বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার নসিহত : ফরহাদ মজহার

বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার নসিহত নতুন কিছু নয়। হামেশাই আওয়ামী লীগ এই পরামর্শ দিয়ে আসছে। সম্প্রতি শেখ হাসিনা তথাকথিত নির্বাচনের পর সংবাদ সম্মেলনে পুরনো কথা আবার বলেছেন। বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের রাজনীতির এটাই সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাদীদের এটাই প্রধান রাজনৈতিক প্রপাগা-া। অস্বীকার করার জো নাই যে, আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে বিএনপিকে সাময়িক কাবু করতে পেরেছে।

 

সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে সাক্ষাতকারে খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার সময় আসেনি, এ মুহূর্তে তিনি পারছেন না, সময় হলেই তিনি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়বেন। এটাও বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট ‘স্থায়ী’ কোনো জোট নয়।

 

অন্যদিকে, গত সোমবার বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথার উত্তরে বলেছিলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) হুকুম করতে পারেন না। তিনিও জামায়াতের সঙ্গে ছিলেন। আমরা তার (শেখ হাসিনা) নির্দেশনা অনুযায়ী পার্টি চালাব না। আমরা একটি স্বাধীন পার্টি। সুতরাং আমরা আমাদের পার্টি নিজেদের পন্থাতেই চালাব।’

 

আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা, তিনি সব সময়ই আলোচনার জন্য প্রস্তুত, এ কথা তিনি আগেও বলেছিলেন, আবারও বিবিসিকে বলেছেন। আলোচনার অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য তার দলের নেতাকর্মীদের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া, নেতাকর্মীদের দমনপীড়ন বন্ধ করা, বে আইনিভাবে বন্ধ করে দেয়া পত্রিকা ও টেলিভিশন স্টেশনগুলো খুলে দেয়ার কথাও তিনি বলেছেন। আওয়ামী লীগ আলোচনা চায় না, আলোচনার অনুকূল পরিবেশও চায় না। ফলে আলোচনার অনুকূল পরিবেশও তৈরি হবে না। বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করলেও আওয়ামী লীগ কোনো আলোচনা ও সমঝোতায় আসবে না। আওয়ামী লীগের দিক থেকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার কথা নিতান্তই রাজনৈতিক প্রচারকৌশল মাত্র।

 

আরেক বিদেশী গণমাধ্যমকে খালেদা জিয়া একটি সাক্ষাতকার দিয়েছেন। সেখানেও তিনি বলেছেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে জোট বা আঁতাতের বিষয়টি শুধুই কৌশলগত ব্যাপার’। ফলে বিএনপির জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা, না করার তর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তর্কে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি শেখ হাসিনার প্রপাগান্ডার শিকার হয়ে পড়েছেন কি-না, কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক চাপের। কৌশলের প্রশ্ন একদিক থেকে সহজ একটি ইস্যু। জটিল কিছু নয়। সংসদীয় রাজনীতিতে আঁতাত বা জোট বাঁধা একটি স্বাভাবিক রীতি বা কৌশল। সেটা হতেই পারে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ‘জোট’ যদি অন্যায় কিছু হয়, তবে সেটা পার্লামেন্টারি রাজনীতির মুশকিল। বিএনপির নয়। আজ জামায়াতের সঙ্গে জোট আছে, কাল নাও থাকতে পারে। এর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাত ছিল, এখন নাই। বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ সেই শূন্যস্থানে জামায়াতের সঙ্গে জোট করবে না তার গ্যারান্টি কী? জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক সম্পর্ক কৌতুক ও কৌতূহল দুটোই তৈরি করেছে। যদি জাতীয় পার্টির সঙ্গে এই মহব্বত দেখি, তাহলে ক্ষমতার দরকারে জামায়াতের সঙ্গ শেখ হাসিনা কামনা করবেন না, তা বলা যাবে না। জামায়াত সেক্ষেত্রে কী করবে সেটা ভিন্ন তর্ক।

 

