ভাল থাকা নিয়ে কিছু কথা

“Hello! How are you?” একে অপরের সাথে দেখা হলে সালাম বিনিময়ের পর কুশল জানতে চেয়ে সাধারনত আমরা জিজ্ঞাসা করি, আপনি কেমন আছেন বা আপনি ভাল আছেন তো? এর উত্তরে সচরাচর বলা হয়, “আলহামদুলিল্লাহ্, ভাল আছি।” এই ভাল থাকা অর্থাৎ শান্তিতে থাকার মর্ম সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলে তবেই জীবন সার্থক হয়। কেউ গাড়ী, বাড়ী, ব্যাংক ব্যালেন্স, সোনার গহনা, একের পর এক জমি ও প্লট কিনে অর্থাৎ অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে ভাল থাকার চেষ্টা ও শান্তির খোঁজ করেন। আবার কেউ হয়ত এত কিছু থাকাকে ভাল ও শান্তিতে থাকার অন্তরায় ভাবেন। যে যাই ভাবুক না কেন, যদি সত্যিই ভাল ও শান্তিতে থাকতে চান তহালে মৌলিক চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আপনাকে অবশ্যই দেহ-মনে সুস্থ থাকার প্রচেষ্টা নিতে হবে। তা না হলে সবই বৃথা হয়ে যেতে পারে।

সুস্থতা মহান স্রষ্টার এক অমূল্য নেয়ামত। দেহ-মন সুস্থ থাকলে তবেই শান্তি মেলে। অপরদিকে অসুস্থতার অপর নাম অশান্তি। বংশগতভাবে কে কোন্ রোগ নিয়ে জন্মাবেন কিংবা কে কখন কতটা অসুস্থ হয়ে যাবেন, তা বলা যায়না। মরণও কাউকে বলে কয়ে আসেনা। কঠিন রোগ নিয়ে বছরের পর বছর কষ্ট পেয়েও মৃত্যু আসেনা। আবার সুস্থ-সবল শরীরে অকস্মাৎ মৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়। এ সবই ভাগ্যের লিখন। মানুষ অসুস্থ হতেই পারে। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভাগ্যের উপর ভর করে বসে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। রোগ নিরাময় এবং তা প্রতিরোধের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ সেবন করার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তাই বলে সুস্থতা মানে কথায় কথায় ডাক্তার বাবুর পিছে ছোটা নয়; এটা ওটা পরীক্ষার নামে হয়রানী আর পয়সা খরচ এবং সকাল- দুপুর- রাতে একটার পর একটা ওষুধ গেলাও নয়। পেট থেকে পিঠ পর্যন্ত থালা ভর্তি মুখরোচক খাবার খেলেই সুস্থ থাকা যায় না। আরাম আয়েশে বসে বসে নাদুস-নুদুস দেহ ধারনই সুস্থতার লক্ষণ নয়; বরং সুস্থতা মানে হলো স্বাস্থ্য বিধি অনুসারে দেহ ও মনে সুস্থ-সবল থাকা।

সবার স্বাস্থ্য-ভাগ্য একরকম নাও হতে পারে। এমনও অনেকে আছেন যারা জন্মগতভাবেই নানাবিধ রোগে ভুগছেন। তাছাড়া কার কখন কি রোগ হবে, নাকি হবে না- তা বলা মুশকিল। তবে এটা ঠিক যে, সুস্থ থাকার বেসিক প্রিন্সিপালগুলো ফলো করলে রোগের হাত থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারনত দেখা যায় যে, রোগে আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত কেউ সুস্থতার মৌল বিধিগুলো মানার ব্যপারে যত্নশীল হতে চান না। বিভিন্ন অনিয়মের কারণে যে একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে রোগ দানা বাধতে পারে তা অনেক সময় আমরা ভুলে যাই। হঠাৎ করে যখন কোন রোগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন মাথায় বাজ পরে। আর একসাথে একের অধিক রোগ ধরা পরলে তো বেহাল অবস্থা। এ ডাক্তার সে ডাক্তার, টেস্টের পরে টেস্ট করা, তালিকা ধরে ওষুধ গেলা, খাবারের তালিকা থেকে অনেক খাদ্যই বাদ দেয়া ছাড়া তখন আর কোন উপায় থাকেনা। আগে থেকে একটু সাবধান হলে জীবনটা হয়ত আরও সহজ হত। হঠাৎ করে এতটা চাপ সহ্য করতে হতনা।

সুস্থতার নাগাল পেতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মৌল বিষয়গুলো জেনে নিতে হবে। সে অনুসারে কিছু নীতিমালা ও নিয়ম মেনে জীবনযাপন করার প্রতি যত্নশীল হতে হবে। তাহলে অনেক রোগের হাত থেকে যেমন বেঁচে থাকা সম্ভব হবে, তেমনি রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমে ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে দমিয়ে রাখা যাবে। ফলে কথায় কথায় ডাক্তারের কাছে ধর্ণা দিতে হবে না, এটা ওটা পরীক্ষার নামে যন্ত্রণা ও খরচও অনেক কমে আসবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, জেনে বুঝে নিজে সচেষ্ট হলে রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখেও সুস্থভাবে জীবন কাটানো যায়।

আমাদেরকে মনে রাখাতে হবে যে, আরাম আয়েশের জীবন ও স্থূলতা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সহজ কথায় দেহে অস্বাভাবিক হারে Fat অর্থাৎ চর্বি জমে গেলে তাকে obesity অর্থাৎ স্থূলতা বলে। শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশসমূহেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ স্থূলতা জণিত নানান জটিলতায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিডনীরোগীদের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তাছাড়া হাড়ের ক্ষয় জনিত স্বাভাবিক চলাফেরা ও ওঠা-বসায় কষ্ট এবং হাঁটুব্যথা, লিভার ও পিত্তথলির সমস্যা মোটা মানুষদের জন্য কমন ব্যাপার। জেনেটিক ফ্যাক্টর একটি অন্যতম কারণ হলেও অতিমাত্রায় ক্যালোরি গ্রহণ এবং সেই সাথে আয়েশী জীবনযাপনই ওবেসিটির জন্য অনেকাংশে দায়ি। তবে জেনেটিকাল কারণ থাকলে অপরিমিত আহার ও আসনাশ্রিত জীবনধারার কারণে একজন স্বাভাবিক ওজনদার বক্তিও রক্তে লিপিডের অসামঞ্জস্যতা কিংবা অন্যান্য অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে যেতে পারেন। সুতরাং স্থুলতা ও আসনাশ্রিত জীবনধারার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে হলে ভালমন্দ জেনেবুঝে আমাদেরকে সময়মত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

স্থুলতা থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমত ওজন বাড়লো কিনা সে বিষয়ে সব সময় নিজেকেই বেশি সচেতন থাকতে হবে। মনের আয়নায় একদিকে আপনার স্লিম ও স্মার্ট এবং অপরদিকে পেটমোটা, গালফোলা থলথেলে চেহারার পার্থক্যটা কল্পণা করতে চেষ্টা করুন। তাহলেই অনেকটা কাজ হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা স্থুলতা জণিত উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন তাদের দেহের ওজন ১ কেজি কমালে সিসটোলিক রক্তচাপ ১.২ এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ ১.০ মিলিমটার-মার্কারি কমে আসে। ওজন কমানোর জন্য সচেষ্ট হলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ ও লিভারে চর্বি জমা সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়। সুতরাং ওজন স্বাভাবিক রাখা সবদিক দিয়েই ভাল।

সব সময় যে একই খাদ্য তালিকা মেনে আহার করতে হবে তা নয়। আগে ওজন, বয়স ও সক্রিয়তা অনুসারে প্রতিদিনকার আদর্শ ক্যালোরী চাহিদা নির্ণয় করে নিন। তারপর খাদ্যের পুষ্টিগুণ অনুসারে নিজের রুচিমত ও সঠিক মাত্রায় খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করে নিতে পারেন। পেট কিছুটা খালি রেখে খাওয়ার অভ্যাস করাই ভাল। তাই বলে ভাববেন না যে, আমি ভাল ভাল মজাদার সব খাবার খাওয়া একদম বন্ধ করে দেয়ার কথা বলছি। না ভাই, আমি কখনই তা বলছিনা। মাঝে মাঝে বিয়ের দাওয়াত, ঘরোয়া আসর ও অফিসিয়াল ডিনার পার্টিতে যোগ দিয়ে সামাজিকতা রক্ষা করতেই হয়। সেখানে গিয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেই তো হবে না, বরং তাতে অংশ না নিলে বেমানানই ঠেকবে। সবার সাথে অংশ নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর আপনি তুলতেই পারেন। কিন্তু মাত্রাছাড়া যেন না হয় সেটার দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। কখনো খাওয়ার পরিমাণ একটু বেশি হয়ে গেলে তা বার্ন করার জন্য ব্যায়ামের পরিমাণটাও বাড়িয়ে দিন। সেইসাথে পরের দিন একটু কন্ট্রোল করে খাওয়ার চেষ্টা করুন। তাহলেই তো হলো। সক্রিয় থাকলে সমস্যা অনেক কমে যাবে। তবে যারা বিভিন্ন রোগে ভুগছেন, তাদেরকে চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক খাদ্য গ্রহণ করার বিষয়ে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। তা না হলে যে নিজেকেই ভুগতে হবে তাতে সন্দেহ নেই।

