটা মানব জাতি এভাবেই পাপে ঝাঁপিয়ে পড়লো। (জেনেসিস ২ : ১৬-১৭ ও জেনেসিস ৩ :২- ৬)

 পক্ষান্তরে আল কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত আদম (আঃ) ও হযরত হাওয়া (আঃ)কে সব জান্নাতের সর্বত্র বিচরণের এবং একমাত্র গন্ধম গাছের ফল ছাড়া বাঁকী সব গাছের ফল খাওয়ার অনুমতি দেন। তদনুযায়ী তাঁরা উভয়ে জান্নাতে পরম প্রশান্তিতে বসবাস করছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন –

وَ قُلْنَا یٰۤاٰدَمُ اسْكُنْ اَنْتَ وَ زَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَ كُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَیْثُ شِئْتُمَا۪-وَ لَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُوْنَا مِنَ الظّٰلِمِیْنَ

(ওয়া কুল্‌না ইয়া আদামা আস্‌কুন্‌ আন্‌তা ওয়া যাওযুকাল্‌ যান্নাতা ওয়া কুলা মিন্‌হা রাগাদান্‌ হাইছু শি’তুমাইন্‌ ওয়া লা তাক্‌রাবা হাযিহিশ্‌ শাযারাতা ফাতাকুনা মিনায্‌ যলিমীন)        

তখন আমরা আদমকে বললাম,’তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে থাকো এবং এখানে স্বাচ্ছন্দের সাথে ইচ্ছে মতো খেতে থাকো, তবে এই গাছটির কাছে যেয়ো না। অন্যথায় তোমরা দুজনেই যালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। (সূরা বাকারাঃ আয়াত ৩৫)          

  বাইবেলের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, শয়তান সাপের আকারে ইভের কাছে গিয়েছিলো এটা অন্যায়। এর অর্থ এই যে, মূল স্বর্গীয় জগত সৃষ্টির সময় কিছু কিছু স্বর্গীয় দূতও পাপ করতো, তারা শয়তান দ্বারা পরিচালিত এবং তারা আজও সক্রীয়। ধর্মগ্রন্থ মনে করে যে, ঈশ্বর অনিষ্ট তৈরী করতেন না, তিনি সম্ভাব্য নৈতিক বিশ্বই সৃষ্টি করতেন যদি না স্বর্গীয় দূত এবং মানুষ সঠিকের পরিবর্তে মন্দকে পছন্দ না করতো। 

 আদম পাপ করার আগে তিনি চিন্তায়, কথায় ও কাজে নির্দোষ ছিলেন। ঈশ্বর তাঁকে নিস্পাপ এবং নৈতিক পছন্দ দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য খুবই সাধারণ। ঈশ্বর যে আদেশ তাঁকে দিয়েছিলেন যা তিনি অমান্য করেছিলেন তা হলো সেই নিষিদ্ধ ফল খাওয়া। আদমের এই পাপের ফলে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটলো। তাঁর আত্মিক মৃত্যু ঘটলো। তাঁর শারীরিক বৃদ্ধি শুরু হলো। স্বাভাবিকভাবেই তিনি বুঝতে পারলেন তিনি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি বুঝলেন তিনি ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে ঈশ্বরও ইভকে প্রলুব্ধ করার জন্য সাপকে অভিশাপ দিলেন।(জেনেসিস ৩: ১৪-১৫) ইভ প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি তাঁর স্বামীর অনুগত থাকবেন এবং আরও বুঝতে পারলেন তাঁর সন্তান জন্মদানের বেদনা বৃদ্ধি পাবে। (জেনেসিস ৩: ১৬) আদম বুঝলেন ভূমি তাঁর কাজের জন্য তাঁকে অভিশাপ করবে, ফলে ভূমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করে খাদ্য তৈরী করা কঠিন হবে। ঘটনাক্রমে তাঁকে জানান হয় যে, তাঁকে মরতে হবে এবং আবার সেই ধূলামাটিতে ফিরে যেতে হবে, যেখান থেকে তাঁকে তৈরী করা হয়েছিলো। পরিবর্তিত অবস্থার কারণে আদম এবং ইভকে নিষিদ্ধ জীবন বৃক্ষের ফল খাওয়ার জন্য স্বর্গে প্রাপ্ত চির শারীরিক দেহ স্থানচ্যূত হয়ে মর্তে অবতরণ করলেন।(জেনেসিস ৩: ২২-২৪) আদমের ব্যক্তিগত বিপর্যকর অবস্থার ফলাফল গোটা মানব জাতির উপর পড়েছে, কারণ আদমই মানব বংশের প্রধান ও সূচনাকারী।

  মানব জাতির এই পাপ এবং এর ফলাফলের ব্যাপারে বাইবেল আমাদেক শিক্ষা দেয় যে, এটা আদম কর্তৃক আরোপিত তাঁর অধঃস্তনদের জন্য। (রোমানস ৫ : ১২-১৪) অতএব পৃথিবীতে পাপ প্রবেশ করেছে একজনের দ্বারা এবং মৃত্যু এসেছে পাপের জন্য; এইরূপে মৃত্যু সবার কাছেই আসে, কারণ পৃথিবীতে সবাই পাপ করে। কাজেই মৃত্যু আদমের সময় থেকে মুসার সময় পর্যন্ত এমন কি যারা পাপ করেনি তারাও আদমের পাপের আওতায় এসে যায়। গোটা মানব জাতিকে এই মর্মে বিবেচনা করা হয় যে, তারাও যদি ঐ অবস্থায় পড়তো তবে তারাও পরিস্থিতির শিকার হয়ে ঐ পাপ করতো। যখন যীশু ক্রুশে জীবন দেন তিনি যেন সমগ্র বিশ্বের জন্য মেষ উৎসর্গের মত নিজেকে উৎসর্গ দিচ্ছেন। (যোহন ১ : ২৯) 

  ঈশ্বরকে ছেড়ে আসার পর আদম ও ইভের সময় কাল থেকে বিশ্বে আনীত মানব ইতিহাসে মানুষের পাপের দুঃখজনক রেকর্ড নিয়ে এসেছিলেন, যদিও ঈশ্বর তাদের জন্য যথেষ্ঠ করেছেন। যদিও আদম ও ইভের মধ্যে ভাল মন্দ পার্থক্য করার সক্ষমতা ছিলো তবুও তাদেক ভাল করতে পারেনি। বরং তাদের ভাবী বংশধরদেক ঈশ্বর থেকে ক্রমান্বয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, যতক্ষণ না নোয়া (নূহ) এবং তাঁর পরিবার ছাড়া বাঁকী সব মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। (জেনেসিস ৬: ১৩)                          

 ইবরাহিমী ও খৃস্ট ধর্ম মোতাবেক হযরত আদম (আঃ) ছিলেন বিশ্বে প্রথম মানব। উভয় ধর্ম মতে তিনি ও  তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া (আঃ) বেহেশতের বাগানের ভাল মন্দ জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেয়ে বেহেশত থেকে বহিস্কৃত হন। বাইবেলের বিভিন্ন সৃষ্টিগত মতবাদ অনুসারে হযরত আদম (আঃ) ছিলেন একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি। কিন্তু বিজ্ঞান ভিত্তিক সাক্ষ্য প্রমাণ এটা সমর্থন  করে না যে, গোটা মানব ধারা এক ব্যক্তি থেকে উৎসারিত হয়েছে। ‘এ্যাডাম’ শব্দটি বাইবেলে সর্বনাম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তিগত হিসেবে মানুষ এবং সমষ্টিগত ভাবে মানব জাতি অর্থে ব্যবহার হয়।