সঙ্গ ত্যাগ করা, না করা যদি নীতিগত প্রশ্ন হয়, তাহলে এর উত্তর আরও অনেক ব্যাখ্যা দাবি করে। বাংলাদেশে জামায়াতের সঙ্গ বা বিসঙ্গ নিয়ে তর্ক সুস্থভাবে করার উপায় নাই। জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিনাশ করার এবং সাধারণভাবে ইসলামী রাজনীতি ‘নির্মূল’ করার একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ধারা বাংলাদেশে রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী তারপরও কেন আজও নির্মূল হলো না সেটাই বরং বিস্ময়ের। এই রাজনীতি রসদ সংগ্রহ করে একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা থেকে। একাত্তরে রাজনৈতিক মতাদর্শিক কারণে জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা করা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ রাজনীতি নয়, অপরাধ। মূলত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠিত হওয়ার পর অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়া ও রায় নিয়ে তর্ক আছে। এতে নতুন রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে বটে, কিন্তু যেহেতু বিচার চলছে, ফলে একাত্তরের যুদ্ধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ে বেশিদিন রাজনীতি করা যাবে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আন্তর্জাতিক আইনি মানদ- রক্ষা করতে পারল, না ব্যর্থ হল সেই তর্ক নতুন রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। কিন্তু সেটা ভিন্ন বিতর্ক। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান ইস্যু বরং হয়ে উঠবে রাজনীতিতে ইসলামের ভূমিকা।

 

দুই

 

একাত্তরে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ধারাই একাত্তরকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন হিসেবেই বিবেচনা করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে নয়। শ্রেণী সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে কোনটি প্রধান দ্বন্দ্ব এই তর্কে কমিউনিস্টদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। যারা বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত নন, তারা এই তর্কের গুরুত্ব ধরতে পারবেন না। অথচ এই তর্কগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস বোঝার জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক।

 

এখানে বিস্তারিত আলোচনা করার অবসর হবে না। তবে একটি বিষয় প্রশ্ন আকারে পাঠকদের ভাববার জন্য পেশ করে রাখি। একজন মাতব্বর, টাউট, জোতদার বা আইয়ুবি আমলে কন্ট্রাকটারি করে হঠাৎ ধনিক হওয়া শোষক গ্রামের গরিব ও নিপীড়িত জনগণের প্রধান শত্র“, নাকি নিপীড়িত জনগণসহ বাঙালি জোতদার, টাউট, কন্ট্রাকটর মিলে যে ‘বাঙালি’, সেই বাঙালির ওপর ‘পাঞ্জাবি’দের নিপীড়নটা মুখ্য? জাতিবাদীরা বলতেন, জাতীয় নিপীড়নই প্রধান দ্বন্দ্ব, পাঞ্জাবিদের তাড়িয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যারা শ্রেণীর বিরোধকে প্রধান গণ্য করতেন তারা সেটা মানতেন না। তারা বলতেন, জাতিবাদী বিভাজনের ভিত্তিতে লড়াই আদতে বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক লড়াই। তা আজ হোক কাল হোক বাঙালি বনাম পাঞ্জাবি বা বাঙালি বনাম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে প্রকাশ পাবে। শ্রেণীর প্রশ্ন উহ্য রাখলে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিণতি লাভ করে বর্ণবাদ ও জাতিগত সাম্প্রদায়িকতায়। উগ্র হলে রূপ নেয় ভয়ংকর ফ্যাসিবাদে। কে ঠিক আর কে বেঠিক সেই তর্ক এখানে করব না। মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের অবদান ও ইতিহাস জাতিবাদীরা মুছে দিতে চায়, একই সঙ্গে এই তর্কের ইতিহাসকেও। যে কারণে, যেমন, খুব কম তরুণই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সম্পর্কে জানে। কমিউনিস্টদের ব্যর্থতার অনেক কারণ আছে। কিন্তু এই তর্কগুলো এখনও প্রাসঙ্গিক। আসলে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে কোথায় ঐক্য আর কোথায় বিরোধ, মার্কসবাদে এটা অনেক আগেই বিবৃত করা হয়েছে। মীমাংসা হয়েছেÑ সেই দাবি করা কঠিন। বরং আরও জটিল হয়েছে। কারণ আরও বড় পরিসরে বিচার করলে বিরোধটা হচ্ছে মূলত রাজনৈতিক সংগ্রাম বনাম অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে পার্থক্য বিচার। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে সঠিক নীতি ও কৌশল প্রণয়নের মামলা।

 

কমিউনিস্ট আন্দোলন সে সময় চীনপন্থী ও রুশপন্থী ধারায় ভাগ হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ষাট ও সত্তর দশকে প্রধান দুশমন হিসেবে বিবেচিত হতো। রুশপন্থীরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতেন, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়াও একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ ছিল সেটা মানতেন না। চৈনিক বামপন্থার কাছে সোভিয়েত রাশিয়া ছিল ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’। দিল্লি ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার মিত্র। রুশ-ভারত অক্ষশক্তি পাকিস্তান ভেঙ্গে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করতে চায়, চীনপন্থী বামরা এই আশংকায় শেখ মুজিবের রাজনীতিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতি গণ্য করত। একই আশংকায় তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বলতে তারা ইসলামাবাদ ও দিল্লি উভয়ের দখলদারি থেকে বাংলাদেশের ‘মুক্তি’ বুঝেছিলেন। এই অসম যুদ্ধে তারা হেরে গিয়েছেন, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু তারা ভুল বলেছিলেন কি-না সেটা আমরা নিজ নিজ বিবেচনায় বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা বিচার করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি।

 

বাংলাদেশকে রুশ-ভারত অক্ষশক্তি বা তখনকার চৈনিক রাজনীতির ভাষায় ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’-এর অধীনে নেয়ার পাঁয়তারার বিরোধিতা করেছিল বিপ্লবী রাজনীতির বেশ কয়েকটি ধারা। বাংলাদেশকে দিল্লির কলোনি বা উপনিবেশে পরিণত করার বিরুদ্ধে এই লড়াই যেন কোনো পরিণত রূপ নিতে না পারে তার জন্য দিল্লি সে সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং মুক্তিযুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করে আনে। বাংলাদেশকে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে স্বাধীনভাবে মুক্ত করার সম্ভাবনাকে ভ্রƒণেই বিনাশ করে দেয়। এই সুবাদেই দিল্লি আমাদের মিত্র।

 

বহু উত্থান-পতন, বহু অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান এবং তথাকথিত সংসদীয় রাজনীতির তামাশার মধ্য দিয়ে দিল্লি-ঢাকার সম্পর্ক আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে খোলা চোখে বিচার করলে সে সময়ের প্রগতিশীল রাজনীতির আশংকাকে আবার নতুন করে বিচার করা জরুরি হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ৪২ বছর পর তারা সঠিক কী ভুল প্রমাণিত হয়েছেন সেই কূটতর্ক নয়, আমরা যেন খোলা মনে নির্মোহভাবে ইতিহাস বিচার করতে শিখি তার তাগাদার জন্যই পুরনো কথা তোলা। এ আলোচনা আমাদের এখনকার রাজনীতির জন্য প্রাসঙ্গিকও বটে।

 

তিন

 

জামায়াত কেন পাকিস্তান ভাঙতে চায়নি, তার পক্ষে নিশ্চয়ই আদর্শগত কারণ রয়েছে। তার ব্যাখ্যা জামায়াতে ইসলামীকেই দিতে হবে। সেটা ইসলাম সংক্রান্ত জামায়াতের ব্যাখ্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সে ব্যাখ্যা ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে কি-না, সেই মানদ-েই জামায়াত তার রাজনীতির পর্যালোচনা করবে, কোনো সুবিধাবাদী জায়গা থেকে নয়। জাতীয়তাবাদীদের সন্তুষ্ট করা ইসলামী রাজনীতির কাজ না। কিংবা বঙ্গীয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদেরও নয়। জামায়াতের ব্যাখ্যা ইসলামের একমাত্র ব্যাখ্যা নাও হতে পারে। ফলে তারও সমালোচনা হতে পারে। আর, ‘ইসলাম’ ডাকনামে যাকে আমরা চিহ্নিত করি সেটাও একাট্টা একরকম নয়। তার নানান ফেরকা, নানান মাজহাব রয়েছে। কিন্তু জামায়াত সম্পর্কে প্রধান অভিযোগ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। সন্দেহ নাই, সুষ্ঠ ও ন্যায়সঙ্গত বিচারের মধ্য দিয়ে এই অভিযোগের নিষ্পত্তি হওয়া উচিত ছিল অনেক আগে। কিন্তু সেটা হয়নি। আর তার দুর্ভোগ আজ সবাইকেই ভোগ করতে হচ্ছে। এমনকি যারা অভিযুক্ত তাদেরও। ভুল রাজনীতির মাশুল খুব চড়া দামে পরিশোধ করতে হয়। সেই দাম শুধু জামায়াতে ইসলামী পরিশোধ করছে না, বাংলাদেশের গোটা ইসলামী আন্দোলনকেও গত ৪২ বছর ধরে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর অবসান হওয়া দরকার।

 

জামায়াত রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। জামায়াতের একটা রাজনৈতিক ভিত্তি আছে। নইলে আওয়ামী লীগ একসময় জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে আগ্রহী হয়েছিল কেন? আজ নানা কারণে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নিয়ে দেশে ও বিদেশে যে বিতর্ক তার আইনি দিক যেমন আছে, তেমনি তার রাজনৈতিক দিকও আছে। সাধারণভাবে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি থেকে এই বিচারকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নাই। আইনি পরিম-লে এর মীমাংসা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনা তা চেয়েছেন বলে এখন প্রমাণ করা মুশকিল। যে বিচার বাংলাদেশকে বিভেদ ও বিভাজনের বিষাক্ত রাজনীতি থেকে মুক্ত করতে পারত, তা হয়ে উঠেছে বিভক্তি ও বিভাজনকে আরও বিষাক্ত করে তোলার উপায়। এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় আমরা জানি না।

 

অতএব খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবেন কি-না তা এখন অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। কারণ বাংলাদেশে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের লড়াইটা দিল্লি বনাম বাংলাদেশের জনগণের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকা এই বিরোধিতাকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে রাজনীতির মোড়ক পরাতেই সহায়তা করছে না, বাংলাদেশ ইসলামপন্থী রাজনীতি দমন করার ছুতা হয়ে উঠেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জিগির দেখলে তা অনায়াসেই টের পাওয়া যায়। একাত্তরে ইসলামাবাদ আমাদের বাংলা ভাষা ত্যাগ করতে বলায় ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি যদি দিল্লি চায় বাংলাদেশের জনগণ ইসলাম ত্যাগ করুক, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় তুফান আসন্ন।

 

না, দিল্লি ধর্ম হিসেবে ইসলাম ত্যাগ করতে বলছে সে কথা বলছি না। ইসলাম শুধু ধর্ম নয়, একই সঙ্গে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও দর্শনও বটে। ভারতের ইতিহাস একই সঙ্গে ইসলামেরও ইতিহাস। ইসলামপন্থীরা দাবি করেন, ইসলাম একটি ‘পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা’। দিল্লি যদি ‘জঙ্গি’ ইসলাম প্রতিরোধের নামে ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের বলয়ের মধ্যে বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার বোকামি অব্যাহত রাখে, তাহলে তার পরিণতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেয়েও আরও রক্তাক্ত হবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। এ আগুনে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের জগৎ ও জীবনকে বিচার করার জন্য যেমন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নিজের বলে গণ্য করে আর সেই সূত্রে সনাতন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও লোকায়ত জ্ঞানের সঙ্গে কোনো বিরোধ দেখে না, ঠিক একইভাবে ইসলামও তার মনোজাগতিক ও ইহলৌকিক জগতের অংশ। এই জগতের বিরুদ্ধে দিল্লি ও শেখ হাসিনা কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। শেখ হাসিনার জামায়াত-বিরোধিতা আসলে ইসলাম-বিরোধিতারই নামান্তর। এই সত্য না বোঝার কোনো কারণ নাই।

 

ফলে খালেদা জিয়া যদি বলে থাকেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিছকই ‘কৌশলগত’, তাহলে তিনি ভুল করবেন এবং জনসমর্থন হারাবেন। বরং একদিকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সুষ্ঠ বিচার চাওয়া এবং অন্যদিকে সব ইসলামী দল ও আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র’ রক্ষার লড়াইয়ে শামিল করার মধ্য দিয়েই তিনি আন্দোলনকে শক্তি দিতে পারবেন। এ ছাড়া তার সামনে আর কোনো বিকল্প নাই। কূটনৈতিক মহল বিকল্প নয়। ‘সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র’ রক্ষার যে ডাক তিনি দিয়েছেন, সেই ডাকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীসহ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সবাই যেন নীতিগত কারণে সাড়া দিতে পারে সেটা স্পষ্ট করে তোলাই এখনকার কাজ। নইলে এই ডাক কাগুজে ডাক হয়ে থাকবে। এই নীতিগত রাজনীতির জায়গায় ইসলামপন্থীদের আনতে পারার অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতিকে সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকেও রক্ষা করা। নিজেদের চিন্তা ও মতাদর্শ প্রচার এবং ইসলামী চিন্তা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ইসলামপন্থীদের বোঝানোই এখন প্রধান কাজ। এটা কৌশল নয়, নীতি। নীতিগত জায়গাগুলো স্পষ্ট করাই কাজ, আবছা করে ফেলা নয়।

পূর্ব প্রকাশিত: আমাদের সময়

 

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *