মানবতাবাদ প্রসঙ্গে (প্রথমাংশ)

এডিটর’স নোট:
ড. আলী শরিয়তী ইরান বিপ্লবের অন্যতম তাত্ত্বিক রূপকার । মার্কসবাদসহ প্রধান প্রধান পাশ্চাত্য মতবাদগুলোর নানান অসঙ্গতি এবং ইসলামের সাথে এগুলোর বৈপরীত্য বিশ্লেষণ করেছেন। এসব মতবাদের বিপরীতে ইসলামের সুসামঞ্জস্যতাও তিনি দেখিয়েছেন। মূল বইটির দুটি ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে। আমরা বার্কলে, ক্যালিফোর্নিয়ার মিজান প্রেস থেকে প্রকাশিত ও পারসিয়ান স্টাডিজের প্রখ্যাত অধ্যাপক হামিদ আলগার সম্পাদিত অনুবাদটি থেকে বাংলায় অনুবাদ করছি। (এন এইচ আব্দুল্লাহ)


‘মানুষ কী?’ এই বিষয়ে সার্বজনীন কোনো যৌক্তিক ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ অসম্ভব প্রায়। কারণ, যে কোনো সংজ্ঞা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ, দার্শনিক মতবাদ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করবে।

বিজ্ঞানও এই ছোট্ট জীবটির (মানুষ) রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। এলেক্সিস ক্যারেল[1] যেমনটা বলেছেন, “বাইরের দুনিয়ায় মানুষ যতটা ব্যস্ত এবং যতটা উন্নতি লাভ করেছে; নিজের সত্তা থেকে সে ঠিক ততটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং নিজের বাস্তবতাকেও ভুলে গেছে।” ‘ফ্রেঞ্চ ফাউন্ডেশন ফর দ্যা স্টাডি অব হিউম্যান প্রবলেমস’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং আমাদের সময়কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ক্যারেল সঙ্গত কারণেই মানুষকে ‘অচেনা’ (the unknown) বলে অভিহিত করেছেন।

মানুষ সম্পর্কিত জ্ঞান মানে আমাদের নিজেদের সম্পর্কিত জ্ঞান এবং এই জ্ঞান ছাড়া আমরা এমন এক অন্ধকারে নিপতিত হই, যেখানে এমনকি বিজ্ঞানের দীপ্যমান আলোও আমাদের পথ দেখাতে পারে না। তাই ‘চির অজ্ঞাত’ হলেও মানুষ কখনো তার নিজের সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন থেকে বিরত থাকতে পারে না। নিজের প্রকৃত বাস্তবতা ও মৌলিক স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের জন্যই জানার এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা জরুরি।

নিজের সম্পর্কে মানুষের অসচেতনতার মাত্রা এতটাই মারাত্মক যে, বিজ্ঞানের জগতে এতসব বিস্ময়কর উন্নতি সত্ত্বেও মানুষ তার জীবনের সঠিক অর্থ বুঝতে পারে না, কিংবা স্বীয় অস্তিত্বের মর্ম অনুধাবন করতে পারে না। এ থেকে বুঝা যায়, আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আধুনিক মানুষ প্রাচীন মানুষের তুলনায় আরো বেশি দুর্বল ও অজ্ঞ। এটি আমেরিকান দার্শনিক জন ডিউই’র মতামত।

তাই অন্য যে কোনো প্রকার জ্ঞান অর্জনের চাইতে এই অজ্ঞতা দূর করাই এখন মানবজাতির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, সাম্প্রতিক কালের যেসব বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও মতাদর্শিক প্রচেষ্টা মানুষকে সত্যিকার অর্থে মুক্ত করতে চেয়েছে, কিংবা তাদের কল্যাণে কাজ করতে চেয়েছে – তার সবই ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ হলো, তারা যাকে মুক্ত করতে চাচ্ছে, সেই মানুষই কোনো না কোনোভাবে তাদের নিকট অজানা রয়ে গেছে, কিংবা তারা মানুষকেই ভুলে গেছে। যেমন করে একটি ঘরে যারা থাকবে তারা কোন ধাঁচের মানুষ, অর্থাৎ তাদের ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী, তাদের মৌলিক প্রয়োজনগুলো কী কী – এসব বিষয় না বুঝেই আমাদের বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ও আর্কিটেক্টগণ নিছক উন্নত প্রযুক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে আধুনিক, বিলাসবহুল ঘর তৈরি নিয়ে কথাবার্তা বলে থাকেন।

আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ফলে ব্যাপক উন্নতি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। যেমন– মনোবিজ্ঞানের জগতে সাম্প্রতিককালের বৈজ্ঞানিক অর্জন। এছাড়া আগামীতে প্রযুক্তিগত ব্যাপক উৎকর্ষতা অর্জনের সম্ভাবনা তো রয়েছেই। এছাড়া নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী তোলা এবং তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি সাধনের ব্যাপারটিও বলা যায়। এর বাইরে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার আর কোনো উল্লেখযোগ্য সফলতা নেই। শুধু তাই নয়, অতীতের পাঠদান পদ্ধতি ও পাঠ্যবিষয় বিবেচনাসহ নানান বিবেচনাতেই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের বন্ধ্যাত্ব তৈরি হয়েছে।

এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার ফলে আধুনিক মানুষ এখন পূর্বসূরীদের চেয়ে মানুষকে অধিক শিক্ষিত করে তুলছে বটে। কিন্তু যে ধরনের মানুষ গড়ে ওঠছে, তারা আগেকার তুলনায় অধিকতর জ্ঞানী, এমন নয়। আধুনিক মানুষ তার ইচ্ছে মতো যে কোনো ধরনের জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু জীবন আসলে কীভাবে যাপন করা উচিত, তা সে জানে না। এর কারণ হলো, জীবনকে কেন যাপন করতে হয়, অর্থাৎ জীবনের উদ্দেশ্য তার জানা নেই। মানুষের এইসব অন্তর্গত মৌলিক প্রশ্নগুলোর জবাব পুঁজিবাদী সমাজে কেউ খুঁজে পায় না। কমিউনিস্ট সমাজেও এর জবাব নেই।

এখান থেকেই সম্ভবত আমরা বুঝতে পারি, প্রাচীন ধর্মগুলোর বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত এইসব নব্য মতাদর্শ কেন মানুষের মৌলিক প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারছে না। আমরা এও বুঝতে পারি, কেন এইসব মতাদর্শ মানুষকে দিনশেষে হতাশা ও মানসিক দাসত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। উপরন্তু, উদারতাবাদ এবং কমিউনিজম, প্রতিষ্ঠিত এই দুটি মতাদর্শের কোনোটিতেই জীবনদর্শনের কোনো স্থান নেই। উভয়টিতেই মৌলিক মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশকে রুদ্ধ করা হয়েছে। অবশ্য, এ ধরনের উপসংহার টানার আগে আমাদেরকে অবশ্যই মৌলিক মানব প্রকৃতি বলতে আসলে কী বুঝায়, তা জানতে হবে। তারপরই কেবল এর স্বাভাবিক বিকাশ, অবক্ষয় কিংবা বিকল্প নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারবো।

এ কারণেই মানুষ বলতে আসলে কী বুঝায়, সেই মৌলিক সংজ্ঞা নির্ধারণের দিকে আমাদেরকে ফিরে যেতে হয়। কারণ, মানুষই হলো প্রকৃতপক্ষে মতাদর্শ বা জীবনাদর্শগুলোর যথার্থতা নিরূপণের মাপকাঠি।


মানব-অস্তিত্বের তাৎপর্য সম্পর্কে বিজ্ঞানের যাবতীয় অস্পষ্টতা সত্ত্বেও, এ ব্যাপারে প্রতিটি দার্শনিক ধারা ও প্রতিটি ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়া সত্ত্বেও, আমরা সম্ভবত একমত হবো যে– প্রধান প্রধান ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক চিন্তাধারাসমূহ কিছু মৌলিক বিষয়ে একমত।