   মানব সৃষ্টি সম্বন্ধে ইহুদী মতবাদের ব্যাপারে আবু মুসা আল-সারাজ বর্ণনা করেন যে, নবী মহম্মদ(ﷺ)  বলেছেন, আল্লাহ হযরত আদম (আঃ) কে বিভিন্ন জায়গার একমুষ্টি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, এজন্য তাঁর সন্তানদেক বিভিন্ন জায়গার মিশ্রিত মাটি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। ইহুদী মতানুসারে হযরত আদম (আঃ)  দেহে আলো ধারণ করতেন, যা আল্লাহ তাঁর মধ্যে প্রথম দিনেই সৃষ্টি করেছিলেন। ইহুদীদের মতে আদম সন্তান ঈশ্বরের প্রতি গভীর ধ্যানের মাধ্যমে তার মূল ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে।

    হযরত আদম (আঃ) কে যে মাটি দিয়ে তৈরী করা হয়েছিলো কুরআনে তাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। এর দ্বারা আমরা বুঝতে পারি তাঁর সৃষ্টির কতিপয় পদ্ধতি। ভূমি থেকে যে মাটি নেয়া হয়েছিলো কুরআনে তাকে মাটি বলা হয়েছে, আবার কোথাও আল্লাহ তাকে কাদা বলেছেন। যখন এর সাথে পানি  মিশানো হয়েছে তখন হয়েছে কর্দম, একে পানি কমানোর জন্য কিছুদিন ফেলে রাখার পর হয়েছে আঠালো কাদা, তারপর আরো কিছুদিন রাখার পর এর গন্ধ বের হয় এবং আরো গারো কালো ও মসৃন গোলা হয়। এই গোলা দিয়েই মহান আল্লাহ হযরত আদম (আঃ) এর কাঠামো গঠন করেন। সেই আত্মাহীন কাঠামোকে শুকাতে দেয়া হয়, যখন এটা কুমারের পাতিল পিটালে যে টন্‌ টন্‌ শব্দ হয় সেই শব্দ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন —  

اِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلٰٓـئِكَةِ اِنِّىۡ خَالِـقٌ ۢ بَشَرًا مِّنۡ طِيۡنٍ‏

(ইয্‌ কালা রাব্বুকা লিল্‌মালাইকাতি ইন্নী খালিকুম্‌ বাশারাম্‌ মিন্‌ তীন)

যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন,’আমি মাটি দিয়ে একটি মানুষ তৈরী করবো।‘(সূরা সাদঃ আয়াত ৭১)

   فَاِذَا سَوَّيۡتُهٗ وَنَفَخۡتُ فِيۡهِ مِنۡ رُّوۡحِىۡ فَقَعُوۡا لَهٗ سٰجِدِيۡنَ‏

 (ফাইযা সাওওয়াইতুহু ওয়ানাফাখ্‌তু ফীহি মির্‌ রুহী ফাকাউ লাহু সাযিদীন)

তারপর যখন আমি তাকে পুরোপুরি তৈরী করে ফেলবো এবং তার মধ্যে নিজের প্রাণ ফুঁকে দেবো তখন তোমরা তার সামনে সিজদাবনত হয়ে যেয়ো। (সূরা সাদঃ আয়াত ৭২)

وَلَقَدْ خَلَقْنٰكُمْ ثُمَّ صَوَّرْنٰكُمْ ثُمَّ قُلْنَا لِلْمَلٰۤىِٕكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْٓا اِلَّآ اِبْلِيْسَۗ لَمْ يَكُنْ مِّنَ السّٰجِدِيْنَ

(ওয়া লাকাদ্‌ খালাক্‌নাকুম্‌ ছুম্মা সাওওয়ার্‌নাকুম্‌ ছুম্মা কুল্‌না লিল্‌মালাইকাতিস্‌ যুদু লি আদামা ফাসাযাদু ইল্লা ইব্‌লীসা লাম্‌ ইয়াকুম্‌ মিনাস্‌ সাযিদীন)

  আমি তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করলাম তারপর তোমাদের আকৃতি দান করলাম অতপর ফেরেশতাদেক বললাম, আদমকে সেজদা করো। এ নির্দেশ অনুযায়ী সবাই সেজদা করলো। কিন্তু ইবলীস সেজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত হলো না। (সূরা আরাফঃ আয়াত ১১)