মনে রাখবেন, হঠাৎ করে খুব বেশি ওজন কমিয়ে ফেললে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই ওজন কমানোর প্রতিযোগীতায় ‘স্লো বাট স্টিডি’ হলেই ভাল ফল পাবেন। দেহের অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে নিজেকে সুস্থ ও ফিটফাট রাখতে চাইলে আজ থেকেই শুরু করুন:-

*আরাম আয়েশের জীবন রক্তে খারাপ চর্বির মাত্রা বাড়ায়। ফলে হৃদরোগ সহ স্থুলতা জনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই সক্রিয় থাকার পাশাপাশি প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম ও হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রাত্যহিক কর্মের পাশাপাশি সকালে বা সন্ধায় অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট করে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ৬ কিমি গতিতে (১১৫ – ১২০ কদম/মিনিট) সপ্তাহে ৫ থেকে ৬ দিন (অর্থাৎ সপ্তাহে মোট অন্তত ১৮০ মিনিট) হাঁটুন। হাঁটার সময় ঢিলেঢালা পোষাক এবং কের্টস পরার চেষ্টা করুন। যাদের হাঁটার অভ্যাস নেই এবং ওজন একটু বেশি তারা শুরুতে কয়েকদিন ১০ – ১৫ মিনিট করে হাঁটুন। তারপর ধীরে ধীরে হাঁটার সময় ও স্পীড বাড়াতে থাকুন। সামর্থ ও সময় থাকলে হাঁটার পাশাপাশি হালকা ব্যয়াম করুন, মাঝে মাঝে সাঁতার কাটুন কিংবা নিজের পছন্দমত খেলাধুলা করুন। দেহ-মনে নিজেকে যত সক্রিয় রাখতে পারবেন ততই মঙ্গল।

*শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য প্রতিদিনকার ক্যালোরী চাহিদা থেকে খুব বেশি না কমিয়ে বরং সক্রিয়তার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়াই উত্তম। তবে কিছুদিন কার্বোহাইড্রেট ও চর্বি গ্রহণের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে তার স্থলে ক্যালোরী চাহিদা মাফিক (২৫ – ৩০%) উচ্চ মাত্রায় প্রোটিন গ্রহণ করা যেতে পারে। ওজন স্বাভাবিক হয়ে এলে সকল খাদ্য উপাদান আবার স্বাভাবিক মাত্রায় গ্রহণ করতে হবে।

*সপ্তাহে অন্তত ৩ – ৪ দিন সকাল ১১ – ১২ টার দিকে অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য হলেও শরীরের যতটা অংশ উন্মুক্ত রাখা সম্ভব তাতে সূর্যের আলো লাগানোর চেষ্টা করুন। ছাদে, বাগানে কিংবা মাঠে বসে সৌররশ্মি সেবন করা যেতে পারে। যাদের পক্ষে সমূদ্র সৈকতে যাওয়ার সুযোগ আছে তাদের জন্য তো সমূদ্র স্নানের সাথে সাথে সূর্যস্নান করারও সুযোগ মেলে, যা শরীর ও মন উভয়ের জন্যই উত্তম। তবে সানবার্ণের ক্ষতি থেকে অবশ্যই নিজেকে রক্ষা করতে হবে।

*চর্বি ও মিষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিন।

*রেড-মিট কম খেয়ে তার বদলে পরিমিত পরিমাণে মাছ ও মুরগি খান।

*আইসক্রিম, সফ্ট ড্রিংক্স ও বেকারির খাবার তথা সকল প্রকার জাঙ্ক ফুড যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন।

*ধুমপান ও এ্যালকোহল পরিত্যাগ করুন।

*ক্যালোরি চাহিদা পূরনের জন্য ফল, সবজি ও শস্য দানা বেশি খেতে চেষ্টা করুন।

*ভাত কম খেয়ে তার বদলে গমের আটার তৈরি রুটি খান।

*পেট পুরে না খেয়ে কিছুটা খালি রেখেই বেশ খানিকটা পানি পান করে নিন। সকালে খালি পেটে ৫০০ – ৬০০ মিলি লিটার পানি পান করার অভ্যাস করুন। প্রতিদিন অন্তত ২.৫ থেকে ৩ লিটার পানি পান করুন।

*পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে খাবার অভ্যাস করুন। লেবুর চোষা খুব ভাল এন্টি অক্সিডেন্টের কাজ করে। তাই লেবুর চোষা ফেলে না দিয়ে কুচি করে কেটে সালাদের সাথে মিশিয়ে খেতে পারেন।

*সকাল, দুপুর ও রাতে সময়মত আহার সেরে নিন। প্রয়োজন অনুসারে সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন।

*সময়মত ও নির্দিষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম ও ঘুম খুবই জরুরী। দুপুরের আহার ও প্রার্থণার পর (জায়নামাজ বা শীতল পাটির উপর) ১৫-২০ মিঃ চোখ বুঝে চুপচাপ সটান শুয়ে থাকাত পারলে খুবই ভাল হয়। তবে রাতে ৬-৭ ঘন্টা ঘুমানো অপরিহার্য। এতে স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং কর্মস্পৃহা বৃদ্ধির সাথে সাথে কাজের মানও বাড়ে।

*প্রত্যহ ঘুম থেকে উঠে ও ঘুমাতে যাওয়ার আগে দাঁত মাজতে ভুলবেন না। কর্মস্থলে যাওয়ার আগে কিংবা যারা বাসায় অবস্থান করেন তারা সময়মত গোসল সেরে নিন। আর বাহিরের কাজ সেরে বাসায় ফিরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিন।

আজকাল কেউ কেউ শুধুই নিরামিষভোজী হয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে আমিষপ্রিয়রা সুযোগ পেলেই পেট ভরে হরদম কালিয়া কোপ্তা, কাচ্চি-বিরিয়ানি, কাবাব, রোস্ট ইত্যাদি মাংসজাত খাদ্যে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। নিরামিষের (Vegetable) গন্ধ পেলে রুমাল দিয়ে নাক ঢেকে দূরে পালাতে পারলে যেন তারা হাফ ছেড়ে বাঁচেন। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছাত্র ছাত্রিরা ফাস্টফুড খাওয়ায় যেন কম্পিটিশনে নেমে গেছেন। ফলে কম বয়সেই মুটিয়ে যাচ্ছেন। কেউ আবার পেটের পিড়া ও নানা রকম উপসর্গে ভুগছেন। সবজি খাওয়ারও যে প্রয়োজন রয়েছে, তা জানা সত্বেও মানার প্রতি তারা উদাসীনই থেকে যাচ্ছেন। কাজটা কি আদৌ ঠিক হচ্ছে?

মহান স্রষ্টা মানুষকে শুধুই নিরামিষভোজী কিংবা আমিষভুক্ নয় বরং প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ, উভয় প্রকার খাদ্য গ্রহণের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তাই বলে কারো সাধ্য থাকলেই ভোগ বিলাসিতায় মেতে (০৭:৩১) উদরপূর্তি করে প্রয়োজনের (৪৭:১২) অতিরিক্ত খেতে ও অপচয় করতে পবিত্র কোরআনে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে:

    ০৭ নং সূরা আল রাফ (মক্কায় অবতীর্ণ), আয়াত নং- ৩১. হে আদম সন্তানেরা! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় পরিচ্ছন্ন পরিচ্ছদ পরিধান করে নাও; খাও ও পান কর, কিন্তু অপচয় করো না। নিঃসন্দেহে তিনি অমিতব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।

    ৪৭ নং সূরা মুহাম্মদ (মদীনায় অবতীর্ণ), আয়াত নং- ১২. যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার নিম্নদেশে নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হয়। আর যারা অবিশ্বাসী, তারা কেবলই ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে এবং চতুস্পদ জন্তুর মত আহার করে। তাদের বাসস্থান জাহান্নাম।

সুতরাং উল্লেখিত বাণীগুলোর নির্দেশনা অনুসারে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কোন্ ধরনের খাদ্য কি পরিমাণে খেতে হবে তা নির্ণয়ের দায়িত্বও মানুষের উপরেই বর্তায়। প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ, উভয় প্রকার খাদ্যই প্রয়োজন অনুসারে কম-বেশি আমাদের খাবারের তালিকায় রাখতে হবে। যেহেতু মানুষ কেবলমাত্র মাংসভূক প্রাণী নয়। তাই প্রাণীজ খাদ্য অপেক্ষা উদ্ভিজ্জ খাদ্য কিছুটা বেশি পরিমাণে খাওয়াই উত্তম। আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালনের পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান ও পরিমিত আহার করা এবং অহেতুক বিলাসিতা ও অপচয় না করাও বিশ্বাসী মানুষের পরিচয় বহন করে। সুস্থ এবং অসুস্থ কারো জন্যই এ বিষয়ে অবহেলা করা ঠিক নয়। অসুস্থদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ওষুধ সেবনের পাশাপাশি খাদ্য গ্রহণ ও বর্জনের ব্যাপারে তাদের নিজেদের স্বার্থেই অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। রোগের ধরন ও প্রকপ অনুসারে খাদ্য নির্বাচন ও তার পরিমাণ নির্ধারণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য পরিহার করার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরী।

    হাদিছ: সুনানে ইবনে মাজাহ / অধ্যায়ঃ ২৩/ আহার ও তার শিষ্টাচার

১/৩২৫৪। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একজনের খাবার দু’জনের জন্য যথেষ্ট, দু’জনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট এবং চারজনের খাবার আটজনের জন্য যথেষ্ট হতে পারে।

২/৩২৫৭। ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ কাফের ব্যক্তি সাতটি পাকস্থলী পূর্তি করে খায় এবং মুমিন ব্যক্তি এক পাকস্থলী পূর্তি করে খায়।

১/৩৩৪৯। মিকদাম ইবনে মাদীকারিব (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছিঃ মানুষ পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোন পাত্র ভর্তি করে না। যতটুকু আহার করলে মেরুদন্ড সোজা রাখা সম্ভব, ততটুকু খাদ্যই কোন ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট। এরপরও যদি কোন ব্যক্তির উপর তার নফস (প্রবৃত্তি) জয়যুক্ত হয়, তবে সে তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।

রাসূলুল্লাহ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত হিসেবে তাঁর নির্দেশনা অনুসারে পেট পুরে না খেয়ে বরং পেটকে তিন ভাগে ভাগ করে তার একভাগ আহার করা, একভাগ পানি পান করা এবং বাকি একভাগ খালি রাখার অভ্যাস করতে হবে। এ পদ্ধতিতে আহার করাটা যে কতটা বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যসম্মত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

দৈহিক সুস্থতার সাথে সাথে মনকে সুস্থ রাখাটাও জরুরী। মনে অশান্তি থাকলে দেহের উপরে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। অহেতুক মানসিক চাপ দেহ-মনে নানান রোগের জন্ম দিতে পারে। এমনকি সময়মত উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি মনকে প্রফুল্ল রাখার বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার জন্যই শরীরচর্চা, খেলাধুলা ও ঘুরে বেড়ানোর মত মানসম্মত স্থান ও সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরে বাইরে সর্বত্র দূষণমুক্ত, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও শঙ্কামুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি আধ্যাত্মিক সাধনা অর্থাৎ একমাত্র মহান স্রষ্টার প্রতি ঐকান্তিকভাবে ইমান এনে ধর্মীয় বিধান মেনে আত্মশোধনে সচ্ষ্টে হতে হবে। স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক কর্ম ছেড়ে সৎকর্ম তথা সৃষ্টিকুলের কল্যাণে নিবেদিত হতে হবে। তা না হলে জাতিগতভাবে কখনই ভাল ও শান্তিতে থাকার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।

Comments are closed.