দশ বছরের রাজনীতি –

এ নিবন্ধটির লেখক , একজন রাজনৈতিক কর্মী যাঁর নাম ইবরাহিম, তিনি তাঁর নিজের জন্য এবং তাঁর সহকর্মীদের জন্য পাঠককূলের নিকট দোয়া ও শুভেচ্ছা প্রার্থনা করছে। মানুষের যেমন জন্মদিন হয়, একজন রাজনৈতিক কর্মীরও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ দিবস থাকে। ওই উপলক্ষ্যেই এই লেখাটি।

রাজনীতি এবং মানুষ কী বলে?
মনে করুন কোনো জায়গায় গল্প করছি। কোনো কুলখানিতে গেলাম সেখানে, অথবা কোনো বিয়ের দাওয়াতে, অথবা কোনো মিশ্র ক্ষুদ্র সমাবেশে গল্প চলছে। এই কথা সেই কথা উঠবেই। রাজনীতির কথা তো উঠতে বাধ্য। দশ-বারোজন যদি আড্ডায় থাকে, পরিচিত বা রাজনৈতিক বিষয়ে মোটামুটি সচেতন এমন কেউ এমন কথা জিজ্ঞাসা করবে: “আপনাদের দলের মহাসচিবের কোনো খবর কি পাওয়া গেল?” একজন না একজন বলবেনই: “খামাখাই রাজনীতি করতেছেন, বড় বড় দলগুলোর বাইরে পাবলিক যাবেও না আবার বড় দলগুলো ছাড়া কিছু হবেও না। আপনারা ছোট দল খামাখাই সময় নষ্ট করছেন।” আরেকজন বলবে, “রাজনীতি-ফাজনীতি দিয়ে কিচ্ছুই হবে না, খামাখাই সময় নষ্ট, যা হওয়ার তা ইন্ডিয়ার কথামতোই হবে।” আরেকজন বলবেন, “আরে সব কাজ কি শুধু ইন্ডিয়া করায়, চায়না আছে না, আমেরিকা আছে না, দেখো না রোহিঙ্গাদের নিয়ে কী হচ্ছে?” আরেকজন বলে উঠবেন, “পাকিস্তানের নাম বাদ দিচ্ছেন কেন? ওদের জ্বালায় কি দেশে শান্তি আছে?” উপস্থিত ব্যক্তিগণের মধ্যে একটু ঠাণ্ডা মেজাজের একজন হয়তো বলে উঠবেন: “ইবরাহিম ভাই, রাজনীতি আপনার জন্য না; মিছা কথা বলতে হবে, চাঁদাবাজী করতে হবে, তেল মারার পাইপ বসাতে হবে; আপনি এগুলো করতে পারেনও না সুতরাং এটা ছেড়ে দেওয়ায় ভালো।” আরেকজন ওই দুইজনকে থামাবেন এবং বলে উঠবেন: “লিডার, ওদের কথায় মন দিবেন না, আট-দশ বছর লাইগা আছেন, লাইগা থাকেন; আগাইয়া যান; ভয় পাবেন না; আল্লাহ একটা রাস্তা করবেই।” আবার কেউ বলবেন, “ইলেকশনে যে গেলেন না, এখন ঠেলাটা সামলান; দেশটাই নিয়া গেল ওরা।” আরেকজন হয়তো খোঁচা দিবে, “ওদের আন্ডারে নির্বাচনে যাওয়া মানে নাকে খত দিয়ে বৈশ্যতা স্বীকার করা। খবরদার সাবধান থাকবেন।” সর্বশেষজন হয়তো বলবেন, “নির্বাচনে না যাইয়া কী করবে, খেজুরের গুড় বেচবে নাকি?” সম্মানিত পাঠক, জনগণের পক্ষ থেকে কোন ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায় তার একটা অতি হালকা নমুনা দিলাম। তবে এটা অবশ্যই নিবেদন করে রাখতে হবে যে, রাজনৈতিক কর্মী ইবরাহিম সুপরিচিত হওয়ার পিছনে টেলিভিশনের টকশোগুলোর অবদান আছে এবং পত্রিকার কলামগুলোর অবদান আছে।

রাজনীতির সংজ্ঞা কী?
বাকি আলাপের আগে, রাজনীতির সংজ্ঞাটা চিন্তা করি। বাংলায় শব্দ হলো রাজনীতি; ইংরেজিতে শব্দ হলো পলিটিকস। অনেক আগে একটা জোক বা কৌতুক ছিল। ঢাকা মহানগরের একটা জায়গা থেকে প্যাসেঞ্জার উঠলো রিক্সায়; বললো: বিশ্ববিদ্যালয়ে চলো। রিক্সাওয়ালা বললো, চিনি না। প্যাসেঞ্জার কথাটা ভেঙে বললো, ইউনিভার্সিটি চলো। রিক্সাওয়ালা বললো, এইটা চিনি। আপনারা সাহেব মানুষ, জায়গার নাম বদলান ক্যান? ওইরকমই আরেকটা জোক বা কৌতুক হলো, কেউ একজন বলছেন: “রাজনীতি কঠিন হয়ে গেছে, রাজনীতির ভেতরে পলিটিক্স ঢুকে গেছে।” পাঠক চিন্তা করুন। শেষের জোক বা কৌতুকের মানে হলো, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ধ্যান ধারণায় পলিটিক্স নামক শব্দটি নেতিবাচক শব্দ, এই শব্দের মাধ্যমে কুটিলতা বোঝায়, প্রতারণা বোঝায়। সংজ্ঞা প্রসঙ্গে কেউ বলেন, (যদিও পৃথিবীতে দেশে দেশে রাজা এখন নেই বললেই চলে) রাজনীতি হলো রাজাদের নীতি; বিংশ বা একবিংশ শতাব্দীতে বলতে পারি রাজা না থাকলেও রাজার স্থলে দেশের শাসক গোষ্ঠীর নীতি। অন্যান্য অনেকে বলেন, রাজাদের নীতি নয় বরং নীতির মধ্যে যেটা রাজা সেটাই রাজনীতি। অর্থাৎ অনেক বিষয়ে অনেক রকমের নীতি থাকতেই পারে; সর্বোত্তম নীতিটি রাজনীতি। দুই প্রকারের লোকের, দুইটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করলাম। কোনো একটাকে বাদ দিলাম না বা কোনো একটাকেই শুধুমাত্র গ্রহণ করলাম না। আদর্শ সংজ্ঞা কীরকম হবে জানি না তবে একটা সংজ্ঞা প্রস্তাব করলাম: শাসক গোষ্ঠী দেশের মানুষের জন্য যেই নীতির উপর নিজেরা চলবেন, যেই নীতিতে মানুষকে চালাবেন, সেটাই রাজনীতি। যাহোক, রাজনীতির সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করা বা এই সম্পর্কিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গুঢ়-তত্ত্ব আলোচনা করা আজকের কলামের উদ্দেশ্য মোটেই নয়। কিন্তু আলোচনাটাকে, পাঠকের নিকট হৃদয়গ্রাহী করতে হলে একটা না একটা সংজ্ঞাকে বেছে নিতেই হবে। এই অনুচ্ছেদে যে আলোচনা করলাম তার আলোকেই পরের দুইটি অনুচ্ছেদ।

রাজনীতি কঠিন
রাজনীতি আসলেই কঠিন, যদি রাজনীতির মধ্যে নীতিটাকে মানতে চান। নীতিটা কী? নীতিটা হলো জনগণের খেদমত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ; জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে গমন; পার্লামেন্ট তথা জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের ভালো-মন্দ নির্ধারণ। প্রশ্নটা দ্বিতীবার করি; নীতিটা কী? নীতিটা হলো, নিজে সৎ থাকো, সততাকে উৎসাহিত করো, মেধাকে উৎসাহিত করো এবং দক্ষতাকে উৎসাহিত করো। প্রশ্নটা তৃতীয়বার করি। নীতিটা কী? নীতিটা হলো, মানুষকে একত্রিত রাখা, মানুষকে উৎসাহিত রাখা, মানুষকে উজ্জীবিত রাখা, মানুষকে শ্রমমুখী করা, মানুষকে সততামুখী করা, পৃথিবীর বুকে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার তাগাদা সৃষ্টি করা; নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে লালন করা এবং আগামীর দিকে সুদূর দৃষ্টি প্রসারিত রাখা। অনুচ্ছেদের শুরুতে যেমন বলেছি, এইরূপ নীতিতে বহাল থেকে রাজনীতি করা খুবই কঠিন।

রাজনীতি সহজ
রাজনীতি একদমই সহজ যদি নীতি মানা না হয়। মানুষ ধারণা করেন যে রাজনীতিবিদরাই দেশ চালান এবং চালাবেন। অর্থাৎ রাজনীতিবিদের হাতে ক্ষমতা থাকবে। ক্ষমতা থাকলে নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করা যাবে, খাতির করা যাবে, চুরি-চামারি-ডাকাতি করা যাবে, দখল-বেদখল করা যাবে। তাহলে টার্গেট ঠিক করো কোন রাজনীতিবিদের পেছনে এখন সময় দিলে, ভবিষ্যতে তার প্রতিদান পাবা। টার্গেট ঠিক করেন, কোন রাজনীতিবিদকে খরচের জন্য টাকা-পয়সা দিলে, আগামী দিনে তিনি আপনার একটা বন্দোবস্ত করে দিবেন। যদি আপনি ২০০০ সালে টার্গেট করে থাকেন, তাহলে দু’চার বছর পর আপনি তার ফল পেয়েছেন; যদি কেউ বিশ্বাসঘাতকতা না করে। যদি আপনি ২০০৫ সালে টার্গেট করে থাকেন, তাহলে আপনি তার ফল ২০০৯ থেকে পেয়েই যাচ্ছেন। যদি আপনি এখন ২০১৭-এর শেষ মুহূর্তে টার্গেট করেন তাহলে সেটার বিনিময় ফল পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বর্ষাকালে গাছের চারা লাগানো হয়; দুই-চার বছর পর ওই গাছে ফল আসে। বৃক্ষমেলায় গেলে এমন গাছও দেখা যায় যেটাতে ফল ধরে আছে; বড় টবের মধ্যে গাছটি। দাম বেশি হবে; কিন্তু সেটিকেই এনে যদি আপনার বাগানে লাগান, তাহলে ফল সঙ্গে সঙ্গে পাবেন। অনুরূপ এখন যারা ক্ষমতায় আছে, তাঁদেরকে যদি নগদ তেল দেওয়া যায়, তাহলে নগদ ফল পাওয়া যাবে। এইরূপ তেল দেওয়া এবং নগদ ফল আশা করা নীতির মধ্যে পড়ে না। তাই বলছিলাম রাজনীতি একমদমই সহজ যদি নীতি অমান্য করতে প্রস্তুত থাকেন।

আমার রাজনীতির প্রেক্ষাপট
দশ বছর আগের কথা। কোনো পাঠক যদি এই প্রসঙ্গে একটু বেশি জানতে চান, তিনি আমার লেখা ‘মিশ্র কথন’ নামক বইটির শেষের তিনটি অনুচ্ছেদ পড়তে পারেন। ২০০৭ সালে এসে, হঠাৎ করে বাংলাদেশের রাজনীতি ভালোও হয়নি বা মন্দও হয়নি। যা হওয়ার তা ক্রমান্বয়ে হয়ে আসছে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতেই, ২০০৭ সালে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম রাজনীতি করবো। এইরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে প্রেক্ষাপটের অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পরবর্তী কয়েকটি লাইন। মহান আল্লাহর দয়ায় বিখ্যাত ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে এবং পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে সফল এবং মেধাবী ছাত্র ছিলাম। মহান আল্লাহর দয়ায় ১৯৭১ সালে একজন কর্মঠ ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। আল্লাহর অসীম রহমতে সেনাবাহিনীতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছি। উপসংহার এই যে, আমার চরিত্র ও চিন্তায় উদ্যম এবং সাহস সর্বদাই ছিল। উদারপন্থী ইসলামী চিন্তা চেতনায় বড় হয়েছি ছোটকাল থেকেই; অতএব দ্বীন ইসলামের শ্বাস্বত শান্তির বাণী, কল্যাণের বাণী, ভ্রাতৃত্বের বাণী আমার চিন্তায় ও চেতনায় সর্বদাই ঢেউ খেলতো। ১৯৯৬তে সেনাবাহিনী থেকে অকালীন অবসরে চলে গেলেও, চারিত্রিক বা মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলো বহাল ছিল। এইরূপ প্রেক্ষাপটেই অবসর নেওয়ার পর থেকেই লেখালেখি করি; ২০০২ সাল থেকে টিভিতে যাই। লিখতে গেলে বা বলতে গেলে, প্রিয় এবং অপ্রিয় উভয় প্রকারের কথা বলতেই হয়। নাগরিক সমাজের একজন ছিলাম; তখন দেশের রাজনীতির সার্বিক অবস্থা নিয়ে চিন্তা করতাম; আলোচনা ও সমালোচনা করতাম। তখন অনেকেই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতেন: বলা সহজ, লেখা সহজ, সমালোচনা সহজ, বাস্তবে কাজ করে দেখানো কঠিন। যদি সাহস থাকে এবং মনে করেন পারবেন তাহলে আপনি ইবরাহিম, প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির মাঠে এসে করে দেখান। সেই থেকেই রাজনীতির মাঠে। কোনো আমলের কোনো সরকারের কোনো প্রকারের প্ররোচনায় বা কোনো প্রকারের উৎসাহে বা কোনো প্রকারের সহায়তায় বা কোনো প্রকারের আহবানে আমি রাজনীতিতে আসিনি। আমি তথা আমাদের দল, নিজেদের সিদ্ধান্তেই নিজেরা রাজনীতি করছি। ক্ষুদ্র দলের ছায়ায় রাজনীতি করা সুবিধা এবং অসুবিধা উভয়েই আছে। গত দশ বছর ধরে দল পরিচালনা, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত শর্তগুলোকে বহাল রাখা ভীষণ কষ্টের কাজ, ভীষণ ত্যাগ স্বীকারের কাজ। শিল্পপতিগণ ব্যবসায়ীগণ সাহায্য সহযোগিতা করেন প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলকে। ক্ষুদ্র বা ছোট রাজনৈতিক দলগুলো কোনোমতেই শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীগণের আগ্রহের তালিকায় পড়েন না; না পড়ারই কথা। তার মধ্যে যদি ক্ষুদ্র বা ছোট রাজনৈতিক দল সরকার বিরোধী অঙ্গনে থাকে তাহলে সেই ছোট দলের খবর আছে! বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে, তেলা মাথায় তেল দেওয়া। রাজনীতি এবং শিল্পাঙ্গনের মধ্যে যেই ইন্টারএ্যাকশন, সেখানে এই প্রবাদ বাক্যটি বেশি বেশি প্রযোজ্য। স্বাভাবিকভাবে ছোট দলগুলোর মাথায় তেল থাকে না; অতএব নতুন কেউ তেল দেয় না। এই কথা জেনেই, এই কথা মেনেই, এই সীমাবদ্ধতা আছে উপলব্ধি করেই কয়েকটি ছোট দলের মধ্যে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নামক ছোট দলটিও অগ্রসর হচ্ছে।

শৈশব থেকে কৈশোরে আসা (দল)
৪ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে ঢাকা মহানগরের বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অবস্থিত ইমপেরিয়াল হোটেল-এর অষ্টম তলা এবং নিচের তলা মিলিয়ে আমাদের সম্মেলন হয়। ১২০০-এর অধিক মেহমান অংশ নেয়। সেদিনই আমাদের দল, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ঘোষণা হয়। ঘোষণার দিনই ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র এবং প্রথম কমিটি ঘোষিত ও প্রচারিত হয়। ওই আমলের বেশিরভাগ সঙ্গী-সাথী এখনও সঙ্গে আছেন। প্রখ্যাত বক্ষব্যাধি চিকিৎসক ও এককালীন জিয়া পরিষদের সভাপতি ডাক্তার ইকবাল হাসান মাহমুদ; সিলেটের সন্তান ফেলো চার্টার্ড একাউনটেন্ট কাহির মাহমুদ; পিরোজপুরের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আজাদ মাহবুব (সেই ১৯৭০ সাল থেকে রাজনীতি করেন); চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং বাংলাদেশের একজন জাতীয় ক্রিড়া ব্যক্তিত্ব শাহজাদা আলম; মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইলিয়াস (যিনি কৈশোরে এবং তারুণ্যের প্রথম অংশে মাওলানা ভাসানীর সাথে রাজনীতি করেছেন); এরা সবাই এখন পার্টির স্থায়ী কমিটিতে। মহিলাদেরকে রাজনীতিতে উৎসাহিত করার নিমিত্তে, একজন মহিলাও স্থায়ী কমিটিতে আছেন: ‘ফোরকান ইবরাহিম’। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখ নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পেয়েছিলাম। নিবন্ধন পাওয়ার ৪০ দিনের মাথায় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে পার্লামেন্ট নির্বাচনে আমাদের দল অংশগ্রহণ করেছিল; ৩৬টি আসনে আমাদের প্রার্থী ছিল। মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল দলকে নির্বাচনমুখী করে ফেলা এবং নির্বাচনের ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতা অর্জন করা। নবীন দল, নতুন দল, জিততে পারবে না এটা স্বাভাবিক ছিল। গত দশ বছরে দল বড় হয়েছে, দলের পরিচিতি বেড়েছে; বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে দলের গুরুত্ব বেড়েছে কি কমেছে সেটা জনগণ বিচার করবেন। তবে বিক্ষুদ্ধ মনের একটি কথা বলতেই হবে যে: বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির কর্মঠ ও দল-অন্তপ্রাণ মহাসচিব, জনাব এম এম আমিনুর রহমান গত তিন মাস নয়দিন যাবত (২৭ আগস্ট রাত দশটার পর থেকে) অপরহণ অবস্থায় আছেন; ইংরেজি ভাষায় এনফোর্সড ডিস-এপিয়ারেন্স; পলিটিক্যাল অপহরণ।

জোট পরবর্তী বিনিয়োগ
২০১১ সালের শেষ দিকে বিএনপির পক্ষ থেকে মহাসচিব মহোদয় আমাদের দপ্তরে মেহমান হয়ে এসেছিলেন। ৪ দলীয় জোটে যোগদানের আমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। আমরা স্বাগতম জানিয়েছিলাম। পরে দেশনেত্রীর সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হয়। সেই থেকে ছয় বছরের অধিককাল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে আছি। শ্রম, অথবা মেধা, অথবা কর্মী অথবা সবকিছুরই একটু একটু দিয়ে আামরা জোটে অবদান রেখে যাচ্ছি। জোটে যাওয়ার সময় থেকেই নির্বাচনী আসন ভিত্তিক পরিশ্রম ও সময় বিনিয়োগ করে আসছি। যদিও আমি থাকি ঢাকা মহানগরের মহাখালী ডিওএইচএস-এ তথা ঢাকা-১৭ আসনে, কিন্তু আমি সময়, মেধা, শ্রম ও রাজনৈতিক খরচ বিনিয়োগ করছি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় তথা চট্টগ্রাম-৫ আসনে। জোট ঘোষণার পর থেকে, আমাদের দলসহ জোটের অন্যান্য দলগুলোর বহু নেতাকর্মীই আসন ভিত্তিক রাজনীতিতেও মনোযোগ দিয়েছেন। কারো জন্য আসন হয়তোবা সুনিশ্চিত, অন্যদের জন্য হয়তো দ্যেদুল্যমান।

জোটের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় তাগাদা
২০ দলীয় জোট বর্তমানে একটি শক্তিশালী অবস্থানে আছে; যদিও জোটের সবগুলো রাজনৈতিক দলই নিবন্ধিত দল নয়। ২০ দলীয় জোট সর্ব অবস্থায় জনমুখী, গণমুখী, গণতন্ত্রমুখী, উন্নয়নমুখী, নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক জোট। ২০১৪ সালে, বিএনপির নেতৃত্বে, ২০ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করেছিল; স্পর্শকাতর পরিবেশেও কল্যাণ পার্টি জোটের প্রতি অনুগত ছিল। আগামী নির্বাচন এখন থেকে ১২ মাস পরে হবে নাকি ১০ মাস পরে হবে নাকি ৪ মাস পরে হবে, এটা জানি না। জোটের শীর্ষতম নেতা বেগম জিয়ার উপর মামলা-হামলার কোনো শেষ নেই। জোটের সবচাইতে বড় দল বিএনপির নেতা-কর্মীদর উপর হামলা মামলা ও জুলুমের কোনো শেষ নেই। এইরূপ পরিস্থিতিতে, আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় বা নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে একটি অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। জোটের শীর্ষতম নেত্রী তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া, বিএনপি মহাসচিব জনাব মির্জা ফখরুল, বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটির সদস্য মহোদয়গণ, এই পরিবেশ সৃষ্টি তাগাদা দিয়েই যাচ্ছেন। আমরাও দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সরকার অবহেলা করে যাচ্ছে।

বড় দলের সহায়তা অপরিহার্য
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নির্বাচনমুখী দল। তবে আমরা রাজনৈতিক শৃংখলাপন্থী দল। দুইমাস আগে নির্বাচন কমিশনে আমাদের সংলাপের দিন আমরা আমাদের রাজনৈতিক ও সংবিধান সম্পর্কিত বক্তব্য তুলে ধরেছি। সেই বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে আমি পত্রিকায় কলাম লিখেছি এবং ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছি যথা (২০ সেপ্টেম্বর ও ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭)। আমরা জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে বিশ্বাস করি। কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়। একলা আমাদের পক্ষে অনেক কাজ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ আমাদের সদিচ্ছা যতবড়ই হোক না কেন, যত ব্যাপকই হোক না কেন, আমাদের সাধ্য ও সুযোগ সীমিত। এটা বাস্তব যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচাইতে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, সবচেয়ে বেশি ক্যারিশমেটিক নেতা হচ্ছেন: বেগম জিয়া। দ্বিতীয় জনপ্রিয় নেতা হচ্ছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু স্কুলের একটা ক্লাসে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে যেমন ফার্স্ট বয় এবং সেকেন্ড বয় কর্তৃক প্রাপ্ত মোট নম্বরের মধ্যে অনেক তফাৎ থাকতেই পারে, তেমনই বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার মধ্যে এই মুহূর্তে বিশাল এবং বিরাট তফাৎ। যাহোক, যেটা বলছিলাম। হঠাৎ করে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অঙ্গনের কালচার বদলানো সম্ভব নয়। হঠাৎ করে নৈতিকতাকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব না। তবে আমরা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি উদ্যমী, সাহস হারাইনি। আমাদের নীতিবাক্য “পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি”। জোটের মধ্যে থেকেও আমরা আমাদের নীতিতে অটল আছি।

রাজনীতির ভিত্তি কল্যাণ
আমাদের দলের রাজনীতির ভিত্তি পবিত্র কুরআনের একুশতম সুরা সুরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াতের উচ্চারণ এইরূপ: “ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন।” এই অতি বিখ্যাত আয়াতটির বঙ্গানুবাদ দিচ্ছি না, ভাবার্ত দিচ্ছি: “মহান আল্লাহ, তাঁর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)কে পাঠিয়েছেন সমস্ত সৃষ্টি জগত বা বিশ্বব্রম্মাণ্ডের জন্য রহমতস্বরূপ।” পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত আরবি শব্দ রহমত-এর নিকটতম বাংলা প্রতিশব্দ: মঙ্গল, কল্যাণ, দয়া, মায়া, উসিলা, উপকার। অর্থাৎ মহান আল্লাহর বন্ধু রাসুলুল্লাহ (সা.) হলেন কল্যাণের প্রতীক, কল্যাণের বাহক, কল্যাণের ধারক এবং কল্যাণ। আমরা যারা তাঁর উম্মত, আমরাও কল্যাণের নিমিত্তেই রাজনীতি করবো। অতএব কল্যাণ করতে হলে, পদ্ধতিগতভাবে বা প্রক্রিয়াগতভাবে পরিচিত বা বিদ্যমান পরিবেশে থেকেই আগাতে হবে। উপযুক্ত জায়গায় যেতে পারলে পরিবেশ এবং পদ্ধতি বদল করার সম্ভব। তাই আমরা মনে করি সেই উপযুক্ত জায়গা পার্লামেন্ট; অতএব পার্লামেন্টে যাওয়া প্রয়োজন। যাওয়ার পর বিভিন্ন কথা উপস্থাপন করা যাবে। দেশব্যাপী প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, ঢাকা কেন্দ্রীক সরকারের কিছু কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ভৌগলিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতি-দমন প্রসঙ্গে কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত ইত্যাদি পার্লামেন্টে গিয়ে উপস্থাপন সহজ এবং গ্রহণযোগ্য। আমরা সেই লক্ষ্যে গত দশ বছর কাজ করে যাচ্ছি। ৪ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে আমাদের দশ বছর বয়স পূর্ণ হয়েছে। এই উপলক্ষ্যে একটি মহতি আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে প্রেস ক্লাবে শনিবার ৯ তারিখ। কলামের অবয়স সীমিত রাখার জন্য, আজকের কলামে দেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা বা নৈতিকতার অবস্থা বা আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবস্থা ইত্যাদি অনেক কিছুই আলোচনায় আনতে পারলাম না; আশা করি আলোচনা সভায় সেগুলো উঠে আসবে।

Posted by Syed Muhammad Ibrahim on Tuesday, December 5, 2017

ফেইস বুকের লিংক

Comments are closed.