বিভিন্ন পক্ষের মোটাদাগের এই ঐক্যমত্যকে ‘মানবতাবাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এই অর্থে মানবতাবাদ এমন আদর্শ, যার ঘোষিত মৌলিক লক্ষ্য হলো মানুষের মুক্তি ও উৎকর্ষতা অর্জন করা। এটি মানুষকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্তা বলে মনে করে এবং মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে তার যাবতীয় মূলনীতি ঠিক করে।

এই মানবতাবাদের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার হিসেবে আমরা বর্তমানে চারটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা দেখতে পাই, যদিও এদের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এগুলো হলো:

১) পাশ্চাত্য উদারতাবাদ
২) মার্কসবাদ
৩) অস্তিত্ববাদ
৪) ধর্ম

ঐতিহাসিকভাবে উদারতাবাদ বলতে যে দর্শন ও সংস্কৃতিকে বুঝায়, পাশ্চাত্য উদারতাবাদ নিজেকে তার স্বঘোষিত উত্তরসূরী দাবি করে। নিজেকে সে প্রাচীন গ্রীসের সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার ধারাবাহিকতা বলেই মনে করে, যা বর্তমান ইউরোপে তুলনামূলকভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। পাশ্চাত্য মানবতাবাদের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন গ্রীসের পৌরাণিক কাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আমরা দেখি, এসব কাহিনীতে স্বর্গ ও মর্ত্যের (দেবতাদের জগৎ ও মানব জগৎ) মধ্যে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এমনকি প্রতিহিংসা পর্যন্ত কাজ করে। সেখানে দেবতারা মানুষের বিরুদ্ধ শক্তি। মানুষের উপর স্বৈরাচারী কায়দায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হলো দেবতাদের কাজ। মানুষেরা যেন আত্মসচেতনতা, স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জন করতে না পারে এবং প্রকৃতির উপর জয়ী হতে না পারে – দেবতাদের সার্বক্ষণিক সংগ্রাম ও মনোযোগের বিষয় হলো তা নিশ্চিত করা। মানুষ মুক্তির পথে পা বাড়ানোর ন্যূনতম পদক্ষেপ নিলেই তা বিরাট পাপ ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে বিবেচিত হয়। একে পরকালের সবচাইতে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে নিন্দা করা হয়।

এমতাবস্থায়, এই বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ যে সর্বদাই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেত, তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। ঐশ্বরিক ক্ষমতা অর্জন করার মধ্য দিয়ে মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা করতো, যেন সর্বশক্তিমান দেবতাদের খপ্পর থেকে নিজের নিয়তিকে মুক্ত করা যায় এবং নিজের স্বাধীন ইচ্ছার আলোকে নিজের ভবিষ্যত গড়ে নেয়া যায়।

অবশ্য গ্রীক পুরাণে বর্ণিত দেবতাদের সাথে মানুষের এই শত্রুতা বেশ স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। এক অর্থে তা সঠিক, এমনকি প্রগতিশীল ব্যাপার। যেহেতু দেবতাদের একেকজন হলো ধরিত্রী, সাগর, নদী, বৃষ্টি, ঋতু, ঝড়, ভূমিকম্প, খরা, অর্থনৈতিক প্রাচুর্য, সৌন্দর্য, শারীরিক শক্তি, অসুস্থতাসহ নানান প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্তা ও প্রতীক। ফলে, ঈশ্বর ও মানুষের যুদ্ধটাই পরবর্তীতে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যেহেতু এই সকল প্রাকৃতিক শক্তি কার্যত মানুষের জীবন, ইচ্ছা ও নিয়তির উপর খবরদারী করে; তাই ক্রমাগত সচেতনতা ও শক্তি অর্জন করার মাধ্যমে ওই সমস্ত শক্তির হাত থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছে এবং নিজেই নিজের নিয়ন্তা হয়েছে। এই সংগ্রাম হলো প্রকৃতির উপর বিজয়ী হওয়ার সংগ্রাম, তথা গ্রীক পুরাণের সবচেয়ে বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ দেবতা জিউসকে উৎখাত করার সংগ্রাম। কারণ, মানবজাতি যে প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন, এর প্রতীক হলো জিউস।