قَالَ مَا مَنَعَكَ اَلَّا تَسۡجُدَ اِذۡ اَمَرۡتُكَ‌ؕ قَالَ اَنَا خَيۡرٌ مِّنۡهُ‌ۚ خَلَقۡتَنِىۡ مِنۡ نَّارٍ وَّخَلَقۡتَهٗ مِنۡ طِيۡنٍ

(কালা মা মানায়াকা আল্লা তাস্‌যুদা ইয্‌ আমার্‌তুকা কালা আনা খাইরুম্‌ মিন্‌হু খালাক্‌তানী মিন্‌ নারিন্‌ ওয়া খালাক্‌তাহু মিন্‌ তীন) 

আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন,’আমি যখন তোকে হুকুম দিলাম তখন সেজদা করতে তোকে বাধা দিয়েছিলো কিসে?’ সে জবাব দিলো,’আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আমাকে সৃষ্টি করেছো আগুন থেকে আর ওকে সৃষ্টি করেছো মাটি থেকে।‘ (সূরা আরাফঃ আয়াত ১২) 

 মহান আল্লাহ প্রথম মানব হযরত আদম (আঃ) কে বিভিন্ন উপায়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। আল্লাহ তাঁর  ভিতরে আত্মা ফুঁকে দেন, নিজের হাতে তাঁকে সজ্জিত করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণকে আদেশ করেন তাঁর সামনে নত শির হতে। যদিও সেজদা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত কিন্তু এটা কেবলমাত্র হযরত  আদম (আঃ)কে সম্মান ও শ্রদ্ধার জন্য মাথা নত করা। কথিত আছে যে, জীবন পেয়ে হযরত আদম (আঃ) এর দেহ কেঁপে উঠলো, তিনি হাঁচি দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ পাকের জন্য।‘ আল্লাহও তাঁকে দয়া প্রদর্শন করলেন। যদিও একথাটি কুরআন বা সহিহ হাদীসের কোথাও উল্লেখ নেই, তবুও কুরআনের কিছু বিবরণীর ভিতরে এটা পাওয়া যায়।

  হযরত মহম্মদ (ﷺ) বলেছেন যে, আল্লাহ তাঁর চেহারায় হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করেছেন, তার অর্থ এ নয় যে, হযরত আদম (আঃ) দেখতে ঠিক আল্লাহর মত। যেহেতু আল্লাহ সব দিক দিয়েই একক, আমরা তাঁর চেহারা বা আকার সম্বন্ধে ধারণাই করতে পারি না। হতে পারে মহান আল্লাহ তাঁর কিছু গুণ হযরত আদম (আঃ) এর মধ্যে দিয়ে থাকতে পারেন, যেমন মায়াদয়া, ভালবাসা, স্বাধীন চিন্তা ইত্যাদি। কিন্তু তা অতুলনীয়। পূর্বে দেয়া পরামর্শ মোতাবেক হযরত আদম (আঃ) এর নিকটে যে সব ফেরেশতা (আঃ) বসে ছিলেন তাঁদেক তিনি সসম্মানে বললেন,’আসসালামু আলাইকুম’। ফেরেশতারা (আঃ) উত্তর দিলেন,’ওয়া আলাইকুম সালাম’। ঐদিন থেকেই এই সম্ভাষণ শুরু হয়েছে। আমরা তাঁর উত্তর পুরুষ হিসেবে আমাদেকও এটা বিস্তার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

 মহান আল্লাহ বলেছেন যে, আমি মানব জাতিকে কেবল মাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। হযরত আদম (আঃ) ও তাঁর অধঃস্তনদের জন্য সৃষ্টি করেছি যাতে তারা নির্বিঘ্নে আমার ইবাদত করার সক্ষমতা লাভ করতে পারে। আল্লাহর সীমাহীন জ্ঞানের বলে জানতে পারেন হযরত আদম (আঃ) ও তাঁর অধঃস্তনরা  পৃথিবীর তত্বাবধায়ক হতে পারবে এজন্য তাঁর কর্তব্য সমাধার নিয়ম শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ তাঁর কুরআনে বলেন –

وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلْأَسْمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى ٱلْمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبِـُٔونِى بِأَسْمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمْ صَٰدِقِينَ

(ওয়া আল্লামা আদামাল্‌ আস্‌মায়া কুল্লাহা ছুম্মা আরাদাহুম্‌ আলাল্‌ মালাইকাতি ফাকালা আম্‌বিউনী বিয়াস্‌মায়ি হাউলায়ি ইন্‌ কুন্‌তুম্‌ সাদিকীন)

অতপর আল্লাহ আদমকে সমস্ত জিনিসের নাম শিখালেন, তারপর সেগুলো পেশ করলেন ফেরেশতাদের সামনে এবং বললেন,’যদি তোমাদের ধারণা সঠিক হয় তাহলে বলতো দেখি এ জিনিসগুলোর নাম কি?’ (সূরাহ বাকারাঃ আয়াত ৩১)

  সর্বশক্তিমান আল্লাহ হযরত আদম (আঃ) কে সব জিনিসের নাম শিখায়ে দিলেন, তিনি তাঁকে ভাষা শিখালেন, কথা বলা শিখালেন এবং কিভাবে যোগাযোগ করতে হয় তাও শিখালেন। আল্লাহ তাঁকে অতৃপ্ত প্রয়োজন পূরণে অনুপ্রাণিত ও জ্ঞান পিপাসু করে তুললেন। আল্লাহ সব জিনিসের নাম ও ব্যবহার শিখানের পর ফেরেশতাদেক প্রশ্ন করলেন –

قَالُوا۟ سُبْحَٰنَكَ لَا عِلْمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَآ ۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلْعَلِيمُ ٱلْحَكِيمُ

(কালু সুব্‌হানাকা লা’ ইল্‌মা লানা’ ইল্লা মা আল্লাম্‌তানা ইন্নাকা আন্‌তাল্‌ আলীমুল্‌ হাকীম)

তারা বলল,’ত্রুটিমুক্ত তো একমাত্র আপনারই সত্তা, আমরা তো মাত্র ততটুকু জ্ঞান রাখি যতটুকু আপনি আমাদের দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে আপনি ছাড়া আর কোন সত্তা নেই যিনি সব কিছু জানেন ও বুঝেন।‘(সূরা বাকারাঃ আয়াত ৩২)

 মহান আল্লাহ হযরত আদম (আঃ) এর দিকে তাকিয়ে বললেন –

قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئْهُم بِأَسْمَآئِهِمْ ۖ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسْمَآئِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ إِنِّىٓ أَعْلَمُ غَيْبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ

(কালা ইয়াআদামু আম্‌বিহুম্‌ বিয়াস্‌মাইহিম্‌ ফালাম্মা আম্‌বায়াহুম্‌ বিয়াস্‌মাইহিম্‌ কালা আলাম্‌ আকুল্‌ লাকুম্‌ ইন্নী আ’লামু গায়বাস্‌ সামাওয়াতি ওয়াল্‌ আর্‌দি ওয়া আ’লামু মা তুব্‌দুনা ওয়া মা কুন্‌তুম্‌ তাক্‌তুমুন্‌)

তখন আল্লাহ আদমকে বললেন,’তুমি ওদেরকে এই জিনিসগুলোর নাম বলে দাও।‘ যখন সে তাদেরকে সে সবের নাম জানিয়ে দিলো, তখন আল্লাহ বললেন,’আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আকাশ ও পৃথিবীর এমন সমস্ত নিগূঢ় তত্ব জানি যা তোমাদের অগোচরে রয়ে গেছে। যা কিছু তোমরা প্রকাশ করে থাকো তা আমি জানি এবং যা কিছু গোপন করো তাও আমি জানি।‘(সূরা বাকারাঃ আয়াত ৩৩)

