বল এখন সরকারের কোর্টেই

এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক শিবির দুই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে। প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই শুরু করি। ১৪ দলীয় জোট বা বর্তমান সরকারের মন্ত্রী মহোদয়রা এ নির্বাচনকে ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ হিসেবে দেখছেন। তাদের ভাবটা হল, যে কোনো নিয়মে বা যে কোনো প্রকারে জিততে হবে। ‘যে কোনো প্রকার’ বলতে প্রশ্ন এসে যায় তা কত প্রকার ও কী কী? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রকার যতই থাকুক না কেন, তার সবই তারা কাজে লাগাবেন যাতে তারা জিততে পারেন।
বর্তমান সরকার সারা পৃথিবীর সামনে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোটকে খলনায়ক হিসেবে প্রচার করে যাচ্ছে। তারা বলছে, বাংলাদেশে যত আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে, সহিংসতা-নাশকতা হয়েছে এ জন্য ২০ দলীয় জোটই দায়ী। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনগণের কাছে আবেদন করেই যাচ্ছেন- খুনিদের ভোট দেবেন না। নাশকতাকারীদের ভোট দেবেন না। যারা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে তাদের ভোট দেবেন না। এ ধরনের উসকানিমূলক কথা নিঃসন্দেহে নির্বাচনী আচরণবিধির লংঘন। নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে কয়টিই বা মাথা আছে এ ধরনের উসকানিমূলক কথাবার্তা প্রতিহত করবে। অথবা তাদের সংযত হওয়ার আহ্বান জানাবে। শুধু প্রধানমন্ত্রী কেন, সরকারদলীয় অনেক মন্ত্রীও জনসমক্ষে এমন সব উসকানিমূলক কথা বলছেন, যেগুলো নির্বাচনী আচরণবিধির লংঘন। নির্বাচন কমিশনের কাছে তাদের বিরুদ্ধে নালিশও করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ওই মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান সরকার ২০ দলীয় জোটকে একটি জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে করে তারা নির্বিঘ্নে জয়লাভ করতে পারে।
যা হোক, এবার ২০ দলীয় জোটের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে আসি। ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক দল হচ্ছে বিএনপি। এর পরে প্রধান গুরুত্বপূর্ণ শরিক দল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এ কলাম লেখার সময় পর্যন্ত আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধান শরিক দল বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কোনো ধরনের সমঝোতা বা সমন্বয় হয়নি। যার কারণে ২০ দলীয় জোটের প্রধান দুটি শরিক দলের প্রার্থী কোনো কোনো এলাকায় পাশাপাশি রয়ে গেছে। বাকি ১৮টি শরিক দলের মধ্য থেকে দু-একটি জায়গায় প্রার্থী দেয়া আছে। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি চট্টগ্রামে মেয়র প্রার্থী দিয়েছিল; কিন্তু সমন্বয়ের কারণে সেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সমন্বয়ের কাজটি সময় নিচ্ছে। এটি আরও দ্রুত হওয়া দরকার ছিল। ২০ দলীয় জোটের জন্য এ নির্বাচন ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ নয়। কারণ ২০ দলীয় জোট যে কী পরিমাণ নির্যাতন, বঞ্চনা ও হুমকির মুখে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, এটি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেকেই প্রত্যক্ষ করছে। ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীরা সবাই মাঠে নেমে গণসংযোগ করতে পারেননি। যারা মাঠে নেমেছেন তাদের অনেককেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ২০ দলীয় জোটের সমর্থকরাও মাঠে নামতে পারছেন না। কারণ তাদেরও গ্রেফতারি পরোয়ানা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ক্ষমতাসীন সরকার ২০ দলীয় জোটের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে সশরীরে আক্রমণ করছে। ২০ দলীয় জোটের কোনো প্রার্থীর পান থেকে চুন খসলেই তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন থেকে নোটিশ যাচ্ছে। রাত ৯টা থেকে ১০ টায়ও নোটিশ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। অপরপক্ষে সরকারদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো নোটিশ চার থেকে পাঁচ দিনেও পৌঁছায় না। কারণ ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীর বিরুদ্ধের নোটিশটি উড়ে গিয়ে পৌঁছে। আর সরকারদলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নোটিশ যায় কচ্ছপগতিতে।
সম্মানিত পাঠক বলতে পারেন, দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক শিবির তথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শিবিরের মধ্যে এ নির্বাচনে অবস্থানগত পার্থক্য কোথায়? পার্থক্যটি হচ্ছে সরকারের জন্য এটি একটি মরা-বাঁচার সমস্যা বা প্রেস্টিজ ইস্যু। অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটের জন্য এটি দল পুনর্গঠনের ক্ষেত্র। দীর্ঘদিন মাঠে নামতে না পারার ফলে যে জনবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা পূরণ হয়ে যাচ্ছে পুনঃ জনসম্পৃক্ততার কারণে। সেটি যতটুকুই হোক না কেন। এতসব প্রতিকূলতার মাঝে ২০ দলীয় জোট হয়তো জয়লাভ নাও করতে পারে। কিন্তু এতে তাদের হারানোর কিছু নেই। কেননা ২০ দলীয় জোট পরাজিত হলে জনগণের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এ নির্বাচনে সরকারের অপতৎপরতা, জাল-জালিয়াতির পরিমাণ কতটুকু ছিল। এতে করে বিএনপির প্রতি জনসমর্থন অনেকাংশেই বেড়ে যাবে।
২০ দলীয় জোটের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ স্পষ্ট করে তুলছে, আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকছে না। সরকার নিজের মতো করেই নির্বাচন পরিচালনা করবে বলে মনে হচ্ছে। যুগান্তরে একটি কলাম লিখেছিলাম যার শিরোনাম ছিল ‘অসমান খেলার মাঠেই খেলতে হবে’। এ অসমান মাঠে খেলে খেলেই এতদূর এসেছি, অসমান মাঠে খেলেই নির্বাচন পার করব। এরূপ মানসিক প্রস্তুতি ২০ দলীয় জোটের রয়েছে।
অনেক দিন পর জনগণ রাজনৈতিক অঙ্গনকে ঘিরে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। কিন্তু আরপিওর অনেক রকমের বিধান মানুষের কাছে স্বচ্ছ নয়। আরপিও মোতাবেক নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য মাত্র তিন সপ্তাহ কি যথেষ্ট? এ কর্মব্যস্ত জীবনে নির্বাচনী প্রেরণা, চেতনা, গণসংযোগ এবং সর্বোপরি নির্বাচনী উষ্ণতার জন্য তিন সপ্তাহ যথেষ্ট নয়। যার কারণে প্রার্থীরা সবার কাছে যেতে পারছেন না এবং প্রার্থীর সমর্থকরাও যেতে পারছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মানুষ ভোট কেন্দ্রে যাবে এবং নিজের অনুমানে ভোট দেবে। ব্যক্তিগতভাবে তিনদিন চট্টগ্রামে এবং দু’দিন ঢাকায় হেঁটেছি, গণসংযোগ করেছি। জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এর বেশি হাঁটতে পারিনি। কিন্তু পরোক্ষভাবে আমি এবং আমার নেতাকর্মীরা শরিক দলের সঙ্গে মিশে কাজ করে যাচ্ছি। গণসংযোগ করতে গিয়ে জনগণের কাছ থেকে যা শুনেছি তা হচ্ছে- চট্টগ্রামের লোকজন বলেছেন, আমরা মার্কা দেখে ভোট দেব। কারণ প্রার্থী আমাদের কাছে আসেননি।’ ঢাকায় শুনেছি- ‘উনি তো মিন্টু সাহেবের ছেলে।’ অর্থাৎ প্রার্থীর নামই এখনও অনেকে জানেন না।
অনেকেই বলছেন, আমরা মার্কা দেখে ভোট দেব। এখন সময় স্বল্পতার কারণে ওই মার্কাটিকে পরিচিত করানোই বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের সামনে একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে- ২০ দলীয় জোট এবং সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক কি মুখোমুখি থাকবে? নাকি শীতল হবে? রাজনীতিতে কি কোনো সুশীতল বাতাস বইবে? এর উত্তর হচ্ছে- সরকারের কোর্টেই এখন বল। মাইকও সরকারের হাতে। সরকার বলটি নিজেই খেলবে। খেলে গোলও দিতে পারে আবার লক্ষ্যভ্রষ্ট শট মেরে গোল পোস্টের বাইরেও বল ফেলে দিতে পারে। আবার মাইক সরকারের সামনে আছে। সরকারের যা ইচ্ছা তাই বলতে পারে। কোনটি করবে সেটি সরকারই ভালো জানে। জনগণের কাছে আমার আবেদন, আপনারা যদি সুশাসন চান, নির্যাতন, নিপীড়ন বন্ধ করতে চান তাহলে অবশ্যই যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেবেন।

(পুর্ব প্রকাশিত ২১ এপ্রিল ২০১৫ যুগান্তর পত্রিকায়)

Loading


মন্তব্য দেখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *