মধ্যযুগের বর্বরতা:

ক্রুসেডস

১০৯৫ সাল থেকে নিয়ে ১২৭২ সাল পর্যন্ত চলা ক্রুসেডে ক্রিস্চিয়ানদের হাতে কয়েক মিলিয়ন নিরাপরাধ মানুষ নিহত হয়। প্রথম ক্রুসেডে পোপ দ্বিতীয় আরবান জ্বালাময়ী ঘোষণা দিয়ে নন-ক্রিস্চিয়ানদের রক্ত হালাল ঘোষণা করে। ইতিহাসে লেখা আছে জেরুজালেম নগরী রক্তের নদীতে পরিণত হয়েছিল সেদিন। দ্বিতীয় ক্রুসেডে মঠাধ্যক্ষ সেন্ট বার্নার্ড অফ ক্লেয়ারবক্স ঘোষণা করেন, প্যাগানদের মৃত্যুর মধ্যেই ক্রিস্চিয়ানদের গৌরব কারণ এতে জিসাস গৌরাবান্বিত হোন। পোপ তৃতীয় ইনোসেন্ট ১২০৯ সালে ফ্রান্সের ক্যাথারদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড ঘোষণা করে, যেই যুদ্ধে নিরাপরাধ ২ লক্ষেরও বেশি ক্যাথার জনগোষ্ঠী নিহত হয়। ক্যাথারদের অপরাধ ছিলো, তারা নাকি কুসংস্কারে বিশ্বাস করতো যা পোপের অপছন্দনীয় ছিল। ১২৩৩ সালে পোপ নবম গ্রেগরী ফ্রেইসল্যান্ডের সমস্ত স্টেডিঙ্গার মানুষদের সমূলে বিনাশ করতে উৎসাহিত করেন এবং ক্রুসেড ঘোষণা করেন ফলাফল, পুরো জনগোষ্ঠীকে হত্যা করা হয়। পোপ গ্রেগরী মনে করতেন, এইসব মানুষদের কাছে শয়তান বিভিন্ন রূপ ধরে আসে, অনেক সময় রাজহাঁসের সুরত ধরে। শুধুমাত্র এই তুচ্ছ কারণে তাদের সমূলে বিনাশ করা হয়।

দ্যা ইনকুইজিশন

দ্যা ইনকুইজিশন ছিলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যাথলিক চার্চ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত কাউকে পেলে মেরে ফেলার লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। ইনকুইজিশনের নামে মিলিয়ন মিলিয়ন নিরাপরাধ মানুষদের বিশেষ করে ফ্রান্সের ক্যাথার ও ওয়ালডেনশিয়ান জনগোষ্ঠীদের উপরে চলে ভয়াবহ নির্যাতন। ইনকুইজিশনের বৈধতা ও নির্যাতন পদ্ধতির প্রথম বৈধতা দেন পোপ চতুর্থ ইনোসেন্ট, এরপরে পোপ নবম গ্রেগরী আরো দুটি লিগাল অর্ডার জারি করে ইনকুইজিশনকে বেগবান করেন। স্পেনে রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানী ইসাবেলার ইনকুইজিশন অনুমোদন করেন পোপ চতুর্থ সিক্সটাস, যার ফলে লক্ষাধিক ইয়াহুদী ও মুসলমানদের মেরে ফেলা হয় ও স্পেন থেকে বের করে দেয়া হয়।

উইচ হান্টিং

ইনকুইজিশনের পরে ক্রিশ্চিয়ানদের দ্বারা সংগঠিত জগন্যতম অপরাধ হলো ‘উইচ হান্টিং’। ‘উইচ হান্টিং’ ছিল মূলত ইনকুইজিশনের ফলোআপ। ‘উইচ হান্টিং’ এর নামে মিলিয়নের মতো নিরাপরাধ মানুষদের হত্যা করা হয় যাদের অধিকাংশই ছিল নারী এবং এদের পুড়িয়ে মারা হয়। তৎকালীন ক্রিশ্চিয়ান ধর্মগুরুরা বিশ্বাস করতো জাদু ও ডাকিনিবিদ্যা চর্চা করার মাধ্যমে এরা সবকিছু নিয়ন্ত্রিত করে, এমনকি আবহাওয়াও নিয়ন্ত্রণ করে!!! ১২৫৮ সালের দিকে পোপ চতুর্থ আলেক্সান্ডার প্রথম ঘোষণা করেন ভুত প্রেতদের সাথে উইচদের যোগাযোগ হয়। তার এই ঘোষণা উইচক্রাফট ইনভেস্টিগেশনের সূচনা করে। ১৩০০ সালের দিকে পোপ দ্বাদশ জন জাদুকর ও ডাকিনিবিদ্যা চর্চাকারীদের খুঁজে বের করার জন্য অভিযানের নির্দেশ দেন। এমনকি ফ্রান্সের একজন বিশপকে জাদুবিদ্যা ব্যবহার করে পোপ দ্বাবিংশ জনকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মৃত্যদণ্ড দেয়া হয়। পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট উইচ হান্টিংয়ের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। উনি উইচদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার আমলে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করা হয় শুধুমাত্র সন্দেহের উপর ভিত্তি করে। যখনি কোনো রোগের প্রাদুর্ভব হতো বা খারাপ আবহাওয়ার সৃষ্টি হতো তখনি নেমে আসতো ভয়াবহ নির্যাতন। ১৫০০ সালের মাঝামাঝির দিকে রাজা পঞ্চম চার্লসের সময় আইন করে জাদুবিদ্যার চর্চাকারীদের মৃত্যুদণ্ড ও বিভিন্ন শাস্তির বিধান চালু করা হয়।

উইচ হান্টিং শুধু তৎকালীন রোমান সম্রাজ্য বা ইউরোপে সীমাবদ্ধ থাকেনি, পরবর্তীতে নর্থ আমেরিকার কলোনিয়াল ম্যাসাচুসেট্সও ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে কয়েকশো নিরীহ নারী ও শিশুদের হত্যা করা হয়। আফ্রিকাতেও এর ভয়াবহতার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। আপাতদৃষ্টিতে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট দ্বন্দ্ব থাকলেও উইচ হান্টিংয়ে উভয় দলের ধর্মগুরুদের সায় ছিল। এইকারণে মার্টিন লুথার, জন ক্যালভিন, জন ওয়েসলির মতো প্রটেস্টান্ট ধর্মগুরুদের সমর্থন ছিল উইচ হান্টিংয়ের নামে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের প্রতি।

দ্যা পিসান্ট ওয়ার

ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট যুদ্ধের কিছুদিন আগে ১৫২৪ সালের দিকে জার্মানিতে গরিব কৃষকের সাথে ক্যাথলিক চার্চ ও স্থানীয় প্রিন্সদের দ্বন্ধ লেগে যায়। কট্টর প্রোটেস্টান্টরা গরিব কৃষকদের সাথে আর ধনীরা ক্যাথলিকদের পক্ষ নেয়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ১ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায় যার অধিকাংশ ছিল গরিব কৃষক শ্রেণী।

প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক দ্বন্দ্ব

ফ্রাঞ্চের ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত ১৫৬২-১৫৯৮ সাল পর্যন্ত চলা এই ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট দ্বন্ধে প্রাণ হারায় ৪০ লক্ষেরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে এক রাতে হত্যা করা হয় ৭০০০০ হাজারেরও বেশি মানুষ। তৎকালীন প্রচন্ড ক্ষমতাশীল ক্যাথলিকদের আক্রমণে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় রিফর্মেশনের পটভূমি। পাল্টা জবাব দিতে সময় নেয়নি প্রটেস্টেন্টরা। থার্টি ইয়ার্স ওয়ার নামে ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে প্রাণ হারায় ৮০ লক্ষেরও বেশি মানুষ, যা পৃথিবী ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম হত্যাকান্ড। জার্মানির ২০% মানুষ মারা যায় এই যুদ্ধে।

আইরিশ রেবেলিওন অফ ১৬৬১

বলপূর্বক নিজেদের দাবি দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে প্রটেস্টান্ট শাসিত আয়ারল্যান্ডের ইংলিশ প্রশাসনিক দপ্তরে হটাৎ ক্যাথলিক গোষ্ঠী হামলে পড়ে এবং আয়ারল্যান্ডের উলস্টার শহরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয় যাতে অর্ধলক্ষের মতো মানুষ নিহত হয়।

আমেরিকা, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রীয় গণহত্যা

ইউরোপীয়ানরা আমেরিকা জয় করার প্রাক্কালে ১৪ মিলিয়নের মতো নেটিভ আমেরিকান ও সাউথ আমেরিকান হত্যা করে। ক্যারিবিয়ান ও সাউথ আমেরিকান হত্যাকান্ড মূলত ইউরোপিয়ান ক্যাথলিকরা ঘটায়। ১৪৫৫ সালের রোমান ক্যাথলিক চার্চের ডিক্রিকৃত নথিতে দেখা যায় পোপ পঞ্চম নিকোলাস দখলকৃত ভূমির বাসিন্দাদের মেরে ফেলা, জোর করে ধর্মান্তর ও দাসে পরিণত করা সমর্থন করেন। আমেরিকা ও আফ্রিকাতে ১৭ মিলিয়নের মতো দাস হত্যা করে ইউরোপীয়ানরা। ১৮৩৯ ও ১৮৬৬ সালে ভ্যাটিকান থেকে এসব হত্যাকান্ডকে সমর্থন দেয়া হয়।

আধুনিক যুগের হত্যাকান্ড:

চার্চ ও পোপদের সরাসরি ও প্রচ্ছন্ন সমর্থে শুধুমাত্র প্রাচীন বা মধ্যযুগেই নয় আধুনিককালেও গণহত্যা হয়েছে এমনকি বর্তমানেও অনেক জায়গা থেকে গণহত্যার খবর পাওয়া যায়, যার সংবাদ অধিকাংশই আমাদের কাছে পৌঁছায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্রোয়েশিয়া রোমান ক্যাথলিক নাজি রাষ্ট্র ছিল, এসময় প্রায় মিলিয়ন সার্ব ও অন্যান্য সংখ্যালগু জাতিগোষ্ঠীকে হত্যা করা হয়। রোমান ক্যাথলিক প্রিস্ট, নান্স, বিশপসরা এতে সমর্থন করে এবং অনেকে হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ নেয়। এই সার্বরাই ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ নিরহ মানুষ হত্যা করে যাদের প্রায় ৯০ ভাগ ছিল মুসলিম। সার্বরা আরো বেশি অর্থডক্স খ্রীষ্টান। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যা সবার মনে এখনো দাগ কেটে আছে, ক্রিশ্চিয়ানিটির নামে তুতসি জনগোষ্ঠীকে সমূলে বিলীন করে দেয়া হয়, হত্যা করা হয় মিলিয়নের মতো তুতসি।

সেন্ট্রাল আফ্রিকাতে ২০১২ থেকে এখন পর্যন্ত সেখানকার মুসলিমদের গণভাবে হত্যা করা হচ্ছে। গার্ডিয়ানের রিপোর্ট অনুযায়ী মিলিয়নের মতো মুসলিম ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে এবং আরো অসংখ্য প্রাণভয়ে দেশ ছেড়েছে। মুসলিম নিধনের মূল নেতৃত্ব দিচ্ছে এন্টি-বলাকা নামের উগ্র ক্রিশ্চিয়ান সন্ত্রাসী সংগঠন ।

ভাবতে অবাক লাগে এখনো উইচ হান্টিং চলছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যা আমরা অনেকেই জানিনা। ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত নাইজেরিয়াতে উইচ সন্দেহে হাজারের উপরে শিশু হত্যা করেছে সেখানকার খ্রীষ্টান ধর্মগুরুরা।

আফসোস লাগে যখন পশ্চিমারা ইসলামের উপর মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে এবং ইসলামকে বর্বর ও মানবতা বিরোধী বিধান বলে প্রচার করে, অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ইসলামের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অন্যায়ভাবে নিরীহ মানুষ হত্যার কোনো প্রমান পাওয়া যায়না।

একটি মাত্র উদাহরণ দিয়ে শেষ করবো, ইতিমধ্যে আপনারা জেনেছেন প্রথম ক্রুসেডে ক্রিশ্চিয়ানরা অকাতরে নিরহ মুসলিম ও ইহুদিদের হত্যা করেছে কিন্তু এর কিছুকাল পরে যখন মুসলিম বীর সালাহউদ্দিন (রঃ:) জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করলো তখন যুদ্ধের ময়দান ছাড়া একজনও নিরীহ ক্রিশ্চিয়ান বা অন্য ধর্মের কাউকে হত্যা করেছে বলে কেউ কোনো প্রমান দিতে পারবেনা।

লেখক: সাইফুর রাহমান [PhD Researcher in Cambridge University]

মূল পোস্ট: https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10212818618994470&id=1058425137

Comments are closed.