ডেনিস দিদেরো ও ভলতেয়ার থেকে শুরু করে ফয়েরবাখ ও মার্কস পর্যন্ত আধুনিক মানবতাবাদীদের সবচাইতে বড় চতুরতা হলো: তারা প্রাচীন গ্রীসের পৌরাণিক জগতের সাথে (যেগুলো শুধু বস্তুগত বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ) প্রাচীন ধর্মগুলোর আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতার জগতকে এক করে দেখেছেন। তারা আহুর মাজদা, রাম, তাও, যিশুখ্রিষ্ট ও আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ককে জিউস ও মানুষের সম্পর্কের সাথে তুলনা করেছেন। অথচ এই ধরনের সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

গ্রীক পুরাণে আমরা দেখতে পাই, একদা ঈশ্বরগণ ঘুমিয়েছিলেন। এই ফাঁকে প্রমিথিউস ঈশ্বরদের কাছ থেকে ‘ঐশ্বরিক আগুন’ চুরি করেন এবং গোপনে পৃথিবীতে এসে তা মানুষের হাতে তুলে দেন। এই পাপের পরিণতি হিসেবে তাকে ঈশ্বরদের হাতে নির্মম নির্যাতন ও শাস্তি ভোগ করতে হয়। অন্যদিকে ধর্মের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহর নির্দেশে সকল ফেরেশতা আদমের পদতলে সেজদা করলেও মহান ফেরেশতা ইবলিশ এই আদেশ অমান্য করে। এর শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তাকে অভিশপ্ত করে দেন। তারচেয়েও বড় কথা হলো, আল্লাহ নিজেই তার নবীদের কাছে ওহী নাজিলের মাধ্যমে হেদায়েতের আলো রূপে ‘ঐশ্বরিক আগুন’ পাঠিয়েছেন। যেন এই আলো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। সেইসাথে অহীর মাধ্যমে আল্লাহর ভয় দেখিয়ে এবং আশা জাগিয়ে আদম সন্তানকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে পথ দেখিয়েছেন।

তাহলে আমরা এখানে দেখি, আল্লাহ জিউসের মতো না হয়ে বরং প্রকৃতির দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মানুষকে মুক্তি দিচ্ছেন। তিনি এই পথকে মুক্তির পথ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। আলোর পথে মানুষের এই পথ চলাকে প্রকারান্তরে প্রমিথিউসেরই সাধনা হিসেবে আমরা বলতে পারি। তাই আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, মহান ধর্মসমূহের বিশ্বদৃষ্টি (worldview) অনুযায়ী– ঈশ্বর আসলে মানুষকে জিউসের উপর বিজয়ী হওয়ার আহ্বান করেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন, “ফেরেশতাদের সবাই আদমের পদতলে সেজদাবনত হয়েছে; আর সমুদ্র ও জমিনকে মানুষের বাধ্যগত করা হয়েছে।”

তাই, প্রাচীন গ্রীসের পৌরাণিক বিশ্বদৃষ্টি বিবেচনায় নিলে প্রকৃতির আদিরূপ হিসেবে বিদ্যমান যে ঈশ্বর, তার আনুগত্য না করা এবং তার বিধিবিধানের বিরুদ্ধে এক ধরনের মানবতাবাদ গড়ে তোলা খুবই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক ব্যাপার। এই অর্থে মানবতাবাদের সাথে ঠুনকো আস্তিক্যবাদের (কিংবা, উদাহরণ হিসেবে সর্বেশ্বরবাদের কথাও বলা যায়) এক ধরনের বিরোধ লক্ষ্য করা যায়।

এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গ্রীক মানবতাবাদ ঈশ্বরকে অস্বীকার করা, ঈশ্বরের বিধিবিধানের উপর অনাস্থা স্থাপন করা এবং মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যকার বন্ধনকে ছিন্ন করার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে মনুষ্যকেন্দ্রিক (anthropocentric)[2] বিশ্বব্যবস্থার গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এই ব্যবস্থায় মানুষই হলো সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের মাপকাঠি, মানুষই হলো সৌন্দর্যের মানদণ্ড। এতে জীবনের এমনসব বিষয়ের উপর জোর দেয়া হয়, যেগুলোতে নিছক মানুষের শক্তিমত্তা ও প্রবৃত্তি চরিতার্থ হয়।

যেহেতু এই মনুষ্যকেন্দ্রিকতা ঐশ্বরিকতার বিপরীত অবস্থান নিয়েছে, তাই মানবতাবাদ নিছক বৈষয়িক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে এবং বস্তুবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। পাশ্চাত্যের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, এইভাবে মানবতাবাদ সেই প্রাচীন গ্রীস থেকে শুরু করে আজকের ইউরোপ পর্যন্ত বস্তুবাদের সাথেই নিজেকে জড়িয়েছে। এনসাইক্লোপিডিস্টদের[3] উদারতাবাদ বলুন, আর পাশ্চাত্যের বুর্জোয়া সংস্কৃতির কথাই বলুন, কিংবা মার্কসবাদের কথাই ধরুন – দিনশেষে পাশ্চাত্যের মানবতাবাদের একই পরিণতি হয়েছে, অর্থাৎ বস্তুবাদের কাছেই গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

পশ্চিমে মানবতাবাদকে সম্পূর্ণরূপে আস্তিকতার বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার পেছনে আরো প্রেরণা যুগিয়েছে মধ্যযুগের ক্যাথলিক মতবাদ। এই মতবাদ খ্রিষ্টধর্মকে মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে যেমন ঈশ্বরদের স্বর্গ ও মানুষের দুনিয়া ছিলো পরস্পরের মুখোমুখি, ক্যাথলিক মতবাদও খ্রিষ্টধর্মকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছে। গ্রীকদের মতো তারাও আদি পাপের ধারণা এবং সে কারণে স্বর্গ থেকে মানুষের বিতাড়নের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে। তাদের মতে, ঐশ্বরিক অসন্তুষ্টির কারণে মানুষ নিশ্চিতরূপে দোষী। ফলে মানুষ হলো তুচ্ছ, তিরস্কারযোগ্য ও দুর্বল পাপী। এই পাপ থেকে কেবল যাজক শ্রেণীটিই মুক্ত। কারণ, তারা নাকি পবিত্র আত্মার ধারক। এমতাবস্থায়, সমাজের বাদবাকি মানুষের পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো এই যাজক শ্রেণীকে বিনা বাক্যে অন্ধভাবে অনুসরণ করে যাওয়া এবং দুনিয়াতে ঈশ্বর পরিচালিত প্রতিষ্ঠান তথা চার্চের সদস্য হওয়া।

এর ফলে আস্তিকতা ও মানবতাবাদের মধ্যে বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। স্বভাবতই, ঐশ্বরিক বিধিবিধান ‘বাস্তবায়নের স্বার্থে’ মানবতাবাদকে তখন বলির পাঁঠা বানানো হয়েছিলো। তাই মধ্যযুগে মানবতাবাদ তেমন কোনো শক্তিশালী মতবাদ হিসেবে গড়ে ওঠেনি। বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে, ধর্ম ও নৈতিকতায়, এমনকি মধ্যযুগের চারুকলা ও নন্দনতত্ত্বেও অতিপ্রাকৃত শক্তি ও অতিমানবের চিত্রায়নে ভরপুর ছিলো। যেমন– পবিত্র আত্মা, ত্রাণকর্তা, দেবদূত, নানা রকমের দৈব ঘটনা ইত্যাদি। এসবের মধ্যে ঘটনাক্রমে মানুষের প্রসঙ্গ আসলেও তা কেবল ধর্ম-সংস্কারক ও সাধুপুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এক্ষেত্রেও আবার তাদের মানবীয় আকৃতি আপাদমস্তক ঢাকা থাকতো ঢিলেঢালা আলখেল্লায়। মুখাবয়ব থাকতো পর্দায় ঢাকা, আর নয়তো স্বর্গীয় আলোকচ্ছটায় তা অস্পষ্ট হয়ে থাকতো।

আর সাহিত্য ছিলো এসব ধর্মীয় ঘটনাবলীর প্রচারপত্র মাত্র। চারুকলা ছিলো এইসব পৌরাণিক কাহিনীর চিত্রায়ণ। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাসের সত্যায়নে। আদি পাপের প্রায়শ্চিত্য হিসেবে সকল প্রকার সহজাত কামনা-বাসনার বিসর্জন করাই ছিলো নৈতিকতার মূলকথা। পরকালের সফলতার জন্য অবশ্যই এই জীবনকে বিসর্জন দিতে হবে – এটিই ছিলো দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে তখনকার ধারণা।

তাহলে মধ্যযুগীয় ক্যাথলিক মতবাদে আমরা দেখি, প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের একান্ত সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলোকে অস্বীকার করে ঈশ্বরের নৈকট্যলাভের প্রচেষ্টা ছিলো। যেন মানুষকে হতে হবে ঈশ্বরের ইচ্ছা বাস্তবায়নের হাতিয়ার। গ্রীক দেবতা জিউসের সাথে খ্রিষ্টধর্মের ঈশ্বরের কী আশ্চর্য মিল‍! রেনেসাঁ পরবর্তী আধুনিক ইউরোপের মানবতাবাদকে যদি আমরা প্রাচীন গ্রীসের মানবতাবাদের ধারাবাহিকতা বলতে পারি, তাহলে মধ্যযুগের খ্রিষ্টধর্মের শিক্ষাও গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর শিক্ষার ধারাবাহিকতা বলা যায়। কী মধ্যযুগ, আর কী আধুনিক যুগ – পাশ্চাত্যে সবাই গ্রীক সূত্র থেকেই সমৃদ্ধ হয়েছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ইতিহাসে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে শত বিরোধ থাকলেও বাস্তবতা হলো, এই দুটি ধারা একই উৎস থেকে জন্মলাভ করেছে।

এতক্ষণে আমরা বুঝতে পারলাম, বর্তমান পাশ্চাত্যে বিদ্যমান বিপরীতমুখী দুটি ধারারই গোড়া হলো গ্রীক মানবতাবাদ। বুর্জোয়া উদারতাবাদ ও মার্কসবাদ তত্ত্বগতভাবে ও কার্যক্ষেত্রে একই পথের পথিক। সেটি হলো মানবরচিত বস্তুবাদ। মানবসত্তার শুদ্ধ পরিচয় তথা আধ্যাত্মিকতার প্রসঙ্গটি ভলতেয়ার এবং মার্কস দুজনেই এড়িয়ে গিয়েছেন। বুর্জোয়া লিবারেল সমাজ ও সংঘবদ্ধ কমিউনিস্ট সমাজ দিনশেষে মানবতা, মানব জীবন ও সমাজের ব্যাপারে অভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। অগ্রসর কমিউনিস্ট সমাজের বুর্জোয়াসুলভ প্রবণতাকে তাই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা কোনো অঘটন নয়, বিপথগামিতাও নয়, নয় কোনো সংশোধনবাদী বিচ্যুতি। সবকিছুর চূড়ান্ত লক্ষ্য যেহেতু মানুষ, সেহেতু মানুষ সম্পর্কে যেসব দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম, তাদের শুরুটা যেখান থেকেই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা একই পথের পথিক এবং তাদের চূড়ান্ত মঞ্জিলও অভিন্ন হয়ে থাকে। এটাই স্বাভাবিক।

পশ্চিমা বুর্জোয়া লিবারেলিজম এবং মার্কসবাদ উভয় মতাদর্শই মানবতাবাদের দাবিদার। বুর্জোয়া লিবারালিজমের দাবি হলো, তারা মানুষকে মুক্তচিন্তা করার সুযোগ করে দিয়েছে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে। আর মার্কসবাদের দাবি হলো, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই ও অর্থনৈতিক উৎপাদনের মাধ্যমে মানুষের প্রতিভা বিকশিত হবে। একই লক্ষ্য অর্জনে মার্কসবাদ মানুষের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে একটি স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বের অধীনে একটিমাত্র আদর্শের ভিত্তিতে, একক সংগঠন হিসেবে সমাজ পরিচালনা করতে চায়। যা দিনশেষে সম্প্রীতির পরিবর্তে মানুষের উপর নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে লিবারেল বুর্জোয়া দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গিটিই মার্কসবাদে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এর ফলে বাস্তবে মার্কসবাদের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরে বুর্জোয়া জীবনের বিস্তৃতি ঘটে। ‘মার্কসবাদ কি বুর্জোয়াদের চেয়েও বেশি বুর্জোয়া নয়?’ কথাটি ঠাট্টাচ্ছলে বলা হলেও অসত্য নয়।

পাশ্চাত্যের বুর্জোয়া লিবারেলিজম নিজেকে যেভাবে মানবতাবাদী সংস্কৃতির ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বলে মনে করে, মার্কসবাদও সেভাবে মানবতাবাদের রূপায়নের মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার পথ দেখানোর দাবি করে। অস্তিত্ববাদও[4] এমন ধরনের একটি মানবতাবাদী তত্ত্ব। পূর্বসূরীদের চেয়ে এটি বরং মানবতাবাদের অধিকতর শক্তিশালী প্রতিনিধি হওয়ার দাবিদার।

এই তিনটি তত্ত্ব বা ধারার বাইরে চতুর্থ একটি বিরাট বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা রয়েছে, যা এসবগুলোর তুলনায় পুরানো এবং যার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। সেটি হলো ধর্মীয় বিশ্বদৃষ্টি (religious worldview)। প্রত্যেক ধর্ম যেহেতু ঘোষণা করে– তার মিশন হলো মানুষকে চূড়ান্ত মুক্তির পথ দেখানো, তাই মানবজাতিকে বুঝার জন্য এদের প্রত্যেকেরই নিজের মতো করে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। মানুষ বলতে কী বুঝায়, তা পরিষ্কার না করে মানুষের মুক্তি নিয়ে কথা বলা সম্ভব নয়। তাই সকল ধর্মের শুরুই হয় সৃষ্টিতত্ত্ব ও মানব-সৃষ্টি দর্শনের প্রসঙ্গ দিয়ে।

আজকের দিনে বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী এই চারটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার প্রত্যেকটিই মানবতাকে তাদের নীতি কিংবা প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। এগুলোর প্রত্যেকটিই নিজের সম্পর্কে এমন দাবি করে যে, তার দেখানো পথে অগ্রসর হলেই কেবল সফলতা আসবে। এমতাবস্থায় আমরা মানুষের এমন একটা সংজ্ঞা দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে পারি, যা আমাদেরকে এই জটিলতা সমাধানের ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।

(চলবে)

[মূল: আলী শরিয়তী, অনুবাদ: এন এইচ আব্দুল্লাহ]
এ লিখাটি পূর্ব প্রকাশিত হয়েছে সিএসসিএস ওয়েব সাইটে

আলী শরিয়তী

About আলী শরিয়তী

বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম। সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। ১৯৭৯ সালে সংঘটিত ইরান বিপ্লবের তাত্ত্বিক রূপকার।

Comments are closed.