  হযরত আদম (আঃ) ফেরেশতাদের (আঃ) সাথে কথা বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাঁরা আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত ছিলেন। ফেরেশতাদের (আঃ) জ্ঞান ও ইচ্ছার স্বাধীনতা সীমিত। তাঁদের মূল কাজই হলো আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর প্রশংসা করা। পক্ষান্তরে হযরত আদম (আঃ) এর কাজ হলো কোন কাজ পছন্দ করা, তার উদ্দেশ্য এবং কেন করবেন তা নিরূপন করা। হযরত আদম (আঃ) সব জিনিসের নাম ও তার কাজ জানতেন কিন্তু তিনি একা। হযরত মহম্মদ(ﷺ) বলেন, একরাতে হযরত আদম (আঃ) যখন ঘুমাচ্ছিলেন, তখন আল্লাহ তাঁর পাঁজরের একখানা বাঁকা হাঁড় নিয়ে তাতে মাংস লাগিয়ে হযরত হাওয়া (আঃ) কে তৈরী করলেন। সকালে হযরত আদম (আঃ) চোখ খুলে দেখেন এক সুন্দর মহিলা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে কেন? মহিলা প্রকাশ করলেন তাঁর একাকীত্বে আরাম ও প্রশান্তি আনার  জন্য। ফেরেশতারা (আঃ) হযরত আদম (আঃ) কে প্রশ্ন করলেন, তিনি তো সবই জানেন তাহলে এ মহিলাটি কে? হযরত আদম (আঃ) জানালেন, এ হযরত হাওয়া (আঃ)।       

Eve আরবীতে Hawwa বা হাওয়া যা মূল শব্দ hay যার অর্থ জীবন্ত এবং ইংরেজী Eve প্রাচীন হিব্রু শব্দ Havva যাhay। হযরত আদম (আঃ) ফেরেশতাগণ (আঃ) জানালেন যে, হযরত হাওয়া(আঃ)এর এ রকম নাম হওয়ার কারণ হলো তিনি তাঁর শরীরের এক অংশ দিয়ে তৈরী এবং তাঁরা দুজনই জীবন্ত মানুষ। ইহুদী ও খৃস্টান সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, ইভ আদমের পাঁজর থেকে সৃষ্টি। যদিও শুধু ইহুদী বিশ্বাস হলো পাঁজর অর্থ দেহের একটা পার্শ্ব।             

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا

(ইয়া আইয়োহান্নাসু আত্তাকু রাব্বাকুমু আল্লাযী খালাকাকুম্‌ মিন্‌ নাফ্‌সিন্‌ ওয়াহিদাতিন্‌ ওয়া খালাকা মিন্‌হা যাওযাহা ওয়াবাচ্ছা মিন্‌হুমা রিযালান্‌ কাছীরান্‌ ওয়া নিসায়ান্‌ ওয়াত্তাকু আল্লাহা আল্লাযী তাসায়ালুনা বিহি ওয়াল্‌ আর্‌হামা ইন্না আল্লাহা কানা আলাইকুম্‌ রাকীবা)

  হে মানব জাতি, তোমাদের রবকে ভয় করো। তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তারপর তাদের দুজন থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। সেই আল্লাহকে ভয় করো যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিজেদের হক আদায় করে থাকো। আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের উপর কড়া নজর রেখেছেন।(সূরা নিসাঃ আয়াত ১)

  হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,’ওহে মুসলিমরা শোনো, আমি তোমাদেক উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা মহিলাদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করো, কারণ তাদেক পাঁজরের হাঁড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, আর এটা হলো উপরের সবচেয়ে বাঁকা অংশ। একে যদি সোজা করতে চেষ্টা করো তবে ভেঙ্গে যাবে। যদি ফেলে রাখো তবে বাঁকা থাকবে। কাজেই আমি তোমাদেক অনুরোধ করছি, মহিলাদের যত্ন নিও। (সহি বুখারী খণ্ড ৪ বই ৫৫ নং ৫৪৮